মুফতি মুহিউদ্দিন কাসেমি
দিন ও রাতে পাঁচওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়েছে। যা মূলত ইসলামের মূল স্তম্ভ এবং ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলোর আগে-পরে এবং অন্য সময়েও আরো কিছু নামায পড়ার ব্যাপারে উৎসাহ এসেছে হাদিসে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন নিজে।
অতঃপর এ নামাযগুলোর মধ্যে যার ব্যাপারে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুত্বারোপ করেছেন কিংবা অন্যকে উৎসাহ দেওয়ার সাথে সাথে নিজে উহার ওপর গুরুত্বসহকারে আমল করেছেন, এগুলোকে সাধারণত ‘সুন্নত’ বলে। সুন্নত ব্যতীত বাকি নামায নফল। কিছু নফলের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
নফল আদায় করা এক তো আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য ও নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। বিভিন্ন হাদিসে নফল নামাযের অনেক ফজিলত ও সওয়াবের কথা বিধৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ কিছু হাদিস উল্লেখ করছি :
- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ قَالَ مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِي لَأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنْ اسْتَعَاذَنِي لَأُعِيذَنَّهُ وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَيْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِي عَنْ نَفْسِ الْمُؤْمِنِ يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ
- হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা বলেন : বান্দা নফলের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জনে উত্তরোত্তর উন্নতি করতে থাকে। অবশেষে তাকে আমার মাহবুব বা প্রিয় বানিয়ে নিই। আর যখন কাউকে আমি নিজের মাহবুব বানিয়ে নিই, তো আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। তার চোখ হয়ে যাই, যার দ্বারা সে দেখে। তার হাত হয়ে যাই, যার উপায়ে সে ধরে। তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে হেঁটে চলে। সে আমার কাছে যা চায় সবই তাকে দিই। সে আমার কাছে মুক্তি চাইলে তাকে মুক্তি দেব। আমি মুমিন বান্দাকে মৃত্যু দেওয়া ছাড়া কোনো কাজেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব করি না, সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে, আর আমি তাকে কষ্ট দিতে অপছন্দ করি। ( বুখারি-২/৯৬৩, হাদিস নং- ৬৫০২; রিয়াজুস সালিহিন : ১/২৪৬)
চোখ, হাত এবং পা হয়ে যাওয়ার মানে হল, তার সব কাজ আল্লাহ তাআলার মুহাব্বত ও সন্তুষ্টির অধীনে হয়। তার কোনো কাজ খোদার অসন্তুষ্টি ও নাফরমানির কারণ হয় না।
দ্বিতীয়ত ফরজের মধ্যে কোনো অপূর্ণতা থাকলে নফলের দ্বারা তা দূরীভূত হয়ে যায়। এ সংক্রান্ত বহু হাদিস রয়েছে। উদাহরণত একটি হাদিস উল্লেখ করছি।
عَن حُرَيْثِ بْنِ قَبِيصَةَ قَالَ قَدِمْتُ الْمَدِينَةَ فَقُلْتُ اللَّهُمَّ يَسِّرْ لِي جَلِيسًا صَالِحًا قَالَ فَجَلَسْتُ إِلَى أَبِي هُرَيْرَةَ فَقُلْتُ إِنِّي سَأَلْتُ اللَّهَ أَنْ يَرْزُقَنِي جَلِيسًا صَالِحًا فَبِحَدِيثٍ سَمِعْتَهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَعَلَّ اللَّهَ أَنْ يَنْفَعَنِي بِهِ فَقَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ إِنَّ أَوَّلَ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عَمَلِهِ صَلَاتُهُ فَإِنْ صَلُحَتْ فَقَدْ أَفْلَحَ وَأَنْجَحَ وَإِنْ فَسَدَتْ فَقَدْ خَابَ وَخَسِرَ فَإِنْ انْتَقَصَ مِنْ فَرِيضَتِهِ شَيْءٌ قَالَ الرَّبُّ عَزَّ وَجَلَّ انْظُرُوا هَلْ لِعَبْدِي مِنْ تَطَوُّعٍ فَيُكَمَّلَ بِهَا مَا انْتَقَصَ مِنْ الْفَرِيضَةِ ثُمَّ يَكُونُ سَائِرُ عَمَلِهِ عَلَى ذَلِكَ قَالَ
الكتاب : الجامع الصحيح سنن الترمذي
-হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, কেয়ামতের দিবসে বান্দার আমলের মধ্যে সর্বপ্রথম নামাযের হিসাব নেওয়া হবে। যদি নামায ঠিক হয়ে যায় তবে সে সফলকাম, কৃতকার্য ও ভাগ্যবান। পক্ষান্তরে যদি নামায ভুল প্রমাণিত হয় তবে সে অকৃতকার্য ও ব্যর্থ। আর যদি নামাযের মধ্যে কোনো অপূর্ণতা থাকে তাহলে আল্লাহ বলবেন, দেখ এ বান্দার কোনো নফল আছে কি-না? যা দিয়ে ফরজ পূর্ণ করে দেওয়া যায়। যদি নফল থাকে তবে ফরজকে পূর্ণ করে দেওয়া হবে। এরপর অন্যান্য আমলের ব্যাপারেও তাই হবে। (তিরমিযি-৯৪, হাদিস নং- ৪১৩; রিয়াজুস সালিহিন : ২/২৩, অধ্যায় নং- ১৯৩; মুসনাদুস সাহাবাহ, হাদিস নং- ৬৮৬; কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ১৮৮৭৭)
কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদ
আর নফল নামাযের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতময় নামায হচ্ছে কিয়ামুল লাইল; যা তাহাজ্জুদ নামায হিসেবে পরিচিত।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের গুণাবলি উল্লেখ করতে গিয়ে উল্লেখ করেন :
كَانُوا قَلِيلًا مِنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ (১৭) وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
অর্থ : তারা রাতের সামান্য অংশেই নিদ্রায় যেত এবং রাতের শেষপ্রহরে তারা ক্ষমাপ্রার্থনা করে। (সূরা আযযারিয়াত : ১৭-১৮)
সুতরাং রাতে কম ঘুমিয়ে নামাযে মশগুল থাকা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করা নেককার, পরেহযগার ও মুত্তাকীদের অন্যতম বিশেষ গুণ। মানুষমাত্রই ভুল-ভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে। যে কোনো গোনাহে ও নাফরমানিতে জড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু গোনাহ হয়ে গেলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়াই তাকওয়ার লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য। আর যদি গোনাহ না থাকে তাহলে বাহ্যত ক্ষমাপ্রার্থনার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এ আয়াতে বলা হচ্ছে, যারা রাতে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকে এবং খুব কম নিদ্রা যায়। তাদের ব্যাপারেই বলা হচ্ছে যে, তারা রাতের শেষপ্রহরে ক্ষমাপ্রার্থনা করে থাকে। এমতাবস্থায় ক্ষমাপ্রার্থনা করার বাহ্যত কোনো মিল পাওয়া যায় না। কারণ, ক্ষমাপ্রার্থনা হয় গোনাহের কারণে আর যারা রাতের অধিকাংশ সময় ইবাদতে কাটায় তাদের তো গোনাহ না হওয়ারই কথা, তাহলে তারা কোন্ গোনাহের কারেণ ক্ষমাপ্রার্থনা করবে?
এর উত্তর হচ্ছে, তারা নিজেদের এ ইবাদতকে আল্লাহর মাহাত্ম্যের পক্ষে যথোপযুক্ত মনে করে না; তাই ত্রুটি ও অবহেলার কারণে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। তাছাড়া ইস্তেগফার কেবল গোনাহের কারণেই হয় না; বরং ইস্তেগফারের দ্বারা মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। নিজের আবদিয়্যতের যথার্থ বহিঃপ্রকাশ ঘটে। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তো কোনো গোনাহ ছিল না; তা সত্ত্বেও তিনি সত্তরবারের অধিক ইস্তেগফার করতেন।
প্রবৃত্তি দলনে কিয়ামুল লাইল
প্রবৃত্তি দলনে কিয়ামুল লাইলের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। মানুষের নফস বা প্রবৃত্তি সৃষ্টিগতভাবে মানুষকে মন্দ ও খারাপ কাজের দিকে পরিচালিত করে। নফসের কুপ্রভাব, প্রতারণা ও ধোঁকা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এবং নফসের উন্নতিসাধনে এ নামাযের কার্যকারিতা অতুলনীয়। কুরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে :
إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا
অর্থ : নিশ্চয় ইবাদতের জন্যে রাত্রিতে উঠা প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল। (সূরা মুযযাম্মিল : ৬)
হযরত আয়েশা রা. বলেন, এর অর্থ রাত্রিতে ঘুমের পর গাত্রোত্থান করা। সুতরাং এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদ নামায।
প্রথমে তাহাজ্জুদ নামায ফরজ ছিল
সূরা মুয্যাম্মিলের দুই ও তিন নং আয়াতের নিদের্শ মোতাবেক প্রথমে তাহাজ্জুদ নামায ফরজ ছিল। তখন পাঞ্জেগানা নামায ছিল না। পরে মেরাজের রজনীতে পাঁচওয়াক্ত নামায ফরজ হয় এবং তাহাজ্জুদের ফরজ নামায সর্বসম্মতিক্রমে উম্মতের ওপর থেকে রহিত হয়ে যায়; কিন্তু রাসুল সা. এর পক্ষে রহিতহ হয় কি-না, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। রহিত হয়ে গেলেও তিনি জীবনে কোনো দিন তাহাজ্জুদ ছাড়েন নি। ভুলবশত ছুটে গেলেও দিনে কাজা করে নিতেন। দুয়েকবার এমনটি হয়েছে। সূরা বনি ইসরাইলের ৭৯ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে :
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا
অর্থ : রাত্রির কিছু অংশ কুরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকুন। এটা আপনার জন্যে অতিরিক্ত। হয়তো বা আপনার পালনকর্তা আপনাকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছাবেন।
তাহাজ্জুদ নামাযের ফরজিয়্যত রহিত হলেও তা নফল হিসেবে থেকে যায়। নফলের মাঝেও সর্বোত্তম নফল। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন ও উম্মাহর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গের বিশেষ পরিচয় হল, তারা নিয়মিত তাহাজ্জুদগুজার ছিলেন।
প্রতিটি রাতই ফজিলতের অধিকারী
প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি রজনী স্বীয় স্থানে সম্মানিত এবং ফজিলত ও মর্যাদার অধিকারী। যে কারণে রাত জেগে নামায পড়া ও রাতে দুআ করার কথা হাদিসে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমনÑ
عَنْ أَسْمَاءَ بِنْتِ يَزِيدَ، عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: " يُحْشَرُ النَّاسُ فِي صَعِيدٍ وَاحِدٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَيُنَادِي مُنَادٍ فَيَقُولُ: أَيْنَ الَّذِينَ كَانَتْ تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ، فَيَقُومُونَ وَهُمْ قَلِيلٌ، يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ، ثُمَّ يُؤْمَرُ بِسَائِرِ النَّاسِ إِلَى الْحِسَابِ
-হযরত আসমা বিনতে ইয়াযিদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিবসে সমস্ত মানুষকে একটি প্রশস্ত ও উন্মুক্ত ময়দানে একত্রিত করা হবে। অতঃপর একজন আহ্বানকারী এই বলে আহ্বান করবে, ঐ সমস্ত বান্দারা কোথায়, রাতের বেলায় যাদের পার্শ্ব বিছানা থেকে পৃথক থাকত। তখন তারা ডাকে সাড়া দিয়ে কোনো হিসাব-কিতাব ছাড়া জান্নাতে চলে যাবে। তবে তাদের সংখ্যা একেবারে স্বল্প। তারপর বাকি সকল মানুষের হিসাব গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হবে। (শুআবুল ঈমান- ৩/১৬৯, হাদিস নং- ৩২৪৪; মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস নং- ২০৫৭৮; মুস্তাদরাকে হাকিম, হাদিস নং- ৩৫০৮)
قَالَ حَدَّثَنِى عَمْرُو بْنُ عَبَسَةَ رَضِىَ اللّٰهُ عَنْهُ قَالَ : أَتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ نَازِلٌ بِعُكَاظٍ فَقُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلْ مِنْ دَعْوَةٍ أقْرَبُ مِنْ أُخْرَى أَوْ سَاعَةٍ نَبْغِى أَوْ نَبْتَغِى ذِكْرَهَا؟ قَالَ :্র نَعَمْ إِنَّ أقْرَبَ مَا يَكُونُ الرَّبُّ مِنَ الْعَبْدِ جَوْفُ اللَّيْلِ الآخِرُ ، فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَن تَكُونَ مِمَّنْ يَذْكُرُ اللَّهَ فِى تِلْكَ السَّاعَةِ فَكُنْ.
-হযরত আমর ইবনে আবাসা রা. বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলাম তখন তিনি উকাজ নামক স্থানে ছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম এমন কোনো দুআ আছে অন্যান্য দুআর তুলনায় বেশি কবুল হয় অথবা এমন কোনো মুহূর্ত আছে যখন দুআ মঞ্জুর হয়? উত্তরে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : হ্যাঁ, রাতের শেষ মধ্যবর্তী অংশে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বান্দার অধিক নিকটবর্তী হন। অতএব, তুমি সক্ষম হলে সেসময় যারা আল্লাহকে স্মরণ করে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত হও। (তিরমিযি- ২/১৯৪, হাদিস নং- ৩৫৭৯; মেশকাত- ১/১০৯; সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস নং- ১১৪৭; সুনানে কুবরা লিলবায়হাকি, হাদিস নং- ৪৮৪৮)
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ فَيَقُولُ مَنْ يَدْعُونِى فَأَسْتَجِيبَ لَهُ وَمَنْ يَسْأَلُنِى فَأُعْطِيَهُ وَمَنْ يَسْتَغْفِرُنِى فَأَغْفِرَ لَهُ.
-হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : আমাদের প্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলতে থাকেন : কে আছে যে আমায় ডাকবে; আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছে যে আমার নিকট কিছু চাইবে; আমি তাকে দিব। কে আছে যে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে; আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। (বুখারি- ২/৯৩৬, হাদিস নং- ৫৯৬২; মুসলিম- ১/২৫৮, হাদিস নং- ১৮০৮; মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হাদিস নং মেশকাত- ১/১০৯)
এই সমস্ত হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয়, প্রতিটি রাতই ফজিলতময়, গুরুত্বপূর্ণ, মর্যাদার অধিকারী, শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। এজন্যই রাত জাগরণকারী বান্দারা কোনো রকম বিভক্তি ছাড়াই প্রতিটি রাতকে ইবাদত, মুনাজাত ও রোনাজারিÑকান্নাকাটির মাধ্যমে আবাদ রাখেন। এবং আসলে তাই হওয়া উচিত। কেননা, মূল উদ্দেশ্য হল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করা। আর তিনি তো মেহেরবান, দয়ালু; প্রতি রাতেই স্বীয় রেজামন্দিÑসন্তুষ্টি বিতরণ করতে আহ্বান করে যাচ্ছেন। যেমনটি উপরের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
কোনো এক বুযুর্গ বলেছেন :
لم يعرف لَيْلَةَ الْقَدْر من لم يعرف قَدْرلَيْلة
“যে রাতের মর্যাদা বুঝে নি, সে কদরের রাত্রির মর্যাদাও বুঝে নি।”
হাকিমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি রহ. বলেন : বুস্তা কিতাবে ঘটনা আছে, ঘুটঘুটে অন্ধকার রজনীতে কোনো এক শাহজাদার একটি মোতি হারিয়ে গিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ ঐ জায়গার সমস্ত কঙ্কর একত্রিত করার নির্দেশ দিল। শাহজাদার এই অবান্তর কষ্টসাপেক্ষ নির্দেশ পেয়ে এক কর্মচারী বিনীতভাবে আরজ করল, জনাব! এতে লাভ কী?
প্রত্যুত্তরে শাহজাদা বলল : যদি কিছু কঙ্কর একত্রিত করা হয় তাহলে তাতে মোতি না আসার সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু সমস্ত কঙ্কর-পাথর জমা করলে মোতি পাওয়া যাবে নিশ্চিতভাবে, অবশ্যম্ভাবীরূপে।
اےخوا جه چه پر سى از شب قدر نشا نى
هر شب شبِ قدر ست گر قدر بدانى
“ হে মালি সর্দার! শবে কদরের মূল্য সম্পর্কে কী জিজ্ঞেস কর?
প্রতিটি রাতই শবে কদর; যদি তুমি তার কদর বুঝ!”
কিয়ামুল সম্পর্কে কয়েকটি হাদিস
অসংখ্য হাদিসে কিয়ামুল লাইলের গুরুত্ব ও ফজিলত বিধৃত হয়েছে। হাদিসের প্রত্যেকটি কিতাবে স্বতন্ত্র অধ্যায়ে কিংবা নফল সালাতের অধ্যায়ে এ বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ হাদিস বর্ণনা করেছেন। নমুনাস্বরূপ কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হল :
عَنْ ضَمْرَةَ بْنِ حَبِيبٍ قَال سَمِعْتُ أَبَا أُمَامَةَ يَقُولُ حَدَّثَنِي عَمْرُو بْنُ عَبَسَةَ أَنَّهُ سَمِعَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الرَّبُّ مِنْ الْعَبْدِ فِي جَوْفِ اللَّيْلِ الْآخِرِ فَإِنْ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَكُونَ مِمَّنْ يَذْكُرُ اللَّهَ فِي تِلْكَ السَّاعَةِ فَكُنْ
-হযরত আমর ইবনে আবাসা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা রাতের শেষভাগে বান্দার অধিক নিকটবর্তী হন। তোমার যদি সম্ভব হয় তবে সেসব পুণ্যবান বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও, যারা সে বরকতময় সময়ে আল্লাহর জিকির করে। (তিরমিযি- ২/১৯৮, হাদিস নং- ৩৫৭৯; কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ১৭৬৬)
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ - رضى الله عنه - يَرْفَعُهُ قَالَ سُئِلَ أَىُّ الصَّلاَةِ أَفْضَلُ بَعْدَ الْمَكْتُوبَةِ وَأَىُّ الصِّيَامِ أَفْضَلُ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ فَقَالَ ্র أَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الصَّلاَةِ الْمَكْتُوبَةِ الصَّلاَةُ فِى جَوْفِ اللَّيْلِ وَأَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ صِيَامُ شَهْرِ اللَّهِ الْمُحَرَّمِ গ্ধ.
-হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞোস করা হল, ফরজ নামাযের পর সর্বোত্তম নামায কোন্টি? তদ্রƒপ রমজান মাসের ফরজ রোযার পর সর্বোত্তম রোযা কোন্টি? উত্তরে রাসুল সা. বলেছেন : ফরজ নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হল রাতের মধ্যভাগের নামায। অর্থাৎ তাহাজ্জুদ। আর রমজান মাসের রোযার পর সর্বোত্তম রোযা হচ্ছে মুহাররম মাসের রোযা। (মুসলিম, হাদিস নং- ২৮১৩; মুসনাদুস সাহাবাহ, হাদিস নং- ৫৫৭)
عَنْ أَبِى أُمَامَةَ الْبَاهِلِىِّ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ :্র عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللَّيْلِ ، فَإِنَّهُ دَأْبُ الصَّالِحِينَ قَبْلَكُمْ ، وَهُوَ قُرْبَةٌ لَكُمْ إِلَى رَبِّكُمْ ، وَمَكْفَرَةٌ لِلسَّيِّئَاتِ ، وَمَنْهَاةٌ عَنِ الإِثْمِ গ্ধ.
-হযরত আবু উমামা বাহেলি রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা অবশ্যই তাহাজ্জুদ পড়। কেননা, এটা পূর্ববর্তী নেককারদের পথ ও নিদর্শন। আল্লাহর নৈকট্য লাভের বিশেষ উপায়। এবং এর মাধ্যমে গোনাহ মাফ হয়ে যায় ও পাপাচার থেকে বেঁচে থাকা যায়। (তিরমিযি- ২/১৯৫, হাদিস নং- ৩৬১৯; সুনানে কুবরা লিলবায়হাকি, হাদিস নং-৪৮৩২; আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস নং- ৩২৫৩)
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- ্র رَحِمَ اللّٰهُ رَجُلاً قَامَ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّى وَأَيْقَظَ امْرَأَتَهُ فَإِنْ أَبَتْ نَضَحَ فِى وَجْهِهَا الْمَاءَ رَحِمَ اللّٰهُ امْرَأَةً قَامَتْ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّتْ وَأَيْقَظَتْ زَوْجَهَا فَإِنْ أَبَى نَضَحَتْ فِى وَجْهِهِ الْمَاءَ গ্ধ
-হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক সে বান্দার ওপর, যে রাতে ওঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয়। সেও নামায পড়ে। ঘুম বেশি হওয়ার দরুন স্ত্রী না জাগলে তার মুখে অল্প পানি ছিটিয়ে তাকে জাগিয়ে দেয়। তদ্রƒপ আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক সে বান্দির ওপর, যে রাতে ওঠে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং স্বামীকে জাগিয়ে দেয়। সেও ওঠে নামায পড়ে। যদি সে না ওঠে তবে তার মুখে অল্প পানির ছিটা দিয়ে তাকে ওঠিয়ে দেয়। (আবু দাউদ- ১/১৮৫, হাদিস নং- ১৩১০, নাসায়ি- ১/১৮৩)
রমজানে কিয়ামুল লাইল
রমজান হচ্ছে কিয়ামুল লাইল আদায়ের মহা সুযোগ। এমনিতে ঘুম ও অলসতার কারণে যারা তাহাজ্জুদ নামায পড়তে পারে না, তাদের জন্যে এর চেয়ে উত্তম সুযোগ আর হতে পারে না। সাহরি খাওয়ার জন্যে তো সকলকে উঠতেই হয়, তখন কয়েক রাকাত সালাত আদায় করলেই এর ফজিলত পাওয়া যাবে। তাছাড়া তারাবির নামাযও কিয়ামুল লাইলের অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ, রাতের সকল নফল নামাযই কিয়ামুল লাইল। আর রমজানে তো প্রত্যেক ইবাদতের সওয়াব বৃদ্ধি করা হয়। একটি হাদিসে রাসুল সা. বলেন :
مَنْ تَقَرَّبَ فِيهِ بِخَصْلَةٍ مِنَ الْخَيْرِ كَانَ كَمَنْ أَدَّى فَرِيضَةً فِيمَا سِوَاهُ، وَمَنْ أَدَّى فَرِيضَةً فِيهِ كَانَ كَمَنْ أَدَّى سَبْعِينَ فَرِيضَةً فِيمَا سِوَاهُ
অর্থ : কেউ রমজানে একটি নফল আদায় করলে অন্যসময়ের ফরজ আদায়ের সওয়াব পাবে। আর ফরজ আদায় করলে অন্যসময়ের সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান হবে। (শুআবুল ইমান, হাদিস নং- ৩৩৩৬)
সুতরাং রমজানে কিয়ামুল পালনের মোক্ষম সুযোগকে কোনোক্রমেই হাতছাড়া করা যাবে না। সারা বছর তাহাজ্জুদ পড়তে না পারলেও রমজানে তাহাজ্জুদ করা অবশ্যই দরকার। এমনিতেই তো আমরা বিভিন্ন গোনাহে জর্জরিত। পঙ্কিল ও পূতিদুর্গন্ধময় জীবন থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে স্বচ্ছ, পবিত্র ও নিষ্কলুষ জীবনের অধিকারী হতে এর চেয়ে উত্তম সুযোগ আর হতে পারে না।
মাসআলা : তাহাজ্জুদের নামায পড়ার জন্য ঘুমানো অত্যাবশ্যক নয়। কেউ যদি সারা রাত জাগ্রত থাকে সেও তাহাজ্জুদ পড়তে পারবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন