সোমবার, ২৯ জুন, ২০১৫

একজন মুসলিমের জন্য প্রয়োজনীয় চারিত্রিক গুণাবলি" আহমদ আল-মাযইয়াদ

                                                                সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ'র জন্য।

ইসলামী শরিয়াহ হচ্ছে জীবন পরিচালনার একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি যা সকল দিক থেকে সার্বিকভাবে একজন মুসলিমের ব্যক্তিগত জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে। এসব দিকের মধ্যে- শিষ্টাচার ও চরিত্রের দিকটি অন্যতম। ইসলাম এদিকে অনেক গুরুত্ব প্রদান করেছে। তাই, ইসলাম; আকিদাহ (বিশ্বাস) ও আখলাকের মাঝে সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছে, যেমন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
“মুমিনদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানদার হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে ব্যক্তি তাদের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।” [আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযি]

সুতরাং উত্তম চরিত্র হচ্ছে ঈমানের প্রমাণবাহক ও চরিত্রের মধ্যে একজনে ঈমানের প্রতিফলন ঘটে। সুন্দর চরিত্র ব্যতীত কারো মধ্যে ঈমান প্রতিফলিত হয় না বরং রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন যে, তাঁকে রসূল হিসেবে প্রেরণের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্রের উত্তম দিকসমূহ পরিপূর্ণ করে দেয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
 আমি তো কেবল চরিত্রের উত্তম দিকসমূহ পরিপূর্ণ করে দিতে প্রেরিত হয়েছি। [ইমাম আহমাদ ও ইমাম বুখারী আদাবুল মুফরাদে বর্ণনা করেছেন]


এ কারণেই আল্লাহ তা'আলা কুর'আনে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উত্তম ও সুন্দরতম চরিত্রের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
 “নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।” [সূরা আল-কালাম : ৪]

বর্তমান বস্তুবাদী মতবাদ ও মানবতাবাদী মানুষের মনগড়া চিন্তা চেতনায় কোথায় এমন চরিত্র? এখানে চরিত্রের ভালো দিকগুলোকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে। এ সমাজ শুধু সুবিদাবাদী নীতিমালা ও বস্তুবাদী স্বার্থের উপর প্রতিষ্ঠিত যদিও বা সেটা অন্যদের উপর জুলুম বা নির্যাতনের মাধ্যমে হয়; অন্য সব জাতির সম্পদ লুন্ঠন ও মানুষের সম্মান হানির মাধ্যমে অর্জিত হয়।

একজন মুসলিমের আচার-আচরণ আল্লাহর সাথে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে, তাঁর সুন্নাহ- এর সাথে, অন্য মানুষের সাথে, এমনকি নিজের সাথে কিরূপ হওয়া উচিত; ইসলাম তার এক অভিনব ও চকমপ্রদ চিত্র অংকন করে দিয়েছে। যখনই একজন মুসলিম; বাস্তবে ও তার লেনদেনে ইসলাম নির্দেশিত চারিত্রিক গুণাবলির অনুসরণ করে তখনই সে অভিষ্ট পরিপূর্ণতার অতি নিকটে পৌঁছে যায়, যা তাকে আরো বেশি পরিমাণে আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও উচ্চ মর্যাদার সোপানে উন্নীত হতে সহযোগিতা করে। পক্ষান্তরে, যখনই একজন মুসলিম ইসলাম নির্দেশিত চরিত্র গুণাবলি ও শিষ্টাচার হতে দূরে সরে যায়, তখনই সে বাস্তবে ইসলামের প্রকৃত প্রাণ-চাঞ্চল্য, নিয়ম-নীতি অনুসরণ থেকে দূরে সরে যায়। সে যান্ত্রিক মানুষের মত হয়ে যায়, সে যেনো অনুভূতিহীন এবং কঠোর হৃদয়ের হয়ে পড়ে।

ইসলামে ইবাদাহ-সমূহ চরিত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে ইবাদাহ চরিত্রের কোন উত্তম দিকের প্রতিফলন ঘটায় না; তার কোন মূল্য নেই। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আল্লাহর সামনে নামায আদায়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, নামায একজন মানুষকে অশ্লীল ও অপছন্দনীয় কাজসমূহ হতে রক্ষা করে। আত্মশুদ্ধি ও আত্মার উন্নতি সাধনে নামাযের ভূমিকা রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
 “নিশ্চয়ই নামায; অশ্লীল ও অপছন্দনীয় কাজ হতে (একজনকে) বিরত রাখে।” [ সূরা আল-আনকাবুত: ৪৫]


অনুরূপভাবে, রোযা একজন মুসলিমকে তাক্কওয়ার দিকে পরিচালিত করে। আর তাক্বওয়া হচ্ছে মহান চরিত্রিক গুণাবলির মধ্যে অন্যতম, যেমন- আল্লাহ তা'আলা বলেন,
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পারো। [সূরা আল-বাকারা: ১৮৩]

  • রোযা অনুরূপভাবে শিষ্টাচার, ধীরস্থিরতা, প্রশান্তি, ক্ষমা, মুর্খদের থেকে বিমুখতা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটায়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

    "তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রোযা রাখে, তাহলে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে, হৈ চৈ না করে এবং অস্থিরতা না দেখায়। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই করে তাহলে, সে যেন বলে দেয়, 'আমি রোযাদার'।" [বুখারী ও মুসলিম]

  • যাকাত অনুরূপভাবে অন্তরকে পবিত্র করে, আত্মাকে পরিমার্জিত করে এবং তাকে কৃপণতা, লোভ ও অহংকারের ব্যধি হতে মুক্ত করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

    “তাদের সম্পদ হতে আপনি সাদকাহ গ্রহণ করুন যার মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিমার্জিত করবেন।” [সূরা তাওবাহঃ ১০৩]

  • হাজ্জ হচ্ছে একটি বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণশালা যার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি সম্ভব এবং তা হিংসা-বিদ্ধেষ ও পঙ্কিলতা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জন করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

    “যে এ মাস গুলোতে নিজের উপর হাজ্জ ফরয করে নিল সে যেন অশ্লীলতা, পাপাচার ও ঝগড়া বিবাদ হাজ্জের মধ্যে না করে।” [সূরা আল বাকারাহ: ১৯৭]
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“যে ব্যক্তি অশ্লীল কথা-বার্তা ও পাপ কর্ম না করে হজ্জ পালন করল, সে তার পাপরাশি হতে তার মা যেদিন তাকে জন্ম দিয়েছে সে দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে ফিরে এলো” [বুখারী ও মুসলিম]

ইসলাম নির্দেশিত চরিত্রের মৌলিক বিষয়সমূহঃ

১ সত্যবাদিতা:

আল্লাহ তা'আলা এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের যে সকল চরিত্রিক গুণ অর্জন করার নির্দেশ দিয়েছেন, তার অন্যতম হচ্ছে- সত্যবাদিতা। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা সত্যবাদীদের সাথী হও।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১১৯]

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
“তোমরা সততা অবলম্বন কর, কেননা সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায় আর পূণ্য জান্নাতের পথ দেখায়, একজন লোক সর্বদা সত্য বলতে থাকে এবং সত্যবাদিতার প্রতি অনুরাগী হয়, ফলে আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।” [মুসলিম]


২ আমানতদারিতা :

মুসলিমদের সে সব চরিত্রিক পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার একটি হচ্ছে- আমানতসমূহ তার অধিকারীদের নিকট আদায় করে দেয়া। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের নিকট আদায় করে দিতে।” [সূরা আন নিসা: ৫৮]

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট আল-আমীন উপাধি লাভ করেছিলেন, তারা তাঁর নিকট তাদের সম্পদ আমানত হিসেবে রাখত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার অনুসারীদের মুশরিকরা কঠোর ভাবে নির্যাতন শুরু করার পর যখন আল্লাহ তাকে মক্কা হতে মদী্নায় হিজরত করার অনুমতি দিলেন তখন তিনি আমানতের মালসমূহ তার অধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা না করে হিজরত করেননি (আলি রাঃ কে রেখে যান)। অথচ যারা তাঁর কাছে আমানত রেখেছিল তারা সকলেই ছিল কাফের, মক্কার ১৩ বছর নব্যুওয়াতী জীবনে এই কাফির'রা তাঁর পর অত্যাচার-অবিচার করলেও আমানত রাখার ব্যাপারে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপেক্ষা অধিক নির্ভরযোগ্য কাউকে তারা খুঁজে পায় নি। অর্থাৎ, ইসলাম আমানতসমূহকে তার অধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে যদিও তার অধিকারীরা কাফের হয়।

৩ অঙ্গীকার পূর্ণ করা:

ইসলাম নির্দেশিত আরেকটি চারিত্রিক গুণ হচ্ছে অঙ্গীকার পূর্ণ করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন :
“আর অঙ্গীকার পূর্ণ কর, কেননা অঙ্গীকার সম্বন্ধে (তোমরা) জিজ্ঞাসিত হবে।” [সূরা ইসরা: ৩৪]
আর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিশ্রতি ভঙ্গকরা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

৪ বিনয় :
ইসলাম নির্দেশিত অপর একটি চারিত্রিক গুণ হচ্ছে- একজন মুসলমান তার অপর মুসলিম ভাই-এর সাথে বিনয়ী আচরণ করবে। সে ধনী হোক কিংবা গরীব। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

“তুমি তোমার পার্শ্বদেশ (স্বীয় বাহু) মুমিনদের জন্য অবনত করে দাও।” [সূরা আল হিজর : ৮৮]

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
“আল্লাহ তা'আলা আমার নিকট ওহী পাঠিয়ে সতর্ক করেছেন যে, ‘তোমরা বিনয়ী হও যাতে একজন অপরজনের উপর অহংকার না করে। একজন অপর জনের উপর সীমালংঘন না করে।” [মুসলিম]


৫ মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার:

মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার উত্তম চরিত্রের নির্দেশক। আর এটা তাদের অধিকার তাদের মহান হওয়ার কারণে, যে অধিকারের স্থান হল আল্লাহর হকের পরেই। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
‘আর আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না, এবং মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর।” [সূরা আন-নিসা: ৩৫]

আল্লাহ তা'আলা তাদের আনুগত্য, তাদের প্রতি দয়া ও বিনয় এবং তাদের জন্য দু’আ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“তাদের উভয়ের জন্য দয়ার সাথে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে আমাকে তারা লালন-পালন করেছেন।” [সূরা আল ইসরা: ২৪]

এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলো,
‘হে আল্লাহর রসূল! আমার উত্তম আচরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী অধিকারী ব্যক্তি কে ? তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ অত:পর জিজ্ঞেস করলো, তারপর কে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ অতঃপর আবারো জিজ্ঞেস করলো, তার পর কে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, তার পর কে? উত্তর দিলেন, ‘তোমার পিতা।’ [বুখারী ও মুসলিম]

মাতা-পিতার প্রতি এ সদ্ব্যবহার ও দয়া অনুগ্রহ অতিরিক্ত বা পূর্ণতা দানকারী বিষয় নয় বরং তা হচ্ছে সকল আলিমের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ফরযে আইন।

৬ আত্মীয়তার সর্ম্পক বজায় রাখা:

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরী আর তারা হচ্ছে নিকটাত্মীয়গণ যেমন, চাচা, মামা, ফুফা, খালা, ভাই, বোন প্রমূখ। আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ওয়াজিব, আর তা ছিন্ন করা জান্নাত হতে বঞ্চিত হবার ও অভিশাপের কারণ হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“ যদি তোমরা ক্ষমতা পাও, তাহলে কি তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? তারা তো ঐ সব লোক, যাদের প্রতি আল্লাহ অভিশম্পাত করেছেন। এতে তিনি তাদেরকে বধির করে দিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টি অন্ধ করে দিয়েছেন।” [সূরা মুহাম্মাদ : ২২-২৩]

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

“আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী বেহেশ্তে প্রবেশ করবে না।” [বুখারী ও মুসলিম]


৭ প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দরতম ব্যবহার:

প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দরতম ব্যবহার করা হচ্ছে ইসলাম নির্দেশিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। প্রতিবেশী হচ্ছে সে সব লোক যারা আপনার বাড়ীর আশে পাশে বসবাস করে। যে আপনার সবচেয়ে নিকটবর্তী। সে সুন্দর ব্যবহার ও অনুগ্রহের সবচেয়ে বেশী হকদার। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“আর মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর, নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকীন, নিকটতম প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতিও।” [সূরা আন-নিসা: ৩৬]

এতে আল্লাহ নিকটতম ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার করতে ওসিয়ত করেছেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
‘জিবরীল আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে এতবার ওসিয়ত করতেছিল যে, আমি ধারণা করতে শুরু করেছিলাম, আল্লাহ হয়ত প্রতিবেশীকে (সম্পদের) উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেবেন।’ [বুখারী ও মুসলিম]

অর্থাৎ আমি মনে করেছিলাম যে ওয়ারিশদের সাথে প্রতিবেশীর জন্য মিরাসের একটি অংশ নির্ধারিত করে দেবে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু যর রা. কে লক্ষ্য করে বলেন,
‘হে আবু যর! যখন তুমি তরকারী রান্না কর তখন পানি বেশি করে দাও, আর তোমার প্রতিবেশীদের অঙ্গীকার পূরণ কর।” [ মুসলিম]

প্রতিবেশীর পার্শ্বাবস্থানের হক রয়েছে যদিও সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী বা কাফির হয়।

৮ মেহমানের আতিথেয়তা:

ইসলামের আরেকটি নির্দেশ হচ্ছে- মেহমানের আতিথেয়তা করা। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।” [বুখারী ও মুসলিম]


৯ সাধারণভাবে দান ও বদান্যতা:

ইসলাম নির্দেশিত চারিত্রিক গুণগুলোর অন্যতম দিক হচ্ছে দান ও বদান্যতা। আল্লাহ তা'আলা ইনসাফ, বদান্যতা ও দানশীলদের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে অতঃপর যা খরচ করেছে; তা থেকে কারো প্রতি অনুগ্রহ ও কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্য করে না, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রতিদান রয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাও করবে না।”   [সূরা আল বাকারাহ : ২৬২]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
‘যার নিকট অতিরিক্ত বাহন থাকে সে যেন, যার বাহন নেই তাকে তা ব্যবহার করতে দেয়। যার নিকট অতিরিক্ত পাথেয় বা রসদ রয়েছে সে যেন, যার রসদ নেই তাকে তা দিয়ে সাহায্য করে।”  [মুসলিম]

১০ ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা:

ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা অর্জন একজন মুসলিমের প্রতি ইসলামের অন্যতম নির্দেশ। অনুরূপভাবে মানুষকে ক্ষমা করা, দুর্ব্যবহারকারীকে ছেড়ে দেয়া, ওজর পেশকারীর ওজর গ্রহণ করা বা মেনে নেয়াও অন্যতম। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“আর যে ধৈর্য্য ধারণ করল এবং ক্ষমা করল, নিশ্চয়ই এটা কাজের দৃঢ়তার অন্তর্ভূক্ত।”   [সূরা আশ শুরা: ৪৩]

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘তারা যেন ক্ষমা করে দেয় এবং উদারতা দেখায়, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেয়া কি তোমরা পছন্দ কর না?’

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

“দান খয়রাতে সম্পদ কমে যায় না। আল্লাহ পাক ক্ষমার দ্বারা বান্দার মার্যাদাই বৃদ্ধি করে দেন। যে আল্লাহর জন্য বিনয় প্রকাশ করে আল্লাহ তার সম্মানই বৃদ্ধি করে দেন।” [মুসলিম ]

তিনি আরো বলেন, “দয়া কর, তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে। ক্ষমা করে দাও, তোমাদেরও ক্ষমা করে দেয়া হবে।”   [আহমাদ]
 

১১  মানুষের মাঝে সমঝোতা ও সংশোধন:


একজন মুসলিমের উচিত- মানুষের মাঝে সমঝোতা ও সংশোধন করে দেয়া, এটা একটি মহান চরিত্রিক গুণ যা ভালবাসা ও সৌহার্দের প্রসার ও মানুষকে পারষ্পারিক সহযোগিতার দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“তাদের অধিকাংশ শলাপরামর্শের মধ্যে কল্যাণ নেই। কেবল মাত্র সে ব্যক্তি ব্যতীত যে সাদকাহ, সৎকর্ম ও মানুষের মাঝে সংশোধনের ব্যাপারে নির্দেশ দেয়। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এসব করে অচিরেই আমরা তাকে মহা প্রতিদান প্রদান করব।” [সূরা আন নিসা: ১১৪]


১২  লজ্জাশীলতা:

একজন মুসলিমের অন্যতম গুণ হওয়া উচিত- লজ্জাশীল হওয়া। এটা এমন একটি চরিত্রিক গুণ যা পরিপূর্ণতা ও মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিকে আহবান করে। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা হতে বিরত রাখে। লজ্জা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। ফলে একজন মুসলিম লজ্জাবোধ করে যে, আল্লাহ তাকে পাপাচারে লিপ্ত অবস্থায় দেখবে। অনুরূপভাবে মানুষের থেকে এবং নিজের থেকেও সে লজ্জাবোধ করে। লজ্জাবোধ অন্তরে ঈমান থাকার প্রমাণ বহন করে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

‘লজ্জা ঈমানের বিশেষ অংশ।’ [বুখারী ও মুসলিম]

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, “লজ্জা কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না।” [বুখারী ও মুসলিম]

১৩  দয়া ও করুণা:

ইসলাম একজন মুসলিমকে নর্দেশ দেয় দয়া বা করুণা করার ব্যাপারে। এ চরিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেক মানুষের অন্তর হতে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে তাদের অন্তর পাথরের মত অথবা এর চেয়েও শক্ত হয়ে গেছে। আর প্রকৃত মু’মিন হচ্ছে দয়াময়, পরোপকারী, গভীর অনুভূতি সম্পন্ন উজ্জল অনুগ্রহের অধিকারী। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“অত:পর সে তাদের অন্তর্ভূক্ত হয় যারা ঈমান এনেছে, পরস্পর পরস্পরকে ধৈর্য্য ও করুণার উপদেশ দিয়েছে। তারা হচ্ছে দক্ষিণ পন্থার অনুসারী।”  [সূরা আল-বালাদ: ১৭- ১৮]

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
“মুমিনদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য, করুণা, অনুকম্পার উপমা হচ্ছে একটি শরীরের মত। যখন তার একটি অঙ্গ অসুস্থ হয়, গোটা শরীর নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।” [মুসলিম]


১৪  ইনসাফ বা ন্যায়পরায়ণতা:

ন্যায় পরায়ণতা হচ্ছে ইসলাম নির্দেশিত চরিত্রের আরেকটি অংশ। এ চরিত্র আত্মার প্রশান্তি সৃষ্টি করে। সমাজে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন প্রকার অপরাধ বিমোচনের দিকে সচেষ্ট থাকে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, ইহসান ও নিকটাত্মীয়দের দান করতে নির্দেশ দেন।”  [সূরা আল নাহাল: ৯০]

আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“ইনসাফ কর, এটা তাক্বওয়ার অতীব নিকটবর্তী।”   [সূরা আল মায়িদা: ৮]

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
“ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিরা আল্লাহর নিকট নূরের মিম্বারের উপর বসবে। তারা হল সে সব লোক, যারা বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে, পরিবার-পরিজনের ক্ষেত্রে এবং যে দায়িত্বই পেয়েছে তাতে ইনসাফ করে।” 


১৫  চারিত্রিক পবিত্রতা:

একজন মুসলিমের চরিত্রের অন্যতম লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে চারিত্রিক পবিত্রতা। এ চরিত্র মানুষের সম্মান সংরক্ষণ এবং বংশে সংমিশ্রন না হওয়ার দিকে সতর্ক করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
“যাদের বিবাহের সামর্থ নেই, তারা যেন চারিত্রিক পবিত্রতা গ্রহণ করে। যতক্ষণ না আল্লাহ তার অনুগ্রহে তাকে সম্পদশালী করেন।” [সুরা আন নূরঃ ৩৩]

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
“তোমরা আমার জন্য ছয়টি বিষয়ের জিম্মাদার হও। তাহলে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব। যখন তোমাদের কেউ কথা বলে, সে যেন মিথ্যা না বলে। যখন তার কাছে আমানত রাখা হয্‌ তখন যেন খেয়ানত না করে। যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, তা যেন ভঙ্গ না করে। তোমরা তোমাদের দৃষ্টি অবনত কর। তোমাদের হস্তদ্বয় সংযত কর। তোমাদের লজ্জাস্থান হেজাফত কর।” [ হাদীসটি তাবারানী বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন ]

ইসলাম নির্দেশিত এসকল চরিত্রিক গুনাবলির মধ্যে এমন কিছু নেই যা ঘৃণা করা যায়। বরং এসব এমন সম্মান যোগ্য মহৎ চারিত্রিক গুণ যা প্রত্যেক নিষ্কলুষ স্বভাবের অধিকারীর সমর্থন লাভ করে। মুসলিমগণ যদি এমন মহৎ চরিত্র ধারণ করত তাহলে সর্বস্থান থেকে তাদের নিকট মানুষ আগমন করত এবং দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে তারা প্রবেশ করত যেভাবে প্রথম যুগের মুসলিমদের লেন-দেন ও চরিত্রের কারণে সে সময়ের মানুষ ইসলামে প্রবেশ করেছিল।

এবং আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন।           

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন