Atik Ullah
মানুষটাকে দেখলেই বোঝা যায়, ধর্মকর্মের অতটা ধার ধারেন না। বিশেষ পরিচয়ের সূত্রে তার গাড়িতে উঠতে হলো। আমাদের গাড়ি কুয়ালালামপুরের বাইরে একটা গ্রামে যাচ্ছিল। আমি পথেই নেমে যাবো। গাড়ির পেছনের আসনে তার দুই ছেলে। শহরের স্কুলে পড়ে। এখন বাড়ি যাচ্ছে। মায়ের কাছে। একটু পর আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, বাচ্চাদুটো কিছুক্ষণ পরপরই ‘আল্লাহু আকবার’ বলছে। আবার সুবহানাল্লাহ বলছে। আবার মাঝে মাঝে আলহামদুলিল্লাহ বলছে। লা-ইলাহা ইল্লাহ বলছে। প্রথম প্রথম কিছু বললাম না। তাদের আনন্দে বাগড়া দিতে মন চাইল না। দু’ভাই বেশ আনন্দ আর উৎসাহের সাথেই কাজটা করছে। তাদের ভাবোচ্ছাস দেখে মনে হলো তারা প্রতিযোগিতা করছে। কে কার আগে বলবে। কে কার চেয়ে বেশি বলবে!
-
আমি শেষমেষ থাকতে না পেরে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম:
-ওদের কচিমুখে যিকির শুনতে বেশ ভালো লাগছে! তারা সব সময় এভাবে যিকির করে?
-ঠিক সব সময় নয়। তারা আসলে নবীজি সা.-এর একটা সুন্নাত পালন করছে। তিনি সফরে গেলে, উঁচুতে আরোহণ করার সময় আল্লাহু আকবার বলতেন। নিচে নামার সময় সুবহানাল্লাহ বলতেন। বাচ্চারাও তাই করছে।
-আপনাকে দেখে তো ধার্মিক মনে হয় না। তারা এসব শিখলো কোথা থেকে?
-তাদের মায়ের কাছে!
-আপনি বড়ই সৌভাগ্যবান! এমন একজন স্ত্রী ঘরে তুলতে পেরেছেন।
-তা বলতে পারেন। আমার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। অনেক বড় এক পুরস্কার। সন্তানকে দ্বীনদার হিশেবে গড়ে তুলতে তার মেহনত-মোজাহাদার কোনও শেষ নেই!
-তিনি কি বিশেষ কোনও পদ্ধতি অবলম্বন করেন? এত ছোট বয়েসেই বাচ্চাদুটো যিকিরে অভ্যস্ত হয়ে গেলো?
-ওদের মা প্রতিটি কাজই সুন্নত তরীকায় করার চেষ্টা করে। ধরুন ‘বাথরূমে’ যাবে, প্রবেশ করার আগে বাচ্চাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে জোরে জোরে দু‘আ পড়ে। কখনওবা বাচ্চাদেরকেই জিজ্ঞেস করে, বলো তো এখন কোন দু‘আটা পড়বো? এখন কোন পা দিয়ে প্রবেশ করবো?
বাচ্চারাও কোনও কাজ করতে গেলে, প্রথমেই মাকে সে কাজের আদব ও সুন্নাত বলে যায়। না পারলে মায়ের মুখে মুখে বলে তারপর যায়। ঘুম-খাওয়া-নাওয়া স্কুলে যাওয়া সবখানেই তাদেরকে প্রথম প্রথম পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। এখন ওরা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নিজে থেকেই আমলগুলো করে।
.
বাচ্চাদের মায়ের আরেকটা সুন্দর পদ্ধতি আছে। ছোটদের মাঝে ঝগড়া-তর্ক লেগেই থাকে। খুনসুটি-মন কালাকালি হরদম হতেই থাকে। দু’ভায়ের কারো মুখ থেকে যদি রাগের মাথায় বেফাঁস কথা বের হয়ে যায়, অথবা কোনও অপরাধ করে ফেলে, তাদের মা সাথে সাথে দু’জনকে কাছে ডাকে। শাসনের স্বরে। একটু রাগত ভঙ্গিতে:
-দু’জন এদিকে এসো! বসো। আচ্ছা আমাকে বলো: তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? শয়তানকে না আল্লাহকে?
-আম্মু, আমি আল্লাহকে বেশি ভালোবাসি!
-তুমি কি আল্লাহর বন্ধু হতে চাও নাকি শয়তানের বন্ধু?
-আমি আল্লাহর বন্ধু হতে চাই!
-তোমার কাজে তো সেটার প্রমাণ পেলাম না। তুমি ভাইয়াকে যে ‘কটুকথা’ বললে, এমন কাজ শুধু শয়তানের বন্ধুরাই করে! আল্লাহর বন্ধুরা কখনোই এমন কাজ করে না। যে এমন কাজ করে, শয়তান তার পিঠে চড়ে বসে বসে হো হো করে হাসতে থাকে! তুমি কি চাও শয়তান তোমার কাজ দেখে খুশিতে হাসুক?
-জ্বি না, আম্মু আমি শয়তানকে হাসাতে চাই না।
-কি করতে চাও?
-আমি শয়তানকে কাঁদাতে চাই!
-তাহলে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে!
-কী কাজ আম্মু?
-কেবলামুখী হয়ে, একশ বার ‘ইস্তেগফার’ করতে হবে।
.
-আম্মু, একশবার পড়েছি!
-এত তাড়াতাড়ি! কিন্তু শয়তানের কান্না তো ঠিকমতো শোনা যাচ্ছে না। আরও পঞ্চাশবার পড়ে এসো!
-আম্মু পড়েছি!
-উঁহু! শয়তানের কান্নাটা বড্ড আস্তে শোনা যাচ্ছে! আরও বিশবার পড়ে দেখো তো! তার কান্নার আওয়াজ বাড়ে কি না!
-আম্মু, পড়েছি! কান্না শোনা যাচ্ছে?
-হুঁ, তবে আরও জোরে কাঁদাতে পারবে বাবা? তাহলে দশবার পড়ে ফেলো!
-পড়েছি!
-এবার হয়েছে! শয়তান এবার হাউমাউ করে কাঁদছে!
-আম্মু! শয়তানকে আমি আরও জোরে কাঁদাই?
-তাহলে তো খুবই ভালো! সে ভবিষ্যতে তোমার কাছেপিঠে ঘেঁষার সাহস করবে না! তুমি যত বেশি ইস্তেগফার করবে, শয়তানও ততবেশি জোরে কাঁদতে থাকবে!
.
একটা শিশু ছোটবেলা থেকেই এভাবে আল্লাহ তা‘আলার পছন্দ-অপছন্দ জেনে গেলে এবং সে অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তোলার শিক্ষা পেলে, বড় হলে এমন ছেলে বাবা-মায়ের অবাধ্য হতে পারে না। কারন সে জানে, বাবা-মায়ের সন্তুষ্টিই আল্লাহর সন্তুষ্টি।
আগের যুগের মানুষ সম্পর্কে আমরা নানা কথা শুনি। তাদের অনন্য কীর্তির কথা পড়ি। এখন সেগুলো অবিশ্বাস্য মনে হয়। একটু চিন্তা করে দেখলেই কিন্তু সেগুলোকে আর অসম্ভব মনে হবে না। তারা জন্মের আগে থেকেই একজন ‘নেককার’ মায়ের ছায়াতে ছিল। একজন ধার্মিক মায়ের কোলে বড় হয়েছিল। একজন মুত্তাকী মায়ের আঁচল ধরে পৃথিবীকে চিনেছিল। একজন পর্দানশীন মায়ের শাসনে বেড়ে উঠেছিল!
.
একজন মহিয়সী মায়ের কারণেই একটি শিশু সাত বছর বয়েসেই কুরআনে হাফেয হয়ে যায়। কেউ নয় বছরে হাফেয হয়ে যায়। মায়ের নিবিড় তত্তাবধানের বরকতেই ইমাম শাফেয়ী রহ. মাত্র চৌদ্দ বছর বয়েসেই ‘ফতোয়া’ দিতে শুরু করেছিলেন। একজন ইলমপিপাসু মায়ের কারণেই, ইমাম নববী রহ. মাত্র বারো বছর বয়েসেই প্রতিদিন বারোজন শায়খের কাছে পাঠ নিতে যেতেন!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন