তম্বুরির বাড়ি সেকালের বাগদাদে। অনেক বড় ধনী ব্যবসায়ী। হলে কী হবে, সে ছিল অত্যন্ত কৃপণ। সেই যে কবে এক জোড়া জুতো কিনেছে, সেটা দিয়েই চালাচ্ছে। ছিঁড়ে গেলে জোড়াতালি দিয়ে দিব্যি পায়ে দিয়ে বেড়াচ্ছে।
শেষে এমন হলো, জুতোর গায়ে চামড়ার নামগন্ধও রইল না। তালির ত্যানা আর রঙবেরঙের সুতাই হলো জুতার বর্তমান রূপ।
.
পুরো বাগদাদে তম্বুরির বিদঘুটে জুতোর খ্যাতি (!) ছড়িয়ে পড়ল। সবাই তাকে জুতা-তম্বুরি নামেই একডাকে চেনে।
.
তম্বুরির বখিলীর কুখ্যাতি প্রবাদপ্রতীম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। এতদিন তো যাওবা জুতার তলাটা ‘অরিজিনাল’ ছিল, এখন ক্ষয়ে ক্ষয়ে সুখতলাটাও তালিযুক্ত হয়ে বিচিত্র কিসিমের এক পদার্থ হয়ে দাঁড়াল তার জুতো।
.
রাস্তায় বেরোলেই দুষ্ট ছেলের দল তার পিছু নেয়। মসজিদে গেলে মুসল্লিরা টিটকারি মারে। বাজারে গেলে ব্যবসায়ীরা জুতো গল্প শুনতে চায়।
.
এতসব ফ্যাচাং আর কাঁহাতক সহ্য হয়? তম্বুরি ঠিক করলো সে বখিলি ছেড়ে দিবে। জুতো জোড়া ফেলে দিবে। তার বখিলির কারণে বুড়ো হতে চলল, এখনো একটা টুকটুকে বউ ঘরে তুলতে পারলো না। কোনও বাড়িতে প্রস্তাব নিয়ে গেলে তার জুতো দেখেই সবাই তাকে চিনে ফেলে। মেয়ের মা ঝামটা মেরে তাকে বাড়ি ছাড়া করে।
.
একদিন সকালে উঠে ঠিক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। আজই জুতোর শেষ দিন। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের শেষ মাথার ভাগাড়ে নিয়ে ফেলে দিল।
.
ফেরার পথে সুন্দর কাঁচভর্তি মেশকে আম্বর বিক্রি হতে দেখে তার ব্যবসায়িক বুদ্ধি চকচক করে উঠলো। আতরবিক্রেতাকে নাজেহাল-নাস্তানাবুদ করে নামমাত্র মূল্যে মেশক কিনে নিল। বাড়ি এনে তাকের ওপর রেখে দিল।
.
ওদিকে বাজারের মেথর ময়লা ফেলতে গিয়ে দেখল, তম্বুরির জুতো ময়লার মধ্যে পড়ে আছে। হায় হায় করে জুতোজোড়া তুলে নিল। ভাবল তাম্বুরি নিশ্চয় জুতো হারিয়ে এখন দিশেহারা!
মেথর জুতো নিয়ে বাড়ি এসে দেখে, দরজা বন্ধ, অনেক ধাক্কাধাক্কির পরও দরজা খুলল না দেখে, জানালা দিয়ে জুতোজোড়া ঘরের ভেতরে ছুঁড়ে ফেলল।
.
পড়বি তো পড়, মালির ঘাড়ে। জুতো গিয়ে পড়ল সকালে কিনে আনা আতরের জারে। কাঁচের জার প্রবল পরাক্রান্ত তালিযুক্ত বিশমণী জুতার আঘাত সইতে পারবে কেন?
.
তম্বুরি রাতে ফিরে দেখে তার সব শেষ। আরেক জনকে ঠকিয়ে কেনা মেশকে আম্বর তো নেই নেই, পুরো ঘরটাও ভাঙা কাঁচে বিপদজনক হয়ে আছে। কিভাবে ভাঙল? কে আমার এমন সর্বোনাশ করলো? খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে চোখ পড়লো, ঘরের কোনে নিরীহ ভঙ্গিতে জুতোজোড়া পড়ে আছে। আর বুঝতে বাকি রইল না, কালপ্রিটটা কে?
-খোদার লা‘নত পড়–ক! তোদের মাথায় আসমান ভেঙে পড়–ক। আমি তোদের ছাড়লেও দেখি তোরা আমার পিছু ছাড়ছিস না! তবে রে বেল্লিক! তোদের দেখাচ্ছি মজা!
.
তম্বুরি জুতা নিয়ে রাতের আঁধারে দজলার একেবারে মধ্যখানে ফেলে দিয়ে এল। এবার নিশ্চিন্ত। অভিশপ্ত জুতো রাহুগ্রাস থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। ওফ!।
.
অন্যদিনের মতো আজও খায়ের মাঝি নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে বের হলো। প্রথম খেপ মেরে জাল টানতে গিয়ে দেখে, বেজায় ভারী। আহ! নিশ্চয় বড় কোনও বোয়াল মাছ পড়েছে! জাল তোলার পর দেখা জুত! আরে এগুলো তো তম্বুরির জুতো। আহ বেচারা না জানি কত কষ্টে আছে! এত বছরের সঙ্গী! যাই গিয়ে দিয়ে আসি!
.
তম্বুরি চোখ কটমট করে চুপচাপ জুতো গ্রহণ করলো। মাঝিকে কিছুই বলল না। মুখের ওপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল। জুতো নিয়ে বাড়ির ছাদে শুকোতে দিল।
.
পাশের বাড়ির একটা বিশাল হুলো বিড়ালটা সব সময় তম্বুরির ছাদে ঘুমায়। একটু পর বিড়াল মাছের গন্ধ পেয়ে শুঁকে শুঁকে জুতোর কাছে এল। ভাবল জুতোর মধ্যে মাছ আছে। কামড়া-কামড়ি শুরু করে দিল।
তাম্বুরি দেখে বেড়ালটাকে তাড়াতে গেল। বেড়াল একটা জুতো মুখে নিয়েই দৌড়ে পালাল। ছাদ টপকাতে গিয়ে বেড়ালের মুখ থেকে জুতোটা মুখ থেকে ছুটে গেল। সোজা গিয়ে পড়ল এক মহিলার মাথায়। মহিলা ছিল গর্ভবতী। এমন ভারী জুতার আঘাত সইতে না পেরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। বেকায়দা পড়ার কারণে আঘাত পেয়ে গর্ভ খালাস হয়ে গেল।
মহিলার স্বামী এসে দেখল জুতোটা তম্বুরির। সোজা কাযির কাছে গিয়ে বিচার দিল। বিচারের রায় হলো, তম্বুরিকে ভ্রƒণ হত্যার জন্যে ‘দিয়ত’ (রক্তপণ) দিতে হবে। অবশ্য বিচারক বিশেষ বিবেচনায়, জুতোজোড়া তাম্বুরিকে ফেরত দিয়ে দিলেন।
.
তম্বুরি দু’চোখকে ভাঁটার মতো লাল করে বললো:
-ওরে মানুষখেকো জুতো! দেখ এবার তোদের কী করি! এমন জায়গায় তোদেরকে ফেলে দিয়ে আসব, যেখানে মানুষও পৌঁছতে পারে না।
.
তম্বুরি জুতোজোড়া নিয়ে বাগদাদের পয়ঃপ্রণালীর সবচেয়ে বড় ড্রেনটাতে ফেলে দিয়ে এল। মুহূর্তেই সোতে ভেসে জুতো কোথায় চলে গেল! ফুরফুরে মেজাজে শীস দিতে দিতে বাড়ি এল।
.
কয়েক ঘণ্টা পর দেখা গেল, বাগদাদের রাস্তাঘাট ময়লা-নোংরা পানিতে সয়লাব। বোটকা দুর্গন্ধে টেকা দায়। মেথর ডাকা হলো। দেখা গেল একজোড়া জুতে ভেসে গিয়ে পাইপের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। জুতোগুলো তম্বুরির। মেথর আবারও দয়া করে হারানো জুতো মালিককে ফেরত দিয়ে এল। কিন্তু জনগনের দুর্ভোগের কারণ হওয়াতে কাযি ধরে নিয়ে তম্বুরিকে দু’চার ঘা দিয়ে বিদেয় করলো।
.
ইয়া আল্লাহ! এ কোন অভিশাপ আমার পিছু লেগেছে!
ঠিক আছে এতদিন তো মাটির ওপরে ফেলেছি। এবার মাটির দশহাত নিচে পুঁতে রাখবো। দেখি কোন বাপর বেটার সাধ্যি, খুুঁজে পায়? রাতের গভীরে বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে গর্ত খুঁড়তে শুরু করলো। গহীন রাতে খন্তার খুপ খুপ আওয়াজে প্রতিবেশির ঘুম ভেঙে গেল। তারা চুপি চুপি এসে দেখল, একটা চোর তাদের ঘরে সিঁধ কাটছে। সাথে সাথে পুলিশ ডেকে চোর ধরিয়ে দিল।
সারারাত বন্দী থাকার পর, সকারে বিচারে আনা হলো। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ হলো, সে চুরি করার চেষ্টা করছিল। আচ্ছামতো ধোলাই দিয়ে সতর্ক করে ছেড়ে দেয়া হলো।
.
মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। জেলখানা থেকে ঘরে না গিয়ে, বাগদাদের বড় হাম্মামে (গোসলখানা) গিয়ে ঢুকলো। বের হওয়ার সময়, জুতো জোড়া না নিয়ে, খালি পায়েই চলে এল। নিশ্চই কেউ না কেউ তার জুতো নিয়ে যাবে বা ফেলে দিবে। এখানে তো সবাই বিদেশী। কেউ তার জুতো চিনবে না। ভারমুক্ত হয়ে ঘরে ফিরে এল।
.
হাম্মামে তখন একজন বড় শাহযাদা গোসল করছিল। বের হয়ে দেখল মণিমাণিক্যখচিত জুতোজোড়া নেই। হুলুস্থ’ূল পড়ে গেল। কে নিল? নিল কে? সবার গর্দান ফেলে দেয়া হবে! তাড়াতাড়ি খুঁজে আন! হাম্মামের দারোয়ান দেখল, তম্বুরির জুতোজোড়া পড়ে আছে, ব্যস! হিসেব সোজা! সে তো ইদানীং চুরি ধরেছে! সেই চোর।
.
বিচার গেল কাযির কাছে। যেহেতু দশ দেরহাম হয়নি,তাই হাত কাটা গেল না। আচ্ছা করে, আজকের মতো দ্বিতীয়বার আড়ঙ ধোলাই দিয়ে ছেড়ে দিলেন। দয়া করে (!) জুতোজোড়াও তাকে দিয়ে দিলেন।
.
ওরে আল্লাহ রে! আমি এখন কোথায় যাব, কী করবো রে! এমন জানলে আমি প্রতিদিন একজোড়া নতুন জুতো কিনে পরতাম!
ঠিক আছে, শহরে হবেনা। আমি মরুভূমিকে নিয়ে অভিশপ্ত জুতো পুঁতে আসবো। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রচন্ড রোদের মধ্যে দরদর ঘামতে ঘামতে বালু খুঁড়তে শুরু করে দিল। আচানক কিছু বুজে ওঠার আগেই, একদল ঘোড়সওয়ার এসে, হাত-পা বেঁধে চ্যাঙদোলা করে, কাযির দরবারে নিয়ে এল:
-হুযুর! এই তো হত্যাকারীর সন্ধান পাওয়া গেছে।
.
ঘটনা হলো, সেই রাতে একজন মানুষ নিহত হয়েছিল। লোকটা ছিল ধনকুবের। কেউ একজন তাকে মেরে, তার টাকাপয়সা মরুভূমিতে পুঁতে রেখেছিল। লাশটাও সেখানে ফেলে রেখেছিল। নিহত ব্যক্তির আত্মীয়রা বুঝতে পেরেছিল, হত্যাকারী টাকা-পয়সা নিয়ে যেতে পারে নি। এখানেই আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। বাস্তবেই তাই। দেখা গেল, তম্বুরি যেখানে গর্ত করছিল, সেখাইে দীনারের বড়সড় একটা থলে পড়ে আছে। ব্যস! দুয়ে দুয়ে চার!
.
এরপর আর প্রমাণের কী প্রয়োজন? তম্বুরি অনেক বোঝালো। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তার ফাঁসীর হুকুম হয়ে গেল। তখন জেলখানার একজন রক্ষীর মনে দয়া এল। সে এগিয়ে এসে কাযিকে বললো:
-হুযুর! তম্বুরি তো গতরাতে জেলখানায় আটক ছিল!
-ও হাঁ, তাইতো! তাইতো!
বেকসুর খালাস দেয়া হলো।
.
কিন্তু কাযী বারবার ঝামেলা পাকানোর অপরাধে, আবারও বাংলাধোলাই দিয়ে ছেড়ে দিতে বললো।
.
মার খাওয়ার পর, মুখের কষার রক্ত মুছতে মুছতে তম্বুরি বললো:
-হুযুর! আমার একটা কথা ছিল!
-কী কথা, বলে ফেল দিকিনি!
-আমাকে একটা সত্যয়নপত্র লিখে দিতে হবে।
-কিসের সত্যয়নপত্র?
-আমি ভেবে দেখেছি, আমার জুতোজোড়াই যতসব নষ্টের গোড়া। আমি চাই, একথা লিখিতভাবে ঘোষণা দিতে, আমার সাথে এ-জুতোর সাথে আজ থেকে কোনও সম্পর্ক নেই।
কাযি হাসতে হাসতে বললেন:
-আচ্ছা, ঠিক আছে যা, লিখে দিলাম!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন