শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫

যৌতুকের ধ্বংসাত্মক জোয়ার রুখতে হবে এখনি : ইউসুফ বিন আব্দুল মজিদ

বিবাহ এমন এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণূ আমল যার মাধ্যমে দুটি মানুষ তাদের নতুন জীবনের সূচনা করে। পা রাখে নতুৃন এক অধ্যায়ে। সবাই আশা করে, যেন এই শুভ সূচনার শুভসমাপ্তি হয়। তবে সবার জীবনে আর সেটা হয়ে উঠে না বিভিন্ন কারণে। এ কারণগুলো কখনও ব্যক্তিগত হয় আবার কখনও হয় সামাজিক। এটাতো বলাই বাহুল্য যে, যতক্ষণ মানুষের ব্যক্তি জীবন ঠিক না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজ ঠিক হওয়ার কল্পনাও করা যায় না। কারণ অনেকগুলো ব্যক্তির সমষ্টিইতো সমাজের বাসিন্দা। তবে এ কথাটাও ফেলে দেয়ার মত না যে, অনেক সময় ব্যক্তি ঠিক হলেও সমাজ বা পরিবার দায় হয়ে দাঁড়ায়।  সুতরাং উন্নত সভ্যতা ও পবিত্র কৃষ্টিকালচারের জন্য প্রয়োজন একটি সুষ্ঠ সমাজ গঠন। যে সমাজ হবে কুসংস্কার মুক্ত। কারণ একটি কুসংস্কারমুক্ত সভ্যসমাজ, নৈতিকতাসমৃদ্ধ সভ্যতা উন্মেষের ভূমিকায় বীজতুল্য। এমন সমাজে সবসময় বিরাজ করে শান্তি। পক্ষান্তরে অনৈতিক কর্মকান্ডে ভরপুর কেনো সমাজ কোনো দিন সুফল বয়ে আনতে পারে না। প্রতিদিন সে সমাজ ও সমাজের মানুষগুলো মনুষত্বের কাতার থেকে পিছিয়ে পড়ে এক কাতার করে। মোটকথা হলো, সমাজব্যবস্থা অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। পরিবেশ বা সমাজের একটা প্রতিক্রিয়া থাকে। একটি মানুষ যে পরিবেশে বড় হয় তার কাজকর্মে সে পরিবেশের মিশ্রন থাকবেই। ভাল হলে ভালো আর খারাপ হলে খারাপ। সুতরাং আমাদের উচিৎ সমাজসভ্যতার দিকে দৃষ্টি দেয়া। সমাজের সমস্যগুলো সবে মিলে সংশোধন করার চেষ্টা করা। কুসংস্কারগুলো আস্তে আস্তে ছেড়ে দেয়া। যাতে করে একসময় সমাজটা ধুয়ে মুছে সচ্ছ হয়ে যায়। এজন্য অবশ্য একা নয় সবে মিলে কাজ করতে হবে। আমাদের সমাজে বিভিন্ন ব্যধি আছে তার মধ্যে যৌতুক হলো একটি মারাত্মক ব্যধি। এই ব্যধিটি দিন দিন বেড়েই চলছে। কোন ভাবেই যেন এর প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে না। আর এর বেশির ভাগ কান্ডারী হচ্ছে শিক্ষিত সমাজ, যাদের উপর এই ব্যধির চিকিৎসার ভার পরে। তারাই কিনা এই রোগে রুগ্ন। অনেকটা সরিষা দানায় ভূূতের মত। একটা ছেলে যদি কোন রকম কিছু পড়াশুনা করে ফেলে, তাহলে তার দাম হয়ে যায় মোটা তাজা লাখ দুই লাখ টাকা দামের একটি গরুর সমান। এখানে গরুর উদাহরণ টানার একটি কারণ আছে। এইতো কিছুদিন আগে উস্তাদজির সাথে কুরবানীর গরু কিনতে গেলাম গরুর হাটে। মোটাতাজা একটি গরু দেখে আমাদের পছন্দ হলো। দাম জিজ্ঞেজ করলে ব্যপারী তার দাম হাকলেন, এক লাখ পঞ্চাশ হাজার।  আমরা প্রথমে তার দাম বললাম এক লাখ, উনি কিছুটা বিরুক্তির স্বরে বললেন, যান যান, আপনারা গরু আহেন নাই। আমরা আর কিছুক্ষণ মুলামোলির পর তার দাম বললাম একলাখ বিশ। সে রাজি হলো না, শেষে তিনি  ত্রিশে দিতে রাজি হলেন। আমরা কিনে নিলাম। কুরবানী শেষ হলো। বাড়ি গেলাম। ঈদের দ্বিতীয় দিন আমাদের প্রতিবেশি এক চাচাত ভাইয়ের বিয়ে। মেয়ে পক্ষ আসল, বিয়ের আলাপ আগে থেকেই মোটামুটি পাকা ছিল, শুধু বাকি ছিল লেনদেনের ব্যপারটা।
একটি মজলিস বসল, বর ও কনে পক্ষের বড় বড় অনেকেই এখানে উপস্থিত। ছেলেকে যৌতুক হিসেবে নগদ টাকা কত দিবে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠল। ছেলের বাবার দাবি দের লাখ। মেয়ের বাবার আকুতি এক লাখ। কিন্তু না, সেই আকুতি ছেলের বাবার কাছে গ্রহণযোগ্য না। মেয়ের বাবাও অসহায়। যাক বহু মোলামুলির পর ছেলের বাবা ত্রিশে রাজি হলো। মেয়ের বাবা অসহায়ের মত তাতে সম্মতি দিল। তবে তার বুকে পাহাড় চাপা একটা কষ্ট বয়ে যাচ্ছিল। চেহারায় তার ছাপ স্পষ্ট ছিল। যাহোক এই বিষয়টা আর আমাদের গরু কিনার বিষয়টায় একটা অভূতপূর্ণ মিল আমার দিলে ধরা দিল। এবার আসুন আমরা যৌতুকে ব্যপারে কিছু ধারণা নিই।
যৌতুক কী? যৌতুক হলো, ছেলের পক্ষ, মেয়ে পক্ষ থেকে  বিয়ে বাবদ পণ সাপেক্ষে নগদ অর্থ বা পণ্য গ্রহণ করা যা দিতে মেয়ে পক্ষ অন্তরিকভাবে রাজি থাকে না।
যৌতুকের সূচনা: ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, প্রাচিনকাল থেকে বাংলাদেশে দুটি ধর্মালম্বিদের বহুল বসবাস। হিন্দু এবং মুসলিম। হিন্দুদের রীতি হলো তারা মেয়েদের বিয়ে দেয়ার সময় তার প্রাপ্যসম্পদের নগদ অংশ বা সে অনুযায়ী বিভিন্ন পণ্য দিয়ে দেয়। সে পরবর্তীতে আর ওয়ারিসের অংশিদার হয় না। আর এখান থেকেই মূলত সমাজে অনেকটা সূচনা হয় যৌতুকের। যা আস্তে আস্তে এক মহামারির দিকে রুপ নিচ্ছে। কিছু দিন আগেও এক হিন্দু দিদির সাথে আমার কথা হয়। আলাপের এক পর্যায়ে তিনি বললেন যে, তিনি মেয়ের জামায়ের চাওয়া মিটাতে তার তিন কাটা জমি বিক্রি করেছেন। এটা হিন্দুদের রীতি হলেও মুসলমানরা এখান থেকেই যৌতুককে বরণ করে নেয়। তাদের মধ্যে অবশ্য আরো কিছু কুসংস্কার আছে যেমন, স্বামী মারা গেলে স্ত্রীকেও তার সাথে জ্যান্ত পুরে ফেলা হতো তবে সেই প্রথা এখন আর নেই বললেই চলে। এখন যেটা দেখা যায় তাহলো কোনো মেয়ের যদি স্বামী মারা যায় তাহলে তার বাকি জীবনটা বিধবা অবস্থায় কাটাতে হয়। এখন অবশ্য তাদের অনেক রীতিতেই পরিবর্তন দেখা যায়। তবে যৌতুকটা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে।
একটি ভুল ধারণা: যৌতুকের সংজ্ঞার মধ্যে হিন্দু ধর্মালম্বিদের যে বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে, তা তাদের ধর্ম বিশ্বাস হলে হতেও পারে, আমাদের কিছু বলার নেই, তবে বিষয়টা এমন না, সম্পূর্ণ কুসংস্কার। তবে যৌতুক যে বড় মারাত্মক একটি ব্যধি তা বলার অপেক্ষা  রাখে না। যা থেকে পরিত্রাণ সবাই চায়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের মুসলমান ভাইদের অনেক কে দেখা যায়। তারা বলে, নবী কারীম সা.ও তো ফাতেমা রা. এর বিয়েতে যৌতুক দিয়েছেন। অথচ কথাটা একেবারেই অজ্ঞতাপূর্ণ কথা। প্রথমত কথা হলো,  হযরত আলী রা. কে নবী কারীম সা. যা দিয়েছেন তা হলো, লেপ, তোষক, বদনা, কেদারা, একটি হার ইত্যাদি খুবি সাধারণ জিনিস। আর সেটা ছিল নবী মুহাম্মদ সা. থেকে সম্পূর্ণ সেচ্চায় কিছু হাদিয়া যা এখনও সম্ভব। কেউ যদি বর্তমান সময়েও তার মেয়ে বা জামাতা কে সম্পূর্ণ সেচ্চায় কিছু দেয় তাহলে তা যৌতুক হবে না। যেমন জামাতাকে সখ করে একটা ভালো ঘড়ি, মোবাইল বা এক সেট কাপড় ইত্যাদি দিল এটা তো আর যৌতুক না। কিন্তু নবীর এই বিষয়ের উপর খোড়া যুক্তি দিয়ে তো আর সামাজিক ব্যধি যৌতুককে হালাল করা যাবেনা; বরং এটা বড় গুনাহ ও নিচু মানের কাজ। নিজের জন্য অপমান! কোনো ছেলে কেন একটা মেয়ের কাছ থেকে যৌতুক নেবে? তাহলে আর তার পূরুষত্বের পাওয়ার থাকলো কোথায়?
যে সমস্ত কারণে সাধারণত যৌতুক আদান  প্রদান হয়-
এক. প্রথমেই বলা যায়, নারী বৈষম্যের কারণে, বরকে খুশি রাখতে কনে পক্ষ যৌতুক দিতে বাধ্য হয়।
দুই. আমাদের দেশে সাধারণত পাত্রী নির্বাচনে সুন্দরীদের প্রাধান্য দেয়া হয়।
তিন. সর্বপরি বলা যায়, সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ কম থাকায়, যৌতুকের মত কালবৈশাখী ঝড় চেপে বসেছে আমাদের সমাজে।
যৌতুকের কু প্রভাব: যে ব্যধি যত ভয়ংকর তার পরিণাম তত ভয়ংকর হবে এটাই স্বাভাবিক। কজন মানুষ আছে বাংলাদেশে, যারা তাদের প্রতিটি মেয়ের বিয়েতে জামাতা কে একটি করে মটর সাইকেল, ফ্রিজ বা নগদ এক দের লাখ করে টাকা দিতে সক্ষম? সুতরাং এই অসহায় মেয়েদের গলায় যখন যৌতুকের ঘ-ি ঝুলিয়ে দেয়, তখন মেয়েটার আর কিছুই করার থাকে না। না পারে টাকার জন্য বাবাকে চাপ দিতে, না পারে নিজে যৌতুক লোভীদের চাপ সহ্য করতে। মাঝখানে পড়ে অবলা অসহায় মেয়েটা দিনের পর দিন নির্যাতনের শিকার হয়। আর সেই নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ বা ছাড়াছাড়ির পথ বেচে নেয়। কেউ কেউ আবার এই অভিশপ্ত দুনিয়াকেই ত্যাগ করে বসে। তার হয়ত এ ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। কিন্তু একটা বারের জন্য কি ছেলের বাড়ির লোকেরা একথা ভাবেনা যে, তাদের ঘরেও তো মেয়ে আছে? যদি এমন হয় যে, ছেলেরা ধনী পরিবার, তবে কেন বউয়ের  বাড়ি থেকে যৌতুক নেবে? আর যদি হয় তারা গরীব, তবে কেন একজন মানুষ হয়েও আরেক জনের দুঃখ বুঝবে না? অথচ স্বজাতির দুঃখ যেখানে একটা পশু পর্যন্ত বুঝে। তবে কি আমরা পশুর চেয়েও অধম? কুরআনের সেই ভাষ্যমত যে, তারা হলো চতুষ্পদ জন্তুর মত বরং এর চেয়ে আরো অধম। অথচ এই একটি মাত্র লোভের জন্য আজ কত ঘর ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। অশান্তির অনল দাউদাউ করে জ্বলছে। সন্তান তার মা হারাচ্ছে। মা বাবা তাদের সদ্য বিবাহ দেওয়া মেয়ের কবর খুঁড়ছে। কাউকে আবার হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হচ্ছে। কোনো বধুর লাশ পাওয়া যাচ্ছে ডোবায়। আবার কাউকে গলা টিপে হত্যা করা হয় ঘুমের মধ্যে? কবে আমাদের ভিতরকার পশুত্বটা শেষ হবে? মনুষত্ব ফিরে আসবে ? কবে লোভ নামক কীট আমাদের মাথা থেকে নামবে? এতই যদি লোভ থাকে তাহলে আর অসহায় নরীর উপর অত্যাচার কেন? লজ্জা যদি নাই থাকে তবে থালা নিয়ে পথে নামলেই তো হয়। নাকি আবার ট্রাই ও প্যান্ট শার্ট পড়ে পথে বসতে লজ্জা লাগে? পাছে লোকে কি বলবে? একথাটা চিরন্তন সত্য যে, আমরা যদি এই যৌতুকের জোয়ার কে আপন গতিতে চলতে দিই তাহলে বোধ হয় একদিন তা আর রোধ করা সম্ভব হবে না। কপাল চাপড়ানো ছাড়া কোন পথ খোলা থাকবেনা আমাদের সামনে। তার আগেই বরং এর প্রতিরোধ করতে হবে। হতে হবে সোচ্চার।
যৌতুক থেকে উত্তরণের পথ: সর্বপ্রথম তো নিজের মন কে বুঝাতে হবে। মানুষের প্রতি একটা মূল্যবোধ থাকতে হবে। নিজের বিবেক হলো বড় আদালত, সেই সুষ্ঠ বিবেকে একটু চিন্তা করতে হবে। আজ আমি অন্য একটা মেয়েকে যেমন যৌতুকের জন্য চাপ দিচ্ছি, কাল যদি আমার বোন এমন চাপে পড়ে? পড়শু যদি আমার  অতি আদরের মেয়েটা এমন চাপের মুখে পড়ে অশুভ একটা সিদ্ধান্ত নেয়? একবারও কি ভেবে দেখেছি আমি যাকে যৌতুকের জন্য চাপ দিচ্ছি সেও তো কারো না কারো বোন বা মেয়ে! আসলে এগুলো হলো মনুষত্বের ব্যপার আর যদি কারো ভিতরে মনুষত্বই না থাকে, তাহলে আর যাই হোক সে সমাজে বসবাসের উপযুক্ত না। হ্যাঁ, যারা যৌতুক নেয় তারা কিন্তু ঠিক এই পর্যায়েরি। যাহোক নিজেকে নিয়ে চিন্তুা করলে বিষয়টা অনেকটাই সমাধান হয়ে যায়। আল্লাহ আমাদের শুভ বুদ্ধি জাগ্রত করুক। সাথে সাথে মৌলিক ভাবে কয়েকটা বিষয় হাতে নেয়া যেতে পারে যৌতুক নামক কুসংস্কার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
এক. নারীদের মধ্যে ইসলামী শিক্ষার প্রচার প্রসার ব্যপক করতে হবে। যার জন্য মহিলা মাদরাসা হতে পারে উত্তম পন্থা।
দুই. বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌতুকের ভয়াবহতা ও তার ধংষাত্মক পরিণতি সমূহ পাঠ্যসূচিতে অন্তুরভূক্ত করা যেতে পারে। [সাথে যৌতুকের সমমানের বিভিন্ন কুপ্রথা]
তিন. বিবাহিত বা অবিবাহিত যুবকদের বিভিন্ন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
চার. সাবার ভিতরে নিজস্ব মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে হবে। আমি আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহ আমায় শ্রেষ্টজাতি করে সৃষ্টি করেছেন, আমি কেন অন্যের দানের প্রত্যাশি হবো? আমি তো কোন ভিক্ষুক না। যে নেয়ার হাত বাড়িয়ে রাখবো? আল্লাহ আমাদের বুঝা ও আমল করার তৌফিক দান করুন, আমীন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন