ইমাম হাফেয সুয়ূত্বী রাহিমাহুল্লাহুর পূর্ণনাম-‘জালাল উদ্দীন আবদুর রহমান ইবনুল কামাল, আবূ বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সা-বিক্বুদ্দীন ইবনুল ফখর ওসমান ইবনে নাযিরুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে শায়খ হুমামউদ্দীন। তাঁর জন্ম ১ রজব, ৮৪৯ হিজরী রবিবার রাতে হয়েছিলো। ‘খুদ্বায়রী’ ও ‘আস্ সুয়ূত্বী, ‘সুয়ূত্বী’ সংক্ষেপে এ দু’টি সম্পর্কজনিত শব্দও তাঁর নামের সাথে সংযোজন করা হয়।
তাঁর বংশীয় পরম্পরা এক অনারবীয় খান্দান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তিনি তাঁরই লিখিত কিতাব ‘হুসনুল মুহা-দ্বারাহ্ ফী-আখবা-রি মিসর ওয়াল ক্বাহেরাহ্’য় আত্মজীবনীতে লিখেছেন,
আমাকে এক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি বলেছেন, আমার পিতা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বর্ণনা করতেন যে, আমাদের পূর্বপুরুষ (বংশের মূল পুরুষ) একজন ‘আজমী’ (অনারবীয়) ছিলেন এবং পূর্বাঞ্চলীয় লোক ছিলেন।
ইমাম সুয়ূত্বীর খান্দান মিশরে আসার পূর্বে বাগদাদের মহল্লা ‘খুদ্বায়রিয়্যাহ্’য় বসবাস করতেন। এ মহল্লা বাগদাদের পূর্ব প্রান্তে ইমাম-ই আ’যম রাহিমাহুল্লাহু তা‘আলার মাযার শরীফের নিকটে অবস্থিত। ‘খুদ্বায়রী’ সম্পর্কবাচক উপাধির কারণ এটাই। ইমাম সুয়ূতীর জন্মের কয়েক পুরুষ পূর্বে এ খান্দান ইরাকথেকে মিশর এসেছেন এবং মিশরের ‘আস্য়ূত্ব’ শহরে বসবাস করতেন । সেটার নামও ‘খুদ্বায়রিয়্যাহ্’ রেখে দেন।
ইমাম সুয়ূত্বীর পিতা আস্য়ূত্ব থেকে কায়রো চলে যান। সেখানে তিনি ‘ইবনে তূলূন জামে মসজিদ’-এ খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। সাথে সাথে শায়খূনী জামে মসজিদ সংলগ্ন মাদরাসায় ‘ফিক্বহ’র ওস্তাদ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ৮৫৫ হিজরীতে তাঁর ইনতিক্বাল হয়। তখন ইমাম সুয়ূত্বীর বয়স পাঁচ কিংবা ছয় বছর ছিলো। তখন তাঁর অভিভাবকত্বের দায়িত্ব তাঁর পিতার এক সূফী বন্ধু নিয়েছিলেন। ইমাম সুয়ূত্বী ৮ বছর বয়সে ক্বোরআন করীম হেফয করে নিয়েছিলেন। তারপর তিনি নাহ্ভ ও ফিক্বহ'র ‘মতন’ মুখস্থ করতে মশগুল হন। ইমাম সুয়ূত্বী তাঁর যুগের বহু ওস্তাদ ও মাশাইখ থেকে জ্ঞানার্জন করেন। তাঁদের অধিকাংশের উল্লেখ (আলোচনা )তিনি তাঁর ‘হুসনুলমুহা-দ্বারাহ্’য় করেছেন।
ইমাম সুয়ূত্বী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর যুগে প্রচলিত সমস্ত আরবী ও ইসলামী বিষয়াদির জ্ঞান অর্জন করেন এবং সেগুলোতে পূর্ণ দক্ষতা লাভ করেন। ওইসব বিষয়ে তাঁর লেখনী (গ্রন্থ-পুস্তক)ও রয়েছে। তাঁর প্রণীত গ্রন্থ পুস্তকাদির আধিক্য ও বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর লেখনী অনুসারে তাঁরপর তাঁর মত আর কাউকে দেখা যায়না; এমনকি পূর্ববর্তীদের মধ্যেও হয়তো তাঁর মতো দু/একজন পাওয়া যায় কিনা সংশয় রয়েছে।
তিনি হাদীস ও হাদীস শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়, তাফসীর ও আল্লাহর কিতাব (ক্বোরআন মজীদ) সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়, ফিক্বহ্ ও এর উসূল, কালাম, জদল,ইতিহাস, অনুবাদ, তাসাওফ, সাহিত্য, অলংকার (মা‘আনী, বয়ান ও বদী’) নাহভ, সরফ, অভিধান ও মানত্বিক বিষয়ে শত-সহস্র কিতাব প্রণয়ন করেন। তিনি তাঁর ‘হুস্নুল মুহাদ্বারাহ্’য় লিখেছেন-
এ পর্যন্ত আমার লিখিত কিতাবগুলোর সংখ্যা তিনশ’হয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে ওইসব কিতাব নেই, যেগুলো আমি বিনষ্ট করে ফেলেছি কিংবা যেগুলো আমি প্রত্যাহার করে নিয়েছি।
কিতাবগুলোর এ সংখ্যা ‘হুস্নুল মুহা-দ্বারাহ্’ লিখার সময়কার ছিলো। আর সম্ভবত এত সংখ্যক কিতাব তিনি পরবর্তীতেও লিখেছেন। ‘মুস্তাশ্রিক্ব ফিলোগুল’ তাঁর লিখিত সমস্ত কিতাব গণনা করেছেন। তাঁর পরিসংখ্যান অনুসারে ইমাম সুয়ূত্বীর লিখিত কিতাবগুলোর সংখ্যা ৫৬১।
তাঁর কিতাবগুলোর মধ্যে এমন বহু কিতাব রয়েছে, যেগুলো কয়েক খন্ডে বিন্যস্থ। তন্মধ্যে কিছু কিতাব এমনও রয়েছে, যেগুলো ‘দাওয়া-ইরে মা‘আ-রিফ’ (জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা সম্ভার)-এর মর্যাদা রাখে। পুস্তক প্রণয়ন ও রচনার ময়দানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে যেই সুবর্ণ সামর্থ্য দান করেছেন, তা খুব কম সংখ্যক লোকই পেয়েছেন। আরবী ও ইসলামী জ্ঞানের এমন কোন রাজপথ নেই, যাতে তাঁর পদচারণাপাওয়া যায় না। তাঁকে ‘হাত্বিবুল লায়ল’ (যাচাই বিহীনলোক) বলে যাঁরা সমালোচনা করেন তারাও জ্ঞান, গবেষণা ও বিশেষণের উপত্যকায় তাঁর সাহায্য ছাড়া এক কদমও চলতে পারে না । বাস্তবাবস্থা হচ্ছে-বেশীর ভাগ পূর্ববর্তী ইমামগণের মতো ইমাম সুয়ূতীরও দু’টি যোগ্যতাপূর্ণ অবস্থান রয়েছে-একটি হচ্ছে জ্ঞান-ভান্ডার ও লেখকের আর অপরটি হচ্ছে-গভীর গবেষক ও বিশষক এবং সূক্ষ্ণদর্শী (মুহাক্বক্বিক্ব ও মুদাক্বক্বিক্ব)-এর । ইমাম সুয়ূতীর জন্য সাধারণভাবে ‘হাত্বিবুল লায়ল’ (নির্বিচারে উদ্ধৃতকারী লেখক) উপাধি ব্যবহারকারীগণ তাঁর এ দু’টি মর্যাদাপূর্ণ স্তরের মধ্যে পার্থক্য করতে অক্ষম এবং র্প্বূবর্তী ইমামগণের উন্নত রুচি ও পদ্ধতি সম্পর্কেও কম অবগত।
ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী দীর্ঘদিন যাবৎ প্রসিদ্ধ ‘খানক্বাহ্-ই বায়বার্সিয়া’র ‘ওয়াক্বফ এস্টেট’-এর মহাব্যবস্থাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তদানীন্তনকালে এটা মিশরের সর্বাপেক্ষা বড় খানকাহ ছিলো;কিন্তু যখন সুলতান মুহাম্মদ ক্বাতবাঈ মিশরের শাসন-ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন ভন্ড সূফীদের একটি দল সুলতানের নিকট ইমাম সুয়ূত্বীর বিপক্ষে কিছু অমূলক অভিযোগ করেছিলো। এতদ্ভিত্তিতে সুলতান তাঁকে উক্ত পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। এ অপসারণের পর থেকে তিনি দুনিয়া ও এর সমস্ত সম্পর্ক থেকে নিজে নিজে অবসর গ্রহণ করেন এবং লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। এমন একাকীত্বের মধ্যে ইমাম সুয়ূতী তাঁর বেশীরভাগ কিতাব রচনা করেন। তাঁর এ একাক্বীত্বও জ্ঞানগত ই’তিকাফ তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। এ বিশ বছর ব্যাপী সময়সীমায় তিনি লোকজনের সাথে মেলামেশা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি তাঁর ঘরের নীল নদের দিকে খোলা হয় এমন জানালাগুলোও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আর নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে ইসলামী ও আরবী জ্ঞানচর্চা, এগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা এবং গ্রন্থ-পুস্তক রচনা ও প্রণয়নের মধ্যে অতিবাহিত করেন। ৯১১ হিজরীতে এ যুগশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও গুণী ইমামের ইনতিক্বাল হয়েছে। আল্লাহ তাঁর উপর রহমতের বারি বর্ষণ করুন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন