বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৫

মৃত্যুই চিরন্তন সত্য : মো. আবু হানীফা

 ২০০৪ সালের কথা। সবে মাত্র ইন্টার পরীক্ষা দিল টিপু সুলতান। পড়া-শুনায় খুব ভাল। বাবা সুলতান আহমদের দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে সে সবার বড়। মধ্যবিত্ত্ব সংসার তাদের। আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল পরীক্ষা শেষে বিদেশ যাবে। কাগজ পত্র আগে থেকেই মোটামুটি গোছানো ছিল। কয়েক দিন পর ভিসা হল। তারপর ফ্লাইটও নির্ধারণ হয়ে গেল। বাবা-মা, ভাই-বোন সকলকেই বিদায় জানিয়ে উড়াল দিল আকাশ পথে। তবে ছোট বোন আঁখিকে বিদায় দিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তার। ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। চোখগুলো ছলছল করছিল অশ্র“তে। টিপু সুলতানের গন্তব্য ছিল কুয়েত। তার চাচা, চাচাত ভাইসহ অনেকেই থাকেন কুয়েতে। চাচা সেখানকার সরকারী চাকুরীজীবী। মনে অনেক স্বপ্ন ছিল টিপু সুলতানের। আশা ছিল শত কষ্ট করে হলেও সংসারটা ঘুচাবে সে। মায়ের মন শান্তি হবে। বাবার প্রশান্তি হবে। বোনদেরকে পড়াশুনা করাবে তারপর বিয়ে দিবে। বোনেরা তার প্রাণের চেয়ে প্রিয়। ছোট ভাইকে পড়াশুনা করাবে। একদিন সেও  বড় হবে। আর তার ভাইয়ের সম্মানে সে অনেক খুশি হবে। আশা ছিল সবাইকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে নিজেও কিছু করবে।
কত স্বপ্ন কত আশা আর কত ভরসা ছিল টিপু সুলতানের কচি মনে। গ্রামের ছেলে। প্রথমেই চলে গেল বিদেশ। তাও আবার কুয়েত। থাকতে খুব কষ্ট হত। তার মায়া হত মা-বাবার জন্য। তবে সবকিছু সে ভুলে যেত, যখন বোনদের মায়াবী চেহারাগুলো তার হৃদয়ে ভেষে উঠতো। বোনদের নিয়ে তার স্বপ্নগুলো মনে পড়ত তখন কষ্টটা কষ্ট মনে হতোনা। কারণ তার এই কষ্টের বিনিময়ে ভাই বোনেরা পড়াশুনা করবে, মা-বাবা সুখে থাকবে। বোনদের সুন্দর করে বিয়ে দিবে। তাদের ফ্যামেলীতে কোন অভাব থাকবেনা। অভাব ছোঁতে পারবে না তার মা-বাবা, ভাই-বোনদের। এতেই তার সুখ আর এটাই তার স্বপ্ন ছিল। তাই শত কষ্ট ও একাকিত্ব সয়ে নিয়ে ছিল টিপু সুলতান। সেখানে চাকুরী হল তার। খুব ভাল একটা মালিক পেয়েছিল সে। কাজও করত সে উদ্যমতার সাথে। কিন্তু থাকতে খুব কষ্ট হত তার। কাজ করতে করতে হঠাৎই আনমনে হয়ে যেতো টিপু সুলতান, যখন তার ছোট বোন আখির চেহারাটা ভেসে উঠতো তার হৃদয়ে। যখন কোন সহকর্মীর মৃদু ডাক বা আদরের হাত বুলানো হতো তখন তার ধ্যান ফিরত। তারপর মৃদু একটু হেসে কাজে মন দিত। তবে এই হাসিতে ভালোবাসা ছিল অফুরন্ত। কারণ এরাইতো তার ভবিষ্যত। তার শত হাড়ভাঙ্গা কষ্ট মুছে যেত যখন সে মোবাইল করে সবার সাথে কথা বলত। মায়ের আদরের ডাকটা শুনত। কিন্তু সবার পরে কথা বলত আখি। তার কথা একটাই কবে আসবা। তখন আর কোন উত্তর খুঁজে পেত না টিপু সুলতান। আখি বলত ভাইয়্যা তোমার জন্য খুব কষ্ট হয় আমার। তোমাকে না দেখে থাকতে পারিনা। জান ভাইয়া তোমার মত কাউকে রাস্তায় দেখলে খুব কষ্ট লাগে আমার। তখন শান্তনা দিয়ে টিপু সুলতান বলত; ধুৎ পাগলি বোন আমার, মন খারাপ করিসনা। কয়েকদিন পরই চলে আসবো। তোর জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসব। তুই ভাল করে পড়া লেখা করিস, আর শুন আখি! কোন কিছুর জন্য কষ্ট করবিনা। কিছু লাগলে সাথে সাথে আমায় জানাবি। সঙ্গে সঙ্গে আমি পাঠিয়ে দিব। আখির খুব কান্না আসত তখন, কিন্তু সে কাঁদতনা। কারণ আখি কাঁদলে যে টিপুও কাঁদবে।
সত্যি বলতে কি বিদেশ কারোই ভাল লাগেনা। মায়ের আদর বাবার স্নেহ ভাই বোনের দুষ্টমি ছেড়ে বিদেশ পড়ে থাকার যে কি মজা তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। টিপু সুলতানও সেই স্বাদ বুঝত। কিন্তু কি করবে? সে তো সবার বড় সব দায়িত্ব যে তার। এভাবেই সময় এগুতে থাকল। সব ঠিক ঠাক করে একেবারে চলে আসবে বলে বেশি সময় নিয়ে ছিল সে। একাধারে আট বৎসর আছে কুয়েতে। ভাল একটা অবস্থান করে একেবারে চলে আসবে মায়ের কোলে আর যাবে না বিদেশ। তাই এত চাপা চাপির পরও সে মাঝখানে আসেনি। ভেবেছিল ২০০৮ সালের শুরুতে একবারে চলে আসবে। মোটামুটি সব কাজ গুচিয়ে ছিল সে। একে একে চারটি বোনের বিয়ে দিয়েছে সম্পূর্ণ নিজের খরচে। তবে সে শরীক থাকতে পারেনি। তাই ছোট বোনের বিয়ে দিবে দেশে এসে, এটা তার মনের সুপ্ত আশা ছিল। বড় একটা বাসাও বানাচ্ছে সে। খুব দানশীল ছিল টিপু সুলতান। কাউকে সহজে ফিরিয়ে দিত না টিপু। উদার মনের ছিল সে। যাক সে দেশে ফিরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কাগজ পত্রের সব কাজ শেষ। দুদিন পর চলে আসবে। তখন তার প্রবাসী কর্ম জীবনের শেষ ডিউটি চলছিল। মাত্র ১ঘন্টা বাকী। তার চাচা তাকে ফোন করে বলল। তুই রেডি হয়ে থাক তোকে নিয়ে টিকিট আনতে যাব। চাচা তার নিজস্ব গাড়ি নিয়ে  ভাতিজাকে নিয়ে টিকিট আনতে যাচ্ছিল। গাড়ি এগুচ্ছে ভাতিজার বাসার দিকে। ঠিক তখন ফোনটা রেখে টিপু সুলতান তার কাজটা শেষ করার প্রতি মনযোগ দিল। কাজটা ছিল ট্যাংকির কাজ। সে তাতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। টাংকির ডালা উঠাতেই হালকা একটু বাতাস পেল গ্যাসের। কিন্তু বাড়ি ফিরার সপ্নে বিভোর থাকায় বিষয়টা বুঝতে পারেনি। হাত ঢুকে গেল ভিতরে। ভিতরে গ্যাস জমা ছিল এবং বিদঘুটে অন্ধকারও ছিল। নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা টিপু। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করছে জোরে জোরে কিন্তু আওয়াজ বের হচ্ছে না তার মুখ থেকে।
নিশ্চই তখন মনে পরছিল তার সারা জীবনের স্বপ্নের কথা মা-বাবা, আখির কথা। কিন্তু শত চেষ্টা করেও বাঁচতে পারেনি সে। আল্লাহর নাম মুখে নিয়ে দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে টিপু সুলতান। নাজানি কী ছটফট করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে সে। না জানি কত কষ্ট হয় এমন মূহুর্তে। কত আর্তনাদ করে তখন মানুষ। আহ্ কতই না কষ্ট নিজের মৃত্যু নিজে অবলোকন করা। হে আল্লাহ তুমি টিপু সুলতান ভাইকে জান্নাত নসীব করো। আর তার পরিবারবর্গদের ধৈর্য ধরার তাওফিক দিও। তাদেরকে এর চেয়ে উত্তম বদলা দিও। কারণ তাদের শোকাহত পরিবারের করুণ কাহিনী লিখারমত ভাষা আমার নেই।
সেই টিপু ভাইয়ের লাশ ২০-০১-২০১৪ তারিখ ঠিক ১২টায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌছার সময় নির্ধারিত হয়।
লেখক : শিক্ষার্থী জামিয়া আশরাফিয়া মাদরাসা, সাইনবোর্ড, ঢাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন