সোমবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

ওয়াজের মাহফিল কেন প্রভাব ফেলতে পারে না? মুহিউদ্দিন কাসেমি

আমাদেরকে যখন কোথাও ওয়াজ মাহফিলে বয়ান ও বক্তৃতা করার জন্যে দাওয়াত করা হয়, তখন প্রথমেই আমরা আশা করি যে, আমাদের নাম শুনেই মাহফিলে অনেক মানুষের সমাগম হবে এবং এমন আলোচনা যেন করতে পারি যা ঐতিহাসিক স্মৃতি হয়ে সকলের মুখে মুখে থাকে। দীর্ঘদিন এর প্রশংসা করা হয়। আর মাহফিলের উদ্যোক্তারা যদি বাহ্যিক আদর-আপ্যায়ন এবং অভ্যন্তরীণ আপ্যায়ন (টাকা-পয়সা, হাদিয়া) এর মাঝে একটু ত্রুটি করে তাহলে আমরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ও নারাজ হই। কখনো এ অসন্তুষ্টির কথা সবার সামনে প্রকাশ করে দিই। অন্যথায় এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে, আগামীতে এখানে আর আসব না। আমরা যদি আমন্ত্রিত বক্তা হই আর ঘটনাক্রমে সময়ের সঙ্কীর্ণতার কারণে বয়ান করতে না পারি তাহলে রাগ ও অসন্তুষ্টির শেষ থাকে না। আমরা এতই গর্বিত ও আত্মতুষ্ট যে, স্টেজে বসে অন্য কারো আলোচনা আনন্দের সাথে শুনতে পারি না। মনে মনে কামনা করি, জলদি তার আলোচনা শেষ হোক বা তার আলোচনা শেষ করানো হোক এবং আমার আলোচনা শুরু হোক, যেন মনখুলে বয়ান করা যায়। 
এসবের কারণ হল, আমরা নিজেকে সবার চেয়ে ভালো বক্তা ও আলোচক মনে করে থাকি। অথচ এটা ভীষণ ক্ষতিকর ও ভয়ানক বিষয়।

আলেমের জন্যে ফেতনা : 
যায়েদ ইবনে হাবিব রহ. বলেন : আলেম ও ফকিহের ফেতনার বিষয় হল, সে অন্যের আলোচনা শোনার তুলনায় নিজের কথা বলতে বেশি পছন্দ করে। অথচ এমন বক্তা আলোচনা করছে যার আলোচনা যথেষ্ট, তার আলোচনা না করলেও চলবে। (অর্থাৎ অন্য যোগ্য ব্যক্তির উপস্থিতিতেও নিজের কথা বলাকে জরুরি মনে করে, যেন মানুষ ভাবে সে অনেক বড় আলেম)। [কিতাবুয যুহদ- ১৬]
নসর ইবনে হাজেব রহ. বলেন : হযরত ইমাম আবু হানিফা রহ. ওমর ইবনে যর এর বয়ান শোনার জন্যে গমন করতেন। এবং তাতে কোনো লজ্জাবোধ করতেন না। একবার মানুষজন দেখল, ইমাম আবু হানিফা রহ. অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ওয়াজ শুনছেন এবং তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। [উকুদুল জিমান- ২২৯]
আজ আমরা অন্যের ওয়াজ শোনার সময়ই পাই না। আমরা ভাবি, এই লোক কী ওয়াজ করবে? তার ওয়াজ শোনার কোনো দরকার নেই। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বলেন : কোনো ব্যক্তি যখন কোথাও মাহফিলে বয়ান করে আর তখন তার বয়ান নিজের কাছে ভালো মনে হয়, সে আত্মতৃপ্তি লাভ করে, সেসময় তার জন্যে কর্তব্য হল বয়ান বন্ধ করে দেওয়া। আর যদি কেউ এমন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয় যেখানে চুপ করে বসে থাকা আত্মগরিমার অন্তর্ভুক্ত সেখানে কিছু বয়ান করা কাম্য। [কিতাবুয যুহদ- ৬৭]
আমাদের আকাবিরদের এমন অনেক ঘটনা আছে, তারা বক্তৃতা করতে করতে যখন মনে করলেন, এ কথা আমাদের বড়ত্বের মাধ্যম হবে তখন তৎক্ষণাৎ বয়ান বন্ধ করে বসে পড়েন।

হযরত শায়খুল হিন্দ রহ. এর শিক্ষণীয় ঘটনা : 
শায়খুল হিন্দ হযরত মাও. মাহমুদ হাসান দেওবন্দি রহ. এর ইলমি ও রুহানি ফয়েজ পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। একবার তিনি হাকিমুল উম্মত হযরত মাও. আশরাফ আলি থানবি রহ. এর দাওয়াতে কানপুর গমন করেন। অনেকবার আবেদনের পর ওলামাদের একটি মজলিসে বয়ান করতে সম্মত হলেন। ইলমি পরিবেশে হযরতের মন খোলামেলা ছিল। অত্যন্ত উচ্চাঙ্গীন বিষয় আলোচনা করছিলেন। তখন বিদআতের প্রতি অনুরাগী আলেম মাও. লুতফুল্লাহ আলিগড়ি মজলিসে প্রবশে করেন। তাকে দেখামাত্রই হযরত শায়খুল হিন্দ বয়ান বন্ধ করে বসে যান। পরবর্তীতে হযরত মাও. ফখরুল হাসান সাহেব রহ. জিজ্ঞেস করেন, হঠাৎ বয়ান বন্ধ করে দিলেন কেন? উত্তরে বলেন : যখন মৌলবি লুতফুল্লাহ প্রবেশ করল তখন ভাবলাম, এখনই মূল আলোচনা করার সময়; সে জানতে পারবে ইলম কী জিনিস! তাই সে সময় ওয়াজে ইখলাস বা নিষ্ঠা ছিল না। এ কারণে ওয়াজ বন্ধ করে দিয়েছি। [আরওয়াহে সালাসা- ৪০৭]
আল্লাহু আকবার! এটাই হচ্ছে ইখলাস! একটু চিন্তা করুন, এমন মজলিসে আমরা সুযোগ পেলে অনুসন্ধান ও খোঁজাখুঁজি করে এমন কথা বলার চেষ্টা করতাম যা কারো চিন্তা ও ধারণায়ই নেই। যেন উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ ইশ ইশ বলে এবং প্রশংসা করতে বাধ্য হয়। নাউজুবিল্লাহ!

লোকজনের সমাগম মূল বিষয় নয় : 
ত‌দ্রূপ আমাদের আকাবিরগণ এ ব্যাপারেও কোনো গুরত্ব দেননি যে, তাদের মাহফিলে অনেক মানুষের সমাগম হোক। বরং যখন যেখানে ফায়েদা মনে করেছেন সেখানেই অল্প লোকদের মাঝেও মনখুলে বয়ান করেছেন, যেমনটি বড় বড় মজলিসে করতেন। 
হাকিমুল উম্মত হযরত মাও. আশরাফ আলি থানবি রহ. এর মাওয়ায়েজ দেখুন। আশ্চর্য হতে হয় যে, মাত্র ২০/২৫ জন মানুষ সামনে বসে আছে। আর তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইলম ও মারেফতের ফুল ঝড়াচ্ছেন। পক্ষান্তরে আমাদের অবস্থা হল, মাহফিল ভরা না হলে আমাদের মেজাজ ঠিক হয় না। বরং মানুষ কম থাকার কারণে আলোচ্যবিষয়ও ভুলে যায়। কেমন যেন আমরা মাহফিলগুলোকে দীনের প্রচার নয় বরং নিজের পরিচয়-পরিচিতির মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছি। কেননা, দীন প্রচার করা উদ্দেশ্য হলে আমরা দুই-চারজনের সামনেও বয়ান করতে কখনো লজ্জাবোধ করব না। অথচ অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, অনেক সময় ছোট্ট মাহফিলের বয়ান দ্বারা এমন ফায়েদা হয় যা বিশাল বিশাল মাহফিল দিয়ে হয় না। তদ্রƒপ আমাদের মনে ইখলাস থাকলে অন্যে কোনো বক্তার বয়ান শুনতে কখনোই খারাপ লাগার কথা নয়। বরং আমরা মনে করতাম, এর দ্বারাও উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে। এমনকি আরো খুশি হওয়ার দরকার ছিল যে, আমার দায়িত্ব সে পালন করে দিচ্ছে।

মাও. আতাউল্লাহ শাহ বুখারি রহ. এর ঘটনা :
স্বীয় যুগের অদ্বিতীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী বক্তা ও ওয়ায়েজ মাও. আতাউল্লাহ শাহ বুখারি রহ. একবার একটি মাহফিলে তাশরিফ নিয়ে গেলেন। সেখার তাঁর পূর্বে মাও. মুহাম্মদ আলি জালেন্দরির বয়ান হচ্ছিল। তাঁর বয়ানের মাঝে শাহ সাহেব বাহ বাহ দিচ্ছিলেন এবং সুবহানাল্লাহ বলছিলেন। অবশেষে যখন শাহ সাহেবেরে বয়ানের পালা আসল তখন তিনি এই বলে মাহফিল সমাপ্ত ঘোষণা করে দিলেন যে, মাওলানার বয়ানের পর আমার বয়ানের কোনো প্রয়োজন নেই। অথচ শাহ সাহেবের নাম শুনেই মানুষ একত্রিত হয়েছিল। [বিস বড়ে মুসলমান]
.
সফল জীবন যাদের গ্রন্থ থেকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন