মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০১৬

শানে নুযুল : পরিচয়, গুরুত্ব ও উদাহরণ

Mohiuddin Kasemi

কুরআনে কারিমের কিছু আয়াত রয়েছে যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোনো বিশেষ ঘটনা কিংবা কারো প্রশ্নের উত্তর ছাড়াই নিজের পক্ষ থেকে নাযিল করেছেন। আবার কিছু আয়াত এমনও আছে, যা কোনো বিশেষ ঘটনা কিংবা কারো প্রশ্নের উত্তরের প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে। যাকে সে আয়াতের প্রেক্ষাপট বলা হয়। মুফাসসিরীনদের পরিভাষায় সে প্রেক্ষাপটকে سبب نزول বা شان نزول বলা হয়। শানে নুযুলের বিষয়ে অনেক ওলামায়ে কেরাম পৃথক পৃথক গ্রন্থও প্রণয়ন করেছেন। যেমন- আল্লামা ওয়াকেদির اسباب النزول ‘আসবাবুন নুযুল’। আল্লামা সুয়ুতির لباب النقول فى اسباب النزول 
---
শানে নুযুলের গুরুত্ব ও উপকারিতা 
কিছু অনভিজ্ঞ লোকেরা শানে নুযুলের গুরুত্বকে অস্বীকার করতে গিয়ে বলেন, কুরআনে কারিম স্বয়ং এতটাই সুস্পষ্ট যে, তা বুঝার জন্য শানে নুযুল জানার কোনো দরকার নেই। কিন্তু তাদের এ ধারণা একেবারেই ভুল ও ভ্রান্ত।
ইলমে তাফসিরের জন্য শানে নুযুল একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বিষয়। এর প্রয়োজনীয়তা অপরিমিত ও অগণিত। কিছু নমুনা নিম্নরূপ :

১. আল্লামা যুরকানি রহ. [الزُّرْقَانِيُّ] বলেন, শানে নুযুল জানার প্রথম ফায়দা এই যে, এর দ্বারা আহকামের হিকমত জানা যায় এবং আল্লাহ তাআলা কোন্ অবস্থায় কী কারণে এ হুকুম নাযিল করেছেন- তাও পরিজ্ঞাত হয় । যেমনÑ সূরা নিসার ৪৩ নং আয়াত :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى 
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাক, তখন নামাযের ধারে কাছেও যেও না।”
যদি এ আয়াতের শানে নুযুল জানা না থাকত তাহলে স্বভাবত প্রশ্ন দেখা দিত যে, মদপান করা যখন কুরআন দ্বারা হারাম প্রমাণিত হয়েছে, তখন এ কথা বলার কী প্রয়োজনীয়তা রয়েছে যে, তোমরা মদপান করে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাযে যেও না। 
এ প্রশ্নের উত্তর শুধু শানে নুযুল দ্বারাই জানা সম্ভব। কেননা, এর শানে নুযুল হল- হযরত আলি রা. থেকে বর্ণিত, মদ হারাম হওয়ার পূর্বে একদিন হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ রা. কিছু সাহাবিকে খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। সেখানে খাবারের পর মদ পরিবেশন করা হয়। মদ খাওয়ার পর নামাযের সময় হওয়ায় সাহাবারা নামাযে দাঁড়ালেন। এক সাহাবি নামাযের ইমামতি করছিলেন, তিনি নেশার কারণে কুরআন ভুল পড়লেন। সে প্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়। মোটকথা, এ আয়াতের হুকুমটি মদ পরিপূর্ণভাবে হারাম হওয়ার পূর্বেকার।

২. অনেক সময় শানে নুযুল জানা না থাকার কারণে আয়াতের সঠিক ভাব ও অন্তর্নিহিত মর্ম উদঘাটন করা যায় না। এবং ঘটনার প্রেক্ষাপট না জানার দরুন মানুষ আয়াতের উল্টো ও ভুল অর্থ বুঝতে পারে। যেমন সূরা মায়েদার ৯৩নং আয়াত দেখুন :
لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا إِذَا مَا اتَّقَوْا وَآَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ثُمَّ اتَّقَوْا وَآَمَنُوا ثُمَّ اتَّقَوْا وَأَحْسَنُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ 
“যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎকর্ম করেছে তারা পূর্বে যা ভক্ষণ করেছে; সেজন্য তাদের কোনো গোনাহ নেই যখন ভবিষ্যতের জন্য সংযত হয়েছে, বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করেছে। এরপর সংযত থাকে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে। এরপর সংযত থাকে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে। আল্লাহ সৎকর্মীদেরকে ভালোবাসেন।” 
এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হল- যদি মুসলমানদের অন্তরে ঈমান ও আল্লাহর ভয় থাকে এবং সে নেক কাজ করে তাহলে সে যা ইচ্ছা তাই খেতে পারে। কোনো জিনিস ভক্ষণ করা হারাম নয়।
আর যেহেতু এ আয়াতটি মদ হারাম হওয়া-সংক্রান্ত আয়াতের পরে এসেছে এজন্য কারো এ কথা বলার সুযোগ রয়েছে যে, এ আয়াতে ঈমানদার ও নেককারদের জন্য মদ পান করার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। (নাউজুল্লিাহ)
এ আয়াত দ্বারা এ ভুল অর্থ গ্রহণ করা শুধু সন্দেহ ও সম্ভাবনা নয়; বরং কিছু সাহাবারা এ ভুল অর্থ বুঝে ফেলেছিলেন। এবং তারা হযরত ওমর রা. -এর কাছে এসে এ আয়াত দ্বারা দলিল দিয়ে বললেন : মদপানকারী যদি অতীতে ঈমানদার ও নেককার হয়ে থাকে তাহলে তার ওপর ‘হদ’ জারি করা যাবে না।
তখন খ্যাতিমান তাফসিরবিদ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এ আয়াতের শানে নুযুল দ্বারাই তাদের ভুল ধারণার অপনোদন করে সঠিক মর্ম ও অর্থ বুঝিয়েছিলেন।
এ আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট হল, সূরা মায়েদার ৯০ ও ৯১নং আয়াত যখন মদ ও জুয়া হারাম হওয়া সম্পর্কিত হুকুম নাযিল হল; তখন কিছু সাহাবা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে প্রশ্ন করল, যেসব সাহাবি মদ ও জুয়া হারাম হওয়ার পূর্বে ইন্তেকাল করেছেন তারা তো জীবদ্দশায় মদ ও জুয়াতে লিপ্ত ছিলেন, এখন তাদের পরিণাম কী হবে? তারা কি ক্ষমা পাবে? এর প্রতি উত্তরে সূরা মায়েদার উপর্যুক্ত আয়াত নাযিল হয় যে, যারা মদ ও জুয়া হারাম হওয়ার পূর্বে এগুলোতে লিপ্ত ছিল সে কারণে তাদের ওপর কোনো আজাব হবে না। তবে শর্ত হলÑ তাকে মুমিন হতে হবে এবং অন্যান্য আহকামের পাবন্দি করা লাগবে।
এ ধরনের আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে যার মাধ্যমে একথা প্রতিভাত হয় যে, বহু আয়াতের সঠিক মর্ম ও অর্থ শানে নুযুল ছাড়া বুঝা যায় না।

৩. কুরআনে কারিমের মধ্যে এমন অনেক শব্দ আছে শানে নুযুলের সাথে যার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যদি আয়াতের সঠিক প্রেক্ষাপট জানা না থাকে তাহলে সে শব্দ অনর্থক হয়ে যায় এবং অসংলগ্ন মনে হয়, যে কারণে কুরআনের ফাসাহত ও বালাগাত তথা সাহিত্যমান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যেমন সূরা বাকারার ২০০নং আয়াত : 
فَإِذَا قَضَيْتُمْ مَنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَذِكْرِكُمْ آَبَاءَكُمْ 
“অতঃপর যখন তোমরা হজের যাবতীয় কার্যাদি সমাপ্ত করে ফেলবে, তখন স্মরণ করবে আল্লাহকে, যেমন করে তোমরা স্মরণ করতে নিজেদের বাপ-দাদাদেরকে’।
যদি এ আয়াতের শানে নুযুল সামনে না থাকে তবে “তোমরা নিজেদের বাপ দাদাদেরকে স্মরণ কর” এ অংশ পূর্বের অংশের সাথে অসংলগ্ন ও অসংহত মনে হয়। কেননা, একথা বোধগম্য নয় যে, হজের এই বিশেষ মুহূর্তে আল্লাহর স্মরণকে বাপ-দাদাদের স্মরণের সাথে তুলনা করার কী অর্থ? কিন্তু শানে নুযুল দ্বারা বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এখানে মুযদালেফায় অবস্থানের কথা বলা হচ্ছে। আর আরবীয় মুশরিকদের রীতি ছিল, তারা হজের কার্যাদি সম্পাদন করে মুযদালেফায় এসে নিজ নিজ বাপ-দাদাদের সুনাম-সুখ্যাতি এবং কীর্তি বর্ণনা করত। এজন্য আল্লাহ তাআলা এখন হুকুম দিচ্ছেন যে, তোমরা সে স্থানে পিতৃপুরুষদের গর্ব-অহংকার বর্ণনা করার পরিবর্তে আল্লাহ তাআলার জিকির কর।

৪. কুরআনে কারিমের মধ্যে অগণিত আয়াত এমন আছে যার দ্বারা কোনো বিশেষ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর যখন সে ঘটনা বিস্তারিত জানা না থাকে তখন সে অয়াতের সঠিক অর্থ বুঝা অসম্ভব। যেমন সূরা আনফালের ১৭নং আয়াত- وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ رَمَى 
“আর যখন আপনি (এক মুষ্টি কঙ্কর) নিক্ষেপ করেছিলেন, তখন আপনি নিক্ষেপ করেন নি বরং আল্লাহ তাআলা নিক্ষেপ করেছেন”। 
আয়াতটি বদর যুদ্ধের ঐ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করছে যখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফেরদের সারি ও মানববন্ধনীর প্রতি এক মুষ্টি কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিলেন। তারপর কাফেররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আপনি ভেবে দেখুন, যদি এ আয়াতের শানে নুযুল জানা না থাকে তবে এর প্রকৃত অর্থ কিভাবে বুঝা সম্ভব? 
বস্তুত এখানে শানে নুযুলের সকল উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা উদ্দেশ্য নয়। উল্লিখিত উদাহরণগুলোর মাধ্যমে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, কুরআনের তাফসির ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে শানে নুযুলের অনেক গুরুত্ব ও প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য ইমাম মাহদি রহ. বলেনÑ যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো আয়াতের শানে নুযুল অথবা সংশ্লিষ্ট ঘটনা জানা না থাকে, ততক্ষণ সে আয়াতের অর্থ ও মর্ম বর্ণনা করা সম্ভব নয়। (শানে নুযুল সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা ইতকানে রয়েছে : খ. ১, পৃ. ৫৩; উলুমুল কুরআন : ৭২)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন