ইসলাম তাওহীদ ও রিসালাত এবং দ্বীন ও শরীয়তের নাম। আকাইদ ও ইবাদত যেমন ইসলামের অংশ তেমনি মুআমালা, মুআশারা ও আখলাক সংক্রান্ত বিধি বিধানও ইসলামের অংশ। ইসলামে যেমন ইবাদত সংক্রান্ত বিধিবিধান রয়েছে তেমনি লেনদেন, জীবন যাপন এবং চরিত্র ও প্রবণতা সংক্রান্ত বিধি বিধানও রয়েছে। ওয়াজ-নসীহতের বিষয় যেমন ইসলামে রয়েছে তেমনি আমর বিল মা’রুফ, নাহি আনিল মুনকার ও জিহাদের বিধানও রয়েছে। ব্যক্তি-সংশোধন ও পরিবার-সংশোধনের বিষয় যেমন আছে তেমনি সমাজ ও সভ্যতা, নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনা এবং আইন ও বিচারের বিষয়টিও রয়েছে।
আত্মশুদ্ধি তথা মানুষের ভিতরগত প্রেরণা এবং চরিত্র সংশোধনের বিষয়ে শরীয়তের বিধিবিধান যে শাস্ত্রে আলোচিত ও বিশ্লেষিত হয় হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে তার নাম হয়ে যায় ‘তাসাওউফ’।অতএব‘তাসাওউফ’ নামের বিষয়টি শরীয়তের বাইরের কোনো বিষয় নয়, আবার তা পূর্ণ শরীয়তও নয়। এটা হল শরীয়তের বিধিবিধানের একটি অংশ।
মানুষ কেবল তখনই মুসলিম হতে পারে যখন সে তাওহীদের সঙ্গে পূর্ণ শরীয়তের উপর ঈমান আনবে এবং শরীয়তকে সমর্পিত হৃদয়ে গ্রহণ করবে। শুধু তাওহীদ স্বীকার করে কিংবা শরীয়তের শুধু একটি অংশকে গ্রহণ করে মানুষ ‘মুসলিম’ হবে-এ চিন্তার কোনো স্থান নেই ইসলামে।
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا ادْخُلُوْا فِی السِّلْمِ كَآفَّةً ۪
এটাই হল ইসলামের সঠিক পরিচয়, যা কুরআন-সুন্নাহয় উল্লেখিত হয়েছে স্পষ্ট ভাষায়। আর এটা ইসলামের প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত এবং অবিচ্ছিন্ন ধারা পরম্পরায় সর্বজন বিদিত। এর বিপরীতে মুলহিদ ও ধর্মদ্রোহী শ্রেণী নিজেরা ভিন্নতর ‘তাসাওউফ’ প্রণয়ন করেছে। তাদের দৃষ্টিতে সেটা এক আলাদা জীবন ব্যবস্থা। এর মূল ভিত্তিটা হল প্রবৃত্তির অনুগামিতা এবং কর্ম ও চরিত্রগত ক্ষেত্রে বিধিবন্ধন-হীনতা। অথচ প্রতারণামূলকভাবে এই উশৃংখলারই নাম তারা দিয়েছে ‘তাসাওউফ’। যাতে হক্কানী ছূফীয়ায়ে কেরামের নিকটে স্বীকৃত বিষয়টির সঙ্গে শুধু নামগত সাদৃশ্য দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করা যায়। তবে মিথ্যা মিথ্যাই। যতই তার বেশ-ভূষা পরিবর্তন করা হোক তার প্রকৃত পরিচয় কখনো গোপন থাকে না। যেদিন থেকে এই বিষয়টির উদ্ভব, সেদিন থেকেই কুরআন-সুন্নাহর পারদর্শী মণীষীগণ তাসাওউফের আবরণ গ্রহণকারী এই প্রতারক গোষ্ঠীকে সর্বসম্মতভাবে বেদ্বীন ও যিন্দীক ঘোষণা করেছেন এবং পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, এরা বাতেনী ও ইবাহী সম্প্রদায়েরই একটি শাখা।
এ যুগটা উন্নতির (?) যুগ। অতএব অতীতের বেদ্বীনী তাসাওউফও এখন উন্নতি করে পরিণত হয়েছে ‘সুফীইজমে’।
প্রকৃত‘তাসাওউফ’ যেহেতু শরীয়তের সবচেয়ে কঠিন অংশ- অন্তরের পরিশুদ্ধির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এজন্য শরীয়তের উপরে ঈমান রাখেন এমন অনেকেও এ অঙ্গণ সম্পর্কে পলায়নপর মানসিকতা পোষণ করেন, কিন্তু আজকালের ‘সূফীবাদ’ এতই মজার বিষয় যে, সেক্যুলার মানসিকতার লোকেরাও এতে আগ্রহ বোধ করেন। এমনকি আগাচৌ সাহেবকেও এ বিষয়ের একজন রসিক সমঝদার হিসেবে দেখা গেল। তার দাবি হল দ্বীন ও শরীয়ত নয়, সূফীবাদই হল প্রকৃত ইসলাম। নাউযুবিল্লাহ।
এ যুগের ধর্মদ্রোহী সেক্যুলার মানসিকতার লোকেরাই যখন এ মতবাদের প্রচারক তখন এটা বোঝা কারো পক্ষেই কঠিন নয় যে, ইসলামী তাসাওউফের সঙ্গে এই সূফীবাদের কোনোই সম্পর্ক নেই। বরং এটা হল ইসলামকে অস্বীকার করারই একটি পন্থা।
প্রকৃত তাসাওউফ শরীয়তে মুহাম্মাদীরও শাখা এবং এই তাসাওউফের ধারক-বাহকগণ আমর বিল মারুফ, নাহি আনিল মুনকার, জিহাদ, নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রপরিচালনা, আইন ও বিচারসহ সকল বিভাগকে স্বীকার করেন। তারা ইসলামকে দ্বীনে তাওহীদ এবং পূর্ণাঙ্গ শরীয়তের সমষ্টি মনে করেন, যার রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি।
সারকথা এই যে, আজকাল কিছু কিছু পাশ্চাত্যজীবী চিন্তাবিদ ও সেক্যুলার মানসিকতার লোকেরা সূফীবাদের যে রূপ-কাঠামো পেশ করে থাকে তার সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর ইলমে তাসাওউফের কোনো সম্পর্ক নেই। এ প্রসঙ্গে গাযালী ও রূমীর নাম ব্যবহার করাও নির্জলা প্রতারণা ও মিথ্যাচার। এই সূফীবাদকে প্রকৃত ইসলাম বলে উল্লেখ করা ইসলামকে অস্বীকার করার এক জঘন্য ও চাতুরীপূর্ণ পদ্ধতি।
আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের ঈমান ও আকীদার হিফাযত করুন।
.
[ মাসিক আলকাউসার » শাবান-রমযান ১৪২৯ . আগস্ট ২০০৮ ]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন