মিরাজ শব্দটির আরবি অর্থগুলো হচ্ছে সিঁড়ি বা সোপান, ঊর্ধ্বে আরোহণ, ওপরে ওঠা। লাইলাতুল মিরাজ বা শবে মিরাজ বলতে আরোহণের রাত্রি বোঝায়। ইসলামিক পরিভাষায়, এটা সেই রাত্রি যখন হজরত মুহাম্মদ সা: মক্কায় মসজিদুল হারাম থেকে জেরুসালেমের বায়তুল মাকদিসে যান এবং সেখান থেকে সপ্ত আসমান ভ্রমণ করেন ও আল্লাহর সন্নিকটে পৌঁছান। আজকের দিনে মিরাজের সাথে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক খোঁজার আগে ভালো করে জানা দরকার এ সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে কী বলা হয়েছে। কুরআনে মিরাজের প্রতি সর্বপ্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় সূরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে অর্থাৎ ১৭ নম্বর সূরার ১ নম্বর আয়াতে। এই আয়াতে বলা হয়েছে : ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁহার বান্দাকে রজনিযোগে ভ্রমণ করাইয়াছিলেন মসজিদুল হারাম হইতে মসজিদুল আকসায়, যাহার পরিবেশ আমি করিয়াছিলাম বরকতময়, তাঁহাকে আমার নিদর্শন দেখাইবার জন্য, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ পরে মিরাজের প্রতি আরো ইঙ্গিত পাওয়া যায় সূরা নাজম অর্থাৎ ৫৩ নম্বর সূরার ১২ থেকে ১৮ নম্বর আয়াতে। হাদিসে মিরাজের যে বর্ণনা আছে তার কয়েকটি ভাষ্য পাওয়া যায়। খুঁটিনাটি বিবরণের দিক দিয়ে এগুলো একটি আরেকটি থেকে ভিন্ন। যা হোক মুসলিম এবং বুখারি শরিফের হাদিসগুলোর সংক্ষিপ্ত সার হলো এ রকম : কোনো এক রাতে যখন নবী হজরত মোহাম্মদ সা: ঘুমাচ্ছিলেন, তখন জিব্রাইল আ:সহ তিনজন ফেরেস্তা তাঁর কাছে আগমন করেন এবং তাঁকে কাবা শরিফে নিয়ে যান। সেখান থেকে জিব্রাইল আ: তাঁকে সাথে নিয়ে বুরাকে চড়েন এবং প্রথমে যান জেরুসালেমের মসজিদুল আকসায়। সেখানে নবী করিম সা: দুই রাকাত নামাজ পড়েন। সেখান থেকে জিব্রাইল আ: তাঁকে সাথে নিয়ে সাত আসমানের প্রতিটির মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করেন।
এসব আসমানে নবী করিম সা: পর্যায়ক্রমে হজরত আদম আ:, হজরত ঈসা আ: ও হজরত ইউসুফ আ:-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। হাদিসের বর্ণনায় আরো আছে যে, নবী করিম সা:-কে সিদরাতুল মুনতাহা ও বায়তুল মামুরেও নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বেহেশত ও দোজখ দেখেন। তিনি আল্লাহকে দেখেন অনন্ত মহিমায় ও শানশওকতে। একই রাতে তিনি পৃথিবীতে ফিরে আসেন। এই ভ্রমণেই তিনি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে পাঁচবার সালাত কায়েম করার নির্দেশ লাভ করেন। এখন এই মিরাজ ঘটনাটি ব্যাখ্যা আমরা কিভাবে দিতে পারি? এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন যে মিরাজ সম্পর্কে মুসলানদের মধ্যে দু’টি School of Thought বা মতবাদ আছে। একটি মতবাদ অনুসারে মিরাজ সংঘটিত হয় আধ্যাত্মিক পর্যায়ে। অন্য মতের অনুসারীরা বলেন, মিরাজ ঘটেছিল শারীরিকভাবেই। যদি প্রথম মতবাদটি গ্রহণ করা হয় অর্থাৎ যদি ধরে নেয়া হয়, মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল আধ্যাত্মিকরূপে, তাহলে সে ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার খুব একটা অবকাশ থাকে না। কারণ জড় পদার্থের ক্ষেত্রে আমরা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ যেমনভাবে করতে পারি, আধ্যাত্মিক ব্যাপারে ঠিক তেমনটি পারি না। আধুনিক বিজ্ঞানের যেসব পদ্ধতি ও হাতিয়ার আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলোর কার্যপরিধি জড় পদার্থের বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করেই। আধ্যাত্মিক জগতকে Probe বা তলিয়ে দেখার কাজটি বিজ্ঞানের বিশেষ পদ্ধতিতে হয়তো কখনই সম্ভব নয়। তাই সে চেষ্টা না করাই সমীচীন। কিন্তু নবী করিম সা:-এর এই নৈশ ভ্রমণকে যদি Literal বা শাব্দিক অর্থে দেখা হয়, অর্থাৎ যদি ধরা হয়, ঘটনাটি শারীরিকভাবেই ঘটেছিল তবে একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রশ্ন আসে এবং এ ক্ষেত্রে একঝাঁক প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রশ্নগুলো হলো এরকম : হজরত মোহাম্মদ সা: Gravitational force বা মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অতিক্রম করলেন কী করে? বুরাক নামক অদ্ভুত জন্তুটি যা আরবি শব্দ ‘বুরক’ অর্থাৎ বিদ্যুতের সাথে সম্পর্কিত, তা কি আসলে একটা মহাশূন্যযান ছিল। এই বুরাক যার উল্লেখ হাদিসে পাওয়া যায়, কুরআনে নয়, তা এত দ্রুতগতিসম্পন্ন কী করে হলো যে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে astronomical দূরত্বে যেতে পারল? প্রশ্নগুলো স্বাভাবিক ও চমকপ্রদ এবং এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া খুব যে একটা সহজ ব্যাপার তাও নয়।
যাক, প্রশ্নগুলো একটু তলিয়ে দেখা যাক। যদিও মিরাজ যেকালে ঘটেছিল তখন বা এমনকি তারও অনেক পরবর্তী সময় পর্যন্ত পৃথিবীর আকর্ষণ, যাকে আমরা Gravity বলে থাকি এবং যার আবিষ্কর্তা বলা হয় Newton-কে। তাকে ডিঙানো বা অতিক্রম করা অকল্পনীয় ছিল। রকেটের যুগে বাস করে আজ অবশ্য আমরা বুঝতে পারছি যে, পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে কোনো বস্তুকে যদি সেকেন্ডে ৭ মাইলের বেশি গতিতে নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে ওই বস্তুর পক্ষে মাধ্যাকার্ষণ শক্তিকে পেরিয়ে যাওয়া কোনোই কঠিন কাজ নয়। এই যে গতিবেগ অর্থাৎ সেকেন্ডে ৭ মাইল এটাকে বলা হয় Escape velocity অর্থাৎ এটা সেই গতিবেগ যা পেলে বস্তু মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পেরিয়ে যেতে পারে। জ্বালানি পুড়িয়ে রকেটগুলো এই গতিবেগ অর্জন করে। পোড়া গ্যাসগুলো যতই পেছন দিকে নির্গত হয়, ততই নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে রকেট সামনের দিকে এগুতে থাকে। তাই যদিও আজ থেকে কয়েক’শ বছর আগে, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণকে অতিক্রম করা অকল্পনীয় ছিল আজ কিন্তু আর তেমন নেই। এমন হয়তো কেউ ভাবতে পারেন যে ‘বুরাক’ কি তা হলে এক ধরনের মহাশূন্যযান ছিল? আমরা এ প্রশ্নের উত্তর জানি না তবে এটুকু বলা যায়, যে বুরাকে চড়ে হজরত মোহাম্মদ সা: মক্কা থেকে জেরুসালেমে গিয়েছিলেন বলে বলা হয়েছে তার গতিবেগ ওই ভ্রমণে Escape velocity-র সমান না হলেও চলে। গতিবেগ অত্যন্ত বেশি হবে বা আধুনিক aeroplane CONCORD-এর গতিকে ছাড়িয়ে যাবে এরকম একটা শর্তই যথেষ্ট। উল্লেখ্য, CONCORD -এর মতো প্লেন মানুষ হালে বানাতে শিখেছে তাই হালে ওই ধরনের গতিসম্পন্ন কোনো বাহক বা যানের কথা কল্পনা করতে অসুবিধা হয় না। এ প্রসঙ্গে আরো প্রশ্ন আসে এবং এ প্রশ্নগুলো খুঁটিনাটির প্রশ্ন যেমন বুরাকের Shape বা আকার কী রকম ছিল? উড়ার শক্তি সে জোগাড় করল কোথা থেকে? ইত্যাদি। বিজ্ঞানের সূত্র ধরে এটুকু বলা চলে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে মক্কা থেকে জেরুসালেমে গমন করা কোনো অসম্ভব বিষয় নয়। তবে অধিকতর কঠিন যে প্রশ্নটি তা হচ্ছে সপ্ত আসমানের আরোহণের ব্যাপারটি।
এখানে অসাধারণ গবিবেগে পৌঁছার আগে acceleration বা ত্বরণের প্রশ্নটি নিহিত আছে। আরো একটি প্রশ্ন, ভ্রমণে সময় কতটুকু লেগেছে? এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে যিনি ভ্রমণ করছেন না, তার ঘড়িতে এই ভ্রমণে যতটা সময় ব্যয়িত হয়েছে বলে মনে হবে, তা, যিনি ভ্রমণ করছেন, তার ঘড়িতে ব্যয়িত সময়ের থেকে আলাদা হবে। এটা হেঁয়ালি ঠেকলেও আপেক্ষিকতা তত্ত্ব তাই বলে। সুতরাং দ্রুতগতিবেগ অর্জন করা এবং প্রাসঙ্গিক প্রযুক্তিগত সমস্যা যতই দুরূহ বলে মনে হোক ভ্রমণটা যে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে ঘটতে পারে সেটা বোঝা তত দুরূহ নয়, বিশেষ করে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব জানার পর। এই তত্ত্ব অনুসারে একজন পর্যবেক্ষক যদি নিজেকে তার ঘড়ির সাথে আপেক্ষিকভাবে স্থির দেখতে পান, তবে অন্য যেসব ঘড়ি যা তিনি সুষম গতিবেগে চলাচল করতে দেখবেন, সেগুলোর সময় তার কাছে দ্রুত চলছে বলে মনে হবে। ঘড়িগুলোতে সময় কত তাড়াতাড়ি অতিবাহিত হবে তা নির্ভর করবে ঘড়িগুলোর গতিবেগের ওপর। উদাহরণস্বরূপ একটি ট্রেন, যদি আলোর গতিবেগ বা তার ০.৯৯৯ ভাগ গতিবেগে ধাবিত হয় এবং ওই ট্রেনের প্যাসেঞ্জারের ঘড়িতে যদি এক মিনিট অতিবাহিত হয়েছে বলে মনে হয় তবে স্টেশনের ঘড়িতে তিনি দেখবেন এক ঘণ্টার বেশি অতিবাহিত হয়েছে। অর্থাৎ ভ্রমণকারীর সময় এবং স্থির হয়ে আছেন যিনি তার সময় আলাদা হবে। জিব্রাইল আ:-এর সাথে হজরত মোহাম্মদ সা:-এর সপ্তম আকাশে আরোহণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যে বিষয়টি এসে পড়ে তা হলো, তারা যদি কোনো যান ব্যবহার করে থাকেন, তবে ওই যান ওঠার সময় অনেক acceleration বা ত্বরণ পেতে হয়েছিল, আবার পৃথিবীতে নামার সময় গতি কমাতে হয়েছিল এ ক্ষেত্রে ওই যানটিকে ঠিক একটি inertial frame বা জড়কাঠামো হিসেবে গণ্য করা যায় না, তাই ভ্রমণকারী ও বাড়িতে থেকে যাওয়া লোকের ঘড়ির সময়ের তফাৎ হয়তো একটি বাস্তব ঘটনা, অবশ্য মিরাজের বর্ণনায় এই সময়ের ব্যবধানের কথা কোথাও উল্লেখ হয়নি।
পরিশেষে বলা চলে যে, জগৎসমূহের পরিচালক আল্লাহ যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনা ঘটাতে পারেন। তার নিজের কথাতেই, তিনি যখন কোনো কিছু ইচ্ছা করেন তখন শুধু বলেন ‘হও’ এবং তা হয়ে যায়। এখন এ ধরনের ঘটনা আমাদের দৃশ্যজগতের প্রাকৃতিক ঘটনাবলির নিয়মে ঘটে থাকে নাকি এমন নিয়মে যা আল্লাহই জানেন, কিন্তু আমরা জানতে পারি না। এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো অবস্থায় আমরা আসিনি। আমরা বিজ্ঞানে এ পর্যন্ত যা জেনেছি, তা দিয়ে মিরাজের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে এখনো আমরা অসমর্থ। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞানের আরো বিকাশ ঘটলে মিরাজের ওপর হয়তো ভবিষ্যতে আরো আলোকপাত করা সম্ভব হবে। আল্লাহ্ আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করুন- এই হোক আমাদের প্রার্থনা।
প্রফেসর ড. এম শমশের আলী
লেখক : বিশিষ্ট বিজ্ঞানী
সৌজন্যে : দৈনিক নয়াদিগন্ত
লেখক : বিশিষ্ট বিজ্ঞানী
সৌজন্যে : দৈনিক নয়াদিগন্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন