বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

হাদিসে ইবনে মাসউদ (রা)-এর অন্যতম রাবী ‘মূসা বিন সাহাল’ এর পরিচিতি

হাদিসে ইবনে মাসউদ (রা) সম্পর্কে ইমাম ইবনে যওজী (রহ)-এর প্রকৃত বয়ান ও রাবী মূসা ইবনে সাহাল সম্পর্কে কিছু কথা:
~~~~~~~~~~~~~~~~~~ ~~~~~~~~~~

যে কথা অবশ্যই বলা লাগে তা হল, শতাব্দির জঘন্যতম মুর্খের দল ভাণ্ডারি সুন্নীরা তাদের আবু জাহেল মার্কা পীর ফকিরদের থেকে শুনেছে যে, ইমাম আবুল ফারাজ ইবনে যওজী (রহ) তিনি হাদিসে ইবনে মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে নাকি মওদ্বূ বলেছেন! ব্যাস, কাম হয়ে গেল। আর যাচাইবাচাই করার কী প্রয়োজন!
কিন্তু মুহাক্কিক উলামায়ে কেরামদের যে বা যারাই ইমাম আবুল ফারাজ ইবনে যওজী (রহ) -এর উক্ত মতটির প্রকৃত ধরণ এবং তার কারণ অনুসন্ধান চালিয়ে উদঘাটন করেছেন তারা প্রমাণ করেছেন ভিন্ন কিছু। যাদের ভেতর আল্লামা ইমাম ইবনে আররাক ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা যারূসী (রহ) প্রমুখ অন্যতম।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~ ~~~~~~ ~~~~
ইমাম আবুল ফারাজ ইবনে যওজী (রহ)-এর উক্ত মতটির প্রকৃত ধরণ এবং তার কারণ :
~~~~~~~~~~~~~~~~~~ ~~~~~~ ~~~~
সহজ করে বলতে গেলে, উনি হাদিসে ইবনে মাসউদ (রা)-এর মতন (মূল টেক্সট) সম্পর্কে কোনো ধরণের নেতিবাচক মন্তব্য করেননি।

বড়জোর তিনি তাঁরই রচিত হাদিসের কিতাব “আল-ইলালুল মুতানাহিয়্যাহ” গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ১৯৩ নং পৃষ্ঠায় হাদিসখানা একটি সনদ সহকারে উল্লেখ করেন। অতপর উক্ত সনদের রাবীদের মধ্যকার “মূসা ইবনে সাহাল” নামক রাবীকে মাজহূল বা অপরিচিত রাবী বলে মন্তব্য করেন। যার ফলে উক্ত হাদিসটির সনদের ভেতর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশংকা বোধ করতে গিয়ে তিনি “লা ইয়াছিহ্যু” তথা সনদটি বিশুদ্ধ নয় বলেছেন। আল্লামা ইবনে যওজী (রহ) তিনি জরাহ তাদিলের মুহাক্কিকদের ভেতর অত্যন্ত কট্টর প্রকৃতির মুহাদ্দিস বলে খ্যাত। যার দরুন সনদের ভেতর একজন মাত্র অপরিচিত রাবী হওয়ার কারণে তিনি কোনো রকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই সেটিকে অশুদ্ধ বলে মত ব্যক্ত করেন। কিন্তু হাদিসটির অসংখ্য শাওয়াহিদ বা সমর্থন থাকায় তিনি তার মতন সম্পর্কে নেতিবাচক কোনো মন্তব্য করতে পারেননি।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~ ~~~~~~ ~~~~
মূসা ইবনে সাহাল সম্পর্কে কিছু কথা:
~~~~~~~~~~~~~~~~~~ ~~~~~~ ~~~~
অত্যন্ত কট্টর প্রকৃতির মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনে যওজী (রহ) রচিত হাদিসের কিতাব “আল-ইলালুল মুতানাহিয়্যাহ” গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ১৯৩ নং পৃষ্ঠায় বর্ণিত হাদিসটির সনদে রাবীদের মধ্যকার “মূসা ইবনে সাহাল” নামক রাবীকে তিনি অপরিচিত বললেও প্রকৃতপক্ষে আল্লামা ইমাম যাহাবী (রহ)-এর তাহকীক অনুযায়ী তিনি অপরিচিত নন, বরং প্রশিদ্ধ। কেননা ইমাম যাহাবী (রহ) “আল-মুগনী” কিতাবে (২/৬৮৪, রাবীর জীবনী নং ৬৪৯৫) মূসা ইবনে সাহাল নামক উক্ত রাবীকে মাশহুর বা প্রসিদ্ধ রাবী বলেছেন।

আমরা যাচাইবাচাই করে যাহা পেলাম তার সারকথা হল, মূসা ইবনে সাহাল নামক উক্ত রাবী সম্পর্কে স্পষ্টত উল্লেখ রয়েছে যে, রাবীর ক্রমিক নং ৩২৩৫৯, উনার প্রশিদ্ধ নাম হল মূসা ইবনে সাহাল আরায়ী। তার কুনিয়ত বা উপনাম হল আবূ হারূন। তিনি বাগদাদ শহরের অধিবাসী ছিলেন। তার থেকে মিথ্যার কোনো অভিযোগ নেই। তার শায়খদের মধ্যে বিশিষ্ট সিকাহ বা বিশ্বস্ত রাবী শায়খ ইসহাক ইবনে ইউসুফ আল-আযরাক্ব ইবনে মিরদাস (রহ) অন্যতম। যার উপনাম, আবূ মুহাম্মদ। নসব বা বংশ, আল-মাখজুমী।
আর মূসা ইবনে সাহালের শিষ্যগণ হলেন, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহমান আল-মা’রূফ বিবুনান আল-মিশরী। (তারিখে দামেস্ক, হাদিস নং ৪৬৫৮৩ দ্রষ্টব্য) । অপর জন হলেন, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহীম আল-বাগদাদী। যার উপনাম, আবুল আব্বাস। (তারিখে বাগদাদ, হাদিস নং ৭৩৭ দ্রষ্টব্য)।
বিশিষ্ট সিকাহ বা বিশ্বস্ত রাবী শায়খ ইসহাক ইবনে ইউসুফ আল-আযরাক্ব ইবনে মিরদাস (রহ) হতে এ একই হাদিস আরো একজন রাবীর পক্ষে রেওয়ায়েত করার প্রমাণ পাওয়া যায়। যার নাম মুহাম্মদ ইবনে আল-মুহাজেরী। যার ক্রমিক নং ২৭৯৩৯। উনার উপনাম হল, আবূ আব্দুল্লাহ। উনি ২৬৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।
আর এ একই হাদিস বিশিষ্ট সিকাহ বা বিশ্বস্ত রাবী শায়খ ইসহাক ইবনে ইউসুফ আল-আযরাক্ব ইবনে মিরদাস (রহ) তিনি বর্ণনা করেন সুফিয়ান আস-সাওরী (রহ) হতে। তিনি আবার এ একই হাদিস দুজন থেকে বর্ণনা করেন। যাদের একজন হলেন, শায়খ আবুল আখওয়াছ আল-জুশমী আর অপরজন হলেন শায়খ আবূ ইসহাক আশ-শাইবানী (রহ)। (তারিখে বাগদাদ, হাদিস নং ৭৩৭ দ্রষ্টব্য)।
উনারা উভয় জন এ একই হাদিস বর্ণনা করেন বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে। আর তিনি বর্ণনা করেন বিশ্বনবী (সা) থেকে।
যাইহোক, অবশেষে বুঝা গেল, মূসা ইবনে সাহালের ব্যাপারে এত সব তথ্য সুস্পষ্ট থাকার দরুন ইবনে যওজী (রহ) কর্তৃক উপরুল্লিখিত মতটি আর ধোপে টিকে না বরং তার মতের উপর ইমাম যাহাবী (রহ)-এর মতই প্রাধান্য পাবে। এতদ্ব্যতীত এ হাদিসখানা একাধিক সনদ দ্বারাও বর্ণিত হয়েছে। যেসব সনদে মূসা ইবনে সাহাল নামক রাবী রয়েছে সেসব হাদিসগুলো অপরাপর বর্ণনাগুলোর মাধ্যমে সমর্থনপুষ্ট হওয়ায় হাসান স্তরে উন্নীত হয়ে গেছে ।
তাযকিরাতুল মওদ্বূ’আত কিতাবের লেখক আল্লামা ইবনু আররাক (রহ) তিনি “মুসা ইবনে সাহাল” নামক রাবী অপরিচিত হওয়ার এ সম্ভাবনাটুকুও রদ করে দিয়েছেন এবং ﻣﻌﺠﻢ ﺷﻴﻮﺥ ﺍﻟﻄﺒﺮﻱ নামক কিতাবে (৬২৮ নং পৃষ্ঠায় ) তার জীবনী আলোকপাত করেছেন। নিচে দেখুন—
– ﻣﻌﺠﻢ ﺷﻴﻮﺥ ﺍﻟﻄﺒﺮﻱ ( ﺹ: 628) ﻣﻮﺳﻰ ﺑﻦ ﺳﻬﻞ، ﺃﺑﻮ ﻫﺎﺭﻭﻥ ﺍﻟﻔﺰﺍﺭﻱ، ﺣﺪﺙ ﻋﻦ ﺇﺳﺤﺎﻕ ﺑﻦ ﻳﻮﺳﻒ ﺍﻷﺯﺭﻕ، ﺭﻭﻯ ﻋﻨﻪ ﻣﺤﻤﺪ ﺑﻦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﺮﺣﻴﻢ ﺍﻟﻤﻌﺮﻭﻑ ﺑﺒﻨﺎﻥ ﺍﻟﻤﺼﺮﻱ ” ﻭﻗﺎﻝ ﺃﻳﻀﺎ ﺑﺴﻨﺪﻩ ﻋﻨﻪ، ﻋﻦ ﺍﺑﻦ ﻣﺴﻌﻮﺩ، ﻗﺎﻝ : ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ:» ﻣﺎ ﻣﻮﻟﻮﺩ ﻳﻮﻟﺪ ﺇﻻ ﻭﻓﻲ ﺳﺮﺗﻪ ﻣﻦ ﺗﺮﺑﺘﻪ ﺍﻟﺘﻲ ﻭﻟﺪ ﻣﻨﻬﺎ، ﻓﺈﺫﺍ ﺭﺩ ﺇﻟﻰ ﺃﺭﺫﻝ ﺍﻟﻌﻤﺮ، ﺭﺩ ﺇﻟﻰ ﺗﺮﺑﺘﻪ ﺍﻟﺘﻲ ﺧﻠﻖ ﻣﻨﻬﺎ، ﺣﺘﻰ ﻳﺪﻓﻦ ﻓﻴﻬﺎ ﻭﺃﻧﺎ، ﺃﺑﻮ ﺑﻜﺮ، ﺧﻠﻘﻨﺎ ﻣﻦ ﺗﺮﺑﺔ ﻭﺍﺣﺪﺓ، ﻭﻓﻴﻬﺎ ﻧﺪﻓﻦ
অনুবাদ, মূসা ইবনে সাহাল আবু হারূন আল-ফাযারী তিনি ইসহাক ইবনে ইউসুফ আল-আযরাক্ব থেকে হাদিস বর্ণনা করতেন। তাঁর থেকে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুর রহিম হাদিস বর্ণনা করেছেন, যিনি বানান আল- মিছরী নামেই প্রসিদ্ধ। তিনি স্বীয় সনদে ইবনে মাসউদ (রা) হতেও হাদিস বর্ণনা করে বলেছেন যে, তিনি বলেছেন রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন, “প্রত্যেক নবজাতক শিশুর নাভিতে মাটির কিছু অংশ নিহিত থাকে যেখান থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যখন সে তার জীবনের অন্তিম সময়ে এসে পৌছে যাবে, তখন সে ওই মাটিতেই ফিরে আসবে যেখান থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এমনকি সেখানেই সে দাফন হবে। নিশ্চয়ই আমি [রাসূল] এবং আবু বকর আর উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) একই মাটি হতে সৃষ্ট এমনকি একই মাটিতে (আমরা তিনজন) দাফন হবো।”
[সূত্র- মু’জামু শুয়ূখিত তিবরী পৃষ্ঠা নং ৬২৮]
অতএব মূসা ইবনে সাহালের হাদিস বর্ণনার উপরিউক্ত দীর্ঘ সূত্রতা প্রমাণ করে যে, তিনি আল্লামা ইবনে যওজী (রহ)-এর নিকট অপরিচিত মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি অপরিচিত নন।
অধিকন্তু যেসব সনদে মূসা ইবনে সাহাল নামক রাবীর উপস্থিতি নেই, সেগুলো সম্পর্কে ইমাম ইবনে যওজী (রহ) থেকে নেতিবাচক কোনো উক্তি থাকা তো দূরের কথা, অন্যান্য ইমামদের থেকেও নেতিবাচক কোনো উক্তি পাওয়া যায়না। যার ফলে আহলে বিদয়াত রেজভিরা তাদের অন্তরে চরম বক্রতা থাকা সত্তেও ভিন্ন সনদে বর্ণিত এ হাদিসখানা অমান্যকরার আর সুযোগ পায়না। সীমাহীন ধূর্তামি আর গোঁড়ামিতে পারংগম হওয়া সত্তেও তাদের পক্ষে এরকম সুস্পষ্ট সত্যের বিরুদ্ধে যাওয়া আর সম্ভব হয় না!!
লেখক, প্রিন্সিপাল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন