মূল :
নিদাল গুসাম : অনুবাদ : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
বিজ্ঞান
ও শিক্ষায় মুসলিম বিশ্বের অতীতের অবদান ছিল বিস্ময়কর। ইসলামের ‘স্বর্ণযুগে’
পাণ্ডিত্য ও শিক্ষা গ্রহণের অন্বেষা গোটা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। শিক্ষার এই
আলোকবর্তিকা বহু শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। ওই সময়ে বিশ্বের প্রথম
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষা ও গবেষণায় মুসলিম
সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো বিশ্বের অবশিষ্ট দেশগুলোর তুলনায় পেছনে পড়ে রয়েছে।
এ
অবস্থার অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। মুসলিম দেশগুলোতে আধুনিক চাকরির সংস্থান ও
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য ভালোভাবে জীবনযাপনের ব্যবস্থা করা গেলে বৈশ্বিক
উন্নয়নের সাথে তালমিলিয়ে মুসলিম বিশ্বও এগিয়ে যেতে পারবে। আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে
শীর্ষ ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মুসলিম বিশ্ব থেকে মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়
স্থান করে নিতে পেরেছে। সেটি হচ্ছে তুরস্কের মিডল ইস্ট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি।
অন্যান্য ৪০০ শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় মাত্র এক ডজনের মতো মুসলিম
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
‘দ্য ট্রেন্ডস ইন ইন্টারন্যাশনাল
ম্যাথমেটিকস অ্যান্ড সায়েন্স স্টাডি অ্যান্ড দ্য প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল
স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্টে’র মতে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে
বিজ্ঞান ও গণিতের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকমানের কোনো পরীক্ষা না থাকলেও এসব বিষয়ে
মুসলিম ওয়ার্ল্ড টেস্টে (মুসলিম বিশ্ব পরীক্ষায়) চতুর্থ, অষ্টম ও দশম গ্রেডের ছাত্ররা গ্লোবাল
অ্যাভারেজ বা গড়ে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে পিছিয়ে রয়েছে। ছাত্রদের মধ্যকার এই
ব্যাপক পার্থক্য ক্রমেই বাড়ছে। অধিকন্তু, আন্তর্জাতিক জার্নালে
প্রকাশিত নিবন্ধ এবং সরকারি প্রতিবেদনে উল্লিখিত গবেষণার ফল হচ্ছে জনসংখ্যা এবং
আর্থিক সামর্থ্য বা সফলতা হার অনুযায়ী কম। মুসলিম দেশগুলো গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য
তাদের জিডিপির গড়ে মাত্র প্রায় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় করে। অপর দিকে, একই খাতে বৈশ্বিক গড় হচ্ছে জিডিপির ১
দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং ওইসিডি গড় হচ্ছে ২ শতাংশের ওপরে।
মুসলিম
বিশ্বে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কর্মরত লোকসংখ্যাও বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গড়
সংখ্যা থেকে অনেক কম। ১৮ মাস আগে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একটি বেসরকারি ও
নির্দলীয় টাস্কফোর্সকে মুসলিম ওয়ার্ল্ড সায়েন্স ইনিশিয়েটিভ এবং মালয়েশিয়ান
ইন্ডাস্ট্রি গভর্নমেন্ট গ্রুপ ফর হাই টেকনোলজি জানায়, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
মুসলিম বিশ্বে খুবই নগণ্য বা অপ্রতুল। তাই পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কিভাবে
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সহায়তা করতে পারে তা- নির্ধারণ করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এই
প্রয়াসের সাথে আমাকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আমাকে এ ব্যাপারে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া
হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে ভালোভাবে বোঝাপড়া এবং সম্ভাব্য প্রতিকার মুসলিম বিশ্বে
বিজ্ঞানকে আবার শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে আসতে পারে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধিত
হলে তা মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বিরাট প্রভাব ফেলবে। মুসলিম
বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আমরা শুধু বাজেট এবং গবেষণার ওপর
গুরুত্ব দিচ্ছি না; আমাদের ইস্যুগুলোতে
বিজ্ঞান শিক্ষা এবং ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থানকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া প্রথমে আমরা মুসলিম বিশ্বে কিভাবে বিজ্ঞান পড়ানো হয়, সেখানে পুঁথিগত বিদ্যার ওপর অধিক
গুরুত্ব দেয়ার পদ্ধতি, পাঠ্যবই, নির্দেশমূলক ভাষা, ‘বিতর্কিত’ বিষয় (যেমন- বিবর্তনের
থিওরি) এবং বিজ্ঞান ক্লাসগুলোতে ধর্মের ভূমিকা ইত্যাদি কিভাবে শিক্ষা দেয়া হয়, তা পর্যালোচনা করি।
অতি
সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে টাস্কফোর্স উল্লেখ করে, মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞানের সার্বিক
অবস্থা দুর্বল হলেও সেটাকে উন্নত করতে কার্যকরভাবে ও আন্তরিকভাবে আরো অনেক কিছু
করা যেতে পারে। টাস্কফোর্স শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জাতীয় নীতি প্রণয়ন বাণীতে
নির্ধারণী সংস্থা এবং সায়েন্স একাডেমি শিল্পসংস্থা ও সিভিল সোসাইটির স্বার্থে
সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর মতো অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পেশ
করেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর
একটি প্রধান লক্ষ্য হতে হবে ছাত্রদের সৃষ্টিশীলরা উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার ক্ষমতা
এবং সমালোচনামূলক এনকোয়ারির বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা। এই লক্ষ্যে
টাস্কফোর্স বিজ্ঞানে মনোযোগী ছাত্রদের মানবিক, সমাজবিজ্ঞান, ভাষা এবং যোগাযোগের বিষয়ে
শিক্ষাদানের মাধ্যমে তাদের মন-মানসিকতাকে আরো বড় ও উদার করার পরামর্শ দিয়েছে। একই
সময়ে টাস্কফোর্স বিশেষভাবে ‘এনকোয়ার বেজড’ এবং ‘অ্যাকটিভ লার্নিং’ অ্যাপ্রোচসহ
আন্তর্জাতিকভাবে ‘স্ট্রেট অ্যান্ড ট্রু টিচিং’ পদ্ধতি অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছে।
অবশ্য এ ধরনের একটি শিক্ষাপদ্ধতি পরিচালনার জন্য এসব পদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত প্রফেসর
প্রয়োজন। অধ্যাপকদের পাঠ্যবই লিখতে এবং বিজ্ঞানকে হাতের নাগালে নিয়ে আসার জন্য বই
লিখতে উৎসাহিত করা উচিত।
এসব
সুপারিশ দেখে কেউ কেউ হয়তো বিস্মিত হতে পারেন এবং মুসলিম বিশ্বের গবেষণাকর্মের
অপ্রতুলতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ ধরনের উদ্যোগ একক মানবিকতাসম্পন্ন
প্রকাশনার চেয়ে অত্যধিক হারে সত্যিকারের বিশ্বব্যাপী প্রকাশনার সুযোগ সৃষ্টির
দ্বার উন্মোচন করবে এবং বিশাল জনগোষ্ঠী এর মাধ্যমে উপকৃত হবে।
টাস্কফোর্স
সুপারিশ করেছে জাতীয় নীতি প্রণয়নকারী সংস্থাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষা
কারিকুলাম এবং গবেষণা কর্মসূচির ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল বিষয়গুলো
অন্তর্ভুক্ত করতে আরো স্পেস অনুমোদন করবে। টাস্কফোর্স সব প্রতিষ্ঠানের প্রতি গুণী
ব্যক্তিদের নিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকে স্বেচ্ছায় গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।
প্রকাশনাকে জোরদার করতে একযোগে অর্থ ব্যয়ের মতো কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়
টাস্কফোর্স। দ্রুত র্যাঙ্কিং জোরদার করলে দীর্ঘমেয়াদে কখনো ক্ষতির মুখে পড়তে হয়
না। এসব পদক্ষেপের জন্য ব্যাপক পরিবর্তনের প্রয়োজন। তাই টাস্কফোর্স মুসলিম বিশ্বের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি এক্সেলেন্স অব ইউনিভার্সিটিজ ফর সায়েন্স
(এনইএক্সইউএস)-এর একটি স্বেচ্ছা নেটওয়ার্কে যোগদানের আহ্বান জানাচ্ছে।
টাস্কফোর্স
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ও ফ্যাকাল্টির সমন্বয়ে গঠিত পিয়ার (পিইইআর) গ্রুপ কর্তৃক
স্বীকৃতি দেয়া এবং পরিবর্তনগুলো নিজেদের মধ্যে প্রথম বাস্তবায়ন করার জন্য পদক্ষেপ
নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তারা আশাবাদী, একবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর
প্রথম গ্রুপটি তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করলে অন্যরাও সে পথে অগ্রসর হবে। এর
মাধ্যমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, রেগুলেটরস এবং অন্যান্য
নীতিনির্ধারণী সংস্থাগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এতে পরিবর্তনের জন্য উপযোগী
পদক্ষেপ নেয়ার পথ সুগম হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে গবেষণা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, এবং বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে
পরবর্তী প্রজন্ম কেবল ফ্যাক্টস ও থিওরি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জাহির করবে না বরং তারা
বিভিন্ন ধারণা ও মতাদর্শ বিশ্লেষণ, ত্রুটি-বিচ্যুতি নির্ণয়
এবং আমাদের জ্ঞানের ভিতকে আরো সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করার বিষয়ে শিক্ষা লাভ করবে।
বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। সুষ্ঠু অ্যাকাডেমিক
পরিবেশ সৃষ্টির গুরুত্ব উপলব্ধি করার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কোনো বিকল্প
নেই।
লেখক :
আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব শারজাহ,

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন