বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫

ইন্টারনেটে আমরা কী করছি কী করা উচিত?


একদিন লাইব্রেরিতে কম্পিউটার ডেক্সটে বসে নেটে কী জানি একটা তথ্য খুঁজে ফিরছিলাম আর মাঝে মাঝে ফেসবুক পেজে ঢুঁ মারছিলাম। এ সময় আমার পাশের বাসার ছোটো ছেলেটা এলো; এগারো কী বারো। আমার পাশে দাঁড়িয়ে মন প্লাস যোগ একত্র করে দেখছিলো। এ সামিউল কি খবর? আচ্ছা তোমার হেফজ ক’পাড়া হলো, মানে কয় পাড়া কুরআন শরিফ মুখস্ত করলে? ছাব্বিশ! ওফ! তাহলে আর ক’টাদিন পরেই তুমি পুরোদস্তুর একজন হাফেজ সাহেব হয়ে যাবে। আচ্ছা এটা কি আপনার আইডি? হুম! তো তুমি কী ফেসবুক ইউস করো? হুম আমার তিন তিনটে আইডি আছে। আরে বলো কি তোমার তিনটে আইডি (!!) অবাক বিষ্ময়ে তার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম। যে ছেলেটার ফেসবুক বোঝার কথা না, তার নাকি তিনটে আইডি দুটো ফেইক একটা মূল। আর একটা আফসানা মিমি নামে একটা মেয়ের নামে। তুমি মেয়ের নামে করলে কেনো? অন্যরা করে তাই আমিও করেছি। আর এই আইডি দিয়ে ভাইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমি করি। আমি আবারো টাসকিত হলাম। প্রিয়পাঠক! আপনি চিন্তা করুন এই জেনারেশনের অবস্থা।
একজন মা আকুতি নিয়ে লিখেছেন, ‘আমার ছেলেমেয়ে সারা দিন ইন্টারনেটে কী যে করে বুঝি না। আমি নিজেও ইন্টারনেটের কিছু বুঝি না। কী করব? সমস্যাটি কি শুধু একজন মায়ের, নাকি এ সমস্যা আরও অনেক মা-বাবার?
ভাবির উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে আছে। ওদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবির দুই চোখে ঘুম নেই। আমি ভাবিকে জিজ্ঞেস করি, ভাবি, আপনার বাড়িতে কোনো অপরিচিত মানুষ ঢুকে আপনার ছেলেমেয়ের সঙ্গে গল্প করতে পারবে। ভাবি বিরক্ত হয়ে বলেন, মানে? অপরিচিত মানুষকে আমি ঢুকতে দেবো কেনো? আমি রসিকতা করে বলি, ধরুন, যদি একজন দুষ্টুপ্রকৃতির লোক গভীররাতে আপনার ছেলেমেয়ের সঙ্গে পাড্ডা মারার জন্য আপনার বাড়িতে আসে, আপনি কী করবেন? এবার ভাবি ভীষণ রেগে গেলেন, এমন ফালতু কথা বলো না তো? বাড়িতে আমরা আছি না? আমার বাড়ির দরজা কি খোলা থাকে যে হুট করে ঢুকে যাবে? দেখো, বাইরের গেটে তালা, ঘরের দরজায় তালা; এসব ভেঙে আসার পরিকল্পনা করলে পুলিশে ফোন করবো। আমি ভাবির নিরাপত্তা বেষ্টনী দেখে বললাম, তাহলে আপনি নিশ্চিত যে আপনার ছেলেমেয়েরা খুব নিরাপদ। ভাবির তৃপ্তির হাসি, অফকোর্স। আমি ভয়ে ভয়ে বলি, কিন্তু ভেবে দেখেছেন, এই আপনি এখন বাইরের গেটে, ঘরের দরজায় তালা দিয়ে নিশ্চিন্তে আছেন। ছেলেমেয়েরা যার যার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ওদের কাজ করছে। ওরা কী করছে? ভাবি অবজ্ঞা করেই উত্তর দিল, কি জানি, ওই ইন্টারনেটে কী যেনো করছে? আপনার ছেলেমেয়ে যে ইন্টারনেটে পৃথিবীর কোনো দূর্ধর্ষ অপরাধীর সঙ্গে কথা বলছে না, সেটা বলবেন কী করে? ভাবি এবার সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠলো, মানে? এবার আমি বুঝিয়ে বলি, ইন্টারনেটে মানুষ ছদ্মনাম ব্যবহার করে। এমনও তো হতে পারে, কোনো শিশু যৌন নির্যাতনকারী বা অপরাধী ভালো মানুষ সেজে আপনার ছেলেমেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে। আপনি বাড়িঘরে তালা দিয়ে ভাবছেন, কেউ আপনার বাড়িতে আসতে পারবে না। কিন্তু খেয়াল করুন, ওই ইন্টারনেট দিয়ে ওই অপরাধগুলো আপনার সন্তানের শোবার ঘরে ঢুকে পড়তে পারে।
ভাবিকে এবার ‘লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস’র প্রফেসর সোনিয়া লিভিংস্টোন এক হাজার শিশু-কিশোরের ওপর জরিপ চালানোর তথ্য তোলে ধরি। সোনিয়া লিভিংস্টোনের জরিপে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি শিশু ইন্টারনেটে আসক্তির কারণে তাদের হোমওয়ার্ক, পরিবার ও বন্ধুদের অবহেলা করছে। জরিপের এমন চিত্রে রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন লিভিংস্টোন।
২০১০ সালে করা তার এ গবেষণায় দেখা গেছে, আসক্তির ফলে শিশুরা ইন্টারনেটে পর্নো ছবি দেখে, অশ্লীল বার্তা আদান-প্রদান করে, এমন কি শুধু অনলাইনে পরিচয় সূত্রে দেখা করার মতো ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়ে ফেলে। তবে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের েেত্র আসক্তির এ ঝুঁকি আরো বেশি। যেমন- লিভিংস্টোনের জরিপে দেখা গেছে, উচ্চবিত্ত পরিবারের শতকরা ৩০ ভাগ শিশু অনলাইনে পর্নোছবি অভ্যস্ত। নিম্নআয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েদের েেত্র এ হার ২৫ শতাংশ।
এবার বোধ হয় ভাবির টনক নড়লো। পারেন তো তখনই ইন্টারনেটের তার কেটে দেন। কিন্তু কথাটা তো সত্য, এই সাইবার কালচার আমাদের প্রচলিত ছেলেমেয়েদের বড়ো করার প্যারেন্টিং বিষয়টি সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে। আমি নিশ্চিত, সেদিন রাতে ভাবির ঘুম হয়নি। গভীররাতে বারবার ওঠে ঘরের দরজা-জানালা চেক না করলেও হয়তো বারবার উঁকি দিয়ে দেখেছেন, তার ছেলেমেয়ে ইন্টারনেটে কোনো অপরাধীর সঙ্গে কথা বলছে কি না। বিষয়টি নিঃসন্দেহে চিন্তার ব্যাপার। কিন্তু এরা তো এই ডিজিটাল যুগের। ইন্টারনেটের তার কেটে এ সমস্যা সমাধান হবে না। আপনার সন্তানকে অবশ্যই ইন্টারনেট দিতে হবে। নতুবা সে স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে চলনে-বলনে এমনকি জ্ঞানেও পিছিয়ে পড়তে পারে। আপনি কি তা চান? ভাবির গভীর আকুতি, তাহলে করবোটা কী?
ভাবিকে বিষয়টার সমাধানের আগে আসক্তির কারণটাও তুলে ধরি, মধ্যবিত্ত এবং নিম্মবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের ইন্টারনেটে আসক্তির জন্য ‘ভয় সংস্কৃতিকে’ দায়ি করেছেন প্রফেসর সোনিয়া লিভিংস্টোন। কারণ বাইরের খারাপ সঙ্গ পেয়ে বখে যেতে পারে, এমন আশঙ্কায় মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের বাইরে খেলতে দেয়া হয় না। ফলে এসব ছেলেমেয়ে ঘরে বসেই খেলতে বাধ্য হয়। আর তখন তাদের অন্যতম খেলার সঙ্গী হয় ইন্টারনেট। তিনি আরো বলেন, গবেষণার শুরুতে আমার ধারণা ছিলো, মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা ইন্টারনেট ব্যবহারে দ হবে অথবা দিকনির্দেশনায় বাবা-মা দ হবেন। আর এ কারণেই তারা কম ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করবে। পান্তরে, বাবা-মা অল্প শিতি হওয়ায় দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করবে। কিন্তু গবেষণায় এর উল্টো ফল দেখে তিনি রীতিমতো হতবাক হয়ে গেছেন। অন্যদিকে, নিম্নআয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েদের ইন্টারনেটে আসক্তির ঝুঁকি কম। কারণ তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ কম। অভিভাবক কম শিতি হওয়ায় তাদের ব্রডব্যান্ড সংযোগের গতিও কম থাকে। ফলে ইন্টারনেটে বেশি সময় ব্যয় করার মতো ধৈর্য তাদের থাকে না।
নতুনদের নিয়ন্ত্রণে অভিভাবকরা যা করতে পারেন
ভাবিকে বললাম দেখুন না, একটা সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ তৈরি করা যায় কি না! এ নিয়ে সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন, এর কোনো বিকল্প নেই। মা-বাবার উচিত পরিকল্পনা করে সন্তানের সঙ্গে বসে ইন্টারনেট ব্যবহার বিষয়ে কথা বলা। যেমন-কখন চ্যাট করবে, কী কী ওয়েবসাইটে যাবে, যাওয়া যাবে না। এমন একটি প্ল্যান সন্তান পরিষ্কার জানিয়ে দিন যে আপনি তাকে বিশ্বাস করেন। অতএব যেদিন এই বিশ্বাস ভঙ্গ হবে সেদিন থেকে ইন্টারনেট ব্যবহারের অবাধ লাইসেন্স বন্ধ হবে। সহজ ভাষায়, আপনার সন্তানকে ইন্টারনেট ব্যবহারের বাউন্ডারি ঠিক করে দিন। এই বাউন্ডারি ঠিক করার সময় আরও কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখবেন: ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহারে কিছুতেই উৎসাহিত করবেন না। যদি ঘরের দরজা বন্ধ করতেই হয়, তাহলে যেকোনো সময়, যেকোনো অজুহাতে ঘরে ঢুকে সন্তানের সঙ্গে কথা বলবেন। অনেক সময় আপনার সন্তান পড়াশোনা এবং ইন্টারনেটে কথাবার্তা চ্যাট একই সময়ে করতে চাইবে। আপনি সেটা না করতে দিলেই ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। দুটো কাজ একসঙ্গে করা যায় না, আমি তা বলবো না। তবে এটা সত্য যে পড়াশোনা এক ঘণ্টায় করা যায়, সেটা করতে দুই ঘণ্টা লাগতে পারে। সন্তানের সঙ্গে আলোচনা করে সময় ঠিক করুন, কখন পড়াশোনা আর কখন চ্যাট করা উচিত। তবে এটা অবশ্যই যৌথ সিদ্ধান্তে হওয়া উচিত। ই-মেইল পাসওয়ার্ড সন্তানকে বলুন আপনার অনুমতি ছাড়া ইন্টারনেট অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড বদলানো যাবে না। তার মানে এই নয়, আপনি প্রতিদিন তার ই-মেইল পড়বেন। কিন্তু ও জানবে আপনি ইচ্ছে করলেই ওর ই-মেইল পড়তে পারেন। আপনার সন্তান যাদের সঙ্গে ইন্টারনেটে কথা বলে ইন্টারনেটের ভাষায় একে বলে চ্যাট, তাদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করুন। জানুন কে কে ওর স্কুলের বন্ধু আর কে কে কাসমেট বাইরের, জিজ্ঞেস করুন কীভাবে পরিচয় হয়েছে? যদি কখনো দেখেন যে নতুন বন্ধুর নাম লিস্টে যোগ হয়েছে, প্রশ্ন করুন। ইন্টানেটে আপনি ইচ্ছে করলেই দেখতে পারেন আপনার সন্তান কী কী ওয়েবসাইট ব্রাউজ করেছে। কথা বলে ঠিক করুন, আপনার সন্তান কখনোই ওই ওয়েবসাইট হিস্ট্রি মুছবে না। কারণ, আপনি যেকোনো সময় তা চেক করতে পারেন। যদি সে ব্রাউজিং হিস্ট্রি মুছে ফেলে, তবে সে তার ইন্টারনেটের স্বাধীনতা হারাবে। সন্তানের ওপর চোখ রাখুন। ওর আচরণে কি হঠাৎ কোনো পরিবর্তন খেয়াল করছেন? আপনার সস্তানের প্রিয় খেলা, বই, এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠান, কম্পিউটার গেম বাদ দিয়ে কি ইন্টারনেটে বসে আছে? যদি তাই হয়, প্রশ্ন করুন ও সারাণ ইন্টারনেটে কী করে? অনেকে বলেন, এতো ঝামেলা না করে বাজার থেকে ইন্টারনেট সিকিউরিটি ফিল্টার কিনলেই তো সব সমাধান হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়া সরকার বিনামূল্যে সবাইকে এই ফিল্টার দিচ্ছে। আমার ধারণা, এই ফিল্টারকে কীভাবে ফাঁকি দেয়া যায়, তা এই ডিজিটাল জেনারেশন জানে। সন্তানের সঙ্গে ইন্টারনেট সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আপনাকেও ইন্টারনেট সম্পর্কে জানতে হবে। নতুবা আপনাকে বোকা বানানো খুব সহজ। অতএব ওদের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে ওদের ভাষা শিখুন। ওদের তাল-লয়ে চলুন। ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, আপনার চারপাশে অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, যারা কম্পিউটার সম্পর্কে বেশ ভালো জানে এবং এককাপ চায়ের বিনিময়ে আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। সামারি হলো, ইন্টারনেট মানে কমিউনিকেশন। অর্থাৎ একজনের সঙ্গে আরেকজনের যোগাযোগ। আপনার বড়ো শক্তি হোক আপনার সন্তান, এর সঙ্গে হোক আপনার যোগাযোগ।
আমরা কী করছি?
এই তো গেলো নতুনদের কথা। আমরা যারা তরুণ-তরুণী, যুবক- যুবা আছি, আমাদের ইন্টারনেটে কী কাজ করছি। নতুনদের তো নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে গার্ডিয়ান একটু সচেতন হলেই মামলা চুকে যায়, কিন্তু আমাদের লাগাম টেনে ধরবে কে? আমরা কী সবে সাধু! আমরা রং জায়গায় নক করছি না। ভার্চুয়াল এমন একটা জগত কেউ যদি ইচ্ছে করে এখানে নিজের লাইফের বলিদান কার্যকর করবে, হলফ করে বলতে পারি, সে অনায়াসেই পারবে। আর যদি কেউ চায় ভার্চুয়াল ভা-ার থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করবে, পারবে। আমরা যারা স্কুল-কলেজে পড়ি, তাদের সিংহভাগ অনাবাসিক থেকে লেখা-পড়া করি, অভিভাবকের সচেতনতায় মা-বাবার কঠোর নিয়ন্ত্রণে বাস করি তারা তো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকি। আর যারা আবাসিক থেকে মাদরাসায় লেখা-পড়া করি। তাদের নেট ব্যবহারে ব্যাপক অনিয়ম হয়। তার কারণটা হলো মাদরাসায় এখনো ভার্চুয়াল জগতটা তেমন পরিচিতি হয়ে ওঠেনি। এজন্য এ জগতটায় আমরা প্রবেশ করার পর ভালো-মন্দ হিসেব করে চলার শিক্ষাটা তেমনটা পাইনি। সঙ্গত কারণেই আমাদের এজগতে চলতে গেলে ভালো-মন্দের হিসেবটা জানা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছি। আমরা হয়তো ভেবে বসে আছি এ জগতটা নিছক একটা ছেলে-খেলার বিষয়; বন্ধুরা বিষয়টা এমন নয়। এ জগতে আমাদের সামান্য ভুলের কারণে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনতে পারি। তার কারণ এটা যেমন জ্ঞানের দুনিয়া তেমনি অপরাধের দুনিয়াও। এ জগতে আমি আপনি ভালো থেকে এ থেকে ফায়দা লুঠতে পারি, তেমনি সাইবার অপরাধীরা আমাদের দূর্বলতার সুযোগে আমাদের মেধা-জ্ঞান, মান-সম্মান, ধন- দৌলত সব কেড়ে নিতে পারে। কারণ মানুষের দূর্বলতার সুযোগে এ জগতের অপরাধীরা ইদানিং ততপর হয়ে ওঠেছে। সম্প্রতি এমনি একটা তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাজ্য পুলিশ। ‘সামাজিক যোগাযোগের সাইটে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে অপরাধও। শুধু যুক্তরাজ্যেই গত চার বছরে ফেইসবুক ও টুইটারের মাধ্যমে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় আটগুণ। আর এসব অপরাধের দায়ে সাজাও পেয়েছে ৬৫৩ জন। অপরাধের নতুন ত্রে হিসেবে সামাজিক যোগাযোগের সাইটের ব্যবহারকে নতুন চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের পুলিশপ্রধান। তিনি জানান, সামাজিক যোগাযোগ সাইটের মাধ্যমে হয়রানি বা সহিংসতার প্রবণতাও দিন দিন বাড়ছে।
অপরাধীরা অপরাধ করে আমাদের দূর্বলতার সুযোগে। এখন আমরা জানার চেষ্টা করবো এক্ষেত্রে আমাদের দূর্বলতাগুলো কি কি?
আমরা যখন ফেসবুক, টুইটার, ইন অথবা অন্যকোনো সামাজিক যোগাযোগ সাইটে যখন ছবি আপলোড করবেন তখন এ ছবিগুলোর কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব নিয়ে ইন্টারনেট জগত কী বলে তা জেনে নেয়া যাক। তার আগে একটু জেনে নিই , যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের আইন অনুযায়ী কোনো কপিরাইটসহ ছবি ইন্টারনেটে ‘আপলোড’ করার নিয়ম নেই। এর মানে হল আপনি যে ছবি ইন্টারনেটে আপলোড করবেন, করার পর ওই ছবির মালিক বা স্বত্বাধিকারী আপনি নন। ওই ছবি তখন উন্মুক্ত হয়ে যাবে। এই উন্মুক্ত করার নীতি হল তথ্যকে মুক্ত করা। এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে দেয়া। যে ছবিতে আপনার আপত্তি আছে সে ছবি আপনি আপলোড থেকে বিরত থাকবেন। তা না হলে আপনার কিছু করার নেই। যদিও কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব আইন যা বলে তা মোটেই কার্যকর নয় এই কাউড কম্পিউটিংয়ের যুগে। ছবির কোনো কপিরাইট আছে বলে খুব বেশি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা নেই, যা আছে তা হলো ছবিটি সম্পাদনা করা বেআইনি। আর যতোণ পর্যন্ত আপনি কোনো ছবিকে রেজিস্ট্রেশন করবেন না, ততোণ পর্যন্ত আপনার কোনো মতাই নেই ওই ছবিটির ওপর।
কিন্তু আসল কথা হলো, ইন্টারনেটে যে ছবি ও ডাটা থাকবে তার ওপর অধিকার হয়ে যায় সবার। কেউ যদি ছবি চুরি অথবা তিসাধন করে, তবে এ েেত্র বলার কিছু নেই। তাই ইন্টারনেটে ছবি আপলোড করতে আরও বেশি সতর্ক হোন।
ছবি আপলোডের ক্ষেত্রে সাবধনতা অবলম্বন করবো দূরের কথা, কেউ নিজের একান্ত জীবন- যৌবনের ছবি পোস্ট করে বসে। এমন এক তথ্য দিয়েছে, দ্যা গার্ডিয়ান। আজকাল বিভিন্ন ওয়েবসাইটে নিজেদের যৌনজীবন শেয়ার করতে দেখা যায় বহু মানুষকে। আর ক্রমশ বাড়ছে এই প্রবণতা। ২০০৮ সালের একটি বইতে বিল ট্যানসার জানান ইন্টারনেট ব্যবহারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো অন্যান্য পর্নোগ্রাফিকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। অনেক ইউজারই এসব নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন। শুধু সেলিব্রেটি নায়ক-নায়িকা নন, বহু ফেসবুকারকে দেখা যায় নিজেদের একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি ফেসবুকে শেয়ার করতে। বিষয়টি নিয়ে আর তাদের মাঝে জড়তা কাজ করছে না। ভারতে সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার দায় এসে পড়েছে বলিউডের বিতর্কিত নায়িকা পুনম পা-ের ওপর। আর এতে বেজায় চটেছেন তিনি। পুনমের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, ইন্টারনেটে পুনম পান্ডের খোলামেলা ছবিই ধর্ষকদের এ কাজে প্ররোচিত করছে। ুব্ধ পুনম আরও বলেন, সমাজের শত্রুদের জন্য আমাকে কেনো দায়ি করা হচ্ছে। আমি কেবল বিশ্বে আমার একটি নিজস্ব জায়গা করে নেয়ার চেষ্টা করছি। সমাজে এখন যে অপরাধগুলো হচ্ছে এ জন্য দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে দায়ি না করে আমার ওপর আঙুল তোলা হচ্ছে কেনো। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমাকে কেনো দায়ি করা হবে। আমি কী এমন করেছি।
ইন্টারনেট যেমন উপকার করে তেমনি মানুষের মহাক্ষতিও সাধন করে এমনি সংবাদ দিয়েছেন। দু’জন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীর মতে সারাদিন ও সারারাত যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বসে থাকেন, তারা দেহ ও মস্তিষ্কের ওপর মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজির অধ্যাপক, স্নায়ুবিজ্ঞানী ও রয়াল ইনস্টিটিউশন অব গ্রেট বিট্রেন-এর পরিচালক সুসান গ্রিনফিল্ড বলেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে, এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাইটগুলো আমাদের মস্তিষ্কের বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায় ছোটো শিশুদের সমপর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। ‘ছোট শিশুরা যেমন কোনো শব্দ বা উজ্জ্বলবাতি থেকে আকৃষ্ট হয়, এখনকার মানুষজনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নোটিফিকেশন দেখে আকৃষ্ট হয়, তাদের দিনের একটা বড়ো অংশ এই সাইটগুলোতে ব্যয় করে।’
রয়াল সোসাইটি অব মেডিসিনের ড. এরিক সিগমান তার এক গবেষণাপত্রের ফলাফল দিয়ে তোলপাড় ফেলে দেন। যেগুলোতে বলা হয়, অনলাইন নেটওয়ার্কিং স্বাস্থ্যের তি করে আর অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার বাড়িয়ে দেয় ক্যান্সারের ঝুঁকি। মানুষ যতই ইন্টারনেট আসক্ত হয়ে পড়ছে ততই তারা পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এরফলে মানুষের মাঝে বিষণ্ণতা ও একাকীত্ব বাড়ছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কি মানুষের মৃতে্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে? সরাসরি হয়তো নয়, তবে কিছু নেটওয়ার্কিং বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এরকমটা ঘটছে ধীরে ধীরে। দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি ফেসবুক বা টুইটারে অতিরিক্ত সময় দেয়ার কারণে মানুষের কাজের চাপ বেড়ে যাচ্ছে। যা বাড়িয়ে দেয় স্বাস্থ্যঝুঁকি। আরেকজন বিজ্ঞানী ড. কামরান আব্বাসি ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঃযব জড়ুধষ ঝড়পরবঃু ড়ভ গবফরপরহব এর সম্পাদকীয়তে বলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় দিতে গিয়ে মানুষ তার প্রতিদিনের কাজকে ব্যহত করছে।“ এছাড়া কোনো ফেসবুক বন্ধুর ক্রমাগত উন্নতির আপডেট পেলে বেশিরভাগ মানুষের মনেই নিজেদের প্রতি এক ধরণের হতাশা ও হীনমন্যতা চলে আসে, যা তাদের সামনে এগিয়ে যাবার পথে সমস্যা সৃষ্টি করে।
আমাদের কী করা উচিত
আমরা ইন্টারনেটের ভেতর-বাইর, ভালো-মন্দ জানলাম। বিশেষ করে আমরা যারা কওমির সন্তান, দীনের কাজ করতে চাই তাদের ইন্টারনেটে কী কাজ হতে পারে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বে ইন্টারনেটে লেখালেখিকে সময়ের একটি ¯্রােত বলে বিবেচনা করা হয়। নামিদামি অনেকেই ইন্টারনেটে লিখছেন। ব্লগিং করা একটি ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। ব্লগকে একটি শক্তিশালী মিডিয়া হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে এ সময়ে। বাংলাদেশে ব্লগিংয়ের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। ব্লগ-ইন্টারনেটে লেখালেখির আলাদা আনন্দ হচ্ছে, এটি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। অনেকে পড়তে পারেন। সাইটে রেজিস্ট্রেশন থাকলে মন্তব্য করতে পারেন। লেখক তার নিজ পাঠকের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন।
ইন্টারনেট ও ব্লগ এখন তাদের দরজা আরও অবারিত করে দিয়েছে। ফেসবুক এখন বাঙালির আড্ডার অন্যতম মাধ্যম। তাহরির স্কয়ার ও আরব বসন্তের কথাও আমাদের জানা আছে, যা এখন বিশ্বে একটি বড়ো উদাহরণ।
ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা অনেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত দিতে শুরু করি, যেমন আমি অমুক জায়গায়, আমি এটা করছি, সেটা করছি, কারণ এতে পশ্চিমাবিশ্ব আমাদের তথ্য বিনামূল্যে পেয়ে যায়। আপনি বলতে পারেন, আমি তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ পার্সন না, না হোন, কিন্তু তারা এসব তথ্য থেকে কখনো কোনো তথ্য কালেক্ট করে ফেলতে, যা দ্বারা আপনার আমার, দেশ-জাতি ও ধর্মের মহা ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
ফেসবুক যেমন মজার বিষয় তেমনি আমাদের জন্য ক্ষতিকর জিনিসও, আমরা জেনেছি ফেসবুকের সব সময় বসে থাকার ক্ষতি সম্পর্কে। আর অনৈতিক, খারাপ পেজে ঢুকার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে চলবো, নবীর আদর্শে কথা ভুলবো না। আপনার কোনো খারাপ পেজে লাইক দেয় কোনো গ্রুফ পেজে জয়েন করে অথবা কোনো আইডির ফ্রেন্ড থাকে বিনা দ্বিধায় আনফ্রেন্ড, আন লাইক অথবা কেনসেল রিকোয়েস্ট করবেন। কারণ কথায় আছে, সত সংঘ স্বর্গবাস অসতসংঘ সর্বনাশ। আমরা নিজেদের ব্যপারে নিজেরাই অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করবো। বিশ্বায়নের যুগে কালের গা ভাসিয়ে না দিয়ে, সব জায়গায় আল্লাহ ও রাসুলের আদর্শকে মেনে চলবো। তাহলে সম্ভব হবে নিজেদের পতন ঠেকানো। একটু সচেতন হলেই আমরা আধুনিক প্রযুক্তিকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি। আল্লাহ আমাদের প্রযুক্তিকে ভালোভাবে জানার এবং নেককাজে ব্যবহার করার তওফিক দিন, আমিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন