রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫

উলামায়ে দেওবন্দ কি বিশ্বনবী (সা)-এর নূর সর্বপ্রথম সৃষ্ট বলে মনে করেন?

প্রশ্ন :
জনৈক রেজভি সাহেব এক বক্তব্যে বলেছেন, আল্লামা থানভী, রশিদ আহমদ গাংগুহী, মুফতি শফি (রহ) সহ উলামায়ে দেওবন্দ মনে করতেন যে, নূরে মুহাম্মদী সর্বপ্রথম সৃষ্টি !

এবার আমি জানতে চাই যে, উক্ত বক্তব্যটি কি পজিটিভ? তাছাড়া “নূরে মুহাম্মদী” (মুহাম্মদ সা: এর নূর বা জ্যোতি) দ্বারা কী উদ্দেশ্য?
আমার জবাব:
প্রথমত, নূরে মুহাম্মদী শীর্ষক রেওয়ায়েতটি জাল বা বানোয়াট হওয়াই প্রমাণিত। ক্লিক করুন-
আলোচ্য বিষয়টি গলদ মাশহুর অতিব প্রচলিত একটি সাবজেক্ট হওয়ায় প্রায় সিরাত গ্রন্থকার সেটির সনদ বা ভিত্তি যাচাইবাচাই করা ছাড়া নিজ নিজ কিতাবে নিয়ে এসেছেন। কেউ এনেছেন রেওয়ায়েতটির ব্যাখ্যা দিতে। তাদের মধ্যে সর্বজন বরেণ্য হযরত মোল্লা আলী ক্বারি আল-হানাফি (রহ) [মৃত ১০১৪ হিজরী] অন্যতম ।
হযরত মোল্লা আলী ক্বারি (রহ) সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতে নূরে মুহাম্মদী শব্দের ব্যাখ্যা নিচে দেয়া হল, এটা দেখুন-
কেউ বা এনেছেন নূরে মুহাম্মদী শীর্ষক রেওয়ায়েতটির অসারতা ও ভিত্তিহীনতা প্রমাণ করার জন্য । তাদের মধ্যে হযরত আল্লামা জালালুদ্দিন আস-সুয়ূতী (রহ) অন্যতম । দেখুন, আল-হাউবী লিল ফাতওয়া- ১/৩৮৪।
আবার কেউ এনেছেন রেওয়ায়েতটির জাহেরী অর্থকে অপরাপর রেওয়ায়েতগুলোর সাথে সমন্বয় করার জন্য। তাদের মধ্যে আল্লামা থানভী, শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী, আল্লামা জুরকানী এবং আল্লামা বদরুদ্দীন আঈনী প্রমূখগণ অন্যতম ।
আর সে জন্য উনাদের প্রতি রেজভিদের নূরী আকিদার নেসবত চালিয়ে দেওয়া পুরোই নীতি-বিরুদ্ধ, যা সুস্পষ্ট প্রতারণা । কেননা, উনাদের কেউ সুস্পষ্টভাবে কোথাও বলেননি যে, নবী (সা) বাশার নন, কিংবা তিনি নূরের সৃষ্ট।
দ্বিতীয়ত, মেকি এশকের মাথামোটা রেজভি গুরুরা আজো কথিত নূরের হাদিসের সনদ দেখাতে পারেনি। শুধু গলাবাজি আর গলাবাজি ! মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক নামক কিতাবের নামে মিথ্যুকদের মত তারাও মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। অথচ তারা প্রমাণ করতে পারেনা যে, সেটি মুসান্নাফের ভেতর রয়েছে!
>> এবার মাথামোটা রেজভি গুরুদের উদ্দেশ্যে আমার দুটি প্রশ্ন।
১- মেশকাত কিতাবের ব্যাখ্যাকারক প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মোল্লা আলী ক্বারি (রহ) তিনি মেরকাত কিতাবে ওই নূরে মুহাম্মদীকে “রূহে মুহাম্মদী” অর্থে ব্যাখ্যা দিলেন কেন?
দলিল : মেরকাত কিতাবের ১/১৬৮-৬৯ নং পৃষ্ঠার লিংক-
২- মোল্লা আলী ক্বারি (রহ)-এর উক্ত ব্যাখ্যার সাথে থানভী, গাংগুহী, মুফতি শফি সহ উলামায়ে দেওবন্দের সকলেই একমত পোষণ করেছেন। তাই যদি উক্ত হাদিসে জাবের দ্বারা নূরের সৃষ্টি বুঝাত, তাহলে মোল্লা আলী ক্বারি (রহ)-এর সুচিন্তিত ব্যাখ্যাটির সাথে উনাদের কেউ দ্বিমত পোষণ করেননি কেন? জবাব দেবেন কি?
অন্যথা মেনে নিতে হবে যে, আপনাদের অভিযোগ অসার এবং উনাদের নীতি-বিরুদ্ধ।
অবশেষে মুহাক্কিকবৃন্দের এরকম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যার মাধ্যমে নূরে মুহাম্মদী শব্দের প্রকৃত মর্মার্থ সুস্পষ্ট হয়ে গেল। যার ফলে রেজভিদের ইসলাম বিরুধী আকিদার মীমাংসা হয়ে গেল। অর্থাৎ, রেজভিদের আকিদা হল, রাসূল (সা)-এর শরীর মুহাম্মদ নূরের সৃষ্ট, যেহেতু হাদিসে (?) উনার নূর সৃষ্টি করার সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু এর প্রতিউত্তরে আমরা যা বুঝি এবং বুঝাতে চাই তা হল, নূরের কথিত রেওয়ায়েতটিতে উদ্ধৃত “নূর” শব্দটি দ্বারা রাসূলেপাক (সা)-এর রূহ মুবারক বুঝানো উদ্দেশ্য । সুতরাং এ কথা একদম সত্য এবং প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, রাসূলেপাক (সা)-এর রূহ মুবারক সমস্ত রূহ সমূহের আগে সৃষ্ট হওয়াতে তাঁকে নূরের সৃষ্ট বলা ভুল এবং চরম হাস্যকর। কেননা, রূহ আর শরীর দুটি আলাদা।
>> আরো দেখা যেতে পারে- সর্বপ্রথম সৃষ্টি কী? নূরে মুহাম্মদী, আরশ, পানি, কলম, বিবেক, না আর কি?
>> আরো দেখুন, নূরে মুহাম্মদী নামক সনদহীন হাদিসের ভয়ংকর ইতিহাস-
>> সুপ্রিয় পাঠক! আরো পরিস্কার করে বলতে গেলে, হযরত জাবের (রা) এর নামে বিদয়াতি রেজভিরা একটি বানোয়াট রেওয়ায়েত প্রচার করে। রেওয়ায়েতটি নূরে মুহাম্মদী সম্পর্কিত। যা সনদ বিহীন ও মিথ্যা।
বিদয়াতি রেজভিদের দাবি, এটি মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক নামক কিতাবের ১৮ নং হাদিস হিসেবে উল্লিখিত । তাদের এসব দাবি জঘন্যতম মিথ্যা ও যাচাইবাচাইহীন শুনাশুনা কথা।
~
মুহাক্কিক ছালিহ আহমাদ আশশামী (রহ) “মাওয়াহিবে লাদুনিয়্যাহ” কিতাবের ১ম খণ্ডের ৭২ নং পৃষ্ঠায় ২নং টীকায় মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক নামক কিতাবে নূরের হাদিসটি থাকার দাবি মিথ্যা প্রমাণ করে লিখেছেন যে
ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺸﻴﺦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻌﺰﻳﺰ ﺍﻟﺨﺎﻟﺪﻱ ﻓﻲ ﺗﻌﻠﻴﻘﻪ ﻋﻠﻲ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﻓﻲ ﻃﺒﻌﺔ ﻟﺸﺮﺡ ﺍﻟﺰﺭﻗﺎﻧﻲ : ﺣﺪﻳﺚ ﺟﺎﺑﺮ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﻤﻨﺴﻮﺏ ﺍﻟﻲ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﺮﺯﺍﻕ ﺧﻄﺎﺀ. ﻓﻬﻮ ﻏﻴﺮ ﻣﻮﺟﻮﺩ ﻓﻲ ﻣﺼﻨﻔﻪ ﻭ ﻻ ﺟﺎﻣﻌﻪ ﻭ ﻻ ﺗﻔﺴﻴﺮﻩ، ﻭﻗﺪ ﺣﻜﻢ ﺍﻟﺸﻴﺦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻦ ﺻﺪﻳﻖ ﻓﻲ ﺭﺳﺎﻟﺘﻪ ” ﻣﺮﺷﺪ ﺍﻟﺤﺎﺋﺮ ﻟﺒﻴﺎﻥ ﻭﺿﻊ ﺣﺪﻳﺚ ﺟﺎﺑﺮ ” ﻋﻠﻲ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﺑﺎﻟﻮﺿﻊ ‏] ﺍﻟﻤﺤﻘﻖ [
অনুবাদ, শায়খ আব্দুর আজীজ আলখালিদী (রহঃ) শরহে জুরকানীর সংস্করণে স্বীয় টীকায় হাদিসটি সম্পর্কে বলেছেন, জাবির (রাঃ) এর হাদিসটি আব্দুর রাযযাক এর প্রতি নেসবত (সম্ভোধন) করা ভুল, যেহেতু এটি মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক কিতাবে নেই, তার “জামে” গ্রন্থেও নেই; এবং তাঁর “তাফসীর” গ্রন্থেও নেই। অনন্তর শায়খ আব্দুল্লাহ বিন ছিদ্দিক (রহঃ) “মুরশিদুল হায়ির লি বায়ানি ওয়াজয়ি হাদিসে জাবির” পুস্তকে হাদিসটিকে মওজূ বা জাল বলে সীদ্ধান্ত দিয়েছেন।”
>> বিখ্যাত হাদিসের সংকলন মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক কিতাবের মুহাক্কিক আল্লামা হাবীবুর রহমান আ’জমী (রহ)-এর “তান্বিহ” বা সতর্কতা শীর্ষক পৃষ্ঠার বয়ান এবং রেজভিদের মিথ্যাচারের জবাব দেখুন :
এবার আশাকরি আপনাদের অন্তরে বদ্ধমূল থাকা সংশয় দূরীভূত হবে, ইনশাআল্লাহ।
লেখক, প্রিন্সিপ্যাল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন