বৃহস্পতিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৬

অবরুদ্ধ বেদুইনকন্যা!

Atik Ullah


খার্তুম রেলওয়ে জংশন। একজন চীনাম্যান ভীষন গোমড়ামুখে বসে আছে। পেশায় রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার। মানুষটাকে প্রায়ই দেখা যায়, পুরাতন রেললাইনের ধারে বসে বসে আকাশ-পাতাল কী যেন ভাবছে। উদাস দৃষ্টিতে আকাশের ডানা মেলে ওড়া চিল দেখছে। চীনের মানুষকে ভাবুক বলে মনে হয় না। তাদেরকে দেখলে বা তাদের কথা শুনলে মনে হয়, তারা একটা রোবটবিশেষ। কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না। ধর্মকর্ম নেই। যন্ত্রবৎ। 
.
কিন্তু আসনপিঁড়ি হয়ে বসে থাকা মানুষটাকে দেখলেই কবি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। প্রথম প্রথম সবাই অবাক হলেও এখন সবার সয়ে গেছে। এতবড় একজন অফিসার! সুদান সরকার তাকে পারলে মাথায় করে রাখে! রেল ইঞ্জিনের এমন কোনও সমস্যা নেই, যা লোকটা সমাধান করতে পারে না। প্রাচীন মান্ধাতা আমলের লক্কর ঝক্কর ইঞ্জিনও তার জীয়নস্পর্শে কোনও এক যাদুমন্ত্রবলে গা ঝাড়া দিয়ে ভোঁওওও করে স্ট্রার্ট নেয়। 
.
চারদিকে গিজগিজে কালো মানুষের ভীড়ে, বোঁচা নাকের একজন শাদা মানুষকে বিশদৃশই মনে হতো। আস্তে আস্তে সয়ে গেছে। অন্য আর দশজন চীনার মতো মানুষটার চেহারা অতটা মঙ্গোলয়েড নয়। চেহারাটাও বেশ মায়াবী। ইংরেজী সুদান আসার আগেই শেখা ছিল, এখানে আসার পর আরবীটাও বেশ ভালোই রপ্ত করেছে। উচ্চারণে সমস্যা থাকলেও সেটাকে কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। আগে ছিল মার্কিন ও জার্মান ইঞ্জিনিয়ার তারা চীনাদের মতো এতটা মিশুক ছিল না। হামবড়া ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে তারা থাকতো। নিজেদের পরিমন্ডলে। একটা বানোয়াট পরিসরে। কল্পিত সুপিরিয়রিটিতে। সুদানে চীনাদের আসার ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়!
.
চীন শুরু থেকেই আফ্রিকার সাথে সম্পর্কোন্নয়নের প্রতি আগ্রহী ছিল। গত কয়েক বছরে আফ্রিকার সাথে চীনের সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে। বিশেষ করে সুদানের সাথে। এখানকার রেলব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই গণচীনের মুখাপেক্ষী। আমেরিকার অর্থনৈতিক অরবোধের পর, সুদানের রেলবিভাগ আস্তে আস্তে গণচীননির্ভর হয়ে পড়ে। আগের জার্মান ও মার্কিন ইঞ্জিনগুলো বিকল হতে শুরু করে। বোকা আমেরিকা গোঁ ধরে অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জীবন থেমে থাকে না। 
সুদানের জীবনযাত্রা রেলনির্ভর। প্রয়োজনের তাকিদে ভিন্ন উপায় খুঁজতে শুরু করে তারা। পথ পেতে দেরীও হয় না। চীন এগিয়ে আসে। তারা সর্বান্তকরণে সুদানের থমকে যাওয়া রেলবিভাগকে সচল করে তোলে। নিবিড় নিষ্ঠায়। লোকবল-অর্থবল-যন্ত্রবল দিয়ে। স্থবির হয়ে আসা রেলস্টেশনগুলো আবার হেসে ওঠে। ছোঁয়া লাগে প্রাণের। 
.
চীন থেকে আসা কর্মকর্তাদেরই একজন হলো আমীর যাদ। এটা তার মূল নাম নয়, কাগজে-কলমে লি হুয়ান নামেই পরিচিত। এখানকার সহকর্মীরাও তাকে লী বলে ডাকে। তবে সুদানীদের কাছে, আসল নাম না বলে, ভিন্ন নাম বলার সুপ্ত একটা কারণ আছে। সাংহাইতে তার বেড়ে ওঠা। পড়াশোনাও সেখানে। ছোটবেলা থেকেই রেলের প্রতি ঝোঁক! ভালোলাগা বিষয় নিয়েই পড়াশোনা। নেশাই এখন পুরোদস্তুর পেশায় পরিণত হয়েছে। তার সাথে আসা অন্য ইঞ্জিনিয়াররা যেখানে অফিসটাইম করে দায়িত্ব শেষ করে, আমীর যাদ সেখানে বলতে গেলে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই বেগার খেটে যাচ্ছে। এতে চীনা ও সুদানী কর্তৃপক্ষ উভয়ই তার প্রতি বেজায় খোশ!
.
বয়েসে সবার চেয়ে কনিষ্ঠ হলেও পদে গরিষ্ঠ হতে দেরী লাগলো না। তার একটা হবি হলো ট্রেনে চড়ে সুদানের দূর-দূরান্তের প্রত্যন্ত শহরগুলো দেখতে যাওয়া। মরুভূমির প্রতি তার আজন্ম আকর্ষণ। ট্রেন যখন মরুভূমির বুক চিরে হু হু করে এগিয়ে যায়, তার মনে হতে থাকে, জীবনটা এভাবে কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হতো না। বেশির ভাগ ট্রেনযাত্রায় চালকের সাথেই বসে আমীর যাদ। এভাবে তার সখ্যতা গড়ে উঠেছে অনেক চালকের সাথে। একজনের সাথে একটু বেশিই দহরম-মহরম! উসমান মাহজুব। বয়েসের দীর্ঘ ব্যবধান থাকলেও দুরপাল্লার যাত্রায় অনেকটা সময় একসাথে থাকার কারণে, অসম বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। 
.
হাশিখুশি মিশুক আমীর যাদকে হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে থাকতে দেখে, তার বস ভেবেছিলেন বাড়ির জন্যে মন খারাপ! জোর করে ছুটি দিলেন। বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে বললেন। আমীর সবিনয়ে ছুটি প্রত্যাখ্যান করে বললো:
-বাড়ি গেলে মন খারাপ ভালো হবে না। এখানেই থাকি! আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে!
কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পরও সমস্যা কাটলো না। কাজে-কর্মে কোনও ফাঁকি নেই, সব ঠিকঠাক মতোই চলছে। তবে কোথাও যেন সুতা ছিঁড়ে গেছে। প্রাণের ছোঁয়া নেই। চীন থেকে আসা ইঞ্জিনিয়ারদের আলাদা একটা ডেরা আছে। সেখানে তারা কয়েকজন করে করে একটা রেলবগিতে থাকে। আরাম-আয়েশের সব ব্যবস্থাই সেখানে আছে। কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার ইন্তেজাম যৌথ। খাবার টেবিলে আমীর যাদের বিমর্ষ ভাব অন্যদের কষ্টের কারন। 
.
সুদানীদের মধ্যেও বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমীর যাদের হয়েছে এক সমস্যা! সে সবকথা নিজের দেশোয়ালি ভাইদেরকে বলতে পারছে না, নিরাপত্তার কারণে। আবার সুদানীদের সাথেও কষ্টের কথা শেয়ার করতে পারছে না। উসমান মাহজুবের সাথে সব সময় দেখা হয় না। উনি সব সময় ট্রেনেই থাকেন। আজ এ শহর কাল ও শহর করেই তার দিন কাটে। তবে খার্তুটে ট্রিপ নিয়ে এলে, যেভাবেই হোক, একবার আমীরের সাথে দেখা করা চাইই! প্রতিবারের মতো এবারও যখন খার্তুম এলেন, অভ্যেসবশত একবার আমীরের সাথে দেখা করতে এলেন। দেখেই ধাক্কামতো খেলেন! আগের বার কী দেখে গেলেন, এবার কী দেখছেন! চোখের নিচে কালশিটে! হনু বেরিয়ে আছে। গায়ের রঙে কালো ছোপ পড়েছে। শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে!
-আমীর আপনার এই অবস্থা কেন?
-নাহ, এমনিতেই শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে!
-আপনার মতো টগবগে যুবকের শরীর খারপহয়ে এমন হয়ে যাবে, বিশ্বাস করা মুশকিল!
-আচ্ছা, না বলতে চাইলে থাক! আমি একটা সুসংবাদ নিয়ে এসেছি!
-কী সুসংবাদ?
-আপনি বলেছিলেন, তালা‘ফার অঞ্চলে আমার ট্রিপ পড়লে আপনাকে বলতে! এবার ট্রেন নিয়ে ওদিকে যাচ্ছি! যাবেন ?
-যাবো!
.
ট্রেনে চড়লে আমীদের মেজায সব সময়ই আমীরানাহ হয়ে ওঠে। মুখে কথার খই ফোটে। নিজেই চা বানিয়ে উসমানকে দেয়। স্টোভে রান্না চড়িয়ে দেয়। স্টেশন থেকে কেনা বুনো বকের গোশত কুটতে বসে! বেশ সংসারী চেহারা! এবার সেসবের কোনও আলামত দেখা গেলো না। উসমান মাহজুব সত্যি সত্যি উৎকণ্ঠা বোধ করলেন। বড় ধরনের কিছু না হলে এমনটা হওয়ার কথা নয়।
-সাদিক! আপনি আমাকে আপন মনে করেন?
-করি! অনেক বেশিই করি!
-তাহলে আমাকে আপনার কষ্টের কথা খুলে বলছেন না কেন?
-একটা শর্তে বলতে পারি! আমি এখন যা বলবো, কাকপক্ষীও যেন টের না পায়! বিশেষ করে আমার দেশী সহকর্মীরা যেন জানতে না পারে!
-আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন!
-আপনার সাথে সেবার আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম। আপনি আমাকে আপনার কাদেরী তরীকার পীরের দরবারে নিয়ে গিয়েছিলেন। মনে পড়ে?
-মনে পড়বে না কেন! আমরা সেখানে সারারাত যিকির করেছি! পীর সাহেবের দু‘আ নিয়েছি!
-সেখান থেকে ফিরে আসার পর আপনার সাথে দীর্ঘদিন আর দেখা হয়নি। আপনি অন্য রুটের দায়িত্বে ছিলেন। আমার কাছে সেই রাতের কাজটা বেশ ভালো লেগেছিল। এভাগে গানের তালে তালে যিকির করা, ঢোল-তবলা বাজানো! ধেই ধেই করে নাচা! সত্যি মনোমুগ্ধকর একটা রাত! আমি খার্তুমে ফিরে এসেই বিভিন্ন খানকায় যাতায়াত শুরু করলাম! কেমন যেন মোহে পড়ে গেলাম! আমাদের চায়নীজ জীবনে এ-ধরনের ধর্মীয় উৎসব তো দূরের কথা, ধর্মের চি‎হ্নও নেই! পাশাপাশি সূফিবাদ সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করলাম। আপনার শুনতে অবাক লাগবে! সুদানে সবমিলিয়ে প্রায় পঁচিশটারও বেশি সুফী তরীকা আছে। অল্প কয়েকটা ছাড়া প্রায় সব তরীকারই একটা বা একাধিক খানকা আছে রাজধানী খার্তুমে!
.
নিয়মিত আসা যাওয়ার সুবাদে কিছু মানুষের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তাদের একজন আমাকে প্রস্তাব দিল, তার গ্রামের বাড়িতে ঘুরে আসতে। গ্রাম মানে বাদিয়া। দক্ষিণ সুদানের দারফুরে! আমি এককথায় রাজি হয়ে গেলাম!
-দারফুরে? তাহলে তো ঘটনা বেশ আগের!
-হাঁ, দারফুর স্বাধীন হওয়ার মাসখানেক আগের ঘটনা!
-আশ্চর্য! আপনি দারফুরে গেলেন, আমি জানতেও পারলাম না! তাহলে আমিও যেতাম! আমার শ্বশুর বাড়িও দারফুরে জানেন তো! 
-জ্বি আপনি বলেছিলেন! 
-তারপর?
-দারফুরে তখন স্বাধীনতা আর গণভোটের প্রস্তুতি চলছে। আমরা এমন গোলযোগময় সময়ে পৌঁছলাম। তার বাড়িটা বেশ রক্ষণশীল! তারা সুফি ঘরানার। কিন্তু তাদের চলনবলন অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন! আমি ভেবেছিলাম অন্যদের মতো তারাও গান-বাদ্যি, ঢোল-তবলা বাজিয়ে যিকির করে! ছেলে মেয়ে একসাথে নাচে! তেমন কিছুই দেখা গেলো না। যিকির হয়, তবে গান-বাদ্যি ছাড়া। এখানে নারীদের দেখাই যায় না। যিকিরে বসা তো দূরের কথা। 
আনন্দের কোনও উপকরণ না পাওয়াতে দিনগুলো বড়ই পানসে আর ম্যাড়ম্যাড়েভাবে কাটছিল। আমি ভেবে এসেছিলাম এখানে জম্পেশভাবে নেচেগেয়ে কিছু আনন্দকর সময় পার করবো! তা হলো না। কেমন যেন নিরস! এরই মধ্যে একটা ঘটনা ঘটলো!
-কী ঘটনা?
-আমি যার সাথে গিয়েছিলাম, তার বাবাই ছিল পীর। একজন সত্যিকার ভদ্রলোক। অন্য পীরদের মতো গান-বাদ্যি নিয়ে পড়ে থাকেন না। পোষাক পরিচ্ছদও আর দশজন সুদানীর মতোই। মানুষটা বেশ শিক্ষিত, কথা বললেই টের পাওয়া যায়। তাকে দেখি সারাদিনই বসে বসে কুরআন শরীফ পড়ছেন অথবা হাঁটার সময় তাতে ইয়াব্বড় এক তাসবীহ নিয়ে কিছু একটা জপছেন!
সে এলাকা মুসলিম অধ্যুষিত হলেও, পাশের গ্রামটা ছিল খ্রিস্টান। আমি আর আলি, মানে যার সাথে গিয়েছি, একসাথে ঘুরে বেড়াই! শিকার করি। বালুতে চুলা বানিয়ে রান্না করে খাই। রাত হলে তাঁবুতে নাক ডেকে ঘুমাই। একদিন আমরা শিকার থেকে ফিরে এসেছি। আলির পিতা তাকে ডেকে নিয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পর আলি থমথমে মুখে আমার কাছে এসে বসলো। আমি তার মন খারাপের কারন জানতে চাইলাম। প্রথমে বলতে না চাইলেও, আমার পীড়াপীড়িতে সে মুখ খুললো:
-আমীর! তুমি দারফুরের বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানো। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, এখানকার খ্রিস্টানরা সবাই দেশভাগের পক্ষেই রায় দিবে। তখন আমরা যারা মুসলমান আছি, তাদের অস্তিত্ব রীতিমতো হুমকির মুখে পড়বে। আমার একটা ছোটবোন আছে। হাশমা। 
-তোমার ছোটবোন আছে? কখনো দেখিনি যে! পরিচয় করিয়ে দিলে না!
-ও পর্দা করে! মুসলিম মেয়েরা অপরিচিত মানুষের সামনে যায় না!
-খার্তুমে তো দেখি নারী-পুরুষ একসাথে যিকির করে?
-ওরা ধর্মকে ঠিকমতো মানে না, তাই এমন করে! এভাবে নারী-পুরুষ মিলে, গান-বাদ্যি করে যিকির করাকে ইসলাম সমর্থণ করে না। এমন করলে গুনাহ হয়!
-আচ্ছা এসব নিয়ে পরে কথা বলবো! তোমার বোনের কথা কী বলছিলে যেন!
-জ্বি, আমাদের এখানে একটা রীতি আছে, মেয়েশিশু জন্ম নেয়ার পরপরই তার বিয়ে ঠিক করা হয়ে যায়। নিজ বংশেরই কারো সাথে। পরে বড় হলে বিয়ের রুসমত সারা হয়। আব্বা অবশ্য এসব প্রথা মানেন না। কিন্তু দাদু নিজে থেকেই আমার এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে হাশমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন। 
-অবাক করা ব্যাপার! এমন কেন করা হয়?
-নিজেদের মেয়ের অন্য গোত্রে যাওয়া ঠেকাতেই মূলত এই প্রথা প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। সুদানের অনেক গোত্রই আরব থেকে আসা। এ-ধরনের প্রথা আরবদের মধ্যে এখানো প্রচলিত আছে। 
-এখন কি কোনও সমস্যা হয়েছে?
-দারফুরে এখন যে স্বাধীনতার আয়োজন চলছে, সেটার পেছনে আছে পাশ্চাত্য শক্তি। ইসরায়েলও শক্তভাবে কলকাঠি নাড়ছে! বিদ্রোহী খ্রিস্টান নেতা সালভাদর কীরের সাথে ইহুদিদের সরাসরি সম্পর্ক! ইসরায়েল চায় আফ্রিকাতে তার একটা শক্ত অবস্থান তৈরী হোক! নিজস্ব একটা ঘাঁটি হোক! দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবাতেও তাদের বড় এক অফিস আছে। 
তো যা বলছিলাম, অনেক আগে থেকেই এখানে খ্রিস্টান মিশনারীদের বেশ আনাগোনা। তারা প্রকাশ্যেই তাদের অপতৎপরতা চালায়। টাকার বিনিমেয় দরিদ্র মুসলমান ও প্রকৃতিপূজারী সুদানীদেরকে তারা খ্রিস্টধর্মে দিক্ষীত করে। আমার চাচাত ভাই ও তার পরিবার যদিও গরীব নয়, কিন্তু কিভাবে যে সে খ্রিস্টানদের টাকার মোহে পড়ে যায়। বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে সে এখন খ্রিস্টানদের বড় নেতা। সালভাদর কীরের সাথেও তার ওঠাবসা! গত কয়েকদিন আগে সে এসে আব্বুকে মনে করিয়ে দিয়ে গেছে, দাদুর কথা। তার সাথে হাশমার বিয়ে হওয়ার কথা!
আব্বু এক কথায় নাকচ করে দিয়েছেন! সে চুক্ষুলজ্জার কারণে আব্বুর সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি, তবে আম্মুর সাথে দেখা করে সে বলে গেছে! আপসে আপ বিয়েটা না হলে, সে জোর খাটাতে বাধ্য হবে! আম্মু বলেছেন:
-তুমি খ্রিস্টান হয়ে গেছো! কিভাবে বিয়ে হবে?
-আমি এতকিছু বুঝি না, দাদুর ইচ্ছা আমাকে পুরণ করতেই হবে। 
-খ্রিস্টান হওয়াটাও দাদুর ইচ্ছেয় হয়েছিলে?
-আমি তর্ক করতে আসিনি! একসপ্তাহ সময়! এরমধ্যে আপনার নিজে থেকে আয়োজন না করলে, আমি নিজেই সব ব্যবস্থা করে আসবো! আর বিয়েটা হলে আপনাদেরই লাভ! এখানে নিরাপদে থাকতে পারবেন। আমি প্রোটেকশন দিয়ে রাখবো। কেউ কিছু বলবে না। নইলে খ্রিস্টানরা বাড়িঘর ছাড়া তো করবেই, জান নিয়েও টানাটানি পড়ে যেতে পারে!
.
-হাশমার প্রতি তার এত আগ্রহ কেন?
-আগ্রহ হওয়ারই কথা। হাশমা জ্ঞানেগুণে আমাদের বংশের মেয়েদের মধ্যে সবার সেরা বলা না গেলেও, সে অনেক ভাল একটা মেয়ে। উচ্চশিক্ষিতা। খার্তুমে থেকেই সে পড়াশোনা করেছে। বাবার কাছে ধর্মীয় শিক্ষা পেয়েছে। আমার চেয়েও অনেক ভাল করে। কুরআনে হেফয করেছে। হেফয অবশ্য আমাদের বংশের সব মেয়েই করে। তুমি দেখেছ বোধ হয়, আমাদের বাড়ির মসজিদের সামনে কাঠের পাত ডাঁই করে রাখা আছে?
-হাঁ, দেখেছি! কিসের ওগুলো?
-সেগুলো লাওহে কুরআনী! আমাদের এখানকার রীতি হলো, কাজগের কুরআন না পড়া। কাঠের পাতে প্রতিদিনের পাঠ লিখে লিখে শিখে নেয়া। একটা পাঠ মুখস্থ হয়ে গেলে, সেটা মুছে ফেলা হয়, তারপর আরেকটা পাঠ লিখে। ওস্তাদ পুরো ব্যাপারটা তদারক করেন। 
-সুন্দর ও প্রাচীন ব্যবস্থা দেখছি!
-হাঁ, বেশ উপকারী! এভাবে পড়লে ভুলে যাওয়ার আশংকা কমে যায়। রাতের বেলার পড়ার পদ্ধতিটাও বেশ মজার! মসজিদের সামনে বিরাট চত্বর থাকে। সেখানে মাঝ বরাবর বিরাট এক অগ্নিকুন্ডলী জ্বালানো হয়। আগুনের চারপাশে বসে বসে ছাত্ররা পড়া মুখস্থ করে। শিক্ষক কুন্ডলির চারপাশে চক্কর দিতে থাকেন। কারো পড়া হয়ে গেলে, তাকে বলা হয়, পুরো পড়াটা একবার হেঁটে হেঁটে পড়ে আসো। আরেক বার দৌড়ে দৌড়ে পড়বে! তারপর তোমার পড়া শোনা হবে!
-মজার ব্যবস্থা! 
-হাশমাও আমাদের গ্রামের ‘দাইর’ মানে মাদরাসায় পড়া শেষ করের্ছিল। তারপর রাজধানীতে চলে গিয়েছিল। ওখানে আমার খালার বাসায় থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। 
-কী বিষয়ে?
-আব্বু চেয়েছিলেন, আমি যেন তেল-গ্যাস খনির ব্যবস্থাপনা নিয়ে পড়ি! কারন দক্ষিণ সুদানে তেল-গ্যাসের বিশাল মজুদ! এ-খনিজ সম্পদ ঠিকমতো কাজে লাগানোর জন্যে শিক্ষিত জনবল দরকার! আমার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ না থাকার কারণে, বোনকেই এ-বিষয়ে পড়াশোনা করতে উৎসাহিত করেন। হাশমা অত্যন্ত মনোযোগী ছাত্রী। মেধাবীও বটে। 
-মসস্যার কথা কী বলেছিলে?
-আমরা তাকে নিয়ে ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়েছি! তাকে যে কোনও মূল্যে খার্তুমে সরিয়ে ফেলতে হবে। আমি সাথে করে নিয়ে যেতে পারবো না! কারন চারদিকে পাহারা বসানো। আব্বু বারবার নিষেধ করেছিলেন হাশমাকে! সে যেন এবারের ছুটিতে বাড়িতে না আসে! এখানকার পরিস্থিতি ভালো নয় মোটেও!
-আমি কি কিছু করতে পারি এ-ব্যাপারে?
-তোমাকে দিয়ে কাজ হতে পারে! তুমি বিদেশী! তোমাকে কিছু বলবে না। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়!
-কী সমস্যা?
-একেতো তুমি মুসলিম নও! দ্বিতীয়ত তুমি বেগানা! মানে পরপুরুষ! ইসলামী আইনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী, বাপ-ভাই-স্বামী ছাড়া আর কারো সাথে দূরের সফর করতে পারে না। আব্বা যেমন অত্যন্ত রক্ষণশীল, হাশমাও তেমনি। সে উচ্চশিক্ষিতা হয়েও পর্দা মেনে চলে পুরোপুরি। যদিও আমাদের সুদানী সমাজে পর্দাকরা মেয়ের সংখ্যা খুবই কম! 
-আমার খুবই ইচ্ছে করছে তোমাদের এই বিপদে আমি কিছু একটা করি! খুউব ইচ্ছে করছে! এজন্য আমি যে কোনও ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত! যে কোনও ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত! আমি খবর পাঠালে, জুবার রেলজংশন থেকে ল্যান্ডরোভার পাঠিয়ে দেবে! ওখানে আমার এক ব্যাচম্যাট কর্মরত আছে। সাংহাই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আমরা একই ডিপার্টমেন্টে পড়েছি! 
-আচ্ছা, আমি আব্বা-আম্মা আর হাশমার সাথে কথা বলে দেখি!
-আলি! তুমি জানো, আমি সুদানকে পছন্দ করি। সুদানের লোক-সংস্কৃতিকে ভালোবাসি। এখানকার মানুষকে ভালোবাসি। আর তোমাদের এখানে এসে মনে হয়েছে: ইশ আমি যদি এখানেই জন্মাতাম! তোমাদের পরিবারের নিখাঁদ ধার্মিকতা আমাকে সত্যি সত্যি অবাক করেছে। এতদিন একরকম জেনেছি, তোমাদের এখানে এসে আমার জানার ধরন পুরোটাই ওলট-পালট হয়ে গেছে! শুধু মনে হচ্ছে, আমি বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস গ্রহন করছি! তুমি আমার ব্যাপারে কোনও দ্বিধা করো না! তোমার বোনকে সাহায্য করতে পারলে, আমার ভীষণ ভালো লাগবে! খুউব ভালো লাগবে! এর বেশি আর কিছু বলতে পারছি না!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন