সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ ওসমানী খিলাফতের রাজধানী ইস্তাম্বুলে একটি জামে মসজিদ নির্মানের ইচ্ছা করলেন। এই কাজের পৃষ্টপোষকতার দায়িত্ব অর্পণ করলেন এক ইটালিয়ান নির্মাণমিস্ত্রীর কাছে। তার নাম এবসলান্টি। কেননা এই নির্মাণমিস্ত্রী অত্যন্ত দক্ষ ছিল। সুলতান আদেশ করলেন মসজিদের খুঁটিগুলো যেন উঁচু হয়, যাতে দূরে থেকেও মসজিদটিকে গগনচুম্বী মনে হয়। এবং উচ্চতার সীমারেখাও নির্ধারণ কিরে দিলেন।
কিন্তু এই নির্মাণমিস্ত্রী কোনো এক কারণে খুঁটিগুলো খাটো করার নির্দেশ দিল অধীনস্ত মিস্ত্রীদের। সুলতান বা অন্য কারো সাথে পরামর্শ ব্যতিরেকেই! যখন সুলতান এ ব্যাপারে অবহিত হলেন, রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন! কারণ, খুঁটিগুলো অনেক দূর থেকে নিয়ে আসা হয়েছে অনেক ব্যয়ভার গ্রহন করে!
সুলতান এতোটাই ক্রুধান্বিত হলেন যে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন! নির্মাণমিস্ত্রীর হাত কেঁটে ফেলার শাহী ফরমান জারি করলেন! কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। অনুতপ্ত হলেন। কিন্তু সেই অনুতাপ কোনো কাজে আসলনা! কাজ যা হবার হয়েই গেছে ইতিমধ্যে। মিস্ত্রীর কব্জি হাত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে!
মজলুম নির্মাণমিস্ত্রীও বসে থাকেনি। নিজের বিচার পাওয়ার জন্য ইস্তাম্বুলের ক্বাযী (বিচারপতি) 'সারি খিজির চলপী'র দরবারে ছুটল। যার ন্যায়পরায়ণতা ওসমানী সাম্রাজের সর্বত্র বিরাজমান। ক্বাযীর দরবারে গিয়ে সরাসরি সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করল!
ক্বাযী কালক্ষেপণ না করে সুলতানকে ডেকে পাঠালেন আসামীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করার জন্যে। কারণ, স্বয়ং রাজার বিরোদ্ধে প্রজার অভিযোগ পাওয়া গেছে! সুলতানও খবর পেয়ে কালবিলম্ব না করে উপস্থিত হলেন ক্বাযীর দরবারে। কারণ, সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা একজন সুলতানের চাইতেও বড়!
নির্দিষ্ট দিনে উপস্থিত হলেন সুলতান ক্বাযীর সামনে। বসার জন্য উপগত হলেন আদালতের বেঞ্চে। ক্বাযী বাঁধা দিয়ে বসলেন! বললেন, জাঁহাপনা! আপনার জন্য বসা সমীচীন নয়; বাদীর কাছে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আপনার জন্য অপরিহার্য! সুলতান বাদীর কাছেই কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন বিবাদী হয়ে। বাদী তার অভিযোগ দায়ের করল। আসল সুলতানের পালা। সুলতান নিজের জবানবন্দী পেশ করলেন। জবানবন্দীতে বাদীর অভিযোগ মাথাপেতে মেনে নিলেন! অত:পর ফয়সালা শুনার জন্য ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন ক্বাযীর দিকে।
ক্বাযী কিছুক্ষণ অবনত মস্তকে নীরব রইলেন। অত:পর মস্তক উত্তোলন করে ফয়াসালা শুনালেন,
"ইসলামী শরী'আহর নীতিমালানুযায়ী ক্বিসাস হিসেবে আপনার হাত কর্তন করে দিতে হবে হে জাঁহাপনা!
ফয়সালা শুনে নির্মানমিস্ত্রী একেবারে ভড়কে গেল! ক্বাযীর মুখ নি:সৃত এই বাক্য শুনে ভয়ে থরথর কাঁপতে লাগল! কারণ, এই ধরণের ফয়সালা তার কল্পনা জগতেও ছিলনা! তার বেশি থেকে বেশি ধারণা ছিল যে, তার জন্য ক্বাযী আর্থিক বিনিময়ের ফয়সালা করে দিবেন। কিন্তু হাত কর্তন! স্বয়ং সুলতানের! কনস্টান্টিনোপল বিজয়ী সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহের! যার ভয়ে ইউরোপের শাসকরা থরথর করে কাঁপে! -এইসব ছিল কল্পনারও উর্ধ্বে!
হতভম্ব স্বরে, হোঁচটখাওয়া ভাষায় নির্মাণমিস্ত্রী ক্বাযীর সকাশে আরজ করল: সে তার অভিযোগ ফিরিয়ে নিয়েছে। সে ক্বাযীর কাছে ফয়সালা হিসেবে আর্থিক বিনিময়েরই আশা রাখে। সুলতানের হাত কর্তন তাকে কোনো উপকার পৌঁছাবেনা।
ক্বাযী তার জন্য জীবনভর দৈনিক দশ ক্বিত্বা (তুর্কী মুদ্রা) সাব্যস্ত করলেন তার কর্তিত হাতের ক্ষতিপূরণ হিসেবে। কিন্তু সুলতান সাব্যস্ত করলেন বিশ ক্বিত্বা! এই দ্বিগুণ মুদ্রা নির্ধারণ কিসাস হিসেবে হাত কর্তন থেকে খালাসি দেয়ার শুকরানা! নিজ ভুলের মাশুল! নিজ অনুতাপের নযরানা!
[রাওয়াঈয়ু' মিনাত তারীখিল উসমানী, ২৩৬। উরখান মুহাম্মাদ আলী]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন