বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় দাওয়াত

আল্লামা শায়খ আবদুল ওয়াহেদ বিশিষ্ট দায়ী, ফিলিস্তিন
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
كُنْتُمْ خَيْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِؕ ۰۰۱۱۰
‘তোমরা শ্রেষ্ট উম্মত। তোমাদের সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দেবে। অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে এবং আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে।[১] নবী করীম সা. ইরশাদ করেন, দীন নামই হল, একজন আরেকজনের মঙ্গল কামনা করা। আল্লাহ তাআলা আমাকে ফিলিস্তিন থেকে আপনাদের সামনে আশা এবং বসার তাওফীক দান করেছেন, তাই তার অসংখ্য শুকরিয়া আদায় করছি। যে ফিলিস্তিনে মুসলমানের পূর্বের কেবলা বিদ্যমান রয়েছে এবং যে ভূমি বর্কতপূর্ণ। যেখানে সাহাবায়ে কেরামগণের অসংখ্য কবর রয়েছে। আমি যে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছি এবং এখন যেখানে তালীমের খেদমতে আছি, এর নাম মাদ্রাসাতুস সাহাবা। যেটি ফিলিস্তিনে অবস্থিত এবং মাকামে লুতফ যেখানে দাজ্জালকে ঈসা (আ.) হত্যা করবেন সেখানেই আমাদের মাদ্রাসাটা অবস্থিত। আমাদের মাদ্রাসা থেকে প্রতি বছরের ফারেগীনরা এক বছরের জন্য দাওয়াতী কাজ নিয়ে বের হয়। একটি জামাআত আমাদের মাদ্রাসা থেকে ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিল। সে জামাআতের আমির ছিলেন আমাদের মাদ্রাসার পরিচালক শায়খ মাহমুদ যাকারিয়া। দক্ষিণ আফ্রিকার লুসুকু নামক শহরের পাশে জামাআতটা অবস্থান করেছিল। সেই এলাকার অধিবাসী ছিল, প্রায় তিন হাজার। সেই শহরের প্রধান ছিলেন একজন মহিলা। মহিলাটি জামাআত সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর জামাআতের সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ করেন। পরে মহিলা এবং ওই এলাকার অধিবাসীদের আগ্রহের কারণে জামাআতটা লুসুকু এলাকায় আসে। মহিলাটি জামাআতের আমিরের কাছ থেকে কিছু জানতে চাইলে শায়খ মাহমুদ মহিলাকে আধা ঘণ্টা যাবৎ দীনের কিছু কথা বোঝালেন। অবশেষে মহিলাটি ইসলামগ্রহণ করেন। মহিলা শায়খ মাহমুদকে বললেন, আমাকে যেসব কথা বলেলেন, আমার গোত্রের লোকদেরও বলুন। শায়খ মাহমুদ তাদেরকে দীনী কথা বলার পর তারা সকলে ইসলামগ্রহণ করে। ২০১০ সালে আবার শায়খ মাহমুদ ওই লুসুকু শহরে একটি জামাআত নিয়ে গেলেন। মহিলাটি আরো সাত হাজার লোকসহ শায়খ মাহমুদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং বললেন, এদেরকে কিছু দীনের নসীহত করুন। শায়খ মাহমুদের নসীহতের পর তারা সকলে একত্রে ইসলাম গ্রহণ করেন। আমি এই ঘটনা সরাসরি শায়খ মাহমুদের কাছে শুনেছি।
নবী করীম (সা.)-কে আল্লাহ তাআলা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। তার চিন্তাধারা ছিল, সমগ্র মানবজাতি কীভাবে জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ পাবে। শুধু মুসলমান কিংবা ঈমানদারের জন্য নবী করীম (সা.)-এর চিন্তধারা সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তাঁর চিন্তাধারা কাফির, মুশরিকদের জন্যও ছিল। আমাদেরকে বিশেষ করে ওলামায়ে কেরামকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। হুযুুর (সা.) দু’ধারায় দীনের মেহনত করতেন। প্রথমত যাদের অন্তরে দীনের চেতনা আছে। তারা নিজ আগ্রহে নবী করীম (সা.)-এর কাছে এসে দীনের কথা শুনতেন। দ্বিতীয়ত যাদের অন্তরে দীনের আগ্রহ বলতে নেই তাদের কাছে রসুল (সা.) দাওয়াতের উদ্দেশ্যে স্বয়ং ছুটে যেতেন। যেমন- তায়েফের ঘটনা আমরা সকলে জানি। আমাদেরকেও এই দু’ধারায় দাওয়াত দিতে হবে।
উম্মতের যারা আলেম তাদেরকে রসুল (সা.) মেঘের সাথে তুলনা করেছেন। রসুল (সা.) বলেছেন,
«مَثَلُ مَا بَعَثَنِي اللهُ بِهِ مِنَ الْعِلْمِ وَالْـهُدَىٰ، كَمَثَلِ غَيْثٍ».
‘আমাকে যে ইলম ও হেদায়ত নিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে তার উদাহরণ হল বৃষ্টির ন্যায়।’[২] এ হাদীসে রসুল (সা.) ইলমকে বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন। আর বৃষ্টির গুণ হল, এক জায়গায় স্থির না থাকা। বরং সারা জগতে ঘুরে বেড়ানো। তেমনি ওলামায়ে কেরাম, যারা ইলমের বাহক তাঁদেরকেও নবী (সা.)-এর নায়েব হিসেবে দাওয়াতের সেই গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যারা নিজ আগ্রহে মাদ্রাসায় ভর্তি হয় তাঁদের কাছে দীনকে সীমাদ্ধ করা যাবে না। বরং এ দাওয়াত নিয়ে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে হবে এবং দীনহারা মানুষকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে দিতে হবে। যদি ওলামায়ে কেরাম আল্লাহর দীনের দাওয়াতে নিজের জান-মাল কুরবান করেন, তাহলে তাঁদেরকে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই সাহায্য করবেন। যা করে ছিলেন, আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) এবং সাহাবায়ে কেরামগণ (রাযি.)-কে।
শ্রীলংকায় দীনের দাওয়াত
শায়খ মাহমুদ যাকারিয়া তার মাদ্রাসার ফারেগীনসহ শ্রীলংকায় আরেকটা জামাআত নিয়ে গিয়ে ছিলেন। যখন শ্রীলংকায় সুনামি তুফান হয়েছিল। শায়খের মাহমুদের সেই জামাআত সমুদ্র তীরবর্তী এক মসজিদে অবস্থান করছিলেন। তখন হঠাৎ ওই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য সরকারি আদেশ এবং পত্রিকায় সতর্কবাণী আসল। এলাকার সব লোকজন নিজ এলাকা ছেড়ে পাহাড়ি অঞ্চলে চলে গেল। শুধু শায়খ মাহমুদের জামাআতটিই সমুদ্র তীরবর্তী ওই মসজিদে রয়ে গেল। পরামর্শ করে তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা ওই মসজিদ ছেড়ে কোথাও যাবে না। কারণ তারা তো আল্লাহর রাস্তায় এসেছেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ তুফনের মধ্যেও তাদেরকে হেফাযত করবেন। তারা সারা রাত আল্লাহর ইবাদতের সাথে কাটালেন। সকালে দেখা গেল যে, রাতে তুফান চলে গেল। এলাকার সব দালান-কোটা , ঘর-বাড়ি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কিন্তু আল্লাহ সেই মসজিদ এবং তাঁদের সকলকে হেফাযত করেছেন।
আম্বিয়ায়ে কেরামের সংখ্যা কিতাবে আছে, এক লক্ষ চব্বিশ হাজার। সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যাও একই। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মক্কা আর মদীনাতে শুধু দশ থেকে পনের হাজার সাহবাদের কবর রয়েছে। বাকি সাহাবাদের কবর কোথায়? বাকী সাহাবাদর কবর পৃথিবীর দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে আছে। আমাদের ফিলিস্তিনেও ত্রিশ হাজার সাহাবায়ে কেরামের কবর রয়েছে। যেসংখ্যক মক্কা-মদীনাতেও নেই। একথায় কোন সন্দেহ নেই যে, সাহাবায়ে কেরাম কোন পার্থিব সম্পদ উপার্জনের জন্য কোন দেশে যাননি। বরং দীনহারা মানুষকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন। মক্কা ও মদীনা শরীফে নামায পড়লে অনেক গুণ নেকী পাওয়া যায়। এসব ত্যাগ করে তারা পুরো বিশ্বে দীনের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে ছুটে গেছেন। দীনের দাওয়াত দেওয়া কি শুধু তাঁদের ছিল? নাকি আমাদেরও রয়েছে? অবশ্যই আমাদেরও রয়েছে। বিশেষ করে আলেম সমাজের। সাহবায়ে কেরাম যদি আমাদের মতো মনে করতেন যে, ইবাদত নিজে করলে হবে। অন্যরা করুক আর না করুক। তাহলে দীন আমাদের পর্যন্ত আসত না। সাহাবাদের মেহনতের কারণেই আজকে দীন আমাদের পর্যন্ত পৌঁছছে। ছাত্রদেরকে লেখাপড়া শেষ করার পর এক বছরের জন্য দাওয়াতি কাজে বের হতে হবে। যারা আলেম নয়, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, দীনী কাজ কি শুধু আলেমদের জন্য? নাকি আপনাদেরও রয়েছে? আলেমদের যদি এক বছর সময় লাগতে হয় তাহলে আপনাদের কয় বছর লাগাতে হবে? আসলে, এই কাজটা ভাগাভাগির কাজ নয় যে, কেউ তাবলীগ করবে। আর কেউ তা’লীম দেবে। আর কেউ ব্যবসা-বানিজ্য করবে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বরং দীনের কাজ করা সকলের দায়িত্ব। মূলত আমরা সকলে তো তাবলীগঅলা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ هٰذِهٖ سَبِيْلِيْۤ اَدْعُوْۤا اِلَى اللّٰهِ١ؔ۫ عَلٰى بَصِيْرَةٍ اَنَا وَ مَنِ اتَّبَعَنِيْؕ ۰۰۱۰۸
অর্থাৎ হে নবী! আপনি বলে দিন যে, এটিই আমার রাস্তা। আমি মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করি এবং যারা আমার অনুসরণ করে তাদেরও এ দায়িত্ব।[৩] আমাদের পাশবর্তী দেশ ভারতে প্রায় একশ কোটি হিন্দু রয়েছে। আর চীনে প্রায় একশ বিশ-ত্রিশ কোটি বৌদ্ধ রয়েছে। তাহলে সাহাবায়ে কেরাম যদি দাওয়াত না দিতেন, চারপাশে শত কোটি হিন্দু আর বৌদ্ধের মাঝখানে আমরা দীনের দাওয়াত পেতাম? আর আমি যদি দীনের দাওয়াত না দিই। আর বাড়িতে আমি একজনই দীনদার আছি। তাহলে আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দীনও আমার গৃহ হতে বের হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَاَهْلِيْكُمْ نَارًا ۰۰۶
অর্থাৎ জাহান্নামের আগুন থেকে তুমি নিজেও বেঁচে থাক এবং তোমার পরিবার-পরিজনকেও বাঁচাও।[৪] এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর আহ্বান করেছেন। আমরা পরিবার-পরিজনকে আহার, কাপড়-চোপড়, ঘর-বাড়ি যোগান দেওয়ার জন্য কত শত চেষ্টা করি। আখিরাত যেহেতু আমাদের সামনে নেই, তাই আখিরাত আর কবরের কথা বড় বড় মুসিবত হলেও আমাদের বুঝে আসে না।
ইমাম গাযালী (রহ.)-এর আখিরাতের যিন্দেগির দৃষ্টান্ত
ইমাম গাযালী (রহ.) আখিরাতের যিন্দেগির দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে বলেন, যদি আসমান-জমিনের মাঝখানের খালি জায়গা সরিসা দানা দিয়ে ভরে দেওয়া হয় এবং একটা পাখি এক হাজার বছর পর পর এসে এক একটা দানা নিয়ে যায়। তাহলে এই সরিসা দানা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আখেরাতের যিন্দেগির চেয়েও অনেক দীর্ঘ। অনন্তকালের সেই জিন্দেগি আমাদের সকলকে ভোগ করতে হবে। সেই জিন্দেগি আমাদের আড়াল হওয়ার কারণে আমরা তার গুরুত্ব দিই না।
ফিলিস্তিনের কিছু দৃশ্য
আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে ফিলিস্তিনের বায়তুল মাকদাসে জুমার নামাযে আধা কাতার মুসল্লী হত। তখন হিন্দুস্থান থেকে মাওলানা মুস্তাকিমসহ শীর্ষ আলেমদের একটি জামাআত গিয়েছিল। মাওলানা মুস্তাকিম জুমার খুতবায় উপস্থিত মুসল্লিদেরকে জিজ্ঞেস করছিলেন যে, বায়তুল মাকদাসের আশে-পাশের বাকি অধিবাসীরা কোথায়? মুসল্লিরা বললেন, উনারা জায়তুন চাষ আর জায়তুন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। তখন মাওলানা সাহেব তাদেরকে বলছিলেন, দীনের ব্যাপারে যদি তোমরা এত উদাসীন হও, তাহলে অতিসত্তর বায়তুল মাকদাস তোমাদের হাত ছাড়া হয়ে যাবে। কিছুদিন পর বায়তুল মাকদাস দীনের ব্যাপার উদাসীনতার ফলে মুসলমানদের হাত ছাড়া হয়ে যায়। এরপর আমাদের ফিলিস্তিনে আপনাদের বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান থেকে জামাআত যাওয়ার পর দীনের নকল ও হরকত এবং দীনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেছে। আল্লাহর রহমতে যেখানে দক্ষিণ ফিলিস্তিনে দুটি মসজিদ ছিল, সেখানে বর্তমানে তিনশত মসজিদ হয়ে গেছে। এটা কোন কাহিনী নয়, আমি এর প্রত্যক্ষদর্শী। উত্তর ফিলিস্তিনের মসজিদগুলোও এখন মুসল্লিতে ভরপুর হয়ে গেছে।
দীনের দাওয়াতের গুরুত্ব নিয়ে একটি দৃষ্টান্ত
দীনের দাওয়াতের জন্য হরকত মানে, নড়া-চড়া করা। দাওয়াত না থাকলে মানুষ জমে যায়। যেমন- আমাদের সামনে যদি একটা চিনি ছাড়া চা রাখা হয়। এরপর চিনি দেওয়া হয়। নড়া-চড়া না করে যদি খাওয়া হয়। তাহলে সেই চা কখনো মিষ্টি হবে না। বরং আগের মতো থেকে যাবে। আর যদি কাটি দিয়ে একটু নড়া-চড়া করা হয়, তখন মিষ্টি হয়ে যাবে। তাই আমাদের ফিলিস্তিনের মানুষকে যখন আপনাদের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত ইত্যাদি রাষ্ট্র থেকে জামাআত গিয়ে দীনের দেওয়া হয়, তাদের ভেতরও দীনের বুঝ চলে আসছে। বায়তুল মাকদাসের চাবি এখনও আমাদের হাতে আসেনি। দাওয়াতি কাজ চালু থাকলে অতিসত্তর বায়তুল মাকদাস আমাদের হাতে আবার ফিরে আসবে বলে আশা করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে দীনের রাস্তায় বের হয়ে সারা বিশ্বে দাওয়াতের মিশন চালু করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
অনুলিখন: মুহাম্মদ ইসম

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন