কিছু মানুষের চরম বিভ্রান্তিমূলক আকিদা হচ্ছে, মানুষ ইবাদত করতে করতে এমন স্তরে পৌঁছে যে, তখন আর তার ইবাদত করার প্রয়োজনীয়তা নেই। সে কামেল হয়ে যায়।
এটাও চরম গোমরাহি ও ভ্রষ্ট আকিদা। আমরা আপনাকে যদি জিজ্ঞাসা করি, পুরো মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে কামেল মানুষ কে ছিলেন? আপনি কালক্ষেপণ ব্যতীতই উত্তর দিবেন ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’। তাঁর চেয়ে বেশি কামেল আর কে হতে পারে? তাঁর চেয়ে বেশি ঈমান-আমল ও মারেফতের অধিকারী আর কে? তিনিও তো মৃত্যু অবধি আল্লাহ তাআলার ইবাদত করেছেন। যদি মারেফত লাভের দ্বারা ইবাদতের প্রয়োজনীয়তা বিদূরীত হত, তবে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজে গিয়ে সরাসরি আল্লাহকে দেখে আসার পর থেকে তিনি আর কোনো ইবাদত করতেন না। কেননা, মেরাজের চেয়ে পূর্ণ ও শক্তিশালী মারেফত আর কীভাবে সম্ভব?
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে :
وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ.
মৃত্যু পর্যন্ত তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর। [হিজর : ৯৯]
এই আয়াতের মধ্যে ‘ইয়াকিন’ বলতে মৃত্যু উদ্দেশ্য। এটা সকল মুফাসসিরদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। সুতরাং ইবাদত মৃত্যু পর্যন্ত। এর চেয়ে আরো স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে :
قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللهِ آَتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا (৩০) وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا.
-সে বলল, আমি (ঈসা) আল্লাহ তাআলার দাস। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন। যেখানেই থাকি তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যতদিন জীবিত থাকব ততদিন যেন নামায আদায় করি ও যাকাত দিই। [সূরা মারয়াম : ৩০]
চিন্তা করুন! হযরত ঈসা আ. একজন প্রসিদ্ধ নবী ছিলেন। অবশ্যই তিনি বড় কামেল মানুষ ছিলেন, তবুও স্পষ্ট ভাষায় তিনি বলেছেন ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে মৃত্যু পর্যন্ত নামায আদায় ও যাকাত প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন।’
প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের ভণ্ড পীরেরা কি নবী-রাসুলদের চেয়ে বেশি কামেল হয়ে গেল? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সোনালী পরশে গড়ে ওঠা সাহাবায়ে কেরামের বিশাল জামাতের ন্যূনতম একজনও কি এমন দাবি করেছে যে, তার আর ইবাদতের প্রয়োজন নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্য ও সাহচর্য লাভ করেও তারা কি প্রকৃত কামেল হতে পারেন নি?
আসল কথা হচ্ছে, এটা চরম গোমরাহিমূলক কথা, শয়তানি চাক্রান্ত—। ভ- পীরেরা ইবাদত থেকে বাঁচার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করেছে। কেননা, শীতের রাতে ফজরের সময় নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে অজু করে নামায পড়া কিংবা নিজের কষ্টার্জিত অর্থ-সম্পদ হতে যাকাত দেওয়া একটু কষ্টই বটে।
কামেল হয়ে গেলে ইবাদতের প্রয়োজন নেই- এই ভ্রান্ত আকিদা ও বিশ্বাসের পক্ষে তারা এই হাদিস দিয়ে দলিল-প্রমাণ পেশ করে থাকে :
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِى شَيْبَةَ وَعَمْرٌو النَّاقِدُ وَزُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ وَإِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ وَابْنُ أَبِى عُمَرَ - وَاللَّفْظُ لِعَمْرٍو - قَالَ إِسْحَاقُ أَخْبَرَنَا وَقَالَ الآخَرُونَ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ بْنُ عُيَيْنَةَ عَنْ عَمْرٍو عَنِ الْحَسَنِ بْنِ مُحَمَّدٍ أَخْبَرَنِى عُبَيْدُ اللهِ بْنُ أَبِى رَافِعٍ - وَهُوَ كَاتِبُ عَلِىٍّ قَالَ سَمِعْتُ عَلِيًّا رضى الله عنه وَهُوَ يَقُولُ بَعَثَنَا رَسُولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- أَنَا وَالزُّبَيْرَ وَالْمِقْدَادَ فَقَالَ ্র ائْتُوا رَوْضَةَ خَاخٍ فَإِنَّ بِهَا ظَعِينَةً مَعَهَا كِتَابٌ فَخُذُوهُ مِنْهَا গ্ধ. فَانْطَلَقْنَا تَعَادَى بِنَا خَيْلُنَا فَإِذَا نَحْنُ بِالْمَرْأَةِ فَقُلْنَا أَخْرِجِى الْكِتَابَ. فَقَالَتْ مَا مَعِى كِتَابٌ. فَقُلْنَا لَتُخْرِجِنَّ الْكِتَابَ أَوْ لَتُلْقِيَنَّ الثِّيَابَ. فَأَخْرَجَتْهُ مِنْ عِقَاصِهَا فَأَتَيْنَا بِهِ رَسُولَ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- فَإِذَا فِيهِ مِنْ حَاطِبِ بْنِ أَبِى بَلْتَعَةَ إِلَى نَاسٍ مِنَ الْمُشْرِكِينَ مِنْ أَهْلِ مَكَّةَ يُخْبِرُهُمْ بِبَعْضِ أَمْرِ رَسُولِ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ رَسُولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- ্র يَا حَاطِبُ مَا هَذَا গ্ধ. قَالَ لاَ تَعْجَلْ عَلَىَّ يَا رَسُولَ اللهِ إِنِّى كُنْتُ امْرَأً مُلْصَقًا فِى قُرَيْشٍ - قَالَ سُفْيَانُ كَانَ حَلِيفًا لَهُمْ وَلَمْ يَكُنْ مِنْ أَنْفُسِهَا - وَكَانَ مِمَّنْ كَانَ مَعَكَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ لَهُمْ قَرَابَاتٌ يَحْمُونَ بِهَا أَهْلِيهِمْ فَأَحْبَبْتُ إِذْ فَاتَنِى ذَلِكَ مِنَ النَّسَبِ فِيهِمْ أَنْ أَتَّخِذَ فِيهِمْ يَدًا يَحْمُونَ بِهَا قَرَابَتِى وَلَمْ أَفْعَلْهُ كُفْرًا وَلاَ ارْتِدَادًا عَنْ دِينِى وَلاَ رِضًا بِالْكُفْرِ بَعْدَ الإِسْلاَمِ. فَقَالَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- ্র صَدَقَ গ্ধ. فَقَالَ عُمَرُ دَعْنِى يَا رَسُولَ اللهِ أَضْرِبْ عُنُقَ هَذَا الْمُنَافِقِ. فَقَالَ ্র إِنَّهُ قَدْ شَهِدَ بَدْرًا وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّ اللهَ اطَّلَعَ عَلَى أَهْلِ بَدْرٍ فَقَالَ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ গ্ধ.
অর্থ : হযরত আলি রা. বলেন, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবায়ের, মিকদাদ ও আমাকে পাঠিয়ে বললেন, তোমরা রাওয়ায়ে খাক নামক স্থানে গিয়ে দেখবে একজন উষ্ট্রারোহণকারিণী নারী রয়েছে, তার কাছে একটি চিঠি আছে, তা নিয়ে আস। আমাদের ঘোড়া প্রতিযোগিতার ঘোড়ার মতো দ্রুত চলল। আমরা গিয়ে সেই মহিলাকে পেলাম। আমি তাকে বললাম, চিঠি বের কর। সে বলল আমার কাছে কোনো চিঠি নেই। আমি আবার বললাম, চিঠি বের কর, অন্যথায় তোমার কাপড় খুলে ফেলব। তখন সে চুলের খোপা থেকে চিঠি বের করে দিলে আমরা তা নিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলাম। চিঠি খুলে দেখা গেল তা হাতিব ইবনে আবি বালতাআর পক্ষ হতে মক্কার মুশরিকদের কাছে প্রেরণ করা হচ্ছিল, যাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাম্প্রতিক খবরাখবর ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে হাতিব! এটা কী? হাতিব বলল, হুজুর! আমার ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না, আমি কুরাইশদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলাম। [আবু সুফিয়ান বলেন, হাতিব তাদের মিত্র ছিল, তাদের বংশের ছিল না]।
আপনার সঙ্গে যেসব মুহাজির হিজরত করে মক্কা থেকে মদিনায় এসেছে সকলেরই সেখানে আত্মীয়স্বজন রয়েছে যারা তাদের পরিবারের হেফাজত করে থাকে। মক্কায় আমার কোনো বংশীয় আত্মীয় না থাকায় তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হলাম, যেন তারা আমার পরিবারের লোকজনদেরকে হেফাজত করে। এ কাজ আমি কুফুরি এবং আমার দীন থেকে ফিরে যাওয়ার জন্যে করিনি; আর ইসলামে প্রবেশ করার পর কুফুরের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশের উদ্দেশ্যেও না।
তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে সত্য বলেছে।
উমর রা. তখন বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসুল আমাকে অনুমতি দিন আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেব। [উমর রা. অতিশয় রাগের কারণে মুনাফিক শব্দটি বলেছিলেন]। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তুমি কী জান না যে, আল্লাহ তাআলা বদরযোদ্ধাদের সম্পর্কে বলেছেন, তোমাদের যা ইচ্ছে তা-ই কর। আমি তোমাদের সকল গোনাহই ক্ষমা করে দিয়েছি।
[সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ৬৫৫৭, বাবু ফাজায়িলি আহলি বদর; সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৪২৭৪, বাবু গাযওয়াতিল ফাতহ; সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং- ২৬৫০; জামে তিরমিযি, হাদিস নং- ৩৩০৫]
এসব অজ্ঞ লোকেরা এই হাদিস দ্বারা দলিল দিয়ে থাকে যে, কামেল হয়ে গেলে আর কোনো ইবাদতের প্রয়োজন নেই। যেমন নাকি বদরযোদ্ধাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন।
অথচ এই হাদিস তাদের ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট দলিল। কারণ, আল্লাহ তাআলা বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে বলেছেন : غَفَرْتُ لَكُمْ অর্থাৎ তোমাদের গোনাহ ও পাপরাশি মাফ করে দিলাম, ক্ষমা ঘোষণা করলাম। গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝে আসে যে, নাজায়েয কাজ দ্বারা তাদের দ্বারা গোনাহ সংঘটিত হয়ে থাকে; তবে তাদের সীমাহীন সম্মান ও বিশেষ মাহাত্ম্যের কারণে আল্লাহ তাআলা মাগফিরাত ও ক্ষমার অঙ্গীকার করেছেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সুতরাং যে জিনিসটি গোনাহ হয় তা আবার জায়েয হয় কীভাবে?
তবে হাদিসে غَفَرْتُ لَكُمْ এর পরিবর্তে যদিاَحْلَلْتُ لَكُمْ , اَبَحْتُ لَكُمْ (তোমাদের জন্যে হালাল করে দিলাম, তোমাদের জন্যে বৈধ করে দিয়েছি) শব্দ থাকত তাহলে এর দ্বারা দলিল দেওয়া যেত।
কাজেই বদরযোদ্ধাদের মাগফিরাত ও ক্ষমা ঘোষণার দ্বারা যদি কেউ ধোঁকা খেয়ে থাকে তাহলে তা অজ্ঞতা ও বোকামি ছাড়া কিছুই নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন