ওহুদের ময়দানে নেতার আদেশ অমান্য করার কারণে সুস্পষ্ট বিজয় পরাজয়ে রূপান্তরিত হলো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তীরন্দাজ বাহিনীর প্রতি আদেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা কোনো অবস্থাতেই যেন গিরি পথ থেকে সরে না আসেন। কিন্তু যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে দেখে তাদের একদল বলছিল, রাসূলের আদেশ বলবৎ ছিল যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সময় পর্যন্ত । সুতরাং এখন বিজয় অর্জিত হয়েছে, এখন আর এখানে প্রহরা দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আরেক দলের অভিমত ছিল, যুদ্ধে জয়-পরাজয় বলে নয়, রাসূলের পরবর্তী আদেশ না আসা পর্যন্ত এখান থেকে সরা যাবে না।
এ ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ার ফলে বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবা স্থান ত্যাগ করে সরে এসেছিলেন। এই সুযোগে মক্কার কুরাইশ বাহিনী অরক্ষিত সেই গিরি পথেই আক্রমণ করেছিল। তাদের আক্রমণে ওহুদের রণপ্রান্তরে মুসলিম বাহিনী চরমভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। মুসলমানদের রক্তে ওহুদের প্রান্তরে যেন প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। ইসলাম বিরোধীদের একমাত্র লক্ষ্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া।
সাহাবায়ে কেরাম তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছেন। মুষ্টিমেয় কয়েকজন জানবাজ সাহাবা নিজেদের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর নবীকে ঘিরে রেখেছেন। শত্রুদের অস্ত্রের আঘাত রাসূলের পবিত্র শরীরে যেন না লাগে, এ জন্য সাহাবায়ে কেরাম রাসূলকে ঘিরে মানববন্ধন তৈরি করে নিজেদের শরীরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আল্লাহর রাসূলকে হেফাজত করতে যেয়ে হজরত আম্মার ইবনে ইয়াজিদ শাহাদাত বরণ করলন। কাফির বাহিনী নানা ধরনের অস্ত্র দিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আক্রমণ করছিল।
এ সময় কাফিরদের তীরের আঘাতে হজরত কাতাদা ইবনে নুমান রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুর চোখ কোটর ছেড়ে বের হয়ে এলো। মুখের কাছে এসে চোখ ঝুলতে থাকলো। হজরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে অবস্থান করে কাফিরদের দিকে তীর ছুড়তে থাকলেন। ‘আল্লাহর নবী তুনীর থেকে তীর বের করে হজরত সা’দের হাতে দিচ্ছিলেন, হে সা’দ! তোমার ওপর আমার মাতা পিতা কোরবান হোক, তুমি তীর চালাও।’ হজরত আবু দুজানা আল্লাহর নবীকে এমনভাবে বেষ্টন করেছিলেন যে, কাফিরদের সমস্ত আঘাত তাঁর দেহেই লাগে এবং আল্লাহর রাসূল যেন অক্ষত থাকেন। হজরত তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু এক হাতে তরবারি ও অন্য হাতে বর্শা নিয়ে নবীর ওপর আক্রমণকারীদেরকে প্রতিহত করছিলেন। এক সময় শত্রুর আক্রমণ এতটা তীব্র হলো যে, মাত্র ১২ জন আনসার আর মক্কার মোহাজির হজরত তালহা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু ব্যতীত আর কেউ নবীর পাশে স্থির থাকতে পারলেন না। এ অবস্থায় কাফিরদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করলেন, ‘আক্রমণের মুখে শত্রুদেরকে যে পিছু হটাতে বাধ্য করবে সে জান্নাতে আমার সাথে অবস্থান করবে।’
হজরত তালহা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি শত্রুদেরকে আক্রমণ করবো।’ আল্লাহর নবী তাঁকে অনুমতি দিলেন না। আনসারদের মধ্যে একজন বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি আক্রমণ করতে যাবো।’
আল্লাহর নবী তাঁকেও অনুমতি দিলেন। কিছুক্ষণ পরই তিনি শাহাদাত বরণ করলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার সেই পূর্বের ঘোষণা দিলেন। হজরত তালহা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু পুনরায় এগিয়ে এলেন। এবারও আল্লাহর নবী তাঁকে নিষেধ করলেন। এভাবে পরপর ১২ জন আনসারই শাহাদাতবরণ করলেন। এবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত তালহাকে এগিয়ে যাবার অনুমতি দিলেন। হজরত তালহা সিংহ বিক্রমে কাফিরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
এর মধ্যেই পাপিষ্ঠ আব্দুল্লাহ ইবনে কামিয়াহ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আঘাত করে তাঁর দান্দান মোবারক শহীদ করলো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রক্তাক্ত হয়ে পড়লেন। হজরত তালহা আল্লাহর নবীকে হেফাজত করতে গিয়ে নিজের একটি হাত হারালেন। তিনি রক্তাক্ত দেহে এক হাতেই তরবারি ধারণ করে কাফিরদের আক্রমণ প্রতিরোধ করছেন এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের কাঁধে উঠিয়ে নিলেন। আল্লাহর নবী তাঁর কাঁধে, কাফিরদের আঘাতে নিজের এক হাত বিচ্ছিন্ন। একটি মাত্র হাত দিয়ে তরবারি চালনা করে কাফিরদের আক্রমণ প্রতিহত করছেন এবং রাসূলকে নিয়ে নিরাপদ স্থানের দিকে সরে যাবার চেষ্টা করছেন। চরমভাবে আহত অবস্থায় একজন মানুষকে কাঁধে নিয়ে পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠা এবং শত্রুকে প্রতিহত করা ছিলো খুবই কঠিন ব্যাপার। হজরত তালহা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুর নিজের দেহের প্রতি লক্ষ্য ছিলো না। তাঁর দেহ থেকে তখন অবিরাম ধারায় রক্ত ঝরছিল। সেদিকে তাঁর ভ্রƒক্ষেপ ছিল না। তাঁর সমস্ত সত্তা দিয়ে তিনি তখন অনুভব করছিলেন আল্লাহর নবীকে হেফাজত করতে হবে। এক সময় তিনি আল্লাহর নবীকে নিয়ে পাহাড়ের এক গুহায় পৌঁছে নবীকে কাঁধ থেকে নামিয়েই জ্ঞানহারা হয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন।
হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বলেন, ‘আমি আর হজরত উবাইদাসহ অনেকেই অন্য দিকে যুদ্ধ করছিলাম। নবীর সন্ধানে এসে দেখলাম তিনি আহত অবস্থায় পড়ে আছেন। আমরা তাঁর সেবা-যতœ করতে অগ্রসর হতেই তিনি বলেন, ‘আমাকে নয়, তোমাদের বন্ধু তালহাকে দেখো।’
হজরত আবু বকর বলেন, আমরা দেখলাম তিনি জ্ঞানহারা হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর শরীর থেকে একটি হাত বিচ্ছিন্ন প্রায়। গোটা শরীর অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। ৮০টিরও বেশি আঘাত ছিল তাঁর শরীরে। নবী (সা.)-কে হেফাজত করতে গিয়েই তিনি তাঁর হাত হারিয়ে ছিলেন এবং এতগুলো আঘাত সহ্য করেছিলেন।
আল্লাহর নবী পরবর্তীকালে হযজরত তালহা সম্পর্কে বলতেন, ‘কেউ যদি কোনো মৃত মানুষকে পৃথিবীতে বিচরণশীল দেখতে চায়, তাহলে সে যেন তালহাকে দেখে নেয়।’ হজরত তালহাকে ‘জীবন্ত শহীদ’ বলা হতো। ওহুদের প্রসঙ্গ উঠলেই হজরত আবু বকর বলতেন, ‘সেদিনের যুদ্ধে সমস্ত কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন তালহা। নবী করীম (সা.) হজরত তালহা রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুকে পৃথিবীতে জীবিত থাকতেই জান্নাতের সুসংবাদ দান করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন