ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১২টা ১০ মিনিট। উত্তর-পূর্ব ভারতের আসামের রাজধানী গুয়াহাটির সরকারি আবাসনে দোতলায় বসার ঘরে তখনো মানুষ গিজগিজ করছে। দেয়ালে ক্যালেন্ডার ঝোলানো। তাতে ইংরেজিতে লেখা, ‘আজমল ফর এডুকেশন, এডুকেশন ফর অল’। দর্শনার্থীদের বেশির ভাগই ভারতীয় সংখ্যালঘু। কিন্তু তাঁদের মধ্যে হিন্দু মহিলা রিতু দাশ, প্রতুল মেধিও রয়েছেন। সবাই আসাম নির্বাচনে সাদৌ ভারত সংযুক্ত গণতান্ত্রিক মোর্চার (এআইইউডিএফ) মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাঁদের বসিয়ে রেখেই ভেতর ঘর থেকে ডাক এল।
দলের শীর্ষ নেতাদের সামনেই প্রথম আলোর মুখোমুখি হলেন এবারের আসাম নির্বাচনের কিং মেকার মাওলানা বদরুদ্দিন আজমল। আসামের হোজাইয়ে জন্ম হলেও ষাটোর্ধ্ব জীবনের বেশির ভাগটাই কেটেছে তাঁর রাজ্যের বাইরে। পঞ্চাশের দশকে বাবা আজমল আলির হাত ধরে চলে যান মুম্বাই। সেখানে ক্লাস এইট অবধি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করার পর ধর্মপ্রাণ ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে বদরুদ্দিন উত্তর প্রদেশে ইসলামি শিক্ষার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। মাস্টার্সও করেন ইসলামিক থিওরির ওপর। ধর্মচর্চা, ব্যবসার পাশাপাশি সমাজসেবা ছিল তাঁর মূল বিষয়। শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানির জমিয়তে-উলেমা-হিন্দের প্রতিই তাঁর আস্থা ছিল প্রথম থেকেই। বিশ্বাস করেন, পৃথিবীটা শুধু মুসলিমদের বাসস্থান নয়, বরং সব মানুষের বাসস্থান।
১৯৮২ সালে মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে গড়ে তোলেন এনজিও মারকাজুল-মা-আরিফ। পরে অবশ্য সেই সংগঠনই নাম পাল্টে হয় আজমল ফাউন্ডেশন। চারটি দাতব্য হাসপাতাল ছাড়াও বিভিন্ন সেবাকাজের সঙ্গে যুক্ত এই সংস্থার সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি ২০০২ সালে তিনি জমিয়তের আসাম রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হন।
২০০৫ সালে সংযুক্ত গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট করে ভোট-রাজনীতিতে। পদার্পণ পূর্ব এশিয়া থেকে ইউরোপ, ৩৪টি দেশে বিস্তৃত বিশাল আতর সাম্রাজ্যের অন্যতম কর্ণধার মাওলানা বদরুদ্দিন আজমল। লোকশ্রুতি, মূলত আসামের ৩৬ শতাংশের বেশি সংখ্যালঘু ভোটারই তাঁর ভরসা। অর্থাৎ মুসলিমরাই তাঁর ভোটব্যাংক।
মাওলানা আজমলের ঘরে ঢোকার আগে হিন্দুদের দেখে একটু অবাক হন অনেকেই। ভুল ভাঙলেন তাঁরাই। বললেন, এআইইউডিএফ মুসলিমদের নয়, হিন্দুদেরও দল। বর্তমানে দলের দুজন হিন্দু বিধায়কও আছেন। তাঁরাও এসেছেন বিধানসভার টিকিট পেতে। ঘরের ভেতরে ঢুকেই টিকিটপ্রত্যাশীদের সঙ্গে আলোচনার সূত্র ধরেই এআইইউডিএফ সুপ্রিমোকে প্রশ্ন, ‘শুধুই কি সংখ্যালঘু উন্নয়ন আপনার পুঁজি!’ জবাবে তিনি বললেন, মানুষের জন্য রাজনীতিতে আসা। আসামের উন্নয়নই লক্ষ্য। তবে এবারের ভোটে বিজেপিকে আটকানোই বড় কাজ।
ক্ষমতাসীন কংগ্রেস অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে, বিজেপিকে রুখতে তাদের একক শক্তিই যথেষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেছেন, ‘কারও সঙ্গে জোট চাই না।’
এ প্রসঙ্গে মাওলানা আজমল বলেন, কংগ্রেসের ভেতর বিজেপির এজেন্ট আছে। তাঁরাই জোট চাইছে না। কিন্তু এআইইউডিএফকে বাদ দিয়ে কিচ্ছু করতে পারবে না। তবে এআইইউডিএফও যে একা কিছু করতে পারবে না, সে বিষয়েও শতভাগ নিশ্চিত আজমল নিজেই। জানালেন, ১২৬ সদস্যের রাজ্য বিধানসভায় ৬৬টি আসনে প্রার্থী দেবেন তাঁরা। তবে ভোট-পরবর্তী সরকার গঠনে তাঁদের ভূমিকাটাই বড় হবে বলেও তিনি দাবি করেন। সে ক্ষেত্রেও বিজেপির সঙ্গে কোনো রকম জোটে যাবেন না তাঁরা। তাঁর সাফ কথা, বিজেপির সঙ্গে জোটের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অভিযোগ করলেন, এআইইউডিএফের ইমেজ খারাপ করতে কংগ্রেস অপপ্রচার চালাচ্ছে বিজেপির সঙ্গে তাদের জোটের সম্ভাবনার কথা বলে। তাঁর দাবি, সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির সঙ্গে গোপনেও কোনো আঁতাত তাঁদের হচ্ছে না।
মাওলানা আজমলের অভিযোগ, বিজেপি আসামের সবাইকে ধোঁকা দিচ্ছে। হিন্দুদের খুশি করতে গিয়ে তাঁদের গত লোকসভা ভোটের সময় মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, আপাতত আসাম নিয়েই তাঁর সবচেয়ে বেশি চিন্তা।
তবে এ রাজ্যের নির্বাচনের পর অন্যত্রও সাংগঠনিক ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করবেন।তিনি জানান, ২০০৫-এ দল গঠনের পর ২০০৬-এ ১০টি আসনে আর ১১-তে ১৮টি আসনে জিতেছে দল। গত লোকসভা নির্বাচনে ১৬টির মধ্যে কংগ্রেসের সমান তাঁরাও তিনটা আসনে জয়ী হন। সামর্থ্য অনুযায়ী এবারও ভালো ফলের বিষয়ে আশাবাদী মাওলানা আজমল।
বাইরে তখনো ভিড়। ঘড়ির কাঁটায় সময় রাত ১২টা ৫৫। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দলের সুপ্রিমোর সাক্ষাৎপ্রার্থী। কান পাততেই বোঝা গেল, হিন্দু-মুসলিম বলে কথা নেই। দলও বড় কথা নয়। বেশ কিছু আসনে আজমল সাহেবের আশীর্বাদই ভোট বৈতরণি পার হওয়ার একমাত্র পুঁজি টিকিট-প্রার্থীদের।
-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন