আধুনিক বিশ্বে সর্বক্ষেত্রে রোবটের ব্যবহার দেখা যায়। ৮০০ বছর আগে একজন মুসলিম প্রকৌশলী আল-জাজারি কর্তৃক সর্বপ্রথম একটি পূর্বলেখন মানবাকৃতির রোবট (programmable humanoid robot) উদ্ভাবনের কারণে তাকে ‘রোবটিক্সের জনক’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
তার পুরো নাম ‘আল-শায়খ রাইস আল-আমল বদিউজ্জমান আবু আল-ইজ্জ ইবন ইসমাঈল ইবন আল-রাজাজ আল-জাজারি’। তিনি একাধারে একজন পণ্ডিত, আবিষ্কারক, যন্ত্রপ্রকৌশলী, কারিগর, শিল্পী এবং গণিতবিদ ছিলেন। ১১৩৬ খ্রিস্টাব্দে জাজিরাত ইবন-উমর নগরীতে (তুরস্কের সিজর) তার জন্ম হয়। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার বিখ্যাত পুস্তক- ‘আল-জামি বাইন আল-ইলম ওয়া আল-আমল আল-নাফি ফি সিনা আত আল হিয়াল’ বা ‘দি বুক অফ নলেজ অফ ইনজেনিয়াস মেকানিকেল ডিভাইসেস’ রচনা করেন। এটি ইসলামি প্রকৌশলের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণামূলক পুস্তক। তার মৃত্যুর আটশ বছর পর বিজ্ঞানের আধুনিক ইতিহাসে তার কর্মের স্বীকৃতি দিয়ে তাকে সম্মান জানানো হয়েছে। আল-জাজারি রচিত এ গ্রন্থটি প্রযুক্তি এবং শিল্পকলার ঐতিহাসিকদের সবসময় আগ্রহ জুগিয়ে এসেছে।
ইংরেজ ঐতিহাসিক ডোনাল্ড আর. হিল তার রচিত ‘স্টাডিস ইন মেডিয়েভল ইসলামিক টেকনলজি’ পুস্তকে উল্লেখ করেন : ‘ প্রকৌশলের ইতিহাসে আল-জাজারির গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আধুনিক কাল পর্যন্ত আর কোনো সভ্যতা থেকে এর তুলনীয় যন্ত্রের নকশা, উৎপাদন এবং বিভিন্ন নির্দেশমালা সংবলিত তেমন কোনো রচনা পাওয়া যায়নি। এর প্রভাব পরবর্তীকালের স্টিম-ইঞ্জিন এবং অন্তর্দাহ যন্ত্রের (internal combustion) নকশায় দেখা যায়।’
বিভিন্ন মৌলিক যান্ত্রিক উদ্ভাবনের কারণে আল-জাজারিকে আধুনিক প্রকৌশলের জনকও বলা হয়ে থাকে। তার রচিত পুস্তকে তিনি ব্যবহারবিধিসহ একশটি যান্ত্রিক নকশা বর্ণনা করেছেন। কিছু কিছু যন্ত্র যেমন, ফোয়ারার নকশার বিষয়ে তিনি বনু-মুসা ভ্রাতৃত্বয় এবং মোমবাতি ঘড়ির বিষয়ে আল-আসতুরলাবির প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন। আর তার স্বয়ংক্রিয় সুরের যন্ত্রের জন্য হিবাতাল্লাহ ইবন আল-হুসেইনের (মৃত্যু.১১৩৯) প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। এছাড়া তার অনেক মৌলিক উদ্ভাবনও ছিল।
১২০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথম ক্যামশ্যাফট ও ক্র্যাংকশ্যাফট উদ্ভাবন এবং প্রচলন করেন। ১৪ শতকে এ ক্যাম ও ক্যামশ্যাফট ইউরোপে প্রচলন শুরু হয়।
ইংরেজ প্রযুক্তি ঐতিহাসিক ডোনাল্ড রুটলেজ হিল (১৯২২-১৯৯৪ ) বর্ণনা করেন : আমরা সর্বপ্রথম আল-জাজারির কর্মেই নকশা প্রণয়ন এবং নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেখতে পাই : কাঠ বেঁকে যাওয়া রোধ করার জন্য স্তরে স্তরে বিন্যস্ত করা (lamination), অনড় অবস্থায় চাকার ভারসাম্য রক্ষা করা, নকশার জন্য কাগজের মডেল ব্যবহার, কোন ফাটলের ব্যাসের মাপ নির্ণয়, ভালবের আসন ও প্লাগ শিরিষ-গুঁড়া দিয়ে পানি নিরোধক করা, বন্ধ ছাঁচের বাক্সে বালু দিয়ে ধাতু ঢালাই করা।
একটি ঘূর্ণায়মান চাকার গতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আল-জাজারি এসক্যাপমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এছাড়া তিনি কয়েক ধরনের যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি- একটি বড় ধাতব দরজা, কম্বিনেশন-লক এবং চার হুরকাবিশিষ্ট তালা উদ্ভাবন করেন।
আল-জাজারি সর্বপ্রথম সেগমেন্টাল-গিয়ার প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে ১৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইতালীয় চিকিৎসক ও ঘড়ি নির্মাতা জিওভান্নি দ্য ডন্ডির (১৩৩০-১৩৮৮) জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক ঘড়িতে তা দেখা যায়।
পানি উত্তোলনের জন্য আল-জাজারি ১২ এবং ১৩ শতকে পাঁচটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। এছাড়া তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলার জন্য অক্ষদণ্ডের সঙ্গে দত্মক (cams) সংযুক্ত করে পানির কল এবং পানির চাকাও আবিষ্কার করেন।
আল-জাজারির সাকিয়া চেইন-পাম্পেই সর্বপ্রথম ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের ব্যবহার শুরু হয়। পানি উত্তোলনের জন্য তিনি হাতে চালিত কিংবা গরু দিয়ে টানার বদলে পানির শক্তিতে চালিত একটি সাকিয়া চেইন-পাম্প নির্মাণ করেন। তার আবিষ্কৃত সাকিয়া-পাম্পটি ১৩ শতক থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত দামেস্কে পানি তোলার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর মধ্যযুগ পর্যন্ত পুরো ইসলামী জগতে এর প্রাত্যহিক ব্যবহার হতো।
বাইজানটাইন আমলে গ্রিক ফায়ার নামে আগুন ছুড়ে মারা অস্ত্রে যে ধরনের সাইফন ব্যবহার করা হতো, তার উদ্ধৃতি দিয়ে আল-জাজারি সর্বপ্রথম শোষণ নল, সাকশন-পাম্প এবং দ্বিগুণ কার্যকর পাম্পের নকশা বর্ণনা করে সর্বপ্রথম ভালব এবং ক্র্যাঙ্কশ্যাফট কানেকটিং রড ব্যবহার করেন। এছাড়া তিনি দুই সিলিন্ডারবিশিষ্ট পিস্টনের সাকশন-পাম্প উদ্ভাবন করেন। আধুনিক প্রকৌশল ব্যবস্থার উন্নতিতে এ পানি উত্তোলন যন্ত্রটির সরাসরি গুরুত্ব রয়েছে। ১৫ শতকে ইউরোপে প্রচলিত সাকশন-পাম্পের চেয়ে এটি অনেক উন্নত ছিল।
আল-জাজারি সর্বপ্রথম গিয়ার ও পানির শক্তিতে চালিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন। এটি নির্মাণ করে ১৩ শতকে দামেস্কের মসজিদ এবং বিমারিস্তান হাসপাতালে পানি সরবরাহ করা হতো। এ পদ্ধতিতে একটি হ্রদ থেকে পানি নিয়ে একটি সেচনি-চাকা এবং প্রণালীবদ্ধ-গিয়ারকে ঘুরিয়ে সেখান থেকেই লম্বা পাত্রে পানি নিয়ে কৃত্রিম জলপথ বেয়ে শহরের মসজিদ ও হাসপাতালে বহন করা হতো।
আল-জাজারি পানির শক্তির সাহায্যে ময়ূর-রোবট এবং পানির শক্তিতে চালিত ঘড়ির অংশ হিসেবে স্বয়ংক্রিয় দরজাও নির্মাণ করেন। তিনি একটি মানবাকৃতির রোবট পরিচারিকা তৈরি করেন যা পানীয় পরিবেশন করতে পারত। একটি জলাধারে পানীয়টি রাখা হতো, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানীয় একটি বালতিতে তারপর একটি কাপে এসে পড়ত। তারপর স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে একজন রোবট-পরিচারিকা বের হয়ে পানীয় পরিবেশন করত।
ফ্লাশ প্রযুক্তিসহ আল-জাজারি একটি স্বয়ংক্রিয় বেসিন উদ্ভাবন করেন যা আজকাল আধুনিক ফ্লাশ টয়লেটে ব্যবহৃত হয়। এতে একটি নারী-রোবট পানিভর্তি বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। ব্যবহারকারী একটি লিভার টান দিলেই পানি নিচে চলে যায় এবং নারী-রোবটটি আবার বেসিনে পানি ভরে দেয়।
আল-জাজারির ময়ূর-ফোয়ারাটিও ছিল একটি অত্যাধুনিক বেসিন। এখানে মানবাকৃতি একটি রোবট-পরিচারক সাবান ও তোয়ালে তুলে দেয়। ময়ূরের লেজের প্লাগ ধরে টান দিলেই ঠোঁট বেয়ে পানি পড়বে। বেসিনের ময়লা পানি নিচে ভর্তি হতেই একটি ভাসমান বস্তু ভেসে উঠে একটি শিকলের আংটাকে প্রণোদিত করে, এর ফলে একটি পরিচারক-মূর্তি নিচের একটি দরজার পেছন থেকে বের হয়ে সাবান বাড়িয়ে দেবে। আরও পানি ব্যবহার করার পর দ্বিতীয় আরেকটি ভাসমান বস্তু আরেকটু উঁচুতে ভেসে উঠবে, এর ফলে দ্বিতীয় পরিচারক-মূর্তিটি একটি তোয়ালে বাড়িয়ে দেবে!
রাজকীয় আসরের অতিথিদের চিত্তবিনোদনের জন্য আল-জাজারি নির্মিত চারটি সঙ্গীতজ্ঞ রোবটসহ একটি নৌকা একটি কৃত্রিম হৃদে ভাসমান থাকবে। এর প্রোগ্রামেবল ঢোলকের কাঠিগুলো ঘুরালে ঢোলবাদক বিভিন্ন ছন্দে ও তালে ঢোল বাজাতে পারবে।
আল-জাজারি বিভিন্ন ধরনের পানি-ঘড়ি এবং মোমবাতি-ঘড়ি তৈরি করেন। পানির শক্তিতে চালিত লেখক-ঘড়িটি ছিল এক মিটার উঁচু এবং আধা মিটার চওড়া। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের বিজ্ঞান জাদুঘরে এ ঘড়িটি সফলভাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়।হাতি-ঘড়ির একটি মডেল দুবাইয়ের ইবনে বতুতা শপিংমলে সাজানো আছে।
আল-জাজারির অটোমেটিক হাতি-ঘড়িটিতে একটি মানবাকৃতি রোবট একটি মন্দিরায় আঘাত করতেই একটি যান্ত্রিক-পাখি কিচিরমিচির করে ডেকে ওঠে। এটিই প্রথম পানিচালিত ঘড়ি যা সঠিকভাবে সারা বছরের অসম দিনগুলোর সঙ্গে মিল রাখার জন্য পার্থিব সময় গমনের সঠিক হিসাব রাখে। আল-জাজারির ১১ ফুট উঁচু জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক দুর্গ-ঘড়িটিতে সময় গণনা ছাড়াও রাশিচক্র এবং সৌর ও চন্দ্র কক্ষপথ দেখানো হয়েছে। এ যন্ত্রটির ওপরের স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে প্রতি ঘণ্টায় একটি মানবমূর্তি বের হয়ে আসে। এছাড়া সারা বছরের দিন-রাতের পরিবর্তনের হিসাব রাখার জন্য দিন ও রাতের দৈর্ঘ্যকে নতুন করে পরিকল্পনা করা হয়। এই যন্ত্রের পাঁচটি রোবট-বাদক দল একটি লিভারের মাধ্যমে সঙ্গীত পরিবেশন করে।
আল-জাজারি উদ্ভাবিত পানি-ঘড়িটি ১৯৭৬ সালে লন্ডনের বিজ্ঞান জাদুঘরে সফলভাবে পুনর্নির্মিত হয়।
একজন উদ্ভাবক এবং প্রকৌশলী ছাড়াও আল-জাজারি একজন সুদক্ষ চিত্রশিল্পীও ছিলেন। তার রচিত কিতাব ফি মারিফাতে তার উদ্ভাবিত বিভিন্ন যন্ত্রের নির্দেশনাবলি অতি ক্ষুদ্রকায় চিত্র দিয়ে তুলে ধরেন। এটি ছিল মধ্যযুগের ইসলামিক চিত্রকলা।
সূত্র : দি বুক অফ নলেজ অফ ইনজেনিয়াস মেকানিক্যাল ডিভাইস, পি. হিল,স্পিন্গার, নেদারল্যান্ডস, ১৯৭৪ অবলম্বনে লিখেছেন কাজী আখতারউদ্দিন
কার্টেসি: দৈনিক যুগান্তর
তার পুরো নাম ‘আল-শায়খ রাইস আল-আমল বদিউজ্জমান আবু আল-ইজ্জ ইবন ইসমাঈল ইবন আল-রাজাজ আল-জাজারি’। তিনি একাধারে একজন পণ্ডিত, আবিষ্কারক, যন্ত্রপ্রকৌশলী, কারিগর, শিল্পী এবং গণিতবিদ ছিলেন। ১১৩৬ খ্রিস্টাব্দে জাজিরাত ইবন-উমর নগরীতে (তুরস্কের সিজর) তার জন্ম হয়। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার বিখ্যাত পুস্তক- ‘আল-জামি বাইন আল-ইলম ওয়া আল-আমল আল-নাফি ফি সিনা আত আল হিয়াল’ বা ‘দি বুক অফ নলেজ অফ ইনজেনিয়াস মেকানিকেল ডিভাইসেস’ রচনা করেন। এটি ইসলামি প্রকৌশলের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণামূলক পুস্তক। তার মৃত্যুর আটশ বছর পর বিজ্ঞানের আধুনিক ইতিহাসে তার কর্মের স্বীকৃতি দিয়ে তাকে সম্মান জানানো হয়েছে। আল-জাজারি রচিত এ গ্রন্থটি প্রযুক্তি এবং শিল্পকলার ঐতিহাসিকদের সবসময় আগ্রহ জুগিয়ে এসেছে।
ইংরেজ ঐতিহাসিক ডোনাল্ড আর. হিল তার রচিত ‘স্টাডিস ইন মেডিয়েভল ইসলামিক টেকনলজি’ পুস্তকে উল্লেখ করেন : ‘ প্রকৌশলের ইতিহাসে আল-জাজারির গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আধুনিক কাল পর্যন্ত আর কোনো সভ্যতা থেকে এর তুলনীয় যন্ত্রের নকশা, উৎপাদন এবং বিভিন্ন নির্দেশমালা সংবলিত তেমন কোনো রচনা পাওয়া যায়নি। এর প্রভাব পরবর্তীকালের স্টিম-ইঞ্জিন এবং অন্তর্দাহ যন্ত্রের (internal combustion) নকশায় দেখা যায়।’
বিভিন্ন মৌলিক যান্ত্রিক উদ্ভাবনের কারণে আল-জাজারিকে আধুনিক প্রকৌশলের জনকও বলা হয়ে থাকে। তার রচিত পুস্তকে তিনি ব্যবহারবিধিসহ একশটি যান্ত্রিক নকশা বর্ণনা করেছেন। কিছু কিছু যন্ত্র যেমন, ফোয়ারার নকশার বিষয়ে তিনি বনু-মুসা ভ্রাতৃত্বয় এবং মোমবাতি ঘড়ির বিষয়ে আল-আসতুরলাবির প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন। আর তার স্বয়ংক্রিয় সুরের যন্ত্রের জন্য হিবাতাল্লাহ ইবন আল-হুসেইনের (মৃত্যু.১১৩৯) প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। এছাড়া তার অনেক মৌলিক উদ্ভাবনও ছিল।
১২০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথম ক্যামশ্যাফট ও ক্র্যাংকশ্যাফট উদ্ভাবন এবং প্রচলন করেন। ১৪ শতকে এ ক্যাম ও ক্যামশ্যাফট ইউরোপে প্রচলন শুরু হয়।
ইংরেজ প্রযুক্তি ঐতিহাসিক ডোনাল্ড রুটলেজ হিল (১৯২২-১৯৯৪ ) বর্ণনা করেন : আমরা সর্বপ্রথম আল-জাজারির কর্মেই নকশা প্রণয়ন এবং নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেখতে পাই : কাঠ বেঁকে যাওয়া রোধ করার জন্য স্তরে স্তরে বিন্যস্ত করা (lamination), অনড় অবস্থায় চাকার ভারসাম্য রক্ষা করা, নকশার জন্য কাগজের মডেল ব্যবহার, কোন ফাটলের ব্যাসের মাপ নির্ণয়, ভালবের আসন ও প্লাগ শিরিষ-গুঁড়া দিয়ে পানি নিরোধক করা, বন্ধ ছাঁচের বাক্সে বালু দিয়ে ধাতু ঢালাই করা।
একটি ঘূর্ণায়মান চাকার গতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আল-জাজারি এসক্যাপমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এছাড়া তিনি কয়েক ধরনের যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি- একটি বড় ধাতব দরজা, কম্বিনেশন-লক এবং চার হুরকাবিশিষ্ট তালা উদ্ভাবন করেন।
আল-জাজারি সর্বপ্রথম সেগমেন্টাল-গিয়ার প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে ১৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে ইতালীয় চিকিৎসক ও ঘড়ি নির্মাতা জিওভান্নি দ্য ডন্ডির (১৩৩০-১৩৮৮) জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক ঘড়িতে তা দেখা যায়।
পানি উত্তোলনের জন্য আল-জাজারি ১২ এবং ১৩ শতকে পাঁচটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। এছাড়া তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলার জন্য অক্ষদণ্ডের সঙ্গে দত্মক (cams) সংযুক্ত করে পানির কল এবং পানির চাকাও আবিষ্কার করেন।
আল-জাজারির সাকিয়া চেইন-পাম্পেই সর্বপ্রথম ক্র্যাঙ্কশ্যাফটের ব্যবহার শুরু হয়। পানি উত্তোলনের জন্য তিনি হাতে চালিত কিংবা গরু দিয়ে টানার বদলে পানির শক্তিতে চালিত একটি সাকিয়া চেইন-পাম্প নির্মাণ করেন। তার আবিষ্কৃত সাকিয়া-পাম্পটি ১৩ শতক থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত দামেস্কে পানি তোলার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর মধ্যযুগ পর্যন্ত পুরো ইসলামী জগতে এর প্রাত্যহিক ব্যবহার হতো।
বাইজানটাইন আমলে গ্রিক ফায়ার নামে আগুন ছুড়ে মারা অস্ত্রে যে ধরনের সাইফন ব্যবহার করা হতো, তার উদ্ধৃতি দিয়ে আল-জাজারি সর্বপ্রথম শোষণ নল, সাকশন-পাম্প এবং দ্বিগুণ কার্যকর পাম্পের নকশা বর্ণনা করে সর্বপ্রথম ভালব এবং ক্র্যাঙ্কশ্যাফট কানেকটিং রড ব্যবহার করেন। এছাড়া তিনি দুই সিলিন্ডারবিশিষ্ট পিস্টনের সাকশন-পাম্প উদ্ভাবন করেন। আধুনিক প্রকৌশল ব্যবস্থার উন্নতিতে এ পানি উত্তোলন যন্ত্রটির সরাসরি গুরুত্ব রয়েছে। ১৫ শতকে ইউরোপে প্রচলিত সাকশন-পাম্পের চেয়ে এটি অনেক উন্নত ছিল।
আল-জাজারি সর্বপ্রথম গিয়ার ও পানির শক্তিতে চালিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন। এটি নির্মাণ করে ১৩ শতকে দামেস্কের মসজিদ এবং বিমারিস্তান হাসপাতালে পানি সরবরাহ করা হতো। এ পদ্ধতিতে একটি হ্রদ থেকে পানি নিয়ে একটি সেচনি-চাকা এবং প্রণালীবদ্ধ-গিয়ারকে ঘুরিয়ে সেখান থেকেই লম্বা পাত্রে পানি নিয়ে কৃত্রিম জলপথ বেয়ে শহরের মসজিদ ও হাসপাতালে বহন করা হতো।
আল-জাজারি পানির শক্তির সাহায্যে ময়ূর-রোবট এবং পানির শক্তিতে চালিত ঘড়ির অংশ হিসেবে স্বয়ংক্রিয় দরজাও নির্মাণ করেন। তিনি একটি মানবাকৃতির রোবট পরিচারিকা তৈরি করেন যা পানীয় পরিবেশন করতে পারত। একটি জলাধারে পানীয়টি রাখা হতো, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানীয় একটি বালতিতে তারপর একটি কাপে এসে পড়ত। তারপর স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে একজন রোবট-পরিচারিকা বের হয়ে পানীয় পরিবেশন করত।
ফ্লাশ প্রযুক্তিসহ আল-জাজারি একটি স্বয়ংক্রিয় বেসিন উদ্ভাবন করেন যা আজকাল আধুনিক ফ্লাশ টয়লেটে ব্যবহৃত হয়। এতে একটি নারী-রোবট পানিভর্তি বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। ব্যবহারকারী একটি লিভার টান দিলেই পানি নিচে চলে যায় এবং নারী-রোবটটি আবার বেসিনে পানি ভরে দেয়।
আল-জাজারির ময়ূর-ফোয়ারাটিও ছিল একটি অত্যাধুনিক বেসিন। এখানে মানবাকৃতি একটি রোবট-পরিচারক সাবান ও তোয়ালে তুলে দেয়। ময়ূরের লেজের প্লাগ ধরে টান দিলেই ঠোঁট বেয়ে পানি পড়বে। বেসিনের ময়লা পানি নিচে ভর্তি হতেই একটি ভাসমান বস্তু ভেসে উঠে একটি শিকলের আংটাকে প্রণোদিত করে, এর ফলে একটি পরিচারক-মূর্তি নিচের একটি দরজার পেছন থেকে বের হয়ে সাবান বাড়িয়ে দেবে। আরও পানি ব্যবহার করার পর দ্বিতীয় আরেকটি ভাসমান বস্তু আরেকটু উঁচুতে ভেসে উঠবে, এর ফলে দ্বিতীয় পরিচারক-মূর্তিটি একটি তোয়ালে বাড়িয়ে দেবে!
রাজকীয় আসরের অতিথিদের চিত্তবিনোদনের জন্য আল-জাজারি নির্মিত চারটি সঙ্গীতজ্ঞ রোবটসহ একটি নৌকা একটি কৃত্রিম হৃদে ভাসমান থাকবে। এর প্রোগ্রামেবল ঢোলকের কাঠিগুলো ঘুরালে ঢোলবাদক বিভিন্ন ছন্দে ও তালে ঢোল বাজাতে পারবে।
আল-জাজারি বিভিন্ন ধরনের পানি-ঘড়ি এবং মোমবাতি-ঘড়ি তৈরি করেন। পানির শক্তিতে চালিত লেখক-ঘড়িটি ছিল এক মিটার উঁচু এবং আধা মিটার চওড়া। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের বিজ্ঞান জাদুঘরে এ ঘড়িটি সফলভাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়।হাতি-ঘড়ির একটি মডেল দুবাইয়ের ইবনে বতুতা শপিংমলে সাজানো আছে।
আল-জাজারির অটোমেটিক হাতি-ঘড়িটিতে একটি মানবাকৃতি রোবট একটি মন্দিরায় আঘাত করতেই একটি যান্ত্রিক-পাখি কিচিরমিচির করে ডেকে ওঠে। এটিই প্রথম পানিচালিত ঘড়ি যা সঠিকভাবে সারা বছরের অসম দিনগুলোর সঙ্গে মিল রাখার জন্য পার্থিব সময় গমনের সঠিক হিসাব রাখে। আল-জাজারির ১১ ফুট উঁচু জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক দুর্গ-ঘড়িটিতে সময় গণনা ছাড়াও রাশিচক্র এবং সৌর ও চন্দ্র কক্ষপথ দেখানো হয়েছে। এ যন্ত্রটির ওপরের স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে প্রতি ঘণ্টায় একটি মানবমূর্তি বের হয়ে আসে। এছাড়া সারা বছরের দিন-রাতের পরিবর্তনের হিসাব রাখার জন্য দিন ও রাতের দৈর্ঘ্যকে নতুন করে পরিকল্পনা করা হয়। এই যন্ত্রের পাঁচটি রোবট-বাদক দল একটি লিভারের মাধ্যমে সঙ্গীত পরিবেশন করে।
আল-জাজারি উদ্ভাবিত পানি-ঘড়িটি ১৯৭৬ সালে লন্ডনের বিজ্ঞান জাদুঘরে সফলভাবে পুনর্নির্মিত হয়।
একজন উদ্ভাবক এবং প্রকৌশলী ছাড়াও আল-জাজারি একজন সুদক্ষ চিত্রশিল্পীও ছিলেন। তার রচিত কিতাব ফি মারিফাতে তার উদ্ভাবিত বিভিন্ন যন্ত্রের নির্দেশনাবলি অতি ক্ষুদ্রকায় চিত্র দিয়ে তুলে ধরেন। এটি ছিল মধ্যযুগের ইসলামিক চিত্রকলা।
সূত্র : দি বুক অফ নলেজ অফ ইনজেনিয়াস মেকানিক্যাল ডিভাইস, পি. হিল,স্পিন্গার, নেদারল্যান্ডস, ১৯৭৪ অবলম্বনে লিখেছেন কাজী আখতারউদ্দিন
কার্টেসি: দৈনিক যুগান্তর
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন