রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পঠভুমি


৬৩৬ খৃষ্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলীয় ওমর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ফিলিস্তীন সর্বপ্রথম ইসলামী খিলাফতের অধিকারভুক্ত হয়। অতঃপর দীর্ঘ চারশত বছর পর ১০৯৬ সালে ক্রসেডাররা মুসলামানদের হাত থেকে ফিলিস্তীন দখল করে নেয়। পুনরায় ১১৮৭ সালে গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর নেতৃত্বে মুসলামানরা জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করে। ১৫১৭ সালে সুলতান প্রথম সেলিম ফিলিস্তীন রাষ্ট্রটি মামলুক সুলতান কানজুল ঘোরীর নিকট থেকে ওছমানীয় খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। ১৯১৮ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তীন কার্যত বৃটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। ইতিমধ্যে তুর্কী খিলাফতের বিরুদ্ধে আরব ভূখন্ডে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ধীরে ধীরে শুরু হতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মক্কার ইমাম বা শাসক ছিলেন শরীফ হুসাইন। তিনি এ আন্দোলনের গতিবৃদ্ধিতে বিস্তর ভূমিকা রাখেন। ঠিক এই সময়ের কিছু পূর্বেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে জায়নিজম (Zionism) নামে একটি আন্দোলন শুরু হয়। এই জায়নিজম আন্দোলনের উদ্ভব হয় ভিয়েনা শহরে। থিওডর হারজল নামক একজন হাঙ্গেরীয় ইহুদী সাংবাদিক ভিয়েনার ইহুদীদের নিয়ে শুরু করেন জায়োনিস্ট আন্দোলন। ১৮৯৭ সালে তিনি সুইজারল্যান্ডে প্রথম ‘আন্তর্জাতিক জায়োনিস্ট কংগ্রেস’ আহবান করেন।

এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ইহুদীদের জন্য একটি আলাদা আবাসভূমি তৈরী করা। এই উদ্দেশ্যকে সামান রেখে থিওডর দাবী করলেন, প্যালেস্টাইন ছিল ইহুদীদের আদি নিবাস। অতএব সব ইহুদীকে সেখানে ফিরে যেতে হবে, গড়তে হবে পৃথক আবাসভূমি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেতা শরীফ হুসাইন প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি তুরস্কের বিরুদ্ধে বৃটেনকে সহযোগিতা করবেন। আর ব্রিটিশ সরকার তাঁকে আরব সাম্রাজ্য গড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিলাতে এসিটনের দারুণ অভাব দেখা দেয়। ঐ সময় জায়োনিস্ট আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা ও রসায়নবিদ হাইম ওয়াইজম্যান। যিনি বিলেতের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারকে বলেন, তিনি এসিটন উৎপাদন করতে পারবেন। ব্রিটিশ সরকারকে তিনি এ বিষয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করতে রাজি তবে শর্ত হচ্ছে যে, যুদ্ধে জিতলে প্যালেস্টাইনে গড়তে দিতে হবে ইহুদীদের বিশেষ আবাসভূমি।

ইহুদীদের দাবী অনুযায়ী ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার নানা স্বার্থকে সামনে রেখে ইহুদীদের জাতীয় আবাসভূমি সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এটাকে ‘বেলফোর ঘোষণা’ (Belfour Declaration) বলা হয়। এখান থেকেই শুরু ফিলিস্তীন সমস্যার। যাহোক প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হারার পর ফিলিস্তীন আসে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে। ফলে বহু ইহুদী ইউরোপ থেকে গিয়ে প্যালেস্টাইনে বসবাস করতে শুরু করে। তারা কিনতে শুরু করে জলাভূমি। ইহুদীরা এসব জলাভূমি সেচে বের করে আবাদি ভূমি। এরকম একটি জলাভূমি সেচে তারা তৈরী করে তেল আবিব শহর এবং প্রতিষ্ঠা করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ক্রমে ক্রমে আরবগণ নিজ দেশে পরবাসীতে পরিণত হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকারের নীতির ফলে আরবদের অসন্তোষ বেড়ে চলল। এ অসন্তোষ আত্মপ্রকাশ পেল আরব-ইহুদী দাঙ্গার মধ্য দিয়ে। ১৯২১, ১৯২৯ ও ১৯৩৬ খৃষ্টাব্দে আরব ও ইহুদীদের মধ্যে যে দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে অসংখ্য লোক হতাহত হয়। ব্রিটিশ সরকার সামরিক শক্তির সাহায্যে এসব দাঙ্গা বন্ধ করে। ১৯৩৬ সালে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ব্রিটিশ সরকার একটি ‘রয়েল কমিশন’ (Royal Commission) নিয়োগ করে। কিন্তু এই কমিশনের প্রস্তাব আরব-ইহুদী উভয়ই প্রত্যাখ্যান করে। ফলে কোন সমাধান ছাড়াই আরব-ইহুদী সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিস্তীনের অবস্থার পরিবর্তন হল। আরব ও ইহুদীরা কিছু সময়ের জন্য সংগ্রাম হতে নিরত হয়ে মিত্রশক্তির খেদমতে আত্মনিয়োগ করল। এ সময় ইহুদীরা আমেরিকার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে তাদের সাহায্য লাভ করে। আমেরিকারও মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী ঘাটির প্রয়োজন ছিল। সে মনে করল ইহুদী-ফিলিস্তীনী দ্বন্দ্ব তার সে প্রয়োজন মেটাতে পারে। সুতরাং সে ফিলিস্তীনে ইহুদীদের জাতীয় আবাসভূমি সৃষ্টির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাল। ১৯৪২ সালে ডা. হাইম ওয়াইজম্যান ও আরও কয়েকজন ইহুদী নেতা আমেরিকার সাথে এক বৈঠকে মিলিত হয় এবং সেখানে বিটমোর প্রোগ্রাম (Bitmore Programme) নামে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়।এ প্রস্তাব অনুসারে ইহুদী সাধারণতন্ত্র হিসাবে ফিলিস্তীন প্রতিষ্ঠার দাবী করা হয়। এ সংবাদে সমগ্র আরব জাহান ক্ষেপে ওঠে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৫ সালে আরবলীগ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে আরবলীগের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাশ হয় ফিলিস্তীনকে বিভক্ত করে ইসরাইল নামে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব। ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এর প্রেসিডেন্ট হন হাইম ওয়াইজম্যান।

জাতিসংঘের অবিচারে হতাশ হয়ে আরব বিশ্ব সশস্ত্র পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। আরবলীগের সমস্ত সদস্য অস্ত্রশক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালে ইহুদী ও আরবদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ বাধে। আরবগণ যখন নিশ্চিত বিজয়ের পথে তখন জাতিসংঘ ৪ সপ্তাহের জন্য যুদ্ধবিরতি করতে বলে। এই সুযোগে ইসরাঈল আমেরিকা থেকে অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করে। অন্যদিকে উদ্বাস্ত্তবেশে আমেরিকাও সৈন্য পাঠায় এবং ষড়যন্ত্র করে মিসর প্রেসিডেন্টের মাধ্যম্যে ইখওয়ানুল মুসলিমের অপ্রতিরুদ্ধ যোদ্ধাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়। ফলে ইহুদীরা প্রভূত শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়। অতঃপর পুনরায় যুদ্ধ শুরু হলে আরবরা আর পেরে উঠেনি। ইহুদীরা ফিলিস্তীনের একটি অংশ অধিকার করে ইসরাঈল নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে দীর্ঘ ষড়যন্ত্র-সংগ্রামের পর ইহুদীরা একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হয়।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন