ব্লাসফেমী[Blasphemy] বলে ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে।এর হুবহু বাংলা অর্থ করলে হয় ‘ঈশ্বরনিন্দা’। ইসলাম ধর্মে আল্লাহর পরেই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন নবী মুহাম্মাদ(ﷺ)।আল্লাহ, নবী(ﷺ) কারো সম্পর্কে নিন্দা করা, কটূক্তি করা বা অশালীন মন্তব্য করলে ইসলামে সেটি মারাত্মক অপরাধ এবং সেটি ব্লাসফেমী বলে বিবেচিত হয়।
.
আমাদের দেশে দিনে দিনে নাস্তিক, মর্ডানিস্ট, ‘সুশীল’ ইত্যাদি ক্যাটাগরির মানুষ বৃদ্ধি পাচ্ছে [আমার খুব নিকট ও আপনজনও এই ক্যাটাগরিতে আছেন]। তারা ‘মুক্তচিন্তা’, ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ ইত্যাদি নিয়ে নিত্য নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন । আমার এই পোস্টটা মূলত তাদেরকে উদ্যেশ্য করেই। তাদের কাছে ব্লাসফেমীর ব্যাপারে কুরআন-হাদিস কী বলে তার কোন মূল্য নেই, তারা নিজেরা যা বোঝেন সেটাকেই হক বলে প্রচার করেন, নিজেদের ইচ্ছামত ইসলামকে ব্যাখ্যা করেন, “আমি মনে করি না ইসলাম এমন, আমি মনে করি না ইসলাম এইটা বলে...” এ জাতীয় কথা বলেন, এরপর দলিল-প্রমাণ দিলে নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন, কিন্তু সেটাকে অগ্রাহ্য করে ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে বলেন---“দাঁড়ি রাখছো বলে কি বেশি বুঝে গেছ? ধর্মের ঠিকাদার হয়ে গেছ? আমি বলতিছি ইসলাম এমন...!!”। কাজেই এই পোস্টে হাদিস-কুরআনের দলিল দিয়ে তাদের আর বিব্রত করব না। তারা কথায় কথায় ‘হুজুরদের’কে জঙ্গী-মৌলবাদী বলেন, “দেশটা আফগানিস্তান হয়ে যাচ্ছে”- বলে আক্ষেপ করেন।তাদের প্রিয় সমাজ হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার ‘আধুনিক’ ও ‘উন্নত’(?) সমাজব্যবস্থা।তাদের প্রিয় সমাজ-সভ্যতার তৈরি করা কিছু স্টান্ডার্ড দিয়েই আজকে ব্লাসফেমী নিয়ে কিছু লিখব।
.
‘মুক্তচিন্তা’, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ ইত্যাদি নিয়ে প্রচুর আলোচনা আমরা ইদানিং শুনতে পাচ্ছি। International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR), Article-19 অনুযায়ীঃ
.
“প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে।এটি আন্তর্জাতিকভাবে আইনরূপে স্বীকৃত হবে। তবে#কিছু_কিছু_ক্ষেত্র ব্যতিরেকে... ”
ঐ অনুচ্ছেদেই এই ক্ষেত্রগুলো আলোচনা করে বলা হয়েছেঃ “যে মত প্রকাশ করা হয়েছে, তা কারো অনুভূতিতে আঘাত করে হতে পারবে না। ...”
মুক্তমনারা নিয়মিতই মুসলমানের অনুভূতিতে আঘাত হানছেন, অনুভূতিকে রীতিমত ক্ষতবিক্ষত করছেন। ‘সুশীল সমাজের’ কাছে এগুলো তবু এগুলো “মত প্রকাশের স্বাধীনতা”। ইসলামের আইনকে তো ওনারা থোরাই কেয়ার করেন। আন্তর্জাতিক আইনকেও যে তারা এ দ্বারা লঙ্ঘণ করছেন তা কি তারা জানেন? নাকি আন্তর্জাতিক আইন প্রনয়ন করা মানুষগুলোও এখন থেকে মুক্তমনাদের চোখে “জঙ্গী-মৌলবাদী-তালেবান” হয়ে ধরা দেবে?
.
আধুনিক সভ্যতার আশির্বাদ কিংবা অভিশাপকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে যেই দেশটি সেটি হচ্ছে ইংল্যান্ড। তাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে একসময়ে সূর্য অস্ত যেত না, এত বড় ছিল তাদের সাম্রাজ্য [এরপরেও ব্রিটেন কিন্তু জঙ্গী না, তারা ‘আধুনিক’ ; যদিও তাদের সাম্রাজ্য রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে এসেছে।] সুশীলদের চোখে ‘আধুনিক’ এই দেশটিতে ১৯২২ সাল পর্যন্ত ব্লাসফেমী আইন ছিল।এর আগ পর্যন্ত ঐ দেশে কেউ যদি বাইবেল অথবা গির্জার ব্যাপারে কোন প্রকারের অভিযোগ করত বা প্রশ্ন তুলতো, সেই অভিযোগটি যদি যথার্থও হত, তাকে মৃত্যদণ্ড দেওয়া হত। ঈশ্বর কিংবা যিশুর বিরুদ্ধে কটূক্তি করা তো অনেক দূরের প্রশ্ন। ইংল্যান্ডে Edward Whitman নামে এক ব্যক্তি ১৬১২ সালে বাইবেলের কিছু অসঙ্গতির ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন। এই ‘অপরাধে’ ইংল্যান্ডের সরকার তাকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়।একই ‘অপরাধে’ ১৬৯৭ সালে ইংল্যান্ডে Thomas Aikenhead নামে আরেক ব্যক্তিকে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডে সর্বশেষ ব্লাসফেমীর কারণে মৃত্যদণ্ড দেওয়া হয় ১৯২২ সালে।এর আগ পর্যন্ত অসংখ্য ব্যক্তিকে “সভ্যতার লীলাভূমি” ঐ দেশে ব্লাসফেমীর জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় যার রেকর্ড উল্লেখ করলে একটা বই হয়ে যেতে পারে।
.
১৯৫২ সালের আগ পর্যন্ত সমগ্র আমেরিকাতে ইংল্যান্ডের মতই ব্লাসফেমী আইন ছিল।১৯৫২ সাল থেকে আমেরিকার কিছু অঙ্গরাজ্যে এই আইন উঠিয়ে নেওয়া হতে থাকে। আমেরিকায় মিশিগান, ওকলাহমা, পেনসিলভানিয়া, ম্যাসাচুসেটস এই অঙ্গরাজ্যগুলোতে আজ পর্যন্ত ব্লাসফেমীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির বিধান রয়েছে।
.
আমরা যারা রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাস পড়েছি, তারা জানি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের পরে কী বিপুল উদ্যমে রোমান সম্রাটরা ব্লাসফেমী আইন কার্যকর করেছেন। বাইবেল কিংবা গির্জা নিয়ে সামান্যতম প্রশ্ন তোলা, এমনকি বাইবেল ল্যাটিন থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করাও সেখানে ব্লাসফেমী ছিল।লক্ষ লক্ষ মানুষ সেখানে ব্লাসফেমী আইন দ্বারা জীবন্ত দগ্ধ হয়ে, কিংবা ফাঁসীতে ঝুলে মৃত্যবরণ করেছে। রোম সভ্যতাকে কিন্তু সুশীলরা “জঙ্গী-মৌলবাদী” কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল বলেন না। বরং রোম হচ্ছে তাদের দৃষ্টিতে “আধুনিক সভ্যতার আঁতুরঘর”, রোম সভ্যতার ইতিহাস তাদের কাছে সুখপাঠ্য। বরং ব্লাসফেমীর জন্য শাস্তি দাবি করা মুসলিমরা হচ্ছে “সভ্যতাবিবর্জিত তালেবান”। সেই দেশে, বর্তমান ইতালীর সংবিধানের ২৭৪নং অনুচ্ছেদে আজ পর্যন্ত ব্লাসফেমীর জন্য শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
.
আরেক ‘আধুনিক’ দেশ ইস্রায়েলে আজ পর্যন্ত সংবিধানের ১৭০ ও ১৭৩ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে—কেউ যদি তানাখ [ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ, বাইবেলের Old Testament] এর বিপক্ষে কিছু বলে, তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হবে ও বিশাল অঙ্কের জরিমানা করা হবে। তাদেরও ব্লাসফেমী আইন আছে।
.
সুশীলদের প্রিয় আরেক দেশ ভারত।সেই দেশের সংবিধাণের ২৫৯ ও ২৫৯(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে--- কোন ব্যক্তি অন্য কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারবে না। এর জন্য শাস্তির ব্যাবস্থাও আছে।
.
অস্ট্রিয়া, জার্মানী, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, ফ্রান্স—এইসব ‘আধুনিক’ দেশের আইনের মধ্যে আজো ধর্মানুভূতিতে আঘাত তথা ব্লাসফেমীর জন্য বিভিন্ন প্রকার শাস্তির বিধান আছে। ইউরোপের আরো অনেক দেশে আজো বাইবেল কিংবা যিশুখ্রিষ্টের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বললে শাস্তির বিধান রয়েছে।
.
আমরা এতক্ষণ ‘সুশীল সমাজের’ প্রিয় ও অনুসরণযোগ্য কিছু দেশের আইনকানুন দেখলাম। এদের কোনটি মুসলিম দেশ নয়। তারা নিজ নিজ দেশের ধর্মের বিরুদ্ধে অবমাননাকারীর জন্য শাস্তির বিধান রেখেছে। এইসব দেশে ধর্মের অবমানকারীর বিচার সরকারীভাবে হয়।তাদের আইন-কানুনের প্রতি সুশীলদের কোন প্রশ্ন নেই।কিন্তু ইসলাম যখন ব্লাসফেমারের মৃত্যদণ্ডের কথা বলে, তখন নানা প্রকারের আপত্তি ওঠে।কেউ বলে “ইসলাম এমন না...”, কেউ আবার ইসলামকে চরম কটুক্তিকারীকেও ‘মুক্তমনা’ কিংবা ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ শব্দের দ্বারা আঁড়াল করেন। জাতির জনক কিংবা প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননা করলে নিশ্চিত গ্রেপ্তার।আর আল্লাহ ও রাসুল(ﷺ)কে অপমান করলে জার্মানীর বৃত্তি, ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’র খ্যাতি অথবা “ইসলাম এইরকম না...” টাইপের সুশীল ফতোয়াবাজি।তারা কি জানেন--নিজেকে মুসলিম দাবি করা, আবার আল্লাহর রাসুল(ﷺ) এর অপমানকে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ বলা তাদের সুশীল চেতনা কিংবা ইসলামী চেতনা উভয়ের সাথেই সাংঘর্ষিক? তারা কি জানেন যে তারা মুনাফিকী করছেন? ডাবল স্টান্ডার্ড ফলো করছেন?
.
এক সময় ইউরোপের প্রতিটি দেশেই যে কোন ব্লাসফেমীর জন্য পুড়িয়ে মারার বিধান ছিল। আস্তে আস্তে তারা ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত হচ্ছে এবং ক্রমে শাস্তি কমছে।তাদের ধর্মের সেই শক্তি আজ নেই যা ছিল ১০০ বছর আগে।ইসলাম কোন মানবসৃষ্ট ধর্ম নয়।এর যথার্থ অনুসরণকারী আজ থেকে ১০০০ বছর আগে যেভাবে ভাবত, আজো সেভাবে ভাবে।ইসলামের আত্মিক শক্তি আজও কমেনি এবং কখনো কমবে না।কুরআন এবং সুন্নাহর বিধানও কখনো পরিবর্তন হবে না। সুশীলরা যতই ফতোয়াবাজি করুক কিংবা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন