বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৫

চাঁদকে ঘিরে তারাদের মেলা : তাহমীদ বিন ইকরাম

মূল : আল্লামা সায়্যিদ আব্দুল মজীদ নাদীম
রূপান্তর-
আল্লাহর রাসুল বসেছেন প্রিয় সাহাবিদেরকে নিয়ে। আবু বকর, উমর, উসমান, আলী আরো কতো প্রোজ্জ্বল তারকা মেলা জুড়েছে পূর্ণিমা চাঁদের সান্নিধ্যে। সবাই তাকিয়ে আছে অপলক নেত্রে। কী বলেন আল্লাহর মহান দূত! নবীজী বললেন, পৃথিবীতে আমার কাছে তিনটি জিনিস সবচে প্রিয়। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এক অদ্ভুত আলোড়ন শুরু হলো। কী সেই সৌভাগ্যবান জিনিসগুলো, আল্লাহর রাসুল যেগুলোকে নিজের প্রিয় বলেছেন! মহানবী সা. নিজেই বলে ফেললেন, খুশবু, খুশবুই আমার প্রিয় জিনিসগুলোর প্রথম। আসলে নবীজীর পবিত্র সত্তাই ছিল সম্পূর্ণ সুগন্ধিময়। হযরত উম্মে সুলাইম রা. বলছেন। “একদিন দেখি, কোথেকে জানি এক অপূর্ব মনমাতানো খুশবু বেসে আসছে। আমি তো অবাক! হঠাৎ দেখতে পেলাম যে আল্লাহর রাসুল সা. আমার বাড়ির পথ ধরেই এগিয়ে আসছেন। ধীরে ধীরে সুঘ্রাণ তীব্র হলো। আমি নিশ্চিত হলাম যে, এটি নবীজীর গা’মোবারক থেকেই নিঃসৃত। রাসুল সা. আমার বাড়ির আঙ্গিনায় পা’ রাখলেন। দেখতে পেলাম। নবীজীর কপালে মুক্তোদানার মতো চিকচিক ঘামবিন্দু জমে আছে। আর তা থেকেই হৃদয়কাড়া সুরভি ছড়াচ্ছে।” মহানবী যে পথেই যেতেন, অনেকক্ষণ পর্যন্ত সেই পথ খুশবু মোহিত হয়ে থাকতো।
তারপর নবীজী বললেন, দ্বিতীয়ত আমার সবচে’ পছন্দনীয় হলো সচ্চরিত্রা স্ত্রী। সন্তান তেমনই হবে, সন্তানের মায়েরা যেমন হবে। তাই তো হাসান-হুসাইনের মতো জান্নাতের যুবক সর্দার জন্ম নিয়েছেন বেহেশতী রমণীদের নেত্রী ফাতেমা রা. এর গর্ভে। ইসলামও ইসলামের নবীর জন্যে জীবন উৎসর্গকারিণী হিসেবে মাখদুমাতুল মুসলিমীন খাদিজা রা. এর সত্যিই কি কোন তুলনা হতে পারে? তাই তোমরাও প্রিয় পাঠক, মহান আল্লাহর দরবারে যখন কিছু চাইবে, জীবন সঙ্গিনীর জন্যেও চাইবে। সে যেন কৃতজ্ঞ হয়, যাকে আল্লাহ সচ্চরিত্রা স্ত্রী দান করেছেন। কারণ, তার ঘরকে সে নিজেই জান্নাত করে সাজিয়ে তুলবে। বিপরীতে কারো ঘরে যদি ‘খোদা না খাস্তা’- দুশ্চরিত্রা বিবি থাকে। তবে তার ঘরকে জাহান্নামে রূপান্তরিত করার জন্যে সে নিজেই যথেষ্ট।
তৃতীয়ত রাসুল বলেন, আমার দু’চোখের শীতলতা নামাযের মধ্যে রাখা হয়েছে।  হযরত আয়েশা রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল যখন নামাযের জন্যে দাঁড়াতেন, তখন মনে হতো আমাদের কারো সাথে তাঁর কোন সম্পর্কই নেই। তাঁর সম্পর্ক কেবল তাঁর এবং শুধু তাঁরই সাথে। গযব-গোস্বার আয়াতে খুব কাকুতি মিনতি করতেন। আর রহমতের আয়াত পড়াকালে তাঁর চেহারায় আশার চিহ্ণ ফুটে উঠতো। কতো রাত এমন হয়েছে যে, একেকটি আয়াতে পুরো রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। একরাতে সুরা মায়েদার একশ’ আঠারো নম্বর আয়াত পড়ছিলেন- “যদি তুমি এদেরকে শাস্তি দাও, তবে এরা তো তোমারই বান্দা। (তোমাকে বাঁধা দেয়ার তো কেউ নেই।) আর যদি তুমি এদেরকে ক্ষমা করে দাও, তাহলে (কে তোমাকে  কৈফিয়ত তলব করতে পারে?) তুমিই তো মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” তিনি এই আয়াত বারবার পড়ছিলেন। আর তার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্র“ নামছিলো। তিনি কাঁপছিলেন আর ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন। এক পর্যায়ে সুবহে সাদিক হয়ে গেলো।
তারপর হযরত আবু বকর রা. দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, আমার কাছেও পৃথিবীতে তিনটি জিনিস সবচে পছন্দনীয়। পিছনেই ছিলেন উমর ফারুক রা.। ভালো কাজে তাঁর প্রতিযোগী মনোভাব ছিলো সুপরিচিত ও প্রশংসিত। তিনি মনে মনে বললেন, আমি আগে থেকেই তিনটি প্রিয় জিনিস তৈরি করে রাখি। যা দিয়ে রাসুল না হোক, কমপক্ষে আবু বকর থেকে আজ আগে বাড়া যাবে। কিন্তু আবু বকর রা. তো আবু বকরই ছিলেন। রাসুল থেকে অনুমতি পাওয়ার পর তিনি বললেন, পৃথিবীতে আমার প্রথম সবচে পছন্দনীয় হলো আপনার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকা। আর কেন বা হবে না? আজকের আকাশ-বাতাস তো চৌদ্দশ’ বছর পূর্বের সেই দৃশ্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। যেদিন আবু বকর রা. সওর পর্বতের গুহায় প্রিয় হাবীবের জন্যে নিজের উরুদ্বয় বিছিয়ে দিয়েছিলেন। আর আল্লাহর রাসুলের চেহারা মোবারক তাঁর রাণের উপর আরাম করেছিলো। বুখারি শরিফের বরেণ্য ব্যাখ্যাকার ইবনে হাজার আছকালানী রহ. সেই দৃশ্যের বর্ণনা দিচ্ছেন; যেন প্রস্ফুটিত কুরআন রেহালের অন্তরঙ্গতায় কেমন অসাধারণ দৃশ্য হয়ে আছে! যেখানে আবু বকর রা. তাঁর প্রিয় নবীর বুক ঘেঁষে শুয়ে আছেন। হযরত আবু বকর রা. এর জানাজা যখন রওজায়ে আতহারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল, তখন নিজে নিজেই রওজা খুলে গেলো। আর ভিতর থেকে আওয়াজ এলো “আদখিলিল হাবীবা ইলাল হবীব। বন্ধুকে তার পরম বন্ধুর কাছে নিয়ে এসো।” একবার আবু বকরকে ডান হাতে এবং উমরকে বামহাতে ধরে রাসুল সা. বললেন “এভাবেই আমরা কিয়ামতের দিন পুনরুত্থিত হবো।”
হযরত আবু বকর রা. দ্বিতীয়তে বললেন, আপনার দির্দেশের পথে আমার সম্পদ খরচ করা। তৃতীয়ত, আমার কন্যাকে আপনার সাথে বিয়ে দেয়া।
তারপর উমর রা. দাঁড়ালেন। বললেন, পৃথিবীতে আমার কাছেও তিনটি জিনিস সবচে’ প্রিয়। নবীজী বললেন, বলো কী কী? হযরত উমর রা. বললেন, এক. সৎকাজের আদেশ করা, দুই. অন্যায় কাজে বারণ করা। তিন. ছেড়াঁফাঁড়া কাপড় পরে থাকা। সত্যিই যথার্থ বলেছেন অর্ধ্ব জাহানের মুকুট ও সিংহাসনবিহীন শাসক উমর রা.। ওই তো তিনি সিরিয়ার পথে যাচ্ছেন জীর্ণ কাপড় পরে, শীর্ণকায় একটি গাধায় চড়ে পালাক্রমে তিনি এবং তার ক্রীতদাস। একবার তিনি চড়েন, তো তাঁর গোলাম টানে। আরেকবার গোলামকে চড়িয়ে নিজেই লাগাম টানতে লেগে যান। তাঁরা বায়তুল মাকদিস অভিমুখে যাচ্ছেন। সেখানে পাদ্রীরা খলীফার নিজ হাতে চাবি অর্পণ করবে। বিজিত হবে মুসলমানদের প্রথম কেবলা। আর ওইতো বায়তুল মাকদিসের কাছাকাছি তারা এসে পড়েছে। ওইতো  বায়তুল মাকদিসের কাছাকাছি তারা এসে পড়েছেন! আর গোলাম গাধার পিঠে চড়ার পালা পড়েছে। ওইতো গোলাম কাকুতি মিনতি করছে। নিজের পালা খলীফাকে দয়া করে গ্রহণ করতে বলছে। আর খলীফা সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়ে দিচ্ছেন। সেই ভূমিই তো সাক্ষী যে, মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনুল আস এলেন। আর একটি তাজী ঘোড়া ও একজোড়া উন্নত কাপড় নিয়ে এলেন। আর খলীফা তাঁর ঐতিহাসিক সেই বাণী উচ্চারণ করলেন, যা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখবার মতো “নাহনু কাউমুন আয়াযযানাল্লাহু বিল ইসলাম”। আমরা তো সেই জাতি, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। আমরা হলাম মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর গোলাম। ওই তো তিনি এক কিবতির নালিশে ডাকিয়ে আনছেন মিশরের গভর্ণর ও  তার শাহজাদাকে, কিবতির হাতে চাবুক তুলে দিচ্ছেন প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে। আর গভর্ণরকে বলছেন “আর কতদিন তোমরা তাদেরকে দাস মনে করবে। তাদের মায়েরা তো তাদেরকে স্বাধীন হিসেবে জন্ম দিয়েছে।” তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন যে, মুসলমানেরা কখনো মারার জন্যে যুদ্ধ করেনি, বাচাঁনোর জন্যেই কেবল করেছে। তাই আজো ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা আছে যে, ইসলামের জয় তলোয়ারে নয়, চরিত্রের উদারতাই ইসলামের বিজয়ের চাবিকাঠি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন