২০০৮ সালের শেষের দিকের কথা।
পাঁচ-ছয়জনের একটি দল চেন্নাই থেকে আমরা দিল্লি হয়ে আজমির শরিফ গেলাম। সারা জীবন আজমিরের কথা দূর থেকেই শুনে এলাম। সেদিন কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হল। খাজা মুইনুদ্দিন চিশতি রহ. এর মাজার জিয়ারত করার সুযোগ পেলাম। মাজারের দুই পাশে দু’টি ইয়া বড় পাতিল রাখা আছে। আপনি দেখলে ভিমড়ি খাবেন। সিঁড়ি বেয়ে পাতিলে চাল-ডাল, টাকা-পয়সা ঢালতে হয়। সেখানে বরকতের (?) খিচুড়ি রান্না করা হয়; যে যে নিয়তে খাবে, নিয়ত পূরণ হতে বাধ্য (!)। নিজ চোখে দেখলাম, ওই অমৃতস্বাদের খিচুড়ির পাতিলে তেল, মসলা ইত্যাদি ঢালা হচ্ছে, একটু পরে দেখলাম বস্তার মুখ খুলে সরাসরি চাউল ঢেলে দিচ্ছে ইয়া মোটামোটা খাদেমগণ।
মাজারের পশ্চিমকোণে অর্ধবয়সী এক নারীকে দেখলাম চিৎকার করে কাঁদছে। কাপড়চোপড়ের কোনো খবর নেই। তার এক আত্মীয়কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, বাবার কাছে বাচ্চার জন্য কাঁদছে। এরকম মানুষ একজন দুইজন না, হাজারো, লাখো।
.
মানুষের জীবনে সুখ যেমন আসে, আসে দুঃখও। আনন্দ যেমন আছে, আছে নিরানন্দও। সমস্যা ও কষ্টকে সঙ্গে করেই জীবনযাপন করতে হয়। সবার জীবনেই যে সবদিক দিয়ে সুখে-আনন্দে ভরপুর- তা নয়। কেউ বিশাল সম্পত্তি ও বিত্তবৈভবের মালিক; কিন্তু জটিল রোগে আক্রান্ত। কিংবা সন্তান হচ্ছে না। আবার কারো চাকরিবাকরি হচ্ছে না। কারো কাছে টাকাপয়সা নেই। অনেকের টাকা আছে কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মিল নেই। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক সমস্যা, ছেলেমেয়ে কথা শুনে নাÑ ইত্যাকার নানা সমস্যায় জর্জরিত মানুষের জীবন।
ভ- ও শরিয়তবিরোধী পীরেরা সাধারণ মানুষকে বোঝায় এসব সমস্যার সমাধান পীরের হাতে রয়েছে। পীর সাহেব ইচ্ছা করলে কাউকে সন্তান দিতে পারেন, ইচ্ছা করলে কারো ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতির জোয়ার বইয়ে দিতে সক্ষমÑ ইত্যাতি ইত্যাদি।
এই আকিদা ও বিশ্বাস পোষণ করা সুস্পষ্ট শিরক। কারণ, সকল সমস্যার সমাধান একমাত্র আল্লাহ তাআলাই দিতে পারেন। অন্য কারো হাতে এ ক্ষমতা নেই। না কোনো নবীর হাতে, না কোনো ফেরেশতার হাতে। সুতরাং পীরের হাতে ওই ক্ষমতা থাকার তো কোনো প্রশ্নই উঠে না।
আমরা মনে করি, আল্লাহ তাআলাকে অবিশ্বাস করাই কেবল শিরক। না, আল্লাহ তাআলাকে অস্বীকার করা কুফুরি, শিরক না। শিরক তো হচ্ছে, আল্লাহ তাআলাকে সৃষ্টিকর্তা বলে স্বীকার করার পর আল্লাহর ক্ষমতায় অন্য কারো অংশীদারত্বকে মেনে নেওয়া। আল্লাহ তাআলার বিশেষকিছু ক্ষমতা, শক্তি ও গুণাবলি রয়েছে, এগুলোতে কেউ শরিক বা অংশীদার নেই। যেমন : অদৃশ্যের সংবাদ জানা, সর্বত্র বিরাজমান থাকা, বালামুসিবত ও সমস্যা দূরীভূত করা, বান্দার গোনাহ মাফ করে দেওয়া, সন্তানাদি দান করা, কুল মাখলুকাতকে একই মুহূর্তে পর্যবেক্ষণ করা ও নখদর্পণে রাখো।
শিরকের নিন্দা, শিরকের ভয়াবহতা, শিরকের সংজ্ঞা ও বিস্তারিত পরিচয় জানতে আকিদার কিতাবাদি অধ্যয়ন করা উচিত। বিশেষত মাও. শাহ মুহাম্মদ ইসমাইল শহীদ রহ. রচিত ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থটি পড়ার জন্যে বিনীত অনুরোধ করছি।
উপর্যুক্ত আকিদার পক্ষে কুরআনে কারিমের অসংখ্য আয়াত ও অগণিত হাদিস রয়েছে। সবগুলো জমা করলে কলেবর অনেক বড় হয়ে যাবে। একটি আয়াতে সরাসরি নবীকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
-হে নবী! আপনি ঘোষণা করে দিন : আমি আমার নিজের কল্যাণ ও অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে সক্ষম হতাম। ফলে আমার কোনো অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো কেবল একজন ভীতিপ্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা ঈমানদারদের জন্য। [সূরা আরাফ : ১৮৮]
আমাদের নবী সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার পরও যদি তাঁর হাতে কোনো কল্যাণ-অকল্যাণ এবং গায়েবের সংবাদ না থাকে, তাহলে কোনো ইমাম, পীর-বুযুর্গ বা ওলির হাতে থাকে কীভাবে? বস্তুত আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কোনো মাখলুকের হাতে এসবের কোনো ক্ষমতা নেই।
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
مَا يَفْتَحِ اللَّهُ لِلنَّاسِ مِنْ رَحْمَةٍ فَلَا مُمْسِكَ لَهَا وَمَا يُمْسِكْ فَلَا مُرْسِلَ لَهُ مِنْ بَعْدِهِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
-আল্লাহ মানুষের জন্য অনুগ্রহের মধ্য থেকে যা খুলে দেন, তা ফেরাবার কেউ নেই এবং তিনি যা বারণ করেন, তা কেউ প্রেরণ করতে পারে না তিনি ব্যতীত। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। [সূরা ফাতির : ২]
অপর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে :
وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (১৭) وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْخَبِيرُ
আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোনো কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী কেউ নেই। পক্ষান্তরে যদি তোমার মঙ্গল করেন, তবে তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। তিনিই পরাক্রমশালী স্বীয় বান্দাদের ওপর। তিনিই জ্ঞানময়, সর্বজ্ঞ। [সূরা আনআম : ১৭, ১৮]
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে মাআরেফুল কুরআনে বিধৃত হয়েছে :
‘উপরের আয়াতে ইসলামের একটি মৌলিক বিশ্বাস বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি লাভ-ক্ষতির মালিক আল্লাহ তাআলা। সত্যিকারভাবে কোনো ব্যক্তি কারও সামান্য উপকারও করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না। আমরা বাহ্যত একজনকে অপরজন দ্বারা উপকৃত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখি। এটি নিছক একটি বাহ্যিক আকার। সত্যের সামনে একটি পর্দার চাইতে বেশি এর কোনো গুরুত্ব নেই।
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম বগভি একটি হাদিস বর্ণনা করেন :
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ وَلَا أَحْفَظُ حَدِيثَ بَعْضِهِمْ عَنْ بَعْضٍ أَنَّهُ قَالَ كُنْتُ رَدِيفَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ يَا غُلَامُ أَوْ يَا غُلَيِّمُ أَلَا أُعَلِّمُكَ كَلِمَاتٍ يَنْفَعُكَ اللَّهُ بِهِنَّ فَقُلْتُ بَلَى فَقَالَ احْفَظْ اللَّهَ يَحْفَظْكَ احْفَظْ اللَّهَ تَجِدْهُ أَمَامَكَ تَعَرَّفْ إِلَيْهِ فِي الرَّخَاءِ يَعْرِفْكَ فِي الشِّدَّةِ وَإِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلْ اللَّهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ قَدْ جَفَّ الْقَلَمُ بِمَا هُوَ كَائِنٌ فَلَوْ أَنَّ الْخَلْقَ كُلَّهُمْ جَمِيعًا أَرَادُوا أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَكْتُبْهُ اللَّهُ عَلَيْكَ لَمْ يَقْدِرُوا عَلَيْهِ وَإِنْ أَرَادُوا أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَكْتُبْهُ اللَّهُ عَلَيْكَ لَمْ يَقْدِرُوا عَلَيْهِ وَاعْلَمْ أَنَّ فِي الصَّبْرِ عَلَى مَا تَكْرَهُ خَيْرًا كَثِيرًا وَأَنَّ النَّصْرَ مَعَ الصَّبْرِ وَأَنَّ الْفَرَجَ مَعَ الْكَرْبِ وَأَنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একবার রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটে সওয়ার হয়ে আমাকে পেছনে বসিয়ে নিলেন। কিছু দূর চলার পর আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন : হে বৎস! আমি আরজ করলাম, আরজ করুন আমি হাজির আছি। তিনি বললেন : তুমি আল্লাহকে স্মরণ রাখবে, আল্লাহ তোমাকে স্মরণ রাখবেন। তুমি আল্লাহকে স্মরণ রাখলে সর্বাবস্থায় তাঁকে সামনে দেখতে পাবে। তুমি শান্তি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দের সময় আল্লাহকে স্মরণ রাখলে বিপদের সময় তিনি তোমাকে স্মরণ রাখবেন। কোনো কিছু যাঞ্চা করতে হলে তুমি আল্লাহর কাছেই যাঞ্চা কর এবং সাহায্য চাইতে হলে আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাও। জগতে যা কিছু হবে, ভাগ্যের লেখনী তা লিখে ফেলেছে। তোমার ভাগ্যে আল্লাহ লেখেননিÑ তোমার এমন কোনো উপকার করতে সমগ্র সৃষ্টজীব সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে, তারা কখনও তা করতে পারবে না। পক্ষান্তরে যদি তারা সবাই মিলে তোমার এমন কোনো ক্ষতি করতে চায়Ñ যা তোমার ভাগ্যে নেই, তবে কখনই তারা তা করতে সক্ষম হবে না। যদি তুমি বিশ্বাস সহকারে ধৈর্যধারণ করতে পার তবে অবশ্যই তা কর। সক্ষম না হলে ধৈর্য ধর। কেননা, স্বভাব-বিরুদ্ধ কাজে ধৈর্য ধরার মধ্যে অনেক মঙ্গল রয়েছে। মনে রাখবে, আল্লাহর সাহায্য ধৈর্যের সাথে জড়িত। কষ্টের সাথে সুখ এবং অভাবের সাথে স্বাচ্ছন্দ্য জড়িত। [মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং- ২৮০৩; তিরমিযি, হাদিস নং- ২৫১৬]
পরিতাপের বিষয়, কুরআন পাকের এ সুস্পষ্ট ঘোষণা এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আজীবনের শিক্ষা সত্ত্বেও মুসলমানরা এ ব্যাপারে পথভ্রান্ত। তারা আল্লাহ তাআলার সব ক্ষমতা সৃষ্টজীবের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছে। আজ এমন মুসলমানের সংখ্যা নগণ্য নয়, যারা বিপদের সময় আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করে না; বরং তারা তাঁর কাছে দুআ করার পরিবর্তে বিভিন্ন নামের দোহাই দেয় এবং তাদেরই সাহায্য কামনা করে। তারা আল্লাহ তাআলার প্রতি লক্ষ্য করে না। পয়গম্বর ও ওলিদের ওসিলায় দুআ করা ভিন্ন কথা। এটা জায়েয। স্বয়ং নবী কারিম সা. এর শিক্ষায় এর প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু সরাসরি কোনো সৃষ্টজীবকে অভাব পূরণের জন্যে ডাকা এ কুরআনি নির্দেশের পরিপন্থী ও প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণার নামান্তর। আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের সরল পথে কায়েম রাখুন।’ [তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন, সৌদি থেকে প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত তাফসির ও অনুবাদ : পৃ. ৩৭১]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন