একলা মানুষ মাতৃ গর্ভে একলা মানুষ চিতায় একলা পুরুষ কর্তব্যে একলা পুরুষ পিতায় আর, মধ্যে খানে বাকিটা সময় একলা না থাকার অভিনয় প্যালেস্টাইন, জেরুজালেম ও মসজিদ আল আকসা এর অপরিসীম ধর্মীয় গুরুত্বঃ প্যালেস্টাইন নবীদের পুণ্যভূমি। ইবরাহীম, ইসমাইল, ইয়াকুব, ইউসুফ, লুত, দাউদ, সোলাইমান, সালেহ, জাকারিয়া, ইয়াহইয়া ও ইসা(আ.) যাদের উল্লেখ কোরানে পাওয়া যায় এ ভূমিতেই জীবন-যাপন করেছেন। কোরান হাদিস ও ইসলামিক সাহিত্যে এ মহান ব্যক্তিত্বদের বারংবার উল্লেখের কারণে মুসলিম মানসে এ সকল ব্যক্তিত্ব ও এ ভূমির সাথে এক নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। প্যালেস্টাইনের এক গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নাম ইবরাহিম আ:-এর নামে নামকরণ করা হয়েছে ইবরাহীম নগর ; হেরেমে ইবরাহিমীর অভ্যন্তরে তার সমাধি অবস্থিত। নবী সালেহ আ:-এর পুণ্য-স্মৃতি ধারণ করে আছে তার সাতটি আবাস, যার একটি অবস্থিত রামাল্লায়। প্রতি বছর এপ্রিলে মানুষ তার সমাধি জিয়ারতে সম্মিলিত হয়। তুলকারেমের এলাকার একটি গ্রামের নাম ইরতাহ, মানুয়ের বিশ্বাস, ইয়াকুব আ: উক্ত গ্রামে বিশ্রামের জন্য অবস্থান করেছিলেন। হাদিসে আছে; রাসূল বলেছেন, শামের কি সৌভাগ্য ! শামের কি সৌভাগ্য ! লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল ! কী কারণে ? কারণ, আল্লাহর ফেরেশতাগণ তাদের পাখা বিস্তার করে রেখেছেন শাম(ফিলিস্তিন) দেশের উপর। জেরুজালেম : এক ঈশ্বরবাদী তিনটি ধর্মের জন্য জুদিয়ান পাহাড়ের উপত্যকায় গড়ে উঠা এ শহরটি পবিত্র হওয়ার কারণে একে বলা হয় পবিত্রতম শহর । আর জেরুজালেম শব্দের অর্থও হলো পবিত্র। প্রাচীন মিশরীয় রেকর্ডে জেরুজালেমের যে নাম পাওয়া যায় তা হলো ‘রুসালিমুন’ অথবা ‘উরসালিমুন’। গ্রীকরা এর পূর্বে ‘হাইক’ সংযোজন করে ‘হাইক্রোসালিমুন’ বলে ডাকে। । আরবদের কাছে এটি আল-কুদস বলে পরিচিত। এই সবগুলোর অর্থই হলো পবিত্র। হিব্রু পান্ডু লিপি আনুযায়ী জেরুজালেম ৯৭০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত ছিলো হযরত দাউদ (আ.) এর শাসনের অধীন। তাঁর সময় এ শহরটি গড়ে উঠেছিলো বলে একে দাউদ এর শহরও বলা হয়। পরবর্তীতে এ অঞ্চলের শাসক হন তাঁর পুত্র হজরত সোলায়মান (আ.)। তিনিই এ নগরীতে আল আকসা মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে ইতিহাসের ধারা বেয়ে গড়ে উঠেছে আজকের সভ্য নগরী জেরুজালেম। পৃথিবীতে সবচে’ বেশী সংখ্যক মানুষের কাছে ধর্মীয় পবিত্র ভুমি কোনটি? সবচে বেশী যুদ্ধ, রক্তপাত হয়েছে কোন নগরীকে ঘিরে? সবাই বিনা দ্বিধায় বলবেন সেই নগরী হল জেরুজালেম। পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশের ও বেশী মানুষের কাছে পবিত্র এ নগরী। ৫০০০ বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাস সম্বৃদ্ধ ।ইসলাম, খৃস্টান এবং ইহুদী ধর্মের পবিত্রভুমি জেরুজালেম। ২৩ বার অবরুদ্ধ হয়েছে এ নগরী , হাত বদল হয়েছে ৪৪ বার, আক্রান্ত হয়েছে ৫২ বার ,আর সম্পুর্নভাবে ধ্বংস হয়েছে দুই বার, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এ নগরী। জেরুজালেম নগরীর কেন্দ্রস্থল হল পুরাতন জেরুজালেম বা Old City. আয়তন মাত্র 0.৯ বর্গ কিলোমিটার। চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা এই জায়গাটায় হল পবিত্রতম স্থান। .ওল্ড সিটি বা পুরান শহরের রয়েছে ৪ টা অংশ বা কোয়ার্টার। মুসলিম কোয়ার্টার, ইহুদী কোয়ার্টার, আর্মেনিয়ান কোয়ার্টার, এবং খৃস্টান কোয়ার্টার। মানচিত্রের উত্তরে যেখানটায় শেষ হয়েছে মৃত সাগর, এর ৩৫ কিলোমিটার অদূরেই পবিত্রতম এক পাহাড়ি উপত্যকা জেরুজালেম। মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদী ধর্মের জন্য পবিত্র এ উপত্যকাটি সভ্যতার ছুঁয়ায় গড়ে উঠেছে জুদিয়ান পাহাড়ের পাদদেশে। কেবল ধর্মীয় কারণে নয় ভৌগলিকভাবেও জেরুজালেমের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এক অবস্থান। প্রকৃতির অঢেল নিঃসর্গ যেন ঢেলে দেয়া হয়েছে এখানে। উপত্যকার পূর্ব দিকে যেমন পৃথিবীর রহস্য ঘেরা এক আশ্চর্য মৃত সাগর, তেমনি মাত্র ৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে এসে আছড়ে পরছে ভ’মধ্যসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালা। এরই মাঝে মানুষের বসতি। শহরের দক্ষিণ অংশ ছাড়িয়ে রয়েছে কিডরুন উপত্যকা। তারপর আবার উঁচু হয়ে উঠেছে জলপাই পাহাড়। একই দিকে গভীর ও ঢালু উপত্যকা হিন্নুন। উত্তর পশ্চিম দিকে দামেস্ক গেটের কাছাকাছি আরেক উপত্যকা তাইরুপিয়ানের অবস্থান। ইউনেস্কো পুরাতন জেরুজালেমকে ঘোষণা দিয়েছে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট হিসাবে। জেরুজালেমের অর্থনীতির বড় একটি অংশ নির্ভর করে শহরের পুরাতন অংশের উপর। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ছুটে আসে ইতিহাসের অনঢ় স্বাক্ষী এ অংশ এবং পশ্চিম দিকে নির্মিত দেয়ালের আকর্ষণে। পবিত্রতম জেরুজালেমে এখনো টিকে রয়েছে প্রাচীন অনেক প্রার্থনাগার। পুরো শহরে সিনাগগের সংখ্যা ১২০৪টি, চার্চ ১৫৮ টি এবং মসজিদ রয়েছে ৭৩টি। এগুলোই শহরের ৭৪৭,৬০০ জন বাসিন্দার প্রার্থনালয়। ২০০৭ সালের এ শুমারি অনুযায়ী এদের মাঝে ৬৪ শতাংশ ইহুদী, ৩২ শতাংশ মুসলিম এবং ২ শতাংশ ক্রিস্টান। ১২৫.১৫৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ নগরীতে ২০০৫ সালের শেষের দিকে বসতির ঘনত্ব ছিলো প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫,৭৫০.৪ জন। পর্যায়ক্রমে এ উপত্যকায় ইহুদী, খৃষ্টান এবং মুসলমানরা জনবসতি গড়ে তোলে। জেরুজালেমকে রাজধানী করে গড়ে তোলা ইহুদীদের জুদাহ রাষ্ট্র একসময় বিধ্বস্ত হয়েছিলো ব্যবলনীয় রাজা নেবুচাঁদনেজারের হাতে। পরবর্তীতে রোমানদের আক্রমনে আবারও ইহুদীরা বিতাড়িত হয় জেরুজালেম থেকে। সপ্তম শতাব্দীতে এলাকা মুসলমানদের আয়ত্ত্বে আসে এবং অটোম্যান সাম্রাজোর শেষ পর্যন্ত তা অক্ষুন্ন থাকে। তখন এখানে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। আজ যে ইহুদীরা মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করার জন্য উত্তপ্ত করে রেখেছে জেরুজালেম ও ফিলিস্তিনকে। সে ইহুদীরা মুসলিম শাসনের অধীনে সবসময়ই থেকেছে নিরাপদ। হজরত ওমর রা. এর খেলাফতের সময় দীর্ঘ ৫০০ বছর পর জেরুজালেমে বসতি গড়ার অনুমতি পায় তারা। কোথাও যখন ঠাঁই মিলছিলোনা তখন ইসলামের ২য় খলিফা আশ্রয় দিয়েছিলেন তাদের। এই জেরুজালেম স্বাক্ষী হয়ে আছে মুসলিম শাসকদের উদারতা ও সম্প্রীতির। ওমরের সময় মুসলিম সৈন্যরা অবরুদ্ধ করে রেখেছিলো জুদিয়ান পাহাড়ের এ উপত্যকা। কিন্তু খ্রীষ্টানদের দাবি ছিরো তারা খলিফা উমরের কাছে উত্মসমর্পণ করবেন। ইসলামের ২য় খলিফা হযরত ওমর (রা.)ও তাদের সাথে চুক্তি সম্পাদনের জন্য আরব থেকে রওয়ানা দেন সুদূর জেরুজালেমের উদ্দ্যেশে । তিনি সেখানে পৌঁছার পর সারা জেরুজালেম অবাক হয় দেখল বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকর্তা ওমর (রা.) গাধার দড়ি হাতে বিনয়ের সাথে হেটে শহরে প্রবেশ করছেন। আর গাধার পিঠে সওয়ার তারই ভৃত্য। কেবল তাই নয় ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার জন্য এ জেরুজালেমেই তিনি নজির রেখে গেছেন আরেক উদারতার। হযরত ওমর (রা.) জেরুজালেমের একটি বিখ্যাত চার্চ পরিদর্শনে ছিলেন। সেখানে নামাজের সময় হয়ে গেলে তিনি অন্য স্থানে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। কারণ তাঁর শংকা ছিলো চার্চের ঐ স্থানে নামাজ আদায় করলে, তার স্বরণে পরবর্তীতে একে মসজিদে রূপান্তর করা হতে পারে। এ কারণেই এ চার্চের আশপাশে মুসলমানরা একত্রিত হয়ে যেন নামাজ আদায় করতে না পারে সেজন্য একটি ডিক্রিও জারি করেন। এখানে রয়েছে , - “Temple Mount” বা Temple Moriah. চারদিকে দেওয়ালে রয়েছে ১১টি গেট বা প্রবেশদ্বার, যার মধ্যে ৪টি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া এবং ৭ টি এখন খোলা আছে। Temple Mount - ডোম অফ দি রক খৃস্টানদের পবিত্র গির্জা “চার্চ অফ দি সেফুলক’র” - ইহুদীদের পবিত্রতম স্থান পশ্চিম দেওয়াল বা "ওয়েলিং ওয়াল” ওয়েলিং ওয়াল - শহরের দক্ষিণ রয়েছে হিন্নুন উপত্যকা। খ্রীস্টানদের ধারণা এ হিন্নুন। থেকেই শুরু হবে পাপিদের পরলৌকিক শাস্তি। - এবং, রয়েছে মুসলমানদের কাছে পবিত্র “ মসজিদে আল আকসা। মসজিদ আল আক্সাঃ জেরুজালেমে অবস্থিত বাইতুল মোকাদ্দাসকে কেন্দ্র করে সর্ব-গুরুত্বপূর্ণ যে বিশ্বাস মানুষ পোষণ করে,বিশেষত: বর্তমান মুসলিম জনগোষ্ঠী, তাহল, এটি ইসরার পুণ্যভূমি। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দা হযরত মোহাম্মদ(সাঃ) মসজিদে হারাম হতে মসজিদ আল আকসা অবধি ভ্রমণ করানোর জন্য মনোনীত করেছেন। মসজিদ আল আকসা মসজিদ আল আক্সার ইতিহাস অতি প্রাচীন। এই মসজিদ ইহুদী ও খৃষ্টান সকলের নিকট সমভাবে পবিত্র।খৃষ্টপূর্ব ১০০৪ শতাব্দীতে হযরত সোলায়মান সর্ব প্রথম এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। এর অবস্থান সম্পর্কে বলা হয় তা ছিলো জেরুজালেমের মরিয়া পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। খৃষ্টপূর্ব ৫৮৬ শতাব্দীতে বেবিলনের রাজা নেবুচান্দনেজার জেরুজালেম আক্রমণ করে, এবং মসজিদটিকে ধ্বংস করে দেয়। খৃষ্টপূর্ব ৫১৫ শতাব্দীতে ইজরা ও নেহেমিয়া মসজিদটির পুনঃনির্মাণ করেন। খৃষ্টপূর্ব ১৬৭ শতাব্দীতে আলেকজান্ডারের একজন উত্তরাধীকারী এন্টীওকাস এপিফেন [Antiochus Epiphaneo] একে মূর্তিপূজার স্থানে পরিণত করে। হেরোড [Herod] [খৃষ্ট পূর্ব ১৭ শতাব্দী - ২৯ খৃষ্টাব্দ] পরবর্তীতে তার সংস্কার করেন। ৭০ খৃষ্টাব্দে সম্রাট টিটাস মসজিদটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন। এর পর থেকে মসজিদটি বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে ছিলো , হযরত ওমরের (রা) আমল পর্যন্ত। তিনি এটি পুনঃ নির্মাণ করেন। ক্রুসেডঃ ১০৯৫ খৃস্টাব্দ (৪৮৮ হিজরী) থেকে ইউরোপীয়রা মুসলমানদের উপর আগ্রাসন চালালে ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু হয় এবং প্রায় দু’শ বছর যাবত তা অব্যাহত থাকে। ইউরোপীয়দের এসব আগ্রাসনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিলঃ পাশ্চত্যে মুসলমানদের অতীত বিজয়ভিযানের কারণে খৃস্টানদের প্রতিশোধ গ্রহণ। প্রাচ্যের (মুসলিম জাহানের) সম্পদ-ভান্ডারের প্রতি ইউরোপীয়দের লালসা এবং ঈসার পাক মাটি জিয়ারতের মাধ্যমে বেহেশত গমন ইত্যাদি। তবে ঐতিহাসিকরা ক্রুসেড যুদ্ধের মূল কারণ হিসাবে ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাস ইস্যু, মুসলমানদের কাছে শহরের খৃস্টানদের পণদান এবং সম্ভবত ওদের সাথে অসদাচরণ ইত্যাদির কথা লিখেছে। মধ্যযুগে অর্থাৎ ৩৯৫ খৃস্টাব্দে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য পশ্চিম রোম ও পূর্বরোমে বিভক্ত হয়ে পড়ার সময় থেকে ১৪৫৩ খৃস্টাব্দে সুলতান ফাতিহ মুহম্মদের হাতে কনস্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) বিজয়ের আগ পর্যন্ত ইউরোপ ছিল গির্জার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কেন্দ্র। পোপ যুদ্ধ শুরু করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং পাদ্রীদের মাধ্যমে রটিয়ে দেন যে, ফিলিস্থিনে ঈসা (আঃ) -এর আর্বিভাবের নিদের্শনাদি প্রকাশ পেয়েছে। ফলে বহু সংখ্যক খৃস্টান হযরত ঈসার আবির্ভাব দেখার জন্য বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। আর পাদ্রীরা হযরত ঈসার আগমনকে বছরের পর বছর পিছিয়ে দিতে থাকে। এতে করে ফিলিস্তিনগামী জনতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলে। ষড়যন্ত্রের প্রথম দিকেই একজন পাদ্রী সাতশ’ তীর্থযাত্রী নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু তিনি সাইপ্রাস হয়ে ইউরোপে ফিরে যান এবং গুজব ছড়িয়ে দেন যে মুসলমানরা তাদের শহরে প্রবেশ করতে দেয়নি। এসব পটভূমি ও ষড়যন্ত্রের ফলেই এমন এক যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে যার লেলিহান শিখা দুশ’ বছর পর্যন্ত দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। পাদ্রীদের প্রচরণা ও প্ররোচনায় তখন প্রায় সাত লাখ দরিদ্র নিঃস্ব খৃস্টান জনতা সামরিক দলপতি তথা নাইটদের সাথে আল কুদসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথে পথে এদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং কোন কোন সূত্রে এদের সংখ্যা কয়েক মিলিয়নে পৌঁছার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তিন বছরের এ পথচলা যুদ্ধ, লুটতরাজ ও ক্রমাগত অগ্রযাত্রার পর মাত্র চল্লিশ হাজার লোক বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছে। অন্যরা হয় মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে নিহত হয়েছে কিংবা রোগে শোকে মারা গেছে। বায়তুল মুকাদ্দাস দীর্ঘদিন অবরোধ থাকার পর তীব্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ক্রুসেড বাহিনী শহরে প্রবেশ করে এবং গণহত্যা ও সর্বস্ব লুন্ঠনে হাত দেয়। ক্রুসেড বাহিনীর অধিনায়ক গোডাফর পরবর্তীতে শহরের রাজা হয়। বিজয়ের পর পোপের কাছে লিখিত পত্রে সে জানায় আপনি যদি জানতে চান বায়তুল মুকাদ্দাসে আমাদের হাতে বন্দীদের সাথে কি আচরণ করা হয়েছে তাহলো এতটুকু জেনে নিনঃ ‘আমাদের সৈন্যরা মুসলমানদের রক্তের গভীর স্রোত পাড় হয়ে সুলায়মান মন্দিরে পৌঁছে। রক্ত ঘোড়াগুলোর উরু পর্যন্ত পৌঁছেছে।’খৃস্টানরা এভাবে (৯০) বছর ফিলিস্তিনের উপর শাসন চালায়। দ্বিতীয় ক্রুসেড যুদ্ধের শেষ দিকে (১১৪৭ খৃঃ-১১৪৯ খৃঃ তথা ৫৪২ হিঃ-৫৪৪ হিঃ) সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী ক্রুসেড বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে বায়তুল মুকাদ্দাসকে উদ্ধার করেন এবং শক্রদেরকে সিরিয়া, মিশর ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে বহিস্কৃত করেন।এরপর স্রোতের বেগে ইউরোপ থেকে সৈন্য সামন্ত ক্রুসেডারদের সাথে যোগ দিতে থাকে। আবার যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তৃতীয় ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু হয় (১১৮৯ খৃঃ-১১৯২ খৃঃ/৫৮৫ হিঃ)। বায়তুল মুকাদ্দাসের পতনকে খৃস্টানদের অবমাননা বলে গণ্য করে পোপ যুদ্ধের ফতোয়া জারি করে। মুসলমানদের হাতে পরাজয়ের পর ইউরোপের সম্রাটগণ ও পোপের দল পারস্পরিক অনৈক্য ভুলে যায় এবং ফ্রান্স ও বৃটেনের রাজা উভয়ই সরাসরি যুদ্ধে নামে। এরা নিজেদের বিজয়াভিযান অব্যাহত রেখে মুসলমানদের খুনে বন্যা সৃষ্টি করতে থাকে। এদের পৈশাচিক বর্বরতার বিস্তারিত বিবরণ ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের যেমন, আলবার মালাহ, গোস্তাভ লোভোন ও অন্যান্যের গ্রনে' রয়েছে। সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর ইন্তেকালের পর আইয়ুবী বংশ শাসন কার্য চালাতে থাকে। ইউরোপ ও পোপদের সাথে রাজা-বাদশাহের প্রচুর দ্বন্দ্ব সংঘাত চলার পর অবশেষে তৃতীয় পোপ এ্যানিউসান রাজাদের কাজের অংশ হিসাবে ঘোষণা দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ জারী করে। এভাবে তিন বছর সন্ধি চলার পর পুনরায় যুদ্ধের (চতুর্থ ক্রুসেড) আগুন জ্বলে উঠে। ক্রসেড বাহিনী কনস্টান্টিনোপল জয় করে নেয়, সেখানে নয়া রাজা বসায় এবং চতুর্থ ক্রুসেড যুদ্ধেরও অবসান ঘটে। পোপ এ্যানিউসান ও তাঁর উত্তরাধিকারীর উস্কানিতে পঞ্চম ক্রুসেড যুদ্ধের (১২১৭-১২২১ খৃঃ/৬১৪-৬১৮ হিঃ) আগুন প্রজ্বলিত হয়। পোপগণ ইউরোপীয় রাজাদের প্রতি বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধারের আহবান জানান। কিন্তু ওরা তা প্রত্যাখান করে। ফলে পোপ নিজেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দান করে। পঞ্চম ক্রুসেড যুদ্ধে খৃস্টান বাহিনী পরাজিত হয়ে ইউরোপ ফিরে যায়। পোপ তৃতীয় এ্যানারিউসের উস্কানিতে ষষ্ঠ ক্রুসেড যুদ্ধ বাঁধে। জার্মানীর রাজা ফ্রেডারিক প্রথমতঃ পোপের আহবানে সাড়া দেন। কিন্তু পরে অনুতপ্ত হয়ে প্রত্যাখান করে। এতে পোপ তাকে কাফের বলে ঘোষণা দেন। এতে ফ্রেডারিক পোপকে বন্দী করে নিজেই বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সে সময় আইয়ুবী বংশীয় শাসকদের ভেতর তীব্র অনৈক্য ও মতভেদকারী মুসলমানগণ ক্রুসেডারদের সাথে সন্ধি করে বায়তুল মুকাদ্দাস ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তবে শর্ত থাকে যে, মসজিদুল আকসা মুসলমানদের হাতে থাকবে। সপ্তম ক্রুসেড যুদ্ধ সেন্ট লুইয়ের মিশর আক্রমনের মধ্য দিয়ে শুরু (১২৪৮-১২৫৪ খৃঃ/৬৪৬-৬৫২ হিঃ) হয়। গাজা উপত্যকায় খৃস্টান বাহিনী পরাজিত হলে নবম লুই এর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যুদ্ধে নামে। কিন্তু তিনি পরাজিত, বন্দী ও কারারুদ্ধ হন। পরে বিপুল পরিমাণে পণ দিয়ে মুসলমানদের হাত থেকে রেহাই পান। সপ্তম ক্রুসেড যুদ্ধের পর এবং আইয়ুবী বংশীয় শেষ সুলতানের ইন্তেকালের ঘটলে দাস বংশীয় শাসকরা প্রায় তিন’শ বছর যাবৎ বায়তুল মুকাদ্দাসসহ সমগ্র অঞ্চলের শাসন কার্য চালান। এদিকে ইসলামী জাহানে আক্রমণকারী একের পর এক দেশ দখলকারী মঙ্গোল বাহিনী বায়তুল মুকাদ্দাস দখলের জন্য সেখানে পৌঁছলে দাস সুলতানদের সাথে লড়াই বাঁধে। লড়াইয়ে দাস বংশের পতন ঘটে এবং আকসায় ফিলিস্তিন বসবাসকারী অবশিষ্ট খৃস্টান ক্রুসেডপন্থীদেরও মূলোৎপাটন হয়ে যায়। অন্যদিকে মঙ্গোল বাহিনী ও গ্রীকদের সাথে উসমান গাজীর দীর্ঘ লড়াই ও একের পর এক বিজয়াভিযানের পর উসমানী বংশীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭২৭ হিঃ মুতাবিক ১৩২৬ খৃস্টাব্দে উসমান গাজীর মৃত্যু ঘটে। তার বংশধররা একের পর এক শাসন কার্য চালাতে থাকে এবং এরপর সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহের পালা আসে। সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহ ১৪৫৩ খৃস্টাব্দে মুতাবিক ৮৫৭ হিজরীতে ক্রুসেডারদের শক্তিসামর্থ্যের কেন্দ্র ও পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টাটিনোপল (ইস্তাম্বুল) জয় করেন এবং খৃস্টান বাহিনীকে ইউরোপের ফটক পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যান। তিনি ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকায় তার বিজয়াভিযান অব্যাহত রাখেন। কনস্টান্টিনোপলের বিজয় ছিল ইউরোপের ইতিহাসে এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। ক্রুসেড যুদ্ধের সময়ে যেমন মুসলমানদের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সভ্যতা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে তেমনি এ ঘটনার ফলে ইউরোপে মধ্যযুগের অবসান ঘটে এবং রেঁনেসার বিশাল পরিবর্তন শুরু হয়ে যায়। পাঁচশ’ বছর যাবত কনস্টান্টিনোপল উসমানী সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। এ সময়ে উসমানী খেলাফতের ভেতর শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য, রাষ্ট্র পরিচালনা, উন্নয়ন, শহর স্থাপন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। ইউরোপীয় সরকারগুলো সব সময়ই উসমানীদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস- অবস্থায় ছিল। ইরানে সাফাভী রাজবংশের পত্তন ঘটায় এবং শিয়া মাজহাবকে সরকারী মাজহাব বলে ঘোষণা দেয় এবং ইউরোপীয় সরকারগুলো, বিশেষ করে বৃটেনের প্রকাশ্য ও গোপন চক্রানে- ইরান ও উসমানীদের ভেতর দু’শ বছর মেয়াদী বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। উসমানীদের সাথে সন্ধি করার পর ইউরোপ যখন জ্ঞানবিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক (রেঁনেসা) আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক তখনি ইসলামী জাহানে বিশাল ও গভীর ফাটল সৃষ্টি হয় এবং মুসলমানদের শক্তি-সামর্থ্য দীর্ঘ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে নষ্ট হয়ে যায়। মুসলমানরা ইসলামী সভ্যতা প্রতিরক্ষা করার বদলে অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ ও মাজহাবী হিংসা-বিদ্বেষে মত্ত হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন