শুরুতেই বলি, মাতৃভাষার গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশী বা ভিনভাষা শিখার জন্য সকলের অল্প হলেও ইচ্ছা থাকে।বিশেষত মাদ্রাসা ছাত্রদের আরবী ভাষা শিখা ও স্কুল,কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রদের ইংরেজি ভাষা শিখার প্রতি বেশ আগ্রহ ও কৌতূহল রয়েছে। শিখার মাধ্যম হিসেবে তাঁরা একাডেমীক বই পুস্তক ছাড়াও আনুষঙ্গিক বইয়ের সাহায্য নিয়ে থাকে।সর্বধরণের চেষ্টা,পরিশ্রম করে থাকে।কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় -তদুপরি আমাদের দেশের ছেলেরা কেন সহজে ভিনভাষা আয়ত্ত করতে পারে না?
হ্যাঁ,খুবই দিব্যি একটা কারণ আছে। আর তা হলো -আমাদের শিক্ষিত সমাজের অনুৎসাহ প্রদান ও ভুলের প্রতি তিরস্কার করণ। একটু ব্যাখ্যা দিয়ে বলছি:-
১.
মনে করুণ, একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আরবীতে একটুআধটু কথা বলতে শুরু করছে।মাতৃভাষার গণ্ডি পেরিয়ে ভিনভাষায় পদার্পণ করছে,সে হিসাবে তাঁর একটুআধটু ভুলের অবকাশ থাকবেই।কিন্তু এটাকে আমাদের শিক্ষিত সমাজ মেনে নিতে পারে না।তার এই ভুলের জন্য এমন তিরস্কার করা হবে,যাতে আর কখো সে এই পথে না যায়।বাস!ছাত্র এখানেই থেকে যায়।
মনে করুণ, একজন ছাত্র আরবী ফা'য়িল (কর্তা) এর জা'গায় মাফউল বলে ফেলছে -তাকে নিয়ে তিরস্কারের সর্বোচ্চ অনুশীলন শুরু হয়ে যাবে।বলা হবে সর্বনাশ! তুমি এখনো আরবীর ফা'ইল,মাফুলের ব্যবহার জান না?ইংরেজির ক্ষেত্রে সাব্জেক্টের আগে ভার্ব বসিয়ে ফেললে শিক্ষককেরা বলবে :'গাধা! এখনো বাক্যগঠনরীতি শিখতে পারলে না।তোর দ্ধারা কিছুই হবে না '।মোদ্দাকথা, আমাদের দেশে ভিনভাষা শিখার ও বলার ক্ষেত্রে 'গ্রামারকে' এতোই গুরুত্ববহ করা হয় যে,যেন পৃথিবীতে যারাই কথা বলে, সবাই ব্যাকরণ অনুকরণ করে কথা বলে।
অথচ,চিন্তা করে দেখুন! আমরা আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলি। ব্যাকরণ কতটুকু অনুসরণ করি? বিদেশীরা তাদের ভাষা (ইংলিশ +আরবী) ব্যবহার করে,তাঁরা কতটুকু ব্যাকরণ অনুকরণ করে? নিশ্চিত, আমরা যেমন মাতৃভাষা (বাংলাভাষা) বলতে ব্যাকরণ অনুকরণ শূন্যের কোটায়,তাঁদের ও অবস্থান সমান কোটায়। কেননা জানা বাহুল্য যে,মাতৃভাষা হোক কিংবা যেকোন ভাষা হোক -কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে 'মনের ভাবকে অন্যের কাছে ফুটিয়ে তুলা।ব্যাকরণ দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে বলার নাম না। ব্যাকরণ দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে বলা ও লিখার নাম হচ্ছে সাহিত্য'।আর সাহিত্য দিয়ে সবার মনকে জয় করা যায়না ;তাই সর্ক্ষেত্রে ব্যাকরণনীতি চালানো যাবে না'।আসল কথা হচ্ছে, ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক -যেকোন উপায়ে অন্যকে নিজের মনোভাব বুঝাতে সক্ষম হওয়া।এই মৌন পার্থক্যটা আমাদের বুঝতে হবে।
২.
আগেও বলেছি, দেশে থাকতে আরবী ও ইংরেজি ভাষা শিখার জন্য বেশ আগ্রহী ও পরিশ্রমী ছিলাম।কিন্তু আশাতীত শিখতে পারি নাই।তার জন্য আমি মোটেও নিজেকে দায়ী করি না;কেননা আমার হিসাবে পরিশ্রম যথাসাধ্য ছিল।কিন্তু সমাজের ইতিবাচক প্রভাব ও উপর্যুক্ত সঙ্গীর শূন্যতা বিরাজ ছিল। কারণ জানার দরকার ;তাই নিচে তুলে ধরলাম :
→আমাদের সমাজে কথা বলতে গিয়ে ভুল বলে ফেলা লজ্জাজনক, তাই কথা বলতে লজ্জা।
→ভুল বলে ফেললে উৎসাহ এর বদলে একরাশ তিরস্কার ও অনুৎসাহ-কটুবাক্য শ্রবণ।
→অনুশীলন এর জন্য সহপাঠী বা শ্রেণীর শূন্য অবস্থান।তথা প্রেক্টিস মাঠ নাই।
→ভিনভাষা শিখার প্রতি যথাযথ উৎসাহ প্রদান ও উপর্যুক্ত প্রয়োগ বিধান নাই।
কি এসব ভুল বললাম নাকি? না,আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে যা সত্য তাই বললাম।এবার আসি, বাস্তবতার মাঠে এসে কি শিখলাম :-
৩.
বিদেশের মাটিতে পা'বাড়াবা মাত্রই একরাশ হতাশা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।দীর্ঘ সময় আরবী+ইংরেজি ভাষা শিখার তরে ব্যয় করে এসে এখন বোবার মত করে যেতে হচ্ছে।অর্থাৎ, উপযোগী কথা বলতে পারতাম না। ভার্সিটিতে পৌঁছে কারো কথা তেমন বুঝতাম না।বোকের বাম পাশে প্রায়শই ব্যথা অনুভূত করতাম। কিন্তু যথাযোগ্য শিখার ময়দানে এসে সব জড়তা ও অজ্ঞতা দূর হলো। কিভাবে -হ্যাঁ, এক এক করে বলতেছি :-
আরবী ভাষা শিক্ষা :-
(আমি প্রথমেই বলে রাখি যে,আমি এই পোস্টের মাধ্যমে সাহিত্যালোচনা করছি না বরং ভিনভাষায় কথা বলার যোগ্যতা নিয়ে বলছি।)
আমাদের লেকচার ভার্সন আরবী।পরিক্ষা ও পড়াপদ্ধতি সবকিছুই আরবী।কিন্তু আমি যে সাদামাঠা ভাতেমারা বাঙ্গালী। প্রথম দিকে কিছু ভয়ভীতি ছিলই বটে;তবে অল্প সময়ে সেই ভয় কেটে গেছে।ক্লাসে রীতিমত বসে শিক্ষকদের রসালো আলোচনা ও লেকচারের ভাবভঙ্গিমা অবসার্ভ করতাম। খুদ আরবী ভাষিদের থেকে আরবী কথা বলার ভঙ্গিমা ও থিয়োরি ফলো আপ করতাম। খুব সহজ! সিরিয়াসলি খুব সহজ! শিক্ষকদের কথা বুঝতে আমার কাছে তেমনি মনে হতো, যেমনি বাংলাভাষা বুঝতে উপলব্ধি হতো। কেননা :-
→আরবীরা কথা বলতে মনোভাব ফুটাতে সহজ সরল ভাষা প্রয়োগ করেন।ব্যাকরণাদি অল্প অনুসরণ করেন। ফলে সহজেই ছাত্ররা বুঝতে পারে।
→ছাত্ররা কখনো ভুল বলছে কি না, তা না দেখে কি বুঝাতে চাচ্ছে - বুঝার ও হৃদয়াঙ্গম করার চেষ্টা করতেন।
→অত:পর, গুরুতর ভুল কিছু হলে অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক শব্দাবলী প্রয়োগ করে শুদ্ধাচার করতেন।
আর এভাবেই আমি/আমরা অর্থাৎ অনারবী ছাত্ররা কথা বলার একটা উপলব্ধি জ্ঞান পেয়ে গেলাম।
তা হলো, কথা বলার ক্ষেত্রে আগে ব্যাকরণনীতি অনুসরণ নয় ;বরং সহজ সরল কথার অনুকরণ। তখন থেকে পূর্বেকার চিন্তা মাথায় থেকে ঝেড়ে ফেলেছি। আগে কথা বলার পূর্বে ব্যাকরণ নীতি চিন্তা করতাম,আর এখন মনোভাব ফুটিয়ে তুলতে সর্বোচ্চ সহজ পথ অনুসরণ করি।কেননা, চিন্তা করে দেখেন -কথা বলার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ নীতি যদি এতোই অপরিহার্য হত,তাহলে সমাজের মূর্খ লোকেরা কথা বলতে পারত না।কিন্তু,তারাও তো শিক্ষিত সমাজে বসবাস করে একে অপরের সাথে কমিউনিকেট করছে।
৪.
ইংরেজি ভাষা শিক্ষা :-
ইংরেজি ভাষা নিয়ে আমার কৌতূহলীর শেষ নাই।চেষ্টা পরিশ্রম ও সাধনার অন্ত নাই।তবে তিরস্কার অর্জনেও কমতি নাই।
আগে ভাবতাম, ইংরেজি একটা বাক্য বলার ক্ষেত্রে সাব্জেক্ট,ভার্ব অত:পর অব্জেক্ট ইত্যাদি রুপ এর ব্যবহার না হলে তাকে ইংলিশ বলাই হয় না।কিন্তু খুদ বৃটেন ও আমেরিকান ছাত্রদের সাথে মিশে দেখি আমার আগেরকার ধারণা নিছল ধোঁকা ছিল।তারা যেভাবে কথা বলে,ব্যাকরণ নীতিতে গেলে আপনার হৃদয়াঙ্গম বিপরীতমূখী হওয়ার সম্ভাবনা আছে।তাদের সাথে বেশ কমিউনিকেট জড়ো করে আমার একথাই শিক্ষা হলো যে, ইংরেজিতে কথা বলে মনোভাব প্রকাশের জন্য ব্যাকরণ ধর্তব্য না।বরং সহজ সরল ওয়ার্ড ব্যবহার করে যেকোন উপায়ে শ্রুতাকে বুঝাতে সক্ষম হওয়া।
আরবীদের সাথে মিশে আরবী শিখার অভিজ্ঞতা ও ইংলিশদের সাথে মিশে ইংরেজি শিখার অভিজ্ঞতা থেকে একথাই সর্বেশেষ বলতে চাই -
পৃথিবীর যেকোন ভাষা অর্জন করতে হলে আগে ভুল বলতে শিখুন। প্রথমে শুদ্ধ বলে আপনি কখনো ঠাই পাবেন না।আপনি নিজেকে একটা শিশু বাচ্চার সাথে তুলনা করেন!(কেননা,ভিনভাষা শিখার ক্ষেত্রে আমি ছোটই) একটা বাচ্চা যখন কথা বলতে শুরু করে,তখন ভুল কথা দিয়েই শুরু করে। অত:পর,আস্তে আস্তে শুদ্ধাচারী হতে থাকে।ঠিক তেমনি আপনিও আরবী, ইংলিশ কিংবা অন্যভাষা শিখার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ নীতি পরিহার করে সহজলভ্য ভাষা ও কথা দিয়ে বলার চেষ্টা করুন।দেখবেন, একদা আপনিও ভিনভাষা শিখে ফেলছেন।
তাহলে চলুন! আজ থেকে সহপাঠীদের নিয়ে ভুলেশুদ্ধে কথা বলা শুরু করি।সর্বোচ্চ অনুশীলন অব্যাহত রাখি।বিদেশীদের সাথে সাধ্যমতো যোগাযোগ করার চেষ্টা করি।আমার পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য 'অশেষ শুভ কামনা 'রইল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন