আরিফ আজাদ
প্রথমত, পহেলা বৈশাখের এই ধারণার প্রবর্তন হয় মোঘল সম্রাট আকবরের হাত ধরে।তার নির্দেশে ৯৯৮ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের প্রবর্তন হয়।
যেহেতু এই ধারণার সূত্রপাত একজন মুসলমানের হাতে এবং আরবি সন (হিজরী) অনুসরণে যেহেতু এর উদ্ভব, তাই এটার বিরোধিতা করা নাস্তিকদের জন্য একরকম ফরজ কাজ বলা যায়।
(উল্লেখ্য, আকবরের উদ্ভাবিত 'দ্বীন-ই-ইলাহী' এখানে আপাতত আলোচ্য নয়)
দ্বিতীয়ত, বাংলা নাস্তিকরা নিজেদের সবসময় মুক্তচিন্তক, বিজ্ঞানমনস্ক এবং আধুনিক চিন্তা ভাবনা সম্পন্ন বলে দাবি করে। তারা দাবি করে যে, তারা কোন কুসংস্কার, কু-প্রথায় বিশ্বাস করে না।
তাদের কথা হলো, চাষা থেকে জেলে, কামার থেকে নাপিত, চারুকলার ছাত্র থেকে প্রাইমারী স্কুলের পিয়ন সবাইকেই সাইন্স ল্যাবে বসে মাইক্রোস্কোপে চোখ ডুবিয়ে দিয়ে স্রষ্টার আয়তন এবং হাবলের টেলিস্কোপে স্রষ্টার অস্তিত্ব নির্ণয় করতে জানতে হবে। যদি ল্যাবের মাইক্রোস্কোপে স্রষ্টাকে লেজ নাড়তে এবং টেলিস্কোপে চোখ টিপতে না দেখা যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে যে স্রষ্টা বলে আদৌ কেউ নেই।
কিন্তু, বাংলা নববর্ষের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এই ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে কিছু 'বিশ্বাস' এবং 'ভক্তি'।
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস থেকে জানতে পারা যায় যে, মানুষ নতুন বছরকে নতুন আশা, নতুন উদ্যম নিয়ে বরণ করে নিতো।
চাষীরা মনে করতো, নতুন বছরকে বরণ করে নিলে তারা নতুন বছরে আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ ফসল পাবে।
যেহেতু নাস্তিকরা এরকম বিশ্বাসের থোড়াই কেয়ার করে, তাই এরকম বিশ্বাস, ভক্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা 'বর্ষবরণ' অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করা বাংলা নাস্তিকদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
তৃতীয়ত, বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সাথে 'মঙ্গল-অমঙ্গল' জাতীয় কিছু ব্যাপার-স্যাপার জড়িয়ে আছে।
নিকট অতীতে অর্থাৎ আশির দশকে ঢাবির চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছাত্ররা বাংলা সনের নতুন দিনটাকে একটু ভিন্নভাবে বরণ করে নেয়। তখন যেহেতু দেশে স্বৈরাচার এরশাদের সময়কাল চলছিলো, তারা স্বৈরাচারের পতন এবং যাবতীয় অমঙ্গলের হাত থেকে মুক্ত হবার প্রত্যয়ে বর্ষবরণের দিন একটি মিছিল বের করে। এই মিছিলের নাম দেওয়া হয় 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'। এই মিছিলে অমঙ্গলের বিরুদ্ধ প্রতীক হিসেবে কিছু পশু , পাখি এবং দানব টাইপ জানোয়ারের মুখোশ, ফেস্টুন এবং প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়। এগুলোকে তারা মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে।তখন থেকে প্রতিবছর নববর্ষের দিন মঙ্গল শোভাযাত্রায় এই পশু,পাখি, দানব,জানোয়ারের প্রতিকৃতি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে।
তারা বিশ্বাস করে, এতে করে সমস্ত অশুভ, অমঙ্গল নিপাত যাবে।
এরকম দানব মানবের প্রতিকৃতি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা করলে, মঙ্গল প্রদীপ জ্বালালে অমঙ্গল দূর হয়ে মঙ্গল আসে কী আসে না সেটা পরের ব্যাপার,
তবে, বাংলা নাস্তিকরা যেহেতু মঙ্গল-অমঙ্গল জাতীয় শব্দাবলী শুনলেই নাক সিটকানো শুরু করে, এবং 'থার্ড পারসন' কেউ যে আদৌ মঙ্গল-অমঙ্গল ঘটাতে পারে- এরকম কিছুতে যখন তারা বিশ্বাসই রাখে না, তাই 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' নামের এরকম বিদঘুটে, অবৈজ্ঞানিক, মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারনার বিরোধিতা করাও বাংলা নাস্তিকদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়।
চতুর্থত, মুসলমানদের কোরবানি ঈদ আসলেই নাস্তিকদের 'মানবিকতা' নামক সপ্তম ইন্দ্রিয়টার বাম্পার ফলন দেখা যায়। কোরবানির ঈদে গরু জবাইকে তারা বিজ্ঞান, মানবিকতা দিয়ে একেবারে ধুঁয়ে দেবার চেষ্টা করে।
তাদের যখন প্রশ্ন করা হয়, 'সারাবছরই তো ব্যাপকহারে গরু জবাই হয়। তখন তো আপনাদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। কোরবানির ঈদ আসলেই কেনো আপনাদের মধ্যে এত্তো পশুপ্রেম জেগে উঠে?'
তারা তখন বসুন্ধরা টিস্যু দিয়ে চোখের কোণা মুছতে মুছতে বলে, 'সারাবছর জবাই করা এক ব্যাপার, কোরবানির ঈদে জবাই করা অন্য ব্যাপার। ধর্মীয় উৎসবের নামে এরকম পশু জবাই করার কোন মানে হয় না। মানবিকতা বলে একটা ব্যাপার আছে। পশুর প্রাণ বলে কি ওটা প্রাণ নয়?'
যাহোক, ধর্মীয় উৎসবের নাম করে গরু জবাই করা যদি নৃশংসতা হয়, অমানবিকতা হয়, তাহলে একইভাবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের নাম করে ইলিশ মাছ নিধন করাটাও নৃশংসতা এবং অমানবিকতা।
গরু এবং ইলিশের মধ্যে বেসিক ডিফারেন্স নেই। একটা সাইজে বড়, অন্যটা ছোট। একটা স্থলচর, অন্যটা জলচর- এইটুকুই।
তবে, নাস্তিকরা যেহেতু কথায় কথায় সাম্যের কথা বলে, তাই গরু আর ইলিশের সাইজ এখানে ফ্যাক্ট না। ফ্যাক্ট হচ্ছে- দুইটারই প্রাণ আছে।
তাই, বাংলা নাস্তিকদের উচিত বর্ষবরণের নাম করে এরকম ব্যাপকহারে ইলিশ নিধন, তা নিয়ে উৎসব,হৈ-হুল্লোড় ইত্যাদির চরম বিরোধিতা করা।
উপরে উল্লিখিত পয়েন্টগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাংলা নাস্তিকদের উচিত 'বর্ষবরণ' নামের এই অপ সংস্কৃতির বিরোধিতায় এগিয়ে আসা, জনমত গড়ে তোলা। কিন্তু আজ অবধি কোন নাস্তিককেই এটার বিরুদ্ধে 'টু' শব্দটিও করতে দেখা যায় নি।
কারণ, এই অপ সংস্কৃতি যতোই আনকালচারড, যতোই অবৈজ্ঞানিক এবং তাদের আইডিওলোজির বিরুদ্ধে হোক না কেনো, এটা যেহেতু ইসলামের বেসিক কনসেপ্টের সাথে সাংঘর্ষিক,তাই এটার বিরোধিতা করা দূরে থাক, এটাকে ফলাও করে যতো বেশি প্রচার-প্রসার করা যায়, বাংলা নাস্তিকদের ততোই লাভ।
ইতোপূর্বে যদিও তাদের 'বর্ষবরণ' নামের এই অপ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখা যায় নি, তবুও, আমি যেহেতু খুব আশাবাদী মানুষ, আমি আশা করছি, এ বছর থেকে বাংলা নাস্তিক সম্প্রদায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে আমাকে ভুল প্রমাণ করবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন