ইবন সায়ফুদ্দিন মুহাদ্দিছ দিহ্লাবী আল বুখারী আল কাদিরি আবুল মাজ্দ; দিল্লীতে জন্ম, মুহাররাম ৯৫৮/ জানুয়ারি ১৫৫১ । তাঁর অপর কবি নাম আবদুল হাক্ক হাক্কী । তাহার পূর্বপুরুষগন বুখারার অধিবাসী ছিলেন । পূর্বপুরুষগনদের মধ্যে আগা মুহাম্মাদ তুর্কি বুখারী এবং সুলতান মুহাম্মাদ আলাউদ্দিন খিলজির নাম উল্লেখযোগ্য । তাঁর পিতা শায়খ সাইফুদ্দিন দেহলভী ছিলেন নিতান্ত ধার্মিক এবং আধ্যাত্নিক ব্যক্তিত্ব; যিনি কাদেরিয়া ছিলছিলার হজরত শায়খ আমানুল্লাহর খলিফা ছিলেন । আবদুল হক মহান আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে প্রেরিত একাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ । হাদিসে বর্নিত আছে
নিশ্চয় মহান আল্লাহ পাক প্রতি হিজরী শতকের শুরুভাগে এ উম্মতের হিদায়েতের জন্য একজন মুজাদ্দিদ প্রেরণ করবেন, যিনি দ্বীনের তাজদীদ করবেন।— আবু দাউদ শরীফ, মিশকাত শরীফ, দাইলামী শরীফ
বহু গ্রন্থের রচয়িতা আবদুল হক (রহঃ) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে মুহাদ্দিসদের মধ্যে অগ্রদূত । তাঁর প্রচেষ্টায় ভারতীয় উপমহাদেশে হাদীছশাস্ত্রের চর্চা জনপ্রিয় হয়ে উঠে ।
আবদুল হক মুহাদ্দেসে দেহলভী(রহঃ) এর দ্বীনী শিক্ষার হাতেখড়ি হয় তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতার মাধ্যমে । তিনি পবিত্র কোরআন সম্পূর্ন হিফয করেন মাত্র ৩ মাস সময় নিয়ে । কিতাব পাঠে তাহার মত নিবেদিত মনিষী ইতিহাসে বিরল । দৈনিক ২০-২২ ঘণ্টা বিভিন্ন কিতাব পাঠে সময় দিতেন । যার ফলে মাত্র ৭/৮ বছর সময়ে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করতে সমর্থ হন । তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ তাঁর এলেমের গভীরতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন । তেরো বৎসর বয়সে তিনি ইসলামিক আক্বাইদ এর খুঁটিনাটিসহ জটিল জটিল বিষয়াদি অধ্যায়ন সমাপ্ত করেন । ১৮ বৎসর বয়সে এলেমের বিভিন্ন শাখা থেকে এলেমের নূর তিনি হাসিল করেন । ঈর্ষনীয় স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি । তাহার বাল্যকালের ঘটনাসমূহ তিনি এমনভাবে বর্ননা করতেন যেন মনে হত গতকালেরই কোন ঘটে যাওয়া ঘটনা । ইলমুল ফারাইয, ইলমুল আক্বাইদ, ইলমুল ফিকাহ্ সহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি পারদর্শী ছিলেন । এলমে বাতেন তথা আধ্যাত্নিক শিক্ষা অর্জন করেন তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা সাইফুদ্দিন দেহলভী (রহঃ) এর নিকট থেকে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
শিক্ষা লাভের জন্য মক্কা গমন
তৎকালীন মুঘল শাসক আকবরের সময়কাল ছিল ইসলামের সংকটকাল । ক্ষমতার প্রভাবে অন্ধ আকবর ইসলাম ধর্মকে নিজের মত করে পরিবর্তন করতে সচেষ্ট ছিলেন । শায়েখ (রহঃ) এর উত্তরোত্তর প্রভাব লক্ষ্য করে আকবর নানান ছলে শায়েখের ক্ষতি করার চেষ্ঠা করেন । কিন্তু রাসূল পাক (সঃ) এর আশেক শায়েখ (রহঃ) স্বীয় পথে অবিচল থাকেন । ৯৯৬ হিজরিতে আরও ব্যাপক এলেম হাসিলের নিয়তে তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন । সেখানে তিনি শায়েখ আবদুল হক ওয়াহাব মুত্তাকী (রহঃ) এর তত্ত্বাবধানে বুখারী, মুসলিম, মেশকাত শরীফ এবং তাসাউফের গভীর সাধনায় নিমজ্জিত হন । তাহাদের বৃত্তান্ত যাদুল-মুত্তাকীন পুস্তকে পাওয়া যায় । এরপর তিনি তাঁর মোর্শেদের অনুমতিক্রমে মদিনায় ভ্রমণ করেন এবং সেখানে এক বছর অবস্থান করেন । মদিনায় অবস্থানকালে মদিনার সম্মানার্থে তিনি খালি পায়ে চলাফেরা করতেন । তিনি চারবার হুজুর পাক (সঃ) এর সাথে স্বপনে সাক্ষাত করেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায় ।
আধ্যাত্নিক শিক্ষা
তাঁর আধ্যাত্নিক সাধনার শুরু হয় তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতার হাতে । অতঃপর তিনি হযরত মুসা পাক শহীদ মুলতান (রহঃ) এর কাছে বায়াত হন । মক্কায় তিনি বায়াত হন শায়েখ আবদুল হক ওয়াহাব মুত্তাকী (রহঃ) এর হাতে । দিল্লি প্রত্যাবর্তনের পর তিনি হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ (রহঃ) এর হাতে বায়াত হন নকশাবন্দিয়া তরিকায় । তিনি একাধারে কাদিরিয়া, নকশাবন্দিয়া, সাজয়ীলিয়া ও মাদানীয়া তরীকার অনুসারী ছিলেন । ভারতে এসময় মুহাম্মাদ জৌনপুরী নামে এক মৌলভি বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেন এবং ইসলামের নামে অপব্যাখ্যা করতে থাকেন । তিনি দাবী করেন ইবাদতের মাধ্যমে যে কেউ রাসূল পাক (সঃ) এর মর্তবায় পৌঁছান সম্ভব । শায়খ মুহাদ্দিস দেহলভী, হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী, ইবনে হাজার মক্কী এবং হযরত আলী মুত্তাকী (রহঃ) এর দৃঢ় প্রচেষ্টায় এরকম অনেক ভ্রান্ত দাবী পরাভূত হয় । শায়েখ (রহঃ) সুন্নতের উপর কঠিনভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সুন্নাতের উপরেই চলেছেন ।
মোজাহেদা
সম্রাট আকবর সে সময় সূর্য পূজাকে জায়েজ ঘোষণা করেছিলেন । তিনি মিরাজকে অস্বীকার করতেন । নিজের পছন্দসই ধর্ম দ্বীন-ই-ইলাহী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । এছাড়া ইসলামের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে আকবর অনৈতিক হস্তক্ষেপ করেছিলেন । শায়েখ (রহঃ) আকবরের বিপক্ষে কলম ধরলেন । প্রতিষ্ঠা করলেন ইসলামিক প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম । অবশ্য আকবর পরবর্তী বাদশাহ জাহাঙ্গীর তাহার জ্ঞান-গরিমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন [1] । জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান অনেক সময় তাহার সুপারিশে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদের অভাব পূরণ করেন [2] । তাফসীর, যুক্তিবিদ্যা, তাজবিদ, তাসাউফ, ইতিহাস, খুতবাত্, হাদিস, ইখলাক, মাকাতিব, আকাঈদ, ব্যাকরণ, কবিতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে মোট ৬০ খানা কিতাব রচনা করেছেন । তিনি জনাব শায়খ আসাদুদ্-দীন শাহ্ আবুল-মা’আলীর সহিত সাক্ষাত করিবার জন্য লাহোর গমন করেন এবং বিশ দিন তাহার সাহচর্যে ছিলেন । শাহ্ আবুল-মা’আলীর অনুরোধে তিনি ফুতুহুল গায়ব পুস্তকের ফারসি তরজমা করেন এবং ব্যাখ্যা লিখেন[3]।
ওফাত
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র হিজরি ১০৫২ এর ২১ রবিউল আউয়াল পর্দার অন্তরাল হন । তাহার মাযার দিল্লীর হাওজ-শামসীর নিকট অবস্থিত । দেওয়ালের উপর একটি ফলকে সংক্ষেপে শায়খের জীবনী উৎকীর্ন রহিয়াছে । শায়খের যেসব বংশধর দিল্লিতে বসবাস করেন তাহারা এখনো প্রতি বৎসর তাহার উড়স পালন করেন ।
লিখিত মূল্যবান কিতাব
তাহার সুযোগ্য পুত্র নুরুল-হাক মহান পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া অধ্যাপনা ও গ্রন্থ রচনায় ব্যপৃত থাকেন । তাহার অন্য এক পুত্র আলী মুহাম্মাদ “ফরহাঙ্গ জামিউল-জাওয়ামী” নামে একখানা অভিধান সঙ্কলন করেন । মহান শায়খ তাহার তালীফুল-কালবিল-আলিফ-বি-কিতাবাত ফিহ্রিস্তিত্-তাওয়ালীফ-এর সহিত একটি পুস্তিকা সংযোজিত করিয়া দিয়াছেন যাহাতে দিল্লির সাহিত্যিক ও কবিদের উল্লেখ রহিয়াছে [4] । এই পুস্তিকায় তিনি আরবী ও ফার্সী ভাষায় রচিত তাহার ৪৯ খানা গ্রন্থের তালিকা দিয়াছেন । উহাদের শেষ পুস্তকখানা পত্রাবলীর সংগ্রহ যাহা কিতাবুল-মাকাতিব ওয়ার-রাসাইল নামে মুদ্রিত হইয়াছে । লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজের অধ্যাপক ওয়াযীরুল-হাসান ‘আবিদীর নিকট উক্ত পত্রাবলীর তুলনাকৃত একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষিত আছে । এই পুস্তকে ৫৭ টি পত্র সন্নিবেশিত হইয়াছে । পরে আরও ১১টি পাওয়া যায় । আরও পরে দুইটি, সর্বশুদ্ধ ৭০ টি পত্রের সন্ধান পাওয়া যায় । পুস্তকটির মুদ্রিত সংস্করণেও এই সংখ্যাই দৃষ্ট হয় হিজাজ হইতে প্রত্যাগমনের পরই তিনি এই সমস্ত রচনা লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন ।বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কিতাবের নাম নিচে উল্লেখ করা হলঃ
- ১) লামাহাতু’ত তানকীহ (ইহা আত-তাবরিযীর মিশ্কাতুল-মাসাবিহ পুস্তকের ‘আরবী ভাষ্য’)
- ২) আশ’আতুল লুম’আত (মিশকাতুল মাসাবিহ, লখ্নৌ ১২৭৭ হি, মিশকাতের পূর্ন ভাষ্য)
- ৩) আল ফিরুয আবাদি রচিত সিফরুস-সা’আদার ফারসি ভাষ্য (দেখুন সুরী, পৃঃ ১৮১)
- ৪) মাসাব্ত বিল সুন্নাহ (মুয়ামালাত এর উপর সঙ্কলিত হাদিসগ্রন্থ, আরবী)
- ৫) মাদারিজুন নবুওয়ত (হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর বিশদ জীবনী)
- ৬) মিফতাহুল ফুতুহ্ (মিফতাহুল গায়ব এর ভাষ্য)
- ৭) তাওসীফুল মুরিদ ইলাল মুরাদ (তাসাউফ, ফার্সী)
- ৮) মারাজুল বাহরাইন (তাসাউফ, ফার্সী)
- ৯) আখবারুল আখ্ইয়ার ফী আস্রারিল আবরার (আউলিয়া কিরামের জীবনী, অধিকাংশই হিন্দুস্তানের সহিত সম্পর্কিত)
- ১০) যুব্দাতুল আছার (শায়েখ আবদুল কাদির জিলানী (রহঃ) এর জীবনী)
- ১১) যাদুল-মুত্তাকীন, তাহার পীর ও উস্তাদ্গনের জীবনী
- ১২) তাকমিলুল ঈমান (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আক্বীদা)
- ১৩) যিক্রুল মুলুক (গুরী বংশীয় সুলতানের সময় হইতে আকবরের যুগ পর্যন্ত সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস)
- ১৪) জায্বুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহ্বুব (মদিনা মুনাওয়ারার ইতিহাস যাহা প্রধানত আস-সাম্হুদী রচিত ওয়াফাউল-ওয়াফা ইলা দারিল-মুস্তাফা হইতে গৃহীত) ।
তথ্যসূত্র
- ↑ আব্দুল্লাহ খেশগী মুখতাসার মা’আরিজুল বিলায়া, ১০৪৪ হিঃ সঙ্কলিত, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাণ্ডুলিপি, পত্র ২৫৮ খ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন