জুমুআর ফরজ নামায দুই রাকাত। ফরজের আগে চার রাকাত সুন্নত আর ফরজের পর দুই রাকাত অথবা চার রাকাত অথবা ছয় রাকাত সুন্নত পড়া যায়। কেননা, এই তিন ধরনের আমলই রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে। বিভিন্ন সময়ে তিনি তিন ধরনের আমল করেছেন। তবে উত্তম হচ্ছে ছয় রাকাত পড়া। কেননা, তখন পূর্ণ সওয়াব পাওয়া যাবে নিশ্চিত। কেউ যদি খুতবা বা বয়ান চলাকালীন মসজিদে আসে তাহলে সুন্নত না পড়ে অপেক্ষা করবে, বয়ান বা খুতবা শেষ হলে পড়ে নিতে পারে। যদি সুযোগ না থাকে তাহলে ফরজের পরে পড়তে পারে। [তবে খুতবা চালাকালীন সুন্নত/নফল পড়ার হাদিস দিয়ে নিয়ম বানানো যাবে না; ওই হাদিস সম্পর্কে স্বতন্ত্র আলোচনা করা দরকার] যেমন নাকি জোহরের ফরজের পূর্বের চার রাকাত না পড়তে পারলে ফরজের পড়ে পড়ার অবকাশ রয়েছে। অনেকে বলতেছেন, জুমুআর ফরজের পূর্বে কোনো সুন্নত নামায নেই; তাদের কথা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ, অনেক হাদিসের মধ্যে জুমুআর পূর্বে নামাযের কথা রয়েছে। নিচের হাদিসগুলো লক্ষ্য করুন :
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « مَنِ اغْتَسَلَ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَصَلَّى مَا قُدِّرَ لَهُ ثُمَّ أَنْصَتَ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ خُطْبَتِهِ ثُمَّ يُصَلِّىَ مَعَهُ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الأُخْرَى وَفَضْلَ ثَلاَثَةِ أَيَّامٍ ».
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : যে ব্যক্তি গোসল করার পর জুমুআয় এসে তার তাওফিক অনুসারে (নফল) নামায পড়ে এরপর ইমামের খুতবা শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকে এবং ইমামের সঙ্গে নামায পড়ে; তাহলে আল্লাহ তাআলা তার এক জুমুআ থেকে অপর জুমুআ এবং অতিরিক্ত তিন দিনের গোনাহ (সগিরা) মাফ করে দেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ২০২৪; মুসনাদুস সাহাবাহ, হাদিস নং- ৫৪০)
عَنْ عَطَاءٍ الْخُرَاسَانِىِّ، قَالَ: (كَانَ) نُبَيْشَةُ الْهُذَلِىُّ يُحَدِّثُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم: "أَنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا اغْتَسَلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ، ثُمَّ أَقْبَلَ إِلَى الْمَسْجِدِ لا يُؤْذِى أَحَدًا، فَإِنْ لَمْ يَجِدِ الإِمَامَ خَرَجَ، صَلَّى مَا بَدَا لَهُ، وَإِنْ وَجَدَ الإِمَامَ قَدْ خَرَجَ، جَلَسَ فَاسْتَمَعَ وَأَنْصَتَ حَتَّى يَقْضِىَ الإِمَامُ جُمُعَتَهُ وَكَلاَمَهُ، إِنْ لَمْ يُغْفَرْ لَهُ فِى جُمُعَتِهِ تِلْكَ ذُنُوبُهُ كُلُّهَا؛ أَنْ تَكُونَ كَفَّارَةً لِلْجُمُعَةِ الَّتِى تَلِيهَا.
তাবেয়ি আতা খুরাসানি রহ. নুবাইশা হুজাইলি রা. থেকে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস বর্ণনা করেন : মুসলমান যখন জুমুআর দিন গোসল করে মসজিদে গমন করে, কাউকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকে, ইমাম খুতবার জন্যে বের হয়নি দেখে যে পরিমাণ ইচ্ছা নামায পড়ে, আর ইমাম বের হয়ে থাকলে বসে যায় ও চুপচাপ শুনতে থাকে; অবশেষে ইমামের নামায ও বক্তব্য শেষ হয়ে যায়, তাহলে এ ব্যক্তির এই সপ্তাহের সকল গোনাহ মাফ না হলেও আগামী জুমুআর জন্যে তা কাফফারা হয়ে যায়। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং- ২০৭২১; কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ২১২৮৭; জামেউল আহাদিস, হাদিস নং- ৭৪২৮)।
عَنْ سَلمَان - رضي الله عنه - ، قَالَ : قَالَ رسول اللهِ - صلى الله عليه وسلم - : (( لاَ يَغْتَسِلُ رَجُلٌ يَومَ الجُمُعَةِ ، وَيَتَطَهَّرُ مَا اسْتَطَاعَ مِن طُهْرٍ ، وَيَدَّهِنُ مِنْ دُهْنِهِ ، أَوْ يَمَسُّ مِنْ طِيبِ بَيْتِهِ ، ثُمَّ يَخْرُجُ فَلاَ يُفَرِّقُ بَيْنَ اثنَيْنِ ، ثُمَّ يُصَلِّي مَا كُتِبَ لَهُ ، ثُمَّ يُنْصِتُ إِذَا تَكَلَّمَ الإمَامُ ، إِلاَّ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الجُمُعَةِ الأُخْرَى ))
হযরত সালমান ফারসি রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : কোনো পুরুষ যখন জুমুআর দিনে গোসল করার পর সাধ্যমতো পবিত্রতা অর্জন করে, ঘরে যে তৈল বা সুগন্ধি রয়েছে তা ব্যবহার করে; এরপর মসজিদের জন্যে বের হয় এবং (বসার উদ্দেশ্যে) দুইজনকে আলাদা করে না, অতঃপর তাওফিক অনুসারে নামায পড়ে, তারপর ইমাম কথা বলার সময় চুপ থাকে, তাহলে তার দুই জুমুআর মধ্যবর্তী সময়ের (সগিরা) গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৮৮৩; মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং- ২৩৭১০; কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ২১২৩৯)।
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « مَنِ اغْتَسَلَ ثُمَّ أَتَى الْجُمُعَةَ فَصَلَّى مَا قُدِّرَ لَهُ ثُمَّ أَنْصَتَ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ خُطْبَتِهِ ثُمَّ يُصَلِّىَ مَعَهُ غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الأُخْرَى وَفَضْلَ ثَلاَثَةِ أَيَّامٍ ».
হযরত আবু হুরায়রা রা. রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : যে ব্যক্তি গোসল করার পর জুমুআর উদ্দেশে মসজিদে এসে স্বীয় তাওফিকমতো নামায পড়ে, তারপর ইমাম খুতবা থেকে অবসর হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকে অতঃপর ইমামের সঙ্গে নামায আদায় করে, তাহলে তার আগামী সপ্তাহের জুমুআ পর্যন্ত এবং অতিরিক্ত আরো তিন দিনের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ২০২৪; জামেউল আহাদিস, হাদিস নং- ২১৩৮৯)।
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ وَأَبِي هُرَيْرَةَ قَالَا قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ اغْتَسَلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَاسْتَاكَ وَمَسَّ مِنْ طِيبٍ إِنْ كَانَ عِنْدَهُ وَلَبِسَ مِنْ أَحْسَنِ ثِيَابِهِ ثُمَّ خَرَجَ حَتَّى يَأْتِيَ الْمَسْجِدَ فَلَمْ يَتَخَطَّ رِقَابَ النَّاسِ ثُمَّ رَكَعَ مَا شَاءَ أَنْ يَرْكَعَ ثُمَّ أَنْصَتَ إِذَا خَرَجَ الْإِمَامُ فَلَمْ يَتَكَلَّمْ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ صَلَاتِهِ كَانَتْ كَفَّارَةً لِمَا بَيْنَهَا وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ الَّتِي قَبْلَهَا قَالَ وَكَانَ أَبُو هُرَيْرَةَ يَقُولُ وَثَلَاثَةُ أَيَّامٍ زِيَادَةٌ إِنَّ اللَّهَ جَعَلَ الْحَسَنَةَ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا
হযরত আবু সাইদ খুদরি ও হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : যে ব্যক্তি জুমুআর দিন গোসল করে, মিসওয়াক করে, সুগন্ধি থাকলে ব্যবহার করে, নিজের একটি উত্তম পোশাক গায়ে দেয়, এরপর রওয়ানা দিয়ে মসজিদে আসে এবং মানুষের কাঁধ ডিঙ্গায় না, এরপর যে পরিমাণ ইচ্ছা নামায পড়ে। অতঃপর ইমাম সাহেব আসার পর থেকে নামায পড়া পর্যন্ত কথা বলে না, তাহলে এই জুমুআ থেকে আগামী জুমুআ পর্যন্ত গোনাহের কাফফারা হয়ে যায়। হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, এর সঙ্গে আরো তিন দিনের গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। কারণ, আল্লাহ তাআলা নেক আমলকে দশ গুণ বৃদ্ধি করে দেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং- ১১১৭৬৮; শরহু মাআনিল আসার, হাদিস নং- ২০০৪)।
উপরে বিধৃত হাদিসের অর্থবোধক আরো অনেক হাদিস রয়েছে যার দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, জুমুআর আগে সুন্নত নামায রয়েছে। তবে রাকাতের সংখ্যা অন্যান্য হাদিস এবং সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্যে (আসারে) উল্লেখ রয়েছে। যথা :
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَرْكَعُ قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا لَا يَفْصِلُ فِي شَيْءٍ مِنْهُنَّ
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমুআর পূর্বে এক সালামে চার রাকাত পড়তেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং- ১২২৯; কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ১৭৯৬৬; মুসনাদুস সাহাবাহ, হাদিস নং- ৫১৯)।
عن أيوب قال قلت لنافع أكان بن عمر يصلي قبل الجمعة فقال قد كان يطيل الصلاة قبلها ويصلي بعدها ركعتين في بيته ويحدث أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يفعل ذلك
হযরত আইউব রহ. বলেন, আমি নাফেকে জিজ্ঞেস করলাম, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. জুমুআর পূর্বে নামায পড়তেন? সে উত্তরে বলল, তিনি জুমুআর পূর্বে চার রাকাত দীর্ঘ নামায আদায় করতেন এবং জুমুআর পরে ঘরে গিয়ে দুই রাকাত পড়তেন। আর ইবনে ওমর রা. বলতেন, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপই করতেন। (التبويب الموضوعي للأحاديث খ. ১, পৃ. ৩৩৯৩; সহিহ ইবনে খুজাইমা : ৩/১৬৮, হাদিস নং- ১৮৩৬)।
عن جبلة بن سحيم عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما أنه : كان يصلى قبل الجمعة أربعا لا يفصل بينهن بسلام ثم بعد الجمعة ركعتين ثم أربعا
হযরত জাবালা ইবনে সুহাইম রহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি জুমুআর আগে এক সালামে চার রাকাত পড়তেন। জুমুআর পরে প্রথমে দুই রাকাত তারপর চার রাকাত পড়তেন। (শরহু মাআনিল আসার, হাদিস নং- ১৮১৬)।
عَن عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ أَنَّهُ كَانَ يُصَلِّي قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا وَبَعْدَهَا أَرْبَعًا
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি জুমুআর আগে চার রাকাত এবং জুমুআর পরে চার রাকাত পড়তেন। (তিরমিযি, ৫২৩ নং হাদিসের অধীনে; মুসনাদুস সাহাবাহ, হাদিস নং- ৫৪২)।
عمرو بن سعيد بن العاص عن أبيه قال: كنت ألقى أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم فإذا زالت الشمس قاموا فصلوا أربعا
২২২. তাবেয়ি আমর ইবনে সাঈদ ইবনুল আস রহ. স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করে, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিদের দেখেছি তারা সূর্য ঢলে যাওয়ার পর চার রাকাত পড়তেন। (আলমুগনি : ৪/২২০)।
عَنْ إِبْرَاهِيمَ ، قَالَ : كَانُوا يُصَلُّونَ قَبْلَهَا أَرْبَعًا.
২২৩. হযরত ইবরাহিম নাখয়ি রহ. বলেন, পূর্বসূরিগণ জুমুআর আগে চার রাকাত নামায পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস নং- ৫৪০৫)।
.
জুমুআর সময় হচ্ছে জোহরের সময়। সুতরাং জোহরের পূর্বে যেমন সুন্নত রয়েছে তদ্রƒপ জুমুআর আগেও সুন্নত থাকবে। এ কারণেই ইমাম বুখারি রহ. স্বীয় সহিহ বুখারি শরিফে كان يصلي قبل الظهر ركعتين وبعدها শিরোনাম দিয়ে হাদিস এনেছেন : كان يصلي قبل الظهر ركعتين وبعدها
তাছাড়া ইবনে রজব হাম্বলি রহ. বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেন : وقد اختلف في الصلاة قبل الجمعة: هل هي من السنن الرواتب كسنة الظهر قبلها، أم هي مستحبة مرغب فيها كالصلاة قبل العصر؟ وأكثر العلماء على أنها سنة راتبة، منهم: الأوزاعي والثوري وأبو حنيفة وأصحابه، وهو ظاهر كلام أحمد، وقد ذكره القاضي أبو يعلى في " شرح المذهب " وابن عقيل، وهو الصحيح عند أصحاب الشافعي. (ফাতহুল বারী লিবনে রজব হাম্বলি : ৫/৫৪১)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন