শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

খলীফার হারানো ছেলে

Atik Ullah

উমাইয়া খিলাফাহ তখন দুর্বল হয়ে এসেছে। আব্বাসীরা গোপনে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আব্বাসীদের দ্বিতীয় খলীফা ছিলেন ‘আবু জা‘ফর মানসুর’। তিনিও গোপন আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। আন্দোলনের প্রয়োজনেই তাঁকে বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়াতে হতো। ছদ্মবেশ নিয়ে। এবার তার রোখ পড়লো ‘মসুলে’। অবিশ্রান্ত তৎপরতার জোরে শক্ত ঘাঁটি গড়ে উঠলো এখানে। সুযোগ বুঝে একটা বিয়েও করে ফেললেন। বিয়ের কিছুদিন পর আর মসুলে থাকা গেলো না। অবস্থান জানাজানি হয়ে যাওয়াতে। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অনিশ্চিত জীবন তার। কখন ধরা পড়ে যান! সাতপাঁচ ভেবে স্ত্রীকে রেখেই মসুল ছাড়লেন। রওনা হওয়ার আগে স্ত্রীকে একটা কাগজ দিলেন:
-কী আছে এতে?
-আমার বংশলতিকা! আমি নিজ হাতে লিখেছি। 
-মানুষটাকে কাছে না পেলে, তার নসবনামা দিয়ে আমি কী করবো?
-শোন, আমার জীবনটা খড়কুটোর মতো। কখন কোথায় যাই, কী করি, তার ঠিক ঠিকানা নেই। আমাদের ঘরে নতুন মেহমান আসবে। ছেলে হলে তার নাম রেখো: জা‘ফর। মেয়ে হলে তুমি পছন্দমতো একটা নাম রেখে দিও। নসবনামাটা তখন কাজে লাগবে!
.
সময় মতোই ঘর আলো করে এক পুত্রসন্তান জন্ম নিল। এদিকে আব্বাসী আন্দোলন সফল হলো। মসনদে বসলেন ‘আবুল আব্বাস’। প্রথম আব্বাসী খলীফা। খুশির খবর মসূলে পৌঁছতে দেরী হলো না। শিশু জা‘ফরও ততদিনে ডাগর হয়ে উঠেছে। কাছের লোকেরা ছেলের মাকে বললো: 
-তুমি আমীরুল মুমিনীনের কাছে গিয়ে সব খুলে বলছো না কেন? 
-তাকে বলে কী হবে? তিনি তো ছেলের বাবা নন!
-তবুও তিনি হয়তো একটা ব্যবস্থা নিবেন! 
-নাহ, তাকে বলার দরকার নেই। ছেলের বাবা হয়তো নানা ঘটনার ডামাঢোলে ছেলের কথা ভুলে গেছেন। কমদিন তো হলো না! দিজলা-ফোরাতে অনেক পানিই এতদিনে বয়ে গেছে! আর খলীফার ভাই-ই যে আমার স্বামী, তার প্রমাণ কি? আমি শুধু তার নামই জানি! নামে মিল হলেও, খলীফার ভাই ভিন্ন কেউও হতে পারেন!
-তুমি একবার নসবনামাটা সরাসরি গিয়ে দেখাও না!
-আমার যাওয়া সম্ভব নয়। শোভনীয়ও নয়। তোমরা বরং কেউ একজন গিয়ে, তাকে দেখে এসো। তার অবয়বটা কেমন, দেখে এসে আমাকে জানাও!
তাই করা হলো। একজন খবর নিয়ে এসে বিস্তারিত জানাল। মা বললেন: নাহ, এই মানুষ ছেলের বাবা হতে পারেন না। মিলছে না। মা এ-বিষয়ে আর আলোচনা বাড়তে দিলেন না। 
.
প্রথম খলীফা বেশিদিন বাঁচলেন না। নতুন খলীফা হলেন প্রয়াত খলীফার ছোট ভাই ‘আবু জা‘ফর মনসুর’। নানা ব্যস্ততায় মসূলে রেখে আসা বিবির কথা হয়তো তার মনেই নেই। বালক জা‘ফর এখন যুবক। বাবার মতোই লায়েক হয়েছে। মা সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে কসুর করেন নি। জা‘ফরের ঝোঁক দেখা দিল ‘লেখালিখির’ দিকে। মানে ‘নকলনবিশী’। একটা কিতাব দেখে আরেকটা ‘কপি’ করা। তখনকার বেশ চালু পেশা। এই পেশায় দক্ষতা অর্জনের পর, ভাগ্য অন্বেষণে বাগদাদে চলে এলো জাফর। কর্মদক্ষতাগুণে সেকালের সেরা নকলনবীশ ‘আবু আইয়ুব’-এর দপ্তরে চাকুরি জুটলো। আবু আইয়ুব ছিলেন, খলীফার খাস ‘নকলনবীশ’। রাষ্ট্রীয় গোপন চিঠিপত্র তিনিই কপি করতেন। জা‘ফর তার মনিবের আস্থা অর্জন করে ফেললো অল্প দিনেই। আবু আইয়ুব মাঝেমধ্যে খলীফার কাজও জাফরকে দিয়ে করাতে শুরু করলো। একদিন দপ্তরে কেউ ছিলো না। জাফর একা বসে কাজ করছিল। খলীফা জরুরী একটা চিঠি লেখাতে নিজেই চলে এলেন। লেখার কাজে জা‘ফরের নিমগ্নরূপ দেখে, তার বেশ ভাল লাগলো। কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন:
-যুবক! তোমার নাম?
-জা‘ফর!
-জা‘ফর বিন....?
এবার যুবক আমতা আমতা করতে লাগলো। খলীফা বিস্মিত হয়ে কিছুটা ধমকের সুরে বললেন:
-জাফর বিন?
-জ্বি, জাফর বিন আবদুল্লাহ। 
-তোমার বাবা কোথায়?
-আমি জন্মের পর থেকেই আব্বুকে দেখিনি! আম্মু বলেছেন, আমার আব্বু একজন ভদ্রঘরের সন্তান। তার কাছে একটা কাগজ আছে। তাতে আমার নসবনামা লেখা আছে!
-নসবনামা? সেটা এখন বলতে পারবে?
-আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আলি বিন আবদুল্লাহ বিন আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিব!
নসবনামা শুনেই খলীফার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেলো। গলার স্বরটা কেমন যেন বদলে গেলো। চোখেমুখে গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো। সামান্য ভেবে প্রশ্ন করলেন:
-তোমার আম্মু কোথায়?
-মসূলে!
-কোন মহল্লায়?
-অমুক মহল্লায়!
-তুমি ‘অমুক’ ব্যক্তিকে চেনো?
-জ্বি চিনি। তিনি আমাদের মহল্লার মসজিদের ইমাম। 
-আর ‘অমুক’কে চেনো?
-জ্বি। তিনি আমাদের এলাকার মুদি দোকানদার। 
-
খলীফাকে এত এত প্রশ্ন করতে দেখে, জা‘ফরের মনে ভয় ঢুকে গেলো। আবার ভয়ের পাশাপাশি অজানা কোনও এক কারনে তার দু’চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। তার চোখে পানি দেখে খলীফার গলাও অনেকটা ধরে এলো:
-অমুক ‘মহিলা’কে চেনো?
-জ্বি। তিনিই আমার আম্মু!
খলীফা ফুঁপিয়ে উঠে, জা‘ফরকে জড়িয়ে ধরলেন:
-তুমি জানতে আমি তোমার বাবা?
-জ্বি। 
-আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। আজকের পুরো ব্যাপারটা আবু আইয়ুবের কাছে গোপন রাখবে। সে এবং অন্যরা যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায় আমার-তোমার পরিচয়টা। খুব সাবধানে থাকবে। খুবই সাবধান। 
.
এরপর থেকে লেখালেখির বিভিন্ন কাজে, খলীফা আবু আইয়ুবের পাশাপাশি জাফরকেও ডেকে পাঠাতে শুরু করলেন। এটা দেখে আবু আইয়ুবের মনে ঈর্ষা জন্ম নিল। তার মধ্যে পদ হারানোর ভয় ঢুকে গেলো। একদিন খলীফা সুযোগ মতো জাফরকে বললেন:
-তুমি চিঠিটা নিয়ে তোমার মায়ের কাছে যাও! যত তাড়াতাড়ি পারো তাকে এবং পরিবারের অন্যদেরকে নিয়ে ফিরে এসো। 
.
বিষয়টা আবু আইয়ুবের দৃষ্টি এড়াল না। জাফর বাগদাদ ছেড়ে মসুলের দিকে রওয়ানা হলো। আবু আইয়ুবও তার পিছু পিছু একজন চর পাঠালো। তাকে বলে দিল:
-ওই যুবক একজন বিদ্রোহী। তাকে হত্যা করে, যা কিছু সাথে পাও, নিয়ে আসবে!
চর তাই করলো। থলের মধ্যে একটা চিঠি পাওয়া গেলো। সেটা পড়ার পর আবু আইয়ুব ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দিল। ঝোঁকের বশে কী ভয়ংকর কাজ করে বসেছে, তার পরিণতি কল্পনা করে শিউরে উঠলো। ঘটনার কথা খলীফার কানে যেতে দেরী হলো না। আবু আইয়ুবকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো। পরবর্তীতে যখনই দরবারে আবু আউয়ুবের প্রসঙ্গ উঠতো, খলীফা দুঃখ-ভারাক্রান্ত স্বরে বলতেন:
-এই লোক আমার কলিজার টুকরার হত্যাকারী!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন