Mohiuddin Kasemi
[সম্প্রতি এক কবির মৃত্যুতে এক লেখকের মূল্যায়ন ছিল এরূপ- ‘মৃত্যুকে তিনি অগ্রাহ্য করেছিলেন’। এ প্রসঙ্গেই দুটি কথা।]
মৃত্যু এক অবধারিত সত্য, অনিবার্য বাস্তব। জগতের কোনো প্রাণী, কোনো কিছুই মৃত্যুহীন অবিনশ্বর নয়। لدوا للموت وابنوا للخراب জন্মাও মৃত্যুর জন্য আর নির্মাণ কর বিলুপ্তির জন্য। অর্থাৎ জন্মের পরিণাম মৃত্যু আর নির্মাণের পরিণাম ধ্বংস। আরবের এক কবির পুণ্য-পংক্তি-
أَلَا كُلُّ شَيْءٍ مَا خَلَا اللهَ بَاطِلُ + وَكُلُّ نَعِيمٍ لَا مَحَالَةَ زَائِلُ.
ওহে! আল্লাহ ছাড়া যা কিছু সবই মরণশীল। আর আনন্দের সকল কিছু নিঃসন্দেহে ধ্বংসশীল।
এই যে স্পষ্ট বাস্তবতা, কুরআন তা বর্ণনা করেছে এভাবে- كُلُّ نَفْسٍ ذائِقَةُ الْمَوْتِ.
প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। (৩ : ১৮৫; ২১: ৩৫; ২৯: ৫৭)
কুরআন এখানে এক বাস্তব সম্পর্কে সচেতন ও সচকিত করেছে। কারণ, যাদের জন্য কুরআন, সেই মানুষ তো উদাসীন হয়ে পড়ে প্রতিদিনের বাস্তবতা সম্পর্কেও। অথচ সচেতনতা ও চিন্তাশীলতার দ্বারা সে পেতে পারে সত্যের দিশা এবং হতে পারে সত্যপথের পন্থী। তাই কুরআন বারবার উল্লেখ করেছে জীবন ও জগতের বিভিন্ন বাস্তবতা।
চারপাশে কত জনের মৃত্যু! তবুও মানুষ ভুলে থাকতে চায় নিজের মৃত্যুকে। কিন্তু ভুলে থাকলেই যে তা দূরে থাকে না! তাই কুরআন স্মরণ করিয়ে দেয়, মৃত্যু শুধু ওদের জন্য নয়, যারা মারা গেল; বরং ওদেরও জন্য, যারা এখনো মারা যায়নি।
***
মৃত্যুর স্মরণে ক্ষতি নেই; বরং আছে উপকার, বহু উপকার। মৃত্যুর স্মরণ মানুষকে দান করে ক্ষণস্থায়িত্বের উপলব্ধি। এ উপলব্ধি মানুষের মোহমুক্তি ঘটায়। অর্থ-বিত্ত, পদ-পদবী, ভোগ-ফূর্তি এবং ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মোহই তো সকল ব্যাধির মূল, ব্যক্তি ও সমাজের সকল অশান্তির কারণ। মৃত্যুর স্মরণ মানুষকে মুক্ত করে এই মোহগ্রস্ততা থেকে । তাই তা এক মহৌষধ মানুষের নৈতিক ও চারিত্রিক শুদ্ধির। আর তাই মানব-মনে মৃত্যুর যে আবেদন তা বিনষ্ট করা কোনো মঙ্গলকর্ম নয়, নয় সমাজের হিতসাধন; বরং তা শুদ্ধি ও সংস্কারের এক বড় অবলম্বনের বিনাশ সাধন।
***
মৃত্যুর পর মানুষের শুধু দেহটি থাকে, রূহ চলে যায়। রূহ কী? কুরআন পাকের ইরশাদ-
قُلِ الرُّوْحُ مِنْ اَمْرِ رَبِّیْ وَ مَاۤ اُوْتِیْتُمْ مِّنَ الْعِلْمِ اِلَّا قَلِیْلًا.
বল, রূহ আমার রবের এক নির্দেশ। আর তোমাদের তো দেয়া হয়েছে জ্ঞানের খুব সামান্য অংশ। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৮৫
আল্লাহর আদেশে মানবদেহ প্রাণ লাভ করে, আবার তাঁরই আদেশে নিষ্প্রাণ হয়। মৃত্যুর পর মানুষ ফিরে যায় তার স্রষ্টার কাছে। কুরআন বলছে-
كُلُّ نَفْسٍ ذَآىِٕقَةُ الْمَوْتِ ثُمَّ اِلَیْنَا تُرْجَعُوْنَ.
জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী; অতপর তোমরা আমারই নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে। -সূরা আনকাবুত (২৯) : ৫৭
তাই মৃত্যুর স্মরণ প্রেরণা যোগায় আপন স্রষ্টার সাথে পরিচিত হওয়ার।
যে জীবনটি মানুষ যাপন করে এবং যে পৃথিবীতে বিচরণ করে এতেই রয়েছে ¯্রষ্টার অপার নিদর্শন। কুরআন মাজীদের ইরশাদ-
وَ فِی الْاَرْضِ اٰیٰتٌ لِّلْمُوْقِنِیْنَ وَ فِیْۤ اَنْفُسِكُمْ اَفَلَا تُبْصِرُوْنَ.
নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শন আছে ধরিত্রীতে এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও। তবুও তোমরা দেখছ না? -সূরা যারিয়াত (৫১) : ২০-২১
سَنُرِیْهِمْ اٰیٰتِنَا فِی الْاٰفَاقِ وَ فِیْۤ اَنْفُسِهِمْ حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَهُمْ اَنَّهُ الْحَقُّ اَوَ لَمْ یَكْفِ بِرَبِّكَ اَنَّهٗ عَلٰی كُلِّ شَیْءٍ شَهِیْدٌ.
আমি ওদের দেখাব আমার নিদর্শনাবলী, বিশ্বজগতে এবং ওদের নিজেদের মধ্যে। ফলে ওদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠবে যে, এ-ই সত্য। তোমার প্রতিপালক সম্পর্কে এই কি যথেষ্ট নয় যে, তিনি সব বিষয়ে অবহিত। -সূরা হা মীম আসসাজদা (৪১) : ৫৩
যার অবারিত দান জীবনজুড়ে, মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ ফিরে যায় তাঁরই কাছে। আহা! কত সৌভাগ্য তাদের, যারা তাঁর কাছে ফিরে যায় আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতার চিহ্ন ললাটে ধারণ করে। হায়! কী দুর্ভাগ্য ওদের, যারা তাঁর সামনে দাঁড়ায় অকৃতজ্ঞতার কলুষ-কালিমা নিয়ে।
তাই মৃত্যুর স্মরণ মানুষকে দান করে স্রষ্টার হক সম্পর্কে সচেতনতা। আর প্রেরণা দেয় বিশ্বাস ও আনুগত্যের এবং নিবৃত্ত করে অবিশ্বাস ও অবাধ্যতা থেকে।
***
মৃত্যুকী? মৃত্যু হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী জীবন থেকে চিরস্থায়ী জীবনে গমন। ক্ষণস্থায়ী জীবনে কেউ থাকে না। রাজা-প্রজা, আমীর-ফকীর, বিদ্বান-মূর্খ কেউই থাকতে পারে না। আর চিরস্থায়ী জীবন থেকে কেউ ফেরে না, কখনো ফিরতে পারে না।
মৃত্যু হচ্ছে, ‘দারুলআমল’থেকে‘দারুল জাযায়’গমন-কর্মের জগৎ থেকে প্রতিদানের জগতে প্রবেশ। কর্মের জগতে কর্ম ছিল এবং অবকাশ ছিল; প্রতিদানের জগতে শুধু প্রতিদান, কর্মের অবকাশ নেই।
কুরআন যেমন মৃত্যুকে স্মরণ করিয়েছে তেমনি মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কেও জানিয়ে দিয়েছে-
كُلُّ نَفْسٍ ذَآىِٕقَةُ الْمَوْتِ وَ اِنَّمَا تُوَفَّوْنَ اُجُوْرَكُمْ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَ اُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَ مَا الْحَیٰوةُ الدُّنْیَاۤ اِلَّا مَتَاعُ الْغُرُوْرِ.
জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর তোমাদের কর্মফল তো পূর্ণমাত্রায় বুঝিয়ে দেওয়া হবে কিয়ামতের দিন। এরপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে দাখিল করা হবে সেই সফলকাম। আর পার্থিব জীবন তো ছলনাময় ভোগ ছাড়া কিছুই নয়। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮৫
মৃত্যুকে স্মরণ করাবার কারণ, প্রতিনিয়ত তা দেখেও মানুষের গাফিল থাকা। আর মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে জানাবার কারণ, তা ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়-নির্ভর উপায়-উপকরণের আওতার বাইরে হওয়া। যাদের জ্ঞানের পরিধি শুধু এই ইন্দ্রিয়ের জগৎ তারা মৃত্যুকে মনে করতে পারে বিলুপ্তি, কিন্তুনা, মৃত্যু মানে বিলুপ্তি নয়। মৃত্যুর মতই অমোঘ বাস্তব মৃত্যুর পরের জীবন। সেই জীবনের রূপ কী, বৈশিষ্ট্য কী, পরিবেশকী, প্রতিবেশ কী, কারা সঙ্গী সেই নতুন দেশে, নতুন জীবনে, কারা প্রতিবেশী, কেমন তাদের আচরণ, কেমন উচ্চারণ- এ এমন কিছু প্রশ্ন, যার জবাব ইন্দ্রিয়ের কাছে নেই; অথচ মানুষকে ঐ জীবনের প্রস্তুতি নিতে হয় এই জীবনের সমাপ্তির আগেই। হায়! কত বড় দায় মানব-জন্মের!
দয়াময় আল্লাহ মানুষকে জানিয়েছেন ঐ জীবন সম্পর্কে, ওপারের ঐ জগৎ সম্পর্কে। তাঁর সংবাদে যারা বিশ্বাস রাখে তারাই ঈমানদার এবং বুদ্ধিমান। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী-
الكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ، وَالعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ.
বুদ্ধিমান সে যে নিজের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য উপার্জন করে। আর অক্ষম সে যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুগামী করে এবং আল্লাহর প্রতি অলীক প্রত্যাশা পোষণ করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪২৬০
মৃত্যুর স্মরণ তাই মানুষকে দেয় সৎ কর্মের প্রেরণা, এককথায় আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায়ের প্রেরণা। ইসলামে ‘আমলে সালিহ’বা সৎকর্ম শুধু ‘ইবাদত-বন্দেগী’নয় যেমন তা নয় শুধু ‘সৃষ্টির সেবা’। ইসলামে আমলে সালিহ উভয় প্রকারের সৎকর্মের নাম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত পরিষ্কার বলেছেন-
مَنْ أَحَبَّ أَنْ يُزَحْزَحَ عَنِ النَّارِ وَيُدْخَلَ الْجَنَّةَ فَلْتُدْرِكْهُ مَنِيَّتُهُ وَهُوَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، وَيَأْتِي إِلَى النَّاسِ مَا يُحِبُّ أَنْ يُؤْتَى إِلَيْهِ.
অর্থাৎ মৃত্যুর পরের চূড়ান্ত সফলতার দুই শর্ত : এক. জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আল্লাহর উপর ও শেষ দিবসের উপর ঈমান। আর দুই. মানুষের সাথে ঐ ব্যবহার করা যা অন্যের কাছ থেকে পেতে মানুষ পছন্দ করে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৮০৭; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ১০৬১৪
এখানে‘শেষ দিবসের উপর ঈমান’কথাটি পড়ুন আর এ কালের ইহবাদী ধারণাটাও স্মরণ করুন। এই মতবাদে মৃত্যুর যে মূল্যায়ন তা যেন চৌদ্দশ বছর আগেই খ-ন করে দিয়েছেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ইহবাদী ধারণায় মৃত্যু মানে বিলুপ্তি। আর ঈমানদারের কাছে মৃত্যু মানে আখিরাতের জীবনের সূচনা। এই ঈমানের সাথেই তারা মৃত্যুর মুখোমুখী হবেন। দ্বিতীয় শর্তটি সংশ্লিষ্ট বান্দার সাথে। অর্থাৎ অন্যের সাথে ঐ ব্যবহার করা যা আমরা তার কাছ থেকে পেতে পছন্দ করি। আমরা কী পেতে পছন্দ করি? ইনসাফ পেতে, সহানুভূতি পেতে, পরোপকার পেতে এবং সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা পেতে। ইসলাম বলছে, মৃত্যুর পরের জীবনে চূড়ান্ত সফলতা পেতে হলে তোমাকে হতে হবে ন্যায়পরায়ণ, সহমর্মী ও পরোপকারী। আর তোমার কাছে নিরাপদ হতে হবে অন্যের সম্পদ ও সম্ভ্রম।
সুতরাং ইসলামে মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী জীবনের যে দর্শন, তা মানুষকে পরিণত করে সৎ ও সজ্জন মানুষে। তো যারা এই চিন্তা ও দর্শনের বিরোধিতা করেন তারা আসলে কিসের বিরোধিতা করেন? তাঁরা কি উপলব্ধি করছেন, এভাবে এই জাতি ও সমাজকে কোন্ গন্তব্যে নিয়ে চলেছেন?
***
মৃত্যুর স্মরণ মানুষকে করে সৎকর্মমুখী ও কর্মতৎপর। জীবন তো ফুরিয়ে যায় পলে পলে যেমন এক বরফ-খ- নিঃশেষ হয় ফোঁটায় ফোঁটায়। তাই একটি ভালো কাজ- তা যত ছোটই হোক, হতে পারে আখিরাতের সঞ্চয়, একটি আলোকিত বাক্য, হতে পারে কারো হেদায়েতের উপায়, কারো একটু উপকার হয়ে যেতে পারে নাজাতের অসীলা। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ.
জাহান্নাম থেকে বাঁচো, খেজুরের একটি টুকরো দ্বারা হলেও। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪১৭
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই শিক্ষা ধারণকারী মুমিন তো কোনো অবস্থাতেই কোনো প্রকারের ভালো কাজ থেকে বিমুখ হয় না। তো ইসলামী শিক্ষায় মৃত্যুর যে মূল্যায়ন তা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক, যা মানুষকে করে তুলে সৎকর্ম-মুখর। কাজেই তা পার্থিব কল্যাণেরও এক বড় উপায়। সর্বোপরি এ হচ্ছে এক সত্য ও বাস্তবতা, যা এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। এই সত্যের মুখোমুখী হতে হবে প্রতিটি মানুষকে- বিশ্বাসীকেও এবং অবিশ্বাসীকেও।
***
মৃত্যু তো অগ্রাহ্য করার মতো বিষয় নয়। এই সমাজে তো ছিল না ‘মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করা’র ধারণা। তবে হাঁ, আমাদের রয়েছে আল্লাহর পথে, মৃত্যুভয় জয় করার উজ্জ্বল ইতিহাস, আছে আমৃত্যু সৎকর্মে সত্য প্রতিষ্ঠায় মশগুল থাকার বর্ণিল উদাহরণ, কিন্তু মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করা? এই বিদ্রোহ-পরায়ণতা ও ভিত্তিহীন অহমিকা তো এই সমাজে ছিল না। আমাদের আবহমান কালের সংস্কৃতি, মৃত্যুকে না-ভোলার এবং যথাসাধ্য ভালো কাজের মাধ্যমে আখিরাতের প্রস্তুতি নেয়ার। আর ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভুল-বিস্মৃতির জন্য অপরাধী-মন নিয়ে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা-প্রার্থনা করার। এই খোদাভীতি আমাদের প্রেরণা দিয়ে এসেছে বিশ্বাসের, ভালো কাজের, ইবাদত-বন্দেগীর, পরোপকারের, লেনদেনে স্বচ্ছতার এবং নৈতিক ও চারিত্রিক শুদ্ধতার। আখেরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতি আমাদের নিবৃত্ত করে এসেছে মন্দ কাজ থেকে, যুলুম ও হিং¯্রতাথেকে, রক্তপাত ও পরস্ব হরণ থেকে এবং নৈতিক ও চারিত্রিক স্খলন থেকে।
মুসলিম-সমাজের এই শুদ্ধ চেতনা ও সর্বকল্যাণপ্রসূ জীবন-দর্শনের পরিবর্তে যারা আজ এখানে এই সমাজে ইহবাদী ধারণার জাল বিস্তার করছেন এবং প্রসঙ্গে অপ্রসঙ্গে অনাহুত শব্দ-বাক্য ও অবিশ্বাসী চেতনা-দর্শন প্রতিষ্ঠা করছেন তারা কি ভেবে দেখেছেন এর পার্থিব ফলাফলও হতে পারে কত ভয়াবহ? এই ইহবাদী চেতনার ঔরস থেকেই জন্ম লাভ করে চরম হিং¯্রতা, চূড়ান্ত প্রবৃত্তিপরায়ণতা এবং সমাজের সকল স্তরে ‘জোর যার মুল্লুক তার’-এর দৃষ্টান্ত-পরম্পরা। আর আখিরাতের পরিণাম তো বলাই বাহুল্য। সুতরাং ঈমানদার, দেশপ্রেমিক ও সমাজ-হিতৈষী জনগণের কর্তব্য, দুর্বৃত্তায়নের এই ডাকে প্রতারিত না হওয়া এবং ইহবাদী ধারণা ও তার সকল প্রকাশকে সম্পূর্ণরূপে বয়কট করা। দায়ীগণের কর্তব্য, ইসলামের‘ঈমান বিল আখিরাহ’শিক্ষাটি বিভিন্ন আঙ্গিকে বারবার আলোচনা করা।
***
মৃৃত্যুকে অগ্রাহ্য করার মাঝে কোনো বীরত্ব নেই। বরং এ এক অসার অহমিকা ও মর্মান্তিক নির্বুদ্ধিতা। কারণ মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করা মানে ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতি মোহগ্রস্ত হওয়া এবং চিরস্থায়ী জীবন থেকে বিমুখ হওয়া। মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করা মানে এক অটল বাস্তবতাকে বিস্মৃত হওয়া এবং অনিবার্য জবাবদিহিতা সম্পর্কে উদাসীন থাকা। মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করা মানে আত্মবিস্মৃত হওয়া এবং আত্মঘাতী হওয়া।
মৃত্যু ও তার পরের জীবনকে যে অগ্রাহ্য করে, জীবনসায়াহ্নে এসেও যে বলে না- ‘দয়াময়! ক্ষমা কর এ বান্দায়’, সে তো ঐ বুদ্ধিহীনের মতো যে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে পড়ে, কিংবা জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দেয়, অথবা চলন্ত ট্রেনের সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেয়। এই অর্থহীন জীবননাশে কোনো বীরত্ব নেই। কিংবা বলুন, এই‘বীরত্বে’কোনো মহিমা নেই। তো যে মানুষটি পরিণাম জেনেও সারাটি জীবন থাকে না-শোকর, না-ফরমান, প্রবৃত্তিই হয় যার উপাস্য আর প্রবৃত্তিপরায়ণতাই ধর্র্ম আর এই ধর্মের আহ্বানেই সে রচনা করে চলে বাক্যের পর বাক্য এবং পংক্তির পর পংক্তি, অবশেষে হায়! জীবনের শেষ মুহূর্তটিও কেটে যায় দুর্বৃত্ত হেন, পঙ্কিল পংক্তি রচনায়; সে তো ঐ মানুষটির মতো, যে অর্থহীন জীবননাশ করে; বরং তার চেয়েও উদ্ধত, বুদ্ধিহীন।
ঐ জীবনই যথার্থ, যা যাপিত হয় জ্যোতির্ময় নির্মলতায় এবং জীবনদাতার প্রতি শোকর ও কৃতজ্ঞতায়; ঐ মৃত্যুই মহিমাপূর্ণ, যা হয় এক শুভ্র জীবনের শুভ সন্ধ্যা এবং এক পবিত্র সান্নিধ্যময় জীবনের শুভ সকাল।
দয়াময় আল্লাহ জ্যোতির্ময় ও কর্মময় করুন আমাদের সকাল ও সন্ধ্যা আর বরকতময় ও রহমতময় করুন আমাদের সন্ধ্যা ও সকাল।
আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন।
.
[ মাসিক আলকাউসার » সম্পাদকীয় » সফর ১৪৩৮ . নভেম্বর ২০১৬ ]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন