শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

ধর্মের নামে মানুষ হত্যা" ও জীবনদর্শনের বাস্তবতা


লিখেছেন Imran Abdullah

নাস্তিক-আস্তিক বিতর্কের সময় প্রতিপক্ষকে চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্য সবচাইতে মোক্ষম লাইনটি সম্ভবত -নাস্তিকরা ধর্মের নামে কাউকে হত্যা করেনা।অন্যদিকে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ স্ব স্ব ধর্মের নামে নিরীহ মানুষ হত্যা করে।এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে নাস্তিকরা তুলনামূলক ভাবে শান্তিপ্রবণ এবং তারা কখনই নিজ মতাদর্শের জন্য মানুষ হত্যা করে না।তাদের ভাষ্যমতে, ধর্ম ব্যাপারটা নাস্তিকতার তুলনায় অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।

এই বিতর্কে খুব সূক্ষ কিন্তু ভুল একটি তুলনা রয়েছে।‘নাস্তিকতা’ টার্মটির বিপরীত শব্দের নাম ‘আস্তিকতা’, ‘ধর্ম’ নয়।নাস্তিকতার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস,যেখানে আস্তিকতার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস।কেবলমাত্র আল্লাহকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করার দরুণ একজন মানুষ কাউকে খুন করতে উদ্যত হন না।তাই আল্লাহর অস্তিত্বের বিশ্বাস বা অবিশ্বাস নিরপেক্ষ একটা ধারণা,যা কেবল চিন্তাভাবনার জায়গাতেই সীমাবদ্ধ।তাই নাস্তিকতা ও আস্তিকতার তুলনা চলে।নাস্তিকতার সাথে ধর্মের তুলনা একটি ভুল ও হাস্যকর ধারণা।ব্যাপারটা এমন যে আমি আস্তিকতার সাথে কমিউনিজমের তুলনা করছি।কেবল আস্তিকতা বা নাস্তিকতা কোন ইস্যু না,এই মতবাদের বিশ্বাসীরা কি কি বিষয়কে বিশ্বাসের সাথে যুক্ত করছেন,সেটাই দেখবার বিষয়।

ধর্ম হচ্ছে কতগুলো বিশ্বাসের সমষ্টি বা আন্তঃসম্পর্কিত বিশ্বাসকে নিয়ে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা যার কেন্দ্রে রয়েছে আস্তিকতা।প্রতিটা ধর্মই আস্তিকতার জায়গা থেকে বিশ্বকে নিয়ে তার ভাবনার ব্যাপারগুলো জানায়।এই ভাবনাগুলোই ঠিক করে যে একজন মানুষ অপরকে সাহায্য করবে নাকি খুন করবে।পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যেখানে একজন আস্তিক বলছেন যে তিনি তার ‘আস্তিকতা’য় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ হত্যা করেছেন।হ্যাঁ,এমনটা হয় যে কেউ কেউ নিজেদের ধর্মীয়শাস্ত্রের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে বড় ধর্মগুলোর নামে খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ে যাতে করে নিজেদের নৈতিক অবস্থানকে সমাজের একই ধর্মের অন্য ভাইদের কাছে যৌক্তিক করে তুলে ধরা যায়।

একইভাবে নাস্তিকরাও এমন কতগুলো ব্যাপারে বিশ্বাস করে যা তাদের বিশ্বভাবনাকে তুলে ধরে। স্বভাবতই এইসব দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রে থাকে আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার ও অবিশ্বাস করা কিংবা এমন কিছু ফুটিয়ে তোলা যাতে করে আল্লাহর অস্তিত্বের অপ্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে।নাস্তিকতাকে কেন্দ্র করে যেসব বৈশ্বিকভাবনা গড়ে উঠে,তাকে সাধারণত ‘বস্তুবাদী’ দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়ে থাকে।যেমনঃ কমিউনিজম,সোশ্যাল ডারউইনিজম।অথবা যে ব্যবস্থায় আল্লাহর অস্তিত্বের প্রশ্ন কোন গুরুত্ব বহন করে না এবং এইসব মতবাদ নাস্তিকতার সাথেই বরং যায়।যেমনঃজাতীয়তাবাদ,নাৎসিজম,সেকুলার লিবারেলিজম/হিউম্যানিজম(মানবতাবাদ)।এইসব মতবাদকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষ হত্যার ইতিহাস রয়েছে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ আর বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণের সবচাইতে বড় পার্থক্য হল ধর্মীয় বিশ্বাস কতগুলো প্রথা এবং কিতাবের উপর প্রতিষ্ঠিত।সাধারণত বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে এই উপাদানগুলো আসমানি প্রত্যাদেশগত এবং এর নানা উপায়ে মানুষের স্বভাব,আচরণ এবং অবৈধ-অনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে।এইসব নির্দেশাবলীকে তখনই পাশ কাটানো যায়,যখন কিনা ধর্মীয়শাস্ত্রের অপব্যাখা করে নিজেদের কাজকে ন্যায়সঙ্গত করে তোলা যায়।কিন্তু এই বিকৃতি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে অগ্রহণযোগ্যই থেকে যায়।

অপরদিকে বস্তুবাদীদের বৈশ্বিকভাবনা কোন নির্দিষ্ট প্রথা বা বইয়ের উপর নির্ভরশীল নয়।তাই যখন কোন বস্তুবাদী বুঝতে পারেন যে তার আদর্শ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যথার্থ নয় এবং নতুন কোন ব্যতিক্রম তৈরির প্রয়াস চালান,তখন তার সামনে এমন কোন শাস্ত্র বা প্রথা থাকে না,যাকে অপব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয়।তাই বলা যায়,ধর্ম বস্তুবাদের তুলনায় অন্যায়,অবিচার ও নির্বিচার হত্যা ঠেকাতে অধিকতর সক্ষম।কারণ,ধর্মের যেখানে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে সেখানে বস্তুবাদীদের আদর্শ পুরোপুরি নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি এবং খেয়াল-খুশির উপর নির্ভরশীল এবং খুব সহজেই পরিবর্তনীয়।

বস্তুবাদী ব্যবস্থার আরও অসুবিধা রয়েছে।ধর্ম যেখানে এই পৃথিবীর যাবতীয় ত্রুটি সর্বজ্ঞাত ও ন্যায়বিচারক আল্লাহর দেওয়া বিধানের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চালায়,সেখানে বস্তুবাদীরা নিজেরাই সেইসব সমস্যার সমাধানে উদ্যত হয়।আপাতদৃষ্টিতে একে নির্বিবাদী ও নিরীহ মনে হলেও এর ফলাফল ভয়ঙ্কর মোড় নিতে পারে।

মানুষ একেবারে নিখুঁত কিছু নয়।পৃথিবীর বুকে ঘটা যাবতীয় অবিচারের জন্য তার দায় রয়েছে।এই কারণে ধর্ম প্রতিশ্রুতি দেয় যে এইসব ত্রুটি এবং অন্যায়কে শেষ বিচারের দিনে কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে দেওয়া হবে। বস্তুবাদী ব্যবস্থার কাছে এমন কিছুই নেই,যার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে এটি মানুষকে প্রতিশোধের পথে চালিত করে,অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ দখল নিতে উৎসাহিত করে এবং যে কোন প্রতিযোগিতায় যাবতীয় অসৎ উপায় গ্রহণ করতে প্রেরণা যোগায়।অন্য কোথাও যেহেতু নিজের অভিযোগ ও কাঙ্খিত পুরস্কার গ্রহণের সুযোগ নেই,তাই আত্নস্বার্থ চরিতার্থ করতে যেকোন অন্যায়কেও ‘প্রয়োজনের স্বার্থে করা’ বলে চালিয়ে দিতে পারে।এইসব কিছু একত্রিত হয়ে রাষ্ট্র ও সরকারকে তার জনগণের উপর নজরদারি বাড়াতে বাধ্য করে।নিয়ন্ত্রণের শৃঙ্খল আরও চেপে বসে গোটা ব্যবস্থাই হয়ে উঠে সর্বগ্রাসী।রাষ্ট্র হয়ে উঠে ‘পুলিশি-রাষ্ট্র’।

দ্বিতীয়ত,মানুষ যে কোন তত্ত্বের চাইতে অনেক বেশি জটিল।বস্তুবাদী ব্যবস্থা তার নিজের আদর্শের সাথে জনগণকে মানিয়ে নিতে এমনভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে যে তা একসময় নির্যাতন-নিপীড়ন এর চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।উদাহরণস্বরূপ,সেকুলার লিবারেলিজম ব্যবস্থা নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কোটার ব্যবস্থা করেছে এমনকি যদি কোন বিশেষ লিঙ্গের প্রতিযোগী তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতিযোগীর তুলনায় কম যোগ্যতাসম্পন্নও হয়ে থাকেন।এর আইনকানুন স্বৈরতান্ত্রিকতার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সে ব্যক্তিবিশেষের ধর্মীয় মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেও খর্ব করতে পারে। কমিউনিজম যেমনটা আশা করে যে প্রত্যেক ব্যক্তি সমাজে ‘ন্যায় ও সাম্যের’ লক্ষ্যে কাজ করবে,যদিও তাদের বেতন ভাতা কম হয় এবং কোন বাড়তি সুবিধা নাও থাকে।পুঁজিবাদ যেমনটা বিশ্বাস করে যে ক্রমবর্ধমান উৎপাদন সমাজের সব সদস্যের সম্পদপ্রাপ্তি নিশ্চিত করবে(যদিও বাস্তবে উল্টোটা ঘটে)।এই তালিকা ক্রমশ লম্বা হতেই থাকবে।

ধর্ম যেখানে তার অনুসারীদেরকে ধৈর্যধারণ,সংগ্রাম এবং চূড়ান্ত বিজয়ের আশ্বাস দেয়,বস্তুবাদী ব্যবস্থা সেরকম নিশ্চয়তার কথা কখনোই বলেনা।এই নিশ্চয়তার অভাবেই হয়ত বস্তুবাদী ব্যবস্থার ধারক-বাহকরা তাদের জীবনদর্শন,রাজনৈতিক,সামাজিক ব্যবস্থার বিরোধিতাকারি সব শক্তিকে বিনাশ করে দিতে চায়।প্রভুত্ব নিশ্চিত করতে ভিন্নমতালম্বী ‘ভয়ংকর সংখ্যালঘু’দেরকে দমনের সর্বোত চেষ্টা করে।হয়ত ধর্মের অনুসারীরাও অপ্রতিরোধ্য বিপক্ষ বস্তুবাদী বা ধর্মীয় শক্তির বিরুদ্ধে বিশেষ রাজনৈতিক,সামাজিক বা কৌশলগত কারণে এমন আচরণ করে থাকে।কিন্তু ধর্ম যেখানে এইসব প্রবণতাকে রুখবার চেষ্টা করে, সেখানে এসব নিপীড়নমূলক প্রবণতা বস্তুবাদী ব্যবস্থারই অংশ।

নাস্তিকতা আর ধর্মের মাঝে কে বেশি ভয়ংকর সে বিতর্ক হওয়ার বদলে প্রকৃত বিতর্কের বিষয় উচিত কোনটি বেশি ভয়ংকর? ধর্মীয় জীবনদর্শন নাকি বস্তুবাদী জীবনদর্শন?যেমনঃ জাতীয়তাবাদ,নাৎসিজম,ফ্য্যাসিজম,সোশ্যাল ডারউইনিজম,সেকুলার লিবারেলিজম/হিউম্যানিজম(মানবতাবাদ),যারা কিনা তাদের জাগতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছে,দুর্বলের উপর অত্যাচার করেছে।

ফুটনোটঃ কেউ আস্তিক হলেই যে তিনি ধর্মের অনুসারী হবেন,ব্যাপারটা তেমন না।এদের কেউ কেউ হয়ত আল্লাহর অস্তিত্বকে বিশ্বাস করেন কিন্তু নিজেদের জীবনবিধান নিজেরাই রচনা করেন।যেমনটা সেকুলারিস্টরা করে থাকেন যে রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা থেকে ধর্মের বিধান সরিয়ে ফেলা।এবং এই ধরনের আচরণ এটাই প্রতীয়মান করে যে তাদের বিশ্বাস ব্যতীত জীবনব্যবস্থার অন্যকোন ক্ষেত্রে আল্লাহর অস্তিত্ব কোন গুরুত্বই বহন করে না।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন