বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৬

ইসলাম আধুনিক সভ্যতার জনক

ইসলাম আধুনিক সভ্যতার জনক—ওয়াহিদুদ্দীন খান
ইসলামের আগমন ও একত্ববাদের বিপ্লব, খৃষ্টোত্তর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আধুনিক ইতিহাসের যা কিছু সমৃদ্ধি, উৎকর্ষ, উজ্জ্বলতা, মৌলিক অর্থে ইসলামী বিপ্লবেরই ফসল তা।
১৯৬৫ সালের ঘটনা। আমি তখন লাক্ষ্নৌতে ছিলাম। একবার এক উচ্চশিক্ষিত অমুসলিমের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। ধর্মে তার বিশ্বাস ছিল না। ধর্মীর আলোচনা ধম-দর্শন ও বিধানকে তিনি নিরর্থক মনে করতেন। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তিনি বললেন-“সমগ্র ইতিহাস পরিক্রমা থেকে যদি ইসলামকে মুছে ফেলা হয় তাহলে ইতিহাসের কি এমন সম্পদহানি ঘটবে?” ভদ্রলোকের এই মন্তব্য শোনার সাথে সাথে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল- “সেই সম্পদ যার অভাবে ইসলাম পূর্ব ইতিহাস ছিল চরম দরিদ্র ও নির্জীব। “তিনি তৎক্ষণাৎ চুপসে গেলেন। কেননা, সব কিছুর পরও তিনি ছিলেন একজন শিক্ষিত ও পন্ডিত ব্যক্তি। তাই যুক্তি ও প্রমাণের সামনে পরাভূত হলেন।
ইতিহাস পর্যালোচনায় এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, যা কিছু আজ উন্নতি, উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির নিদর্শনরূপে গ্রাহ্য, ইসলামের আবিভার্বপূর্ব ইতিহাস কখনই তার স্পর্শ পায়নি। ইসলামের আবির্ভাবের অনুগমেই তার উণ্মেষ-বিকাশ। কিন্তু ইসলাম ও ইসলামী বিপ্লবের সাথে এই ঐতিহাসিক সংঘটনের কোন সম্পর্ক রয়েছে কি না, আপাত নিরীক্ষণে তা ধরা পড়ে না। তাই কেউ কেউ তাতে সংশয়ের সুযোগ পায়। অথচ সময়ের পশ্চাদতা যেমন স্বীকৃত, তেমনি ঐতিহাসিক সমীক্ষায় এ সত্যও প্রমাণিত যে, ইসলাম ও একত্ববাদের বিপ্লব এবং সমৃদ্ধি-উন্নতি-অগ্রগতির পথে মানব ইতিহাসের যাত্রা-উভয়ের মাঝে এক নিগুঢ় সম্পর্ক রয়েছে। যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পের উন্নতি পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করেছে-মৌলিক অর্থে, তা ইসলামী বিপ্লব, বিশেষত চিন্তানৈতিক বিপ্লবেরই প্রতিফলন।
এ কথা নিঃসন্দেহ যে, সৃষ্টির সামনে স্রষ্টার পরিচয়-শিক্ষা পরিষ্ফুট করা এবং তাকে পরকালীন চিরন্তন সফলতার প্রতি পরিচালিত করার জন্যই ইসলামের আগমন। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পোন্নতি ইত্যাদি জাগতিক স্বার্থকতা কখনই ইসলামের মৌলিক লক্ষ্য নয়। তবে এও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অভাবিত সাফল্য আমাদের অভিভূত করেছে তা মূলত ইসলামী বিপ্লবেরই প্রলম্বিত প্রতিফলন। ইসলামী বিপ্লব যদি নানাবিধ পৌরাণিক সংস্কার ভেঙ্গে আদিম বন্ধ্যাত্ব থেকে মানব মেধার মুক্তির পথ সুগম না করত, মানুষের আচরণ-অধিকারের স্বাধীনতা নিশ্চিত না করত, তাহলে এই বিপুল সম্ভাবনা কখনই অপ্রকাশ মুক্তি পেত না। প্রাক ইসলামী যুগের মত আবিষ্কারের অন্তরালেই তা অবসিত হত।
ফল দানই বৃক্ষের প্রধান জন্ম লক্ষ্য-এটা সত্য, কিন্তু পরিণত বৃদ্ধি লাভের পর তার ছায়া দ্বারাও মানুষ উপকৃত হয়। তেমনি স্রষ্টা থেকে কল্যাণ লাভের দ্বারকে সৃষ্টির জন্য অবারিত করা এবং স্রষ্টার অনন্ত সান্নিধ্য নিশ্চিত করাই ইসলামের আবির্ভাবের প্রধান লক্ষ্য। তার পরও ইসলাম এক পরম সত্য। পরম সত্য যখন আত্মপ্রকাশ করে তখন তা মানবের সর্বপ্রকার কল্যাণের উৎস হয়; কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো পরোক্ষভাবে।
সৃষ্টিলগ্নেই স্রষ্টা মানুষ থেকে এই অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, আমিই তোমাদের একমাত্র স্রষ্টা ও উপাস্য। আমাকে ছাড়া তোমরা আর কারো উপাসনা করবে না। অতপর এক সম্পন্ন পৃথিবী সৃষ্টি করে যাবতীয় সম্পদ সম্ভোগের অধিকার দিয়ে তাতে মানুষকে প্রেরণ করেন। সেই পৃথিবীর জীবনের মায়ায় জড়িয়ে মানুষ ভুলে যায় তার আদি অঙ্গীকার। ইন্দ্রিয়াতীত-বিমূর্ত স্রষ্টার প্রতি তার বিশ্বাস টলে ওঠে। ক্রমে সে তৈরি করে নেয় বিভিন্ন দৃশ্যমান ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাস্য। তার কৌতূহলী দৃষ্টি ও মনের সামনে যা-ই বৃক্ষও মহৎরূপে প্রতিভাত হয়েছে তাকেই সে ভেবেছে দেবতা-ঈশ্বর, কিংবা দৈব গুণের অধিকারী, তাই পূজনীয়। এভাবে একদিকে যেমন মহৎ-পুণ্যাত্মাদের পবিত্রতার সংস্কার গড়ে উঠে অপরদিকে সূচীত হয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাসনার দীর্ঘ মলিন ইতিহাস।
এই আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপাসনাকেই ধর্মীয় পরিভাষায় বলে শিরক বা বহুত্ববাদ। ক্রমে মানুষের বিশ্বাস, চেতনা ও আচরণীয় জীবনের সর্বত্র এর প্রাদুর্ভাব ঘটে। শুভ-অশুভের বিভিন্ন পৌরাণিক সংস্কারের প্রশ্রয়ে তা সামাজিক জীবনেও ছড়িয়ে পড়ে। “দৈব রাজত্বের” অপবিশ্বাসের ফলে এমন কি তা রাষ্ট্রীয় বিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। এই ছিল প্রাচীন পৃথিবীর ধর্মীর বিশ্বাসের চিত্র। প্রাচীন পৃথিবী সামগ্রিকভাবে এই ধরনের বিশেষ কিছু বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিশুদ্ধ ধর্ম মতে যাকে শিরিক বা বহুত্ববাদ এবং দর্শনের পরিভাষায় পৌরাণিক বিশ্বাস বলা হয়। বিগত সময়ে যত পয়গাম্বর বা প্রেরিত পুরুষগণ আগমন করেছিলেন, এই স্খলন ও বিকৃতির সংশোধনই ছিল তাঁদের আগমন বৃত। প্রতি যুগের মানুষের সামনে তাঁরা এই আহ্বান উচ্চকিত রেখেছিলেন যে, তোমরা বহুত্ববাদ বর্জন কর। একত্ববাদেই নিহিত রয়েছে তোমাদের মুক্তির উপায়। এই আহ্বান নিয়ে-এক হাদীসের বক্তব্য অনুসারে, হযরত আদম আ. থেকে নিয়ে হযরত ঈসা আ. পর্যন্ত প্রায় এক লক্ষাধিক পয়গম্বর ইতিহাসের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে মানুষের নিকট আগমন করেছিলেন। কিন্তু বিচ্যুত মানব সমাজ আর সর্বতোভাবে তাদের গ্রহণ করতে পারেনি। তবে বিগত পয়গম্বরদের আহ্বানে সত্যের উচ্চারণ ছিল মাত্র। সত্যের পক্ষে বিপ্লবের বিঘোষণে কখনই তা উচ্চকিত হয়ে উঠেনি।
বহুত্ববাদ ও পৌরাণিক বিশ্বাসের এই সমস্যাটি, সরল অর্থে কোন ধর্মীয় সমস্যা ছিল না বরং ব্যাপক অর্থে তা ছিল এক মানবিক সমস্যা। কেননা, এই অপবিশ্বাসই দীর্ঘকাল ধরে মানুষের সর্ব প্রকার অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে রেখে ছিল। এই অপ্রাকৃত বিশ্বাস প্রকৃতিকে শ্রদ্ধার বেদীতে বসিয়ে, মুক্ত বিশ্লেষণ ও অধিকার প্রয়াসের প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রেখে ছিল। অথচ যাকে বলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রকৃতির মুক্ত বিশ্লেষণ ও তার উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া, তার উদ্ভব বিকাশ কখনই সম্ভব নয়। তাছাড়া এসব পৌরাণিক বিশ্বাস বিভিন্ন ভিত্তিহীন মনগড়া মূলনীতির ভিত্তিতে সমাজে বৈষম্যপূর্ণ শ্রেণীবিভাগ ও মানুষে মানুষে প্রভেদের যে প্রাচীর তুলে দিয়েছিল, কোন প্রবল বৈপ্লবিক অভিঘাতে তা ধূলিসাৎ করা ছাড়া মানব সাম্যের সূচনা ছিল না। এভাবে যা কিছু ঔজ্জ্বল্য-উৎকর্ষ-প্রগতির নিদর্শন, এসব সংস্বার, অপবিশ্বাস তার সব কিছুর প্রকাশ-বিকাশকে অবরুদ্ধ করে রেখে ছিল। কেননা, সে জন্য প্রয়োজন জীবনজগৎ সম্পর্কে মুক্ত-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির। অথচ পৌরাণিক সংস্কার-জর্জর সেই পরিবেশ এই চেতনার জন্ম-বৃদ্ধির পক্ষে কোনভাবেই অনুকূল ছিল না।
মূলত পৃথিবীকে এই পৌরাণিক সংস্কার থেকে মুক্ত করার জন্য শুধু চিন্তানৈতিক ও আহ্বানধর্মী কার্যক্রমই যথেষ্ট ছিল না বরং এর জন্য প্রয়োজন ছিল এক সশস্ত্র সংগ্রামের-সহস্র বছরব্যাপী পয়গম্বরদের কার্যক্রম ও তার ফলাফল অন্তত তাই প্রমাণ করেছিল। কেননা, সর্বযুগের সমকালীন রাজন্য শ্রেণী ও সমাজ প্রভূরা ছিল এই বহুত্ববাদ ও পৌরাণিক বিশ্বাসের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক। কেননা, এই ছিল তাদের ক্ষমতার ভিত্তি। নিজেদের ক্ষমতা নিঃসংশয় করার জন্যই তাদের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা ছিল জনচেতনায় এসব অপবিশ্বাস টিকিয়ে রাখা। তাই সে সব অপবিশ্বাসের বিরুদ্ধে উচ্চারিত যে কোন কণ্ঠের বিরুদ্ধেই তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি ছিল সদা সোচ্চার।
শেষ পয়গম্বরের আবির্ভাব:
ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে ষষ্ঠ শতকে আবির্ভাব ঘটে শেষ পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ স.-এর। বিধাতার বিশেষ সিদ্ধান্তে ‘আহ্বানকারীর’ সাথে সাথে যিনি ‘দমনকারী’ ও ছিলেন। অর্থাৎ বহুত্ববাদ ও পৌরাণিক বিশ্বাসে-প্রথার বিরুদ্ধে অসত্যের ঘোষণাই নয় বরং তার পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করে চিরদিনের জন্য মানব জাতিকে এর অভিশাপ থেকে মুক্ত করাও ছিল তাঁর দায়িত্বে অন্তর্ভুক্ত। কোরআনে রাসূল স. কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে- “এই কিতাব আপনার উপর অবর্তীণ করা হয়েছে এই জন্য যে, আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে বের করে আনবেন।
অন্ধকার থেকে আলোর পথে মানুষকে মুক্ত করাই ছিল সকল যুগের পয়গম্বরদের মৌল দায়িত্ব, আবির্ভাব-লক্ষ্য। কিন্তু রাসূল সা.-এর বিশেষত্ব এখানে ছিল যে, সে ক্ষেত্রে তিনি শুধু সত্যের আহ্বান মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েই থেমে যাননি বরং সহস্র বছরের প্রচলিত কুসংস্কারের দূর্গ ভেঙ্গে তার উপর নির্মাণ করেছেন স্বচ্ছ বিশ্বাসের নতুন প্রাসাদ। এই বিপ্লব সংঘটন ও সফলতার জন্য যে পরিবেশ ও উপকরণ অপরিহার্য ছিল আল্লাহ তাঁর জন্য তা প্রস্তুত করে রেখেছিলেন এবং তিনি এই আশ্বাস ও দান করেছিলেন যে, বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ঐশী দূত প্রেরণের মাধ্যমে বস্তুগত উপকরণ সংকটের ক্ষতিপূরণ করে দিবেন।
আখেরী পয়গম্বরের এই বিশেষ দায়িত্ব ও বিপ্লবী চরিত্রের কথা নানা হাদীসে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
অর্থাৎ “আমি নির্মূলকারী আমার মাধ্যমে আল্লাহ কুফরীকে নিশ্চিহ্ন করবেন।”
এ থেকে প্রমাণিত হয়, পয়গম্বর স. শুধু সত্যের আহ্বানকারীই ছিলেন না বরং সাথে সাথে অসত্যের দমনকারীও ছিলেন। বাস্তব বিপ্লবের মাধ্যমে অসত্যকে পরাজিত করে মানবজীবনে তিনি সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কোরআনে এসেছে-পয়গম্বর স.-এর কার্যক্রমকে পূর্ণাঙ্গ সফল করার জন্য সৎ মুমিন এমনকি আল্লাহ ও ফেরেশতাগণও তাঁর সহযোগী হবেন।
গবেষণার স্বাধীনতা ও ইসলাম
বেরণ কারা ডি ভাক্সের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইসলামের উত্তরাধিকার’ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। তাতে গ্রন্থকার আরবদের বিভিন্ন কীর্তি-অবদানের কথা স্বীকার করলেও তাদেরকে তিনি প্রাচীন গ্রীকদের সৃজনহীন শিষ্যের অধিক মর্যাদা দান করতে কুণ্ঠিত। বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্যা হিস্ট্রি অফ ওয়েস্টার্ন ফেলোসফি’তে বার্ট্রান্ড রাসেল আরবদের বলেছেন নিছক বাহক ও অনুবাদক, যারা অনুবাদের সাহায্যে প্রাচীন গ্রীক বিদ্যাকে পুনরুদ্ধার করে নতুন করে ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও ঐতিহাসিক সমীক্ষায় এ তথ্য ভুল প্রমাণিত। এটা সত্য যে, আরবরা গ্রীক বিদ্যা-জ্ঞান-দর্শন গ্রহণ করেছিলেন এবং তার দ্বারা অনেক উপকৃতও হয়েছিলেন। কিন্তু তা পরিপাক করে ইউরোপকে আরবীয় প্রতিভা যা দান করেছিল, মানে ও পরিমাণে তা গ্রীক বিদ্যার চেয়ে অধিক কিছু ছিল। যে জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায় রেনেসাঁর জন্ম হয়েছিল, ইউরোপ লাভ করেছিল নব জীবন, বাস্তব সত্য এই যে, প্রাচীন গ্রীকদের পুঁথিতে সে মন্ত্র কখনই ছিল না। যদি তাই হত তাহলে রেনেসাঁর জন্য ইউরোপকে এই দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হল কেন? এই ‘মহা সম্পদ’ তো সহস্র বছর ধরে তাদের সিন্দুকেই ছিল।
বস্তুত এ এক সিদ্ধ তথ্য যে, প্রাচীন গ্রীসের যা কিছু কীর্তি-উন্নতি- উৎকর্ষ’ তার সবই দর্শন ও শিল্পকলার এলাকাতেই সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অবদান এতই অপ্রতুল যে আর্কিমিডাসের- খৃষ্টপূর্ব ২২২ অব্দে শহরতলীর বালুকা বেলায় কোন জটিল জ্যামিতিক সমস্যায় মগ্ন অবস্থায় এক রোমান সৈন্য যাকে হত্যা করেছিল- একমাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া গ্রীক আর কোন বৈজ্ঞানিক সন্তান প্রসব করতে পারেনি।
বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, চিন্তা-গবেষণার উন্মেষ-বিকাশের জন্য মুক্ত চিন্তার যে স্বাধীন পরিবেশ একান্ত অপরিহার্য, বাস্তব এই যে, সমকালীন অন্যান্য রাজত্বের মত প্রাচীন গ্রীসও তার অভাবে নিষ্কম্প ছিল। এ্যাথেন্সের যুবকদের মাঝে মুক্ত জ্ঞান চর্চার মনোভাব জাগ্রত করছেন- এই অভিযোগে সক্রেটিসকে হেমলক বিষ পানে বাধ্য করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। প্লটার্কের ভাষ্য অনুযায়ী, স্পার্টার লোকদের বিদ্যা চর্চা শুধু বাস্তব জীবনের একান্ত প্রয়োজনীয় এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এছাড়া অন্যান্য সমৃদ্ধ জ্ঞানের গ্রন্থ অধ্যয়ন-চর্চা এবং বিদ্বানদের সাহচর্য গ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল।
এ্যাথেন্সে আর্ট ও ফোলোসফি-শিল্পকলা ও দর্শন বিকশিত হয়েছিল সত্য, কিন্তু তার চেয়ে নির্মম সত্য এই যে, এ্যাথেন্স অনেক শিল্পী ও দার্শনিককে নির্বাসিত করেছিল। ভীতি প্রদর্শন করে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছিল, অনেককে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল ফাঁসিতে, কারাগারের অন্ধকার কুঠিরে অনেক প্রতিভাবানের প্রদীপ্ত মেধা নিঃফল নির্বাপিত হয়েছিল। ইসকাইলাস, ইউরিফাইডস, ফিদিয়াস সক্রেটিস ও এ্যারিস্টটল- যারা ছিলেন মানব প্রতিভার চিরন্তন বিস্ময়, এ্যাথেন্সের সেই অবমূল্যায়ন ও নির্যাতন থেকে তারাও রক্ষা পাননি।
প্রাচীন গ্রীসে বিজ্ঞান বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না- এসকাইলাসের হত্যার ঘটনা এই সত্যকেই প্রবলভাবে প্রমাণিত করে। তিনি Elcusinin, Myster ics রহস্য উন্মোচন করেছিলেন শুধু এই অপরাধেই তাকে হত্যা করা হয়েছিল। এই ‘রহস্য’ ছিল প্রাচীন গ্রীসের সেই সব অগণিত অলিক রূপকথার একটি, বাস্তবে যার কোন অস্ত্মিত্বই ছিল না। অথচ তা গ্রীক চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির এক অপরিহার্য অঙ্গের মর্যাদা লাভ করেছিল।
আধুনিক বিজ্ঞানের বিপ্লবের অব্যবহিত পূর্বে স্বয়ং ইউরোপেই বিজ্ঞান মানস-চেতনা কতটা অবিকশিত ছিল, গারবেট নামে খ্যাত পোপ সেলভেস্টারের জীবন-ঘটনা থেকে তার কিছুটা অনুমান করা যায়।
৯৪৫ সালে তিনি ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০০৩ সালে রোমে মৃত্যুবরণ করেন। গ্রীক এবং ল্যাটিন উভয় ভাষায় তার অধিকার ছিল প্রবল। তিনি স্পেন সফর করে বারসোলোনায় তিন বছর অবস্থান করেন এবং এই সময়ে প্রবল প্রভাবের সাথে আরবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ করেন। প্রত্যাবর্তনকালে তিনি স্পেন থেকে কয়েকটি আরবী গ্রন্থের অনুবাদ ও একটি টেলিস্কোপ নিয়ে এসেছিলেন। তর্কশাস্ত্র, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান- রোমে তিনি এই সব আরবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা শুরু করেন। কিন্তু সে সময় তিনি কঠিন বাঁধার সম্মুখীন হন। কোন কোন খৃস্টান পন্ডিত মন্তব্য করেন যে, স্পেন থেকে তিনি জাদু বিদ্যা শিখে এসেছেন এবং তার উপর শয়তান ভর করেছে- কোন কোন ধর্মগুরু এই ফতোওয়াও ছেড়েছিলেন। এইভাবে অবরুদ্ধ অবস্থায়ই ১০০৩ সালে রোমে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ইসলামের আগমপূর্ব পৃথিবীতে কোথাও মুক্ত জ্ঞান চর্চার অনুকূল পরিবেশ ছিল না। তাই প্রাচীনকালের দীর্ঘ ইতিহাসে বৈজ্ঞানিক গবেষণা-আবিষ্কারের কিছু কিছু ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার খ-চিত্র লক্ষ্যগোচর হলেও কখনই তা ব্যক্তিগততা ও সাময়িকতার সীমাবদ্ধতা ভেঙ্গে ব্যাপক আলোড়নের রূপ লাভ করেনি। চিন্তার স্বাধীনতা না থাকার কারণে অনেক অনুভব-উপলব্ধি জ্বলে উঠে সহসা আবার নির্বাপিত হয়েছে।
ধর্মীয় বিদ্যা আর প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। প্রথমটির উৎস ঐশী প্রত্যাদেশ। পক্ষান্তরে ‘বস্তু জগতের বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চিন্তা, গবেষণা ও সিদ্ধান্তের মুক্ততায় মানব মেধা সম্পূর্ণ স্বাধীন’- মানবসৃষ্ট ও বিকৃত ধর্মান্ধতার দীর্ঘ ইতিহাসের পর ইসলামই সর্বপ্রথম এই ঐতিহাসিক ঘোষণা দেয়। বলাবাহুল্য, ইসলামের এই মুক্ত ঘোষণা জ্ঞান বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে।
মুসলিম শরীফে এমন স্বতন্ত্র শিরোনামে একটি অধ্যায় রয়েছে যে “নিজস্ব অনুমানের ভিত্তিতে পার্থিব উপকরণ অবলম্বনের ক্ষেত্রে রাসূল স. যা বলেছেন তা নয় শুধু ধর্মীয় বিষয়ে তিনি যা বলেছেন তাই মানা অপরিহার্য।” এই অধ্যায়ে ইমাম মুসলিম রাহ. এমন একটি হাদিস উল্লেখ করেন যে, “মুসা ইবনে তালহা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন তিনি রাসূল স. -এর সাথে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক খেজুর উদ্যানে কিছু লোককে গাছে চড়ে কিছু করতে দেখে রাসূল স. জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কি করছে? সাহাবীগণ উত্তর করলেন, তারা পরাগায়ন করছেন। (অর্থাৎ পুরুষ বৃক্ষের ফুল মহিলা বৃক্ষের ফুলে লাগানো। এতে ফসল ভাল হয়- আরবদের মাঝে এই ধারণা প্রচলিত ছিল।) শুনে রাসূল স. বললেন- আমার মনে হয় না এতে কোন লাভ হবে। এই কথা শুনে তারা সেই কাজ বন্ধ করে দিল। রাসূল বললেন, এতে যদি তোমাদের কোন উপকার হয় তাহলে তোমরা তা করতে পার। তা অনুসরণে তোমরা বাধ্য নও। তবে আমি যখন তোমাদেরকে আল্লাহর কোন কোন কথা বলি তখন অবশ্যই তোমরা তা গ্রহণ করবে। কেননা, আমি আল্লাহর ব্যাপারে কখনই মিথ্যা বলব না।
আরব সভ্যতার প্রভাব
একথা অনস্বীকার্য যে, প্রাচীন সময়েও বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু ক্ষণজন্মা প্রতিভা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বিজ্ঞান চর্চা করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবেশের আনুকূল্যের অভাবে তা স্বদেশে বা ভিন্ন রাজ্যে কোথাও ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি। কোথাও তারা যথার্থ সমাদৃত হননি- ইতিহাসের এ এক নির্মম সত্য।
মোসেলিবিয়ান “আরব সভ্যতা” নামক গ্রন্থে লিখেন- প্রাচীন পৃথিবীতে অনেক জাতিই ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে আরোহণ করেছে। পারসিক, রোমান, গ্রীক- ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা প্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবল প্রতাপের সাথে শাসন চালিয়েছে। কিন্তু সেই সব শাসিত জাতির উপর শাসক জাতির প্রভাব ছিল খুবই নগণ্য। সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্পকলা- ইত্যাদি দ্বারা তারা সেই সব জাতিগুলোকে খুব কমই প্রভাবিত করতে পেরেছিল। দীর্ঘকাল গ্রীক রাজবংশ টলেমীয়দের অধীনে এবং রোমানদের আশ্রিত রাজ্য তাকাকালে মিসরীয়রা নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ধর্মের উপর শুধু প্রতিষ্ঠিতই ছিল না বরং বিশেষত ধর্ম ও স্থাপত্য শিল্পে, বিজয়ী শাসক শ্রেণীকেই দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। গ্রীক, রোমান উভয় জাতির উত্তরকালের স্থাপত্যে ফারাও স্থাপত্যের প্রভাব সুস্পষ্ট।
কিন্তু যে অর্থে গ্রীক, রোমান ও পারসিকরা মিশর জয় করতে পারেনি, স্বল্প সময়ে বিনা শক্তি ব্যয়ে আরবরা সে জয় পেয়েছিল অতি সহজে। বিজাতীয় চিন্তা-চেতনা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যে মিশর ছিল চরম অনমনীয়, মাত্র একশ’ বছরের নীরব সান্নিধ্য বিপ্লবের ফলেই হাজার বছরের ঐতিহ্য ত্যাগ করে সে মিশরই সহজে আত্মসমর্পণ করল এক নতুন সভ্যতা ও ধর্মের কাছে। সর্বতোভাবে গ্রহণ করল, এমনকি আরবদের ভাষা পর্যন্ত। এছাড়া আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলে পারস্য, সিরিয়া ইত্যাদি অঞ্চলের আরবদের প্রভাব ঐতিহাসিক সত্য। এসব অঞ্চলে স্বল্প সময়ে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল দুর্বার গতিতে। এমন কি যে সব অঞ্চলে আরবরা কখনই রাজ্য স্থাপন করেনি, বরং আরব যোদ্ধারা শুধু সে সব দেশের উপর দিয়ে পথ অতিক্রম করেছে মাত্র, কিংবা নিছক বণিক বেশে গমন করেছে- যেমন চীন, ইতিহাসের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা, এমন অনেক দেশেও ইসলাম, আরবীয় সভ্যতা সমাদৃত হয়েছে বিপুলভাবে। বিজিত জাতির উপর বিজয়ী জাতির এমন ব্যাপক সতঃপ্রভাবের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। যে সব জাতি কিছুকালের জন্য আরবদের সাথে বিভিন্ন সূত্রে সম্পৃক্ত ছিল মাত্র, তারাও বিপুলভাবে গ্রহণ করল তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্ম। এমন কি তুর্কী ও মোঘলদের মত অনেক বিজয়ী জাতি মুসলিমদের পরাজিত করার পরও শুধু তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ধর্ম গ্রহণই করেনি বরং পরবর্তীকালে সে সভ্যতার মহা পৃষ্ঠপোষক ও রক্ষকের ভূমিকা পালন করেছে। আজও যখন আরবীয় সভ্যতা তার সেই অতীতের প্রাণ হারিয়েছে, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত এবং ভূমধ্যসাগর থেকে আফ্রিকা, সর্বত্র এক ধর্ম এক ভাষা- পয়গম্বরে ইসলাম এর ধর্ম ও ভাষা, প্রচলিত।” (আরব সভ্যতা)
মোসোলিবিয়ান এও লিখেছেন, প্রাচ্যের অনুরূপ পাশ্চাত্যও আরবীয় সভ্যতা দ্বারা সমভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, বরং এই প্রভাব গ্রহণ করেই পাশ্চাত্য হয়ে উঠেছিল সুসভ্য। কিন্তু উভয়ের মাঝে যে মৌলিক পার্থক্য ছিল তা হল প্রাচ্যে, ধর্ম, ভাষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা- সব ক্ষেত্রে আরবীয় সভ্যতার প্রভাব যেমন প্রকট হয়ে উঠেছিল পাশ্চাত্যে তেমন ছিল না; পাশ্চাত্যে যতটা না ধর্মীয় প্রভাব ছিল তার তুলনায় কারিগরি শিল্পের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। আর পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ছিল আবর সভ্যতার প্রধান শিকার।
আরবদের মাধ্যমে একত্ববাদের বিশ্বাস এবং তার আদলে গড়ে উঠা সভ্যতা প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর প্রায় সকল জাতি ও সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছিল। এর ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ যাতে মুক্তভাবে বিকশিত হতে পারে জ্ঞান-বিজ্ঞান। স্বাধীনভাবে চলতে পারে প্রকৃতির গবেষণা ও তার উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস।
প্রগতির পথে যাত্রা
বিজ্ঞানাগার ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা:
খৃষ্টপূর্ব ইতিহাসে গ্রীস, ভারতবর্ষ, চীন এবং পারস্য- এই চারটি ছিল বিশ্ব সভ্যতার কেন্দ্র। ৭৬২ খৃষ্টাব্দে আব্বাসী খলিফা মানছুর বাগদাদ শহর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্নেই বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত বিদ্যান ও বিজ্ঞদের সমাবেশে বাগদাদ সহসা মুখরিত হয়ে উঠে। খলিফা তাঁদের যথার্থ সমাদর করতেন। বিভিন্ন অনারবীয় ভাষার গ্রন্থরাজি অনুবাদের ব্যাপারে তিনি তাদের উৎসাহিত করেন। ফলে রাজশক্তির সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয় অনুবাদ কর্ম। এরপর ৮৬২ খৃষ্টাব্দে খলিফা মামুনুর রশিদ বাগদাদে “বাইতুল হিকমাহ” প্রতিষ্ঠা করেন। সাথে সাথে একটি মান মন্দির ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠাও ছিল তার অন্যতম কীর্তি। তবে তার সবচেয়ে কার্যকরী ও উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল, বিখ্যাত অনুবাদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা। যাতে এত দ্রুত ও ব্যাপক আকারে অনুবাদ কর্ম শুরু হয় যে, বাগদাদ প্রতিষ্ঠার চার দশকের মধ্যে গ্রীক গ্রন্থ সম্ভারের অধিকাংশ গ্রন্থ আরবী ভাষায় অনূদিত হয়ে যায়।
আব্বাসী যুগে কাগজশিল্প কুটির শিল্পের সহজতা লাভ করেছিল। ফলে আরবদের হাতে প্রচুর গ্রন্থ রচিত এবং প্রচলিত হতে থাকে। এমনকি দশম শতকে স্পেনের কর্ডোভা শহরের ইসলামী পাঠাগার চার লক্ষাধিক গ্রন্থের সমাবেশে সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। অথচ সেই সময় ইউরোপের অবস্থা এমন ছিল যে, ক্যাথলিক ইনসাইক্লোপিডিয়ার তথ্যানুসারে ১৮ হাজার গ্রন্থ সংগ্রহের ‘গৌরবে’ কেন্টারব্রি পাঠাগারই ছিল তৎকালীন খৃষ্টান জগতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ পাঠাগার।
বিজ্ঞান ও ভূগোলে চরম উৎকর্ষ সাধন:
নবম শতকেই ইসলামী বিজ্ঞান ভূগোল চরম উৎকর্ষ সাধন করে। নবম শতকের প্রথমার্ধেই আল খাওয়ার যামী ও তার সহ-গবেষকগণ আবিষ্কার করেন যে, পৃথিবী গোলাকার এবং তার বৃত্তাকার আয়তন হচ্ছে ২০ হাজার বর্গমাইল আর তার ব্যাসার্ধ ২৫০০ মাইল। উপকরণ স্বল্পতারই সেই সময়েই এমন এক নির্ভুল পরিমাপ ইতিহাসের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। ইসলামী বিশ্বে এই বিপুল তৎপরতা চলছিল সেই সময়ে যখন ‘পৃথিবী সমতল’ এই ভেবে সমগ্র ইউরোপ ‘স্বস্থি’ বোধ করত- দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি আল ইদরিসী একটি মানচিত্র তৈরি করেন যাতে তিনি নীল নদের উৎস পর্যন্ত নির্দেশ করেছিলেন। অথচ ইউরোপ তা আবিষ্কার করেছিল ১৯ শতকে, তার প্রায় ৮ শতক পর। মূলত মুসলিম বিজ্ঞানীরাই ইউরোপকে পৃথিবীর গোলাকৃতির ধারণা দান করেছিল। মুসলিম বিশ্বই ইউরোপে বিভিন্ন নির্ভুল পরিমাপ পদ্ধতি ও যন্ত্র সরবরাহ করেছিল।
‘পৃথিবী স্থির, তাকে কেন্দ্র করে সূর্য ঘুরছে” দ্বিতীয় শতকের প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমী সর্বপ্রথম এই মত প্রকাশ করেছিলেন। স্বীয় গ্রন্থ আল মাজেস্টে তিনি স্পষ্টভাবে এই মত ব্যক্ত করেন। এই ধারণা প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে মানব মেধাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। অবশেষে ষোড়শ শতকে কোপারনিকাস গ্যালেলিও এবং কেপলারের গবেষণা-আবিষ্কার চূড়ান্তভাবে একে ভ্রান্ত প্রমাণিত করে। আজ সমগ্র পৃথিবীতে এই মতের একজনও সমর্থক পাওয়া যাবে না।
পৃথিবীর ঘূর্ণনের ব্যাপারে শোচনীয়ভাবে এমন একটি ধারণা এই দীর্ঘকাল টিকে থাকার একমাত্র কারণ শিরক তথা বহুত্ববাদের প্রতিষ্ঠা- যা পরম নয় তাকে পরমের মর্যাদা দান। অপরিবত্রকে পরিবত্র জ্ঞানের অপসংস্কার। তখন ছিল খৃষ্টীয় শক্তির যুগ। খৃষ্টীয় অনুসারীরা বিশ্বাস করত যে, ঈশ্বরপুত্র যিশুর জন্মস্থান হওয়ার কারণে পৃথিবীর জগতের সবচেয়ে পবিত্রতম স্থান।
পৃথিবী জগতের স্থির কেন্দ্র, অন্যান্য গ্রহ তাকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণরত- এই তত্ত্বে তারা তাদের সেই আসার বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক সমর্থন পেয়ে আপস্নুত হলেন। তাই খৃষ্টীয় ধর্মবেত্তারা টলেমীর এই মতকে ধর্মীয় বিশ্বাসের মর্যাদা দান করে ব্যাপকভাবে প্রচার করলেন। পৃথিবীর পবিত্রতার বিশ্বাস তাদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা- প্রতিগবেষণার পথে এক অলংঘনীয় প্রতিবন্ধক ছিল। অবশেষে সত্যের ঝড় এসে সেই প্রাচীর ভেঙ্গে তাদেরকে অগ্রসর হতে বাধ্য করার পূর্ব পর্যন্ত তারা তার উপরই অটল ছিল।
ইনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রেটিনিকার ভাষ্য অনুসারে, আদিম জ্যোতির্বিজ্ঞানে পৃথিবী ছিল জগতের কেন্দ্র। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, যিশুর প্রায়শ্চিত্যের মাধ্যমে মানব মুক্তির ঘটনা জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা- মানুষের মাঝে এই সব বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। সৌরজগতের অসংখ্য গ্রহের মাঝে পৃথিবী এক ক্ষুদ্র গ্রহমাত্র যা পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। আর সূর্য জগতের অগণিত নক্ষত্ররাজির মধ্যে একটি, তেমন বিশেষত্বহীন নক্ষত্র মাত্র- জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই সব আবিষ্কার মানুষ সম্পর্কে প্রাচীন বিশ্বাসকে ধ্বসিয়ে দেয়। মহাজগতের বিশালত্বে পৃথিবী এক মহিমাহীন গ্রহে পরিণত হয়। নিউটনসহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা এই গবেষণা শুরু করেন।
খৃষ্টীয় মতবাদের বিশ্বাসীরা ত্রিত্ববাদের ভিত্তিতে যিশুকে পরমেশ্বরের মর্যাদা দান করে এবং এই সংস্কার গড়ে তুলে যে, মানব মুক্তির জন্য ঈশ্বর পুত্র যিশুর শূলে চড়া ছিল জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পৃথিবীতে সংঘটিত হয়েছিল বলে পৃথিবী তাদের বিশ্বাসে লাভ করে পবিত্রতমের মর্যাদা। তাই খৃষ্টীয় রক্ষণশীল সমাজ পৃথিবীর কেন্দ্রিকতার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে, এমন যে কোন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ছিল চরম সোচ্চার। বলাবাহুল্য, পৃথিবীকে ঘিরে গড়ে উঠা এই সংস্কার সৌরজগৎ সম্পর্কে স্বাধীন গবেষণার ক্ষেত্রে এক বিরাট প্রতিবন্ধক ছিল। এইভাবে আদিম মানুষের অপাত্রে পবিত্রতার নানা বিশ্বাস জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি-অগ্রগতিতে ব্যাহত-অবরুদ্ধ করে ছিল শোচনীয়ভাবে।
প্রাচীনকালের মত যদি দেব দূতরা চাঁদকে ঘিরে থাকত তাহলে মানুষের পক্ষে কখনই চাঁদকে জয় করে স্বগর্বে চাঁদে বিচরণ করা সম্ভব হত না। সমুদ্রের পবিত্রতমের সংস্কার থাকা অবস্থায় তাকে অধিকার করা, তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা কখনই সম্ভব ছিল না। দেব মহিমা আরোপিত অবস্থায় গরুর গোস্ত ও দুধের খাদ্য গুণ ও প্রোটিন নিয়ে গবেষণা করা। এবং তাকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার কতা মানুষ কখনই ভাবেনি। এই ধরনের সকল গবেষণা ও আবিষ্কার তখনই সূচীত হয়েছিল যখন ইসলামী একত্ববাদের বিশ্বাস প্রকৃতির সকল শক্তি-উৎসকে পবিত্র বিশ্বাসের বেদী থেকে নামিয়ে মানুষের স্বাধীন চিন্তা-গবেষণার সামনে সাধারণ বিষয়ের মত উপস্থাপন করেছিল। ইসলামের আগমনের পূর্বে নক্ষত্ররাজি ছিল শুধুই পূজনীয়। ইসলামী বিপ্লবের পরেই ইতিহাসে সর্বপ্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞান সফলভাবে বিকশিত হতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত হয় মান মন্দির। শুরু হয় মহাকাশ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা-পর্যালোচনা। বিভিন্ন খনিজ পদার্থকে এখনও কেউ কেউ পবিত্রের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই প্রথম পদার্থ বিজ্ঞান আবিষ্কার করেন এবং পদার্থকে গবেষণা ও বিশেস্নষণের বিষয়বস্তুরূপে গ্রহণ করেন। কোন কোন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এখনও পৃথিবীর দেবত্বের বিশ্বাস প্রচলিত। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই সর্বপ্রথম দেবতাদের হটিয়ে পরিমাপ করে ভূভাগের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ নির্ধারণ করেন। মানুষের ভীত মনের বিশ্বাসে ঝড়-তুফান ছিল এক রহস্যময় শক্তি। মুসলমানেরাই সর্বপ্রথম বুঝেছিলেন ওটা একটা প্রত্যক্ষভাবে আল্লাহ প্রদত্ব ঘটনা মাত্র। তাদের হাতে ঝড়ের তাণ্ডব হয় ‘উইন্ড মিল’।
বিভিন্ন বৃক্ষকে ঘিরে বিচিত্র অলিক কাহিনী গড়ে তুলে তাকে মহিমান্বিত, এমনকি দৈবমর্যাদা দান করা হয়েছিল। মুসলিম বিজ্ঞানীগণও বৃক্ষকে মহিমান্বিত করেছিলেন কিন্তু পূজার মাধ্যমে নয়। বরং তার উপর গবেষণা করে তার অপার সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের তালিকায় মুসলিম উদ্ভিদ বিজ্ঞানীগণ প্রায় দুই হাজার উদ্ভিদের পূর্ণাঙ্গ গবেষণা সংযোজন করেছিলেন। যে সমুদ্র দেবতার সন্তুষ্টির জন্য, এমনকি মানুষ সন্তান উৎসর্গ করত, সেচ প্রকল্পে সে সমুদ্রকে ব্যবহার করে তা থেকে নদী-খাল কেটে মুসলমানগণ কৃষি ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন।
স্পেন পতনের পর মুসলমানগণ যখন স্পেন ছেড়ে যান তখন সেখানে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের প্রতিষ্ঠিত অনেক মানমন্দির ছিল। অবিকশিত, অবিজ্ঞানমুখী খৃষ্টানদের কাছে এগুলোর কোন মূল্য ছিল না। বরং ওই আদিম প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে, এক সময় বিজ্ঞান গবেষণায় মুখর এই মানমন্দিরগুলো হল গীর্জার ঘণ্ট গৃহ। তৎকালীন অন্যান্য জাতিবর্গের সনাতনী চিন্তা-চেতনা থেকে মুসলমানগণ কতটা অগ্রণী ছিলেন, এই ঘটনা থেকে তার কিছুটা বরং অনেক কিছুই অনুমান করা যায়।
বহুত্ববাদের অপবিশ্বাস ও সংস্কারে সমগ্র প্রাচীন পৃথিবী সমাচ্ছন্ন ছিল- এ যেমন সত্য তেমনি এও নির্মম সত্য যে, এই সব অপবিশ্বাসই ছিল সর্ব প্রকার মানবীয় উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায়। ইসলামের আগমনের ফলে একত্ববাদের যে বিপ্লব সংঘটিত হল তার অভিঘাতেই ইতিহাস প্রথমবার কুসংস্কারের আঁধার কেটে উজ্জ্বল প্রভাতের স্পর্শ পেল। সূচিত হল মানব জাতির উন্নতি-অগ্রগতির এক দীর্ঘ সমুজ্জ্বল অধ্যায়।
প্রাচীন সময়ে যে, কোন কোন সৃষ্টিশীল প্রতিভা জন্মগ্রহণ করেনি, প্রতিবেশের সাথে যুদ্ধ করে কিছু সৃষ্টির নিদর্শন রেখে যাননি- তা নয়। কিন্তু প্রতিবেশের অসহযোগ, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে চরম বিরোধিতার কারণে তাদের সে প্রচেষ্টা অগ্রগতি লাভ করেনি। তাদের প্রতিভা-কলিগুলো প্রস্ফূটিত পুষ্পের সার্থকতা লাভের পূর্বেই ঝড়ে পড়েছিল। ইসলামী বিপ্লব যখন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করল, কুসংস্কারের বাঁধ ভেঙ্গে দিল, তখন হাজার বছরের অবরুদ্ধ চেতনা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অজস্র আবিষ্কারের উৎসবে সবেগে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।
মুক্ত জ্ঞানচর্চা ও ইসলাম
খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পর তার সেনাপতি দ্বিতীয় টলেমী মিসর অঞ্চলের ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিদ্যানুরাগী ছিলেন এবং জ্ঞানের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। তিনিই বিচিত্র শাস্ত্র ও বিষয়ের প্রায় পাঁচ লক্ষ গ্রন্থের সংগ্রহে ইতিহাসখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া পাঠাগার গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তীতে, ইসলাম আগমনের পূর্বেই এই পাটাগার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিংবা বিভ্রান্ত হয়ে অনেক ঐতিহাসিক এই ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন যে, মুসলিম খলিফা ওমরের নির্দেশে আলেকজান্দ্রিয়া পাঠাগার জ্বালিয়ে দেযা হয়েছিল। অথচ ইতিহাস বলে চতুর্থ শতাব্দীতে ইসলাম আগমনের বহু পূর্বেই তার অস্ত্মিত্ব সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ইনসাইক্লোপিডিয়ার ভাষ্য অনুসারে রোম রাজ্যের অধীনে তৃতীয় খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এর অস্ত্মিত্ব ছিল। এরপর তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
আলেকজান্দ্রিয়া পাঠাগার ধ্বংসের মূল ইতিহাস হচ্ছে খৃষ্টপূর্ব ৪৭ অব্দে রোমান সেনাপতি জুলিয়াস সিজার সর্বপ্রথম এর আংশিক জ্বালিয়ে দেন। অতপর তৃতীয়বার এই অঞ্চলের উপর খৃষ্টানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে আনুমানিক ৩৯১ খৃষ্টাব্দে খৃষ্টানদের হাতে এর চূড়ান্ত অবলুপ্তি ঘটে। এ ক্ষেত্রে ইনসাইক্লোপিডিয়ার স্বীকৃতিমূলক ভাষ্য এরূপ-
These institution survived until the main museum and library were destroyed during the civil war of the 3rd century AD: a subsidiary library was burned by Christians in AD 391 (1/479).
দু’স্থানে এমন স্পষ্ট স্বীকৃতির পর এই বইতেই তৃতীয় এক স্থানে আলেকজান্দ্রিয়া পাঠাগার ধ্বংসের এই ঘটনাকে অসঙ্গতভাবে মুসলিম আমলের সাথে সম্পৃক্ত করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। ‘সেন্সরশিপ’ নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় যে- বিভিন্নভাবে এটা প্রমাণিত যে, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে আলেকজান্দ্রিয়া পাটাগার আক্রান্ত হয়েছিল। প্রথম বার খৃষ্টপূর্ব ৪৭ সালে জুলিয়াস সিজারের হাতে, দ্বিতীয়বার ৩৯১ খৃষ্টাব্দে খৃষ্টানদের হাতে এবং ৬৪২ খৃষ্টাব্দে মুসলিম খলিফা ওমরের নির্দেশে তৃতীয়বারের মত একে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। পাঠাগারে সংরক্ষিত গ্রন্থগুলো প্রচার পেলে খৃষ্টবাদ ও কোরআনের যথার্থতা বিপণ্ন হতে পারে- এই আশঙ্কাই খৃষ্টান ও মুসলমানদের তা ধ্বংসের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছিল- নিবন্ধকার এই মন্তব্যও করেন-
There are many accounts of the burning, in serveral stages, of part or all of the library at Alexandria, from the siege of Julius Caesar in 47 BC to its destruction by Christians in AD 391 and by Muslims in 642. In the latter two instances, it was alleged that pagan literature presented a danger to the Old and Nwe Testatments or the Quran (3/1084).
পাঠাগার ধ্বংসের এই ঘটনাকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করা ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় কোনভাবেই নয়। ইনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটেনিকা থেকে সংগৃহিত প্রথম দু’টি উদ্ধৃতিও তাই প্রমাণ করছে। তাছাড়া গোটা ইতিহাসে ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের অনুকূল ছিল। ইসলাম সর্বদা মুক্ত জ্ঞান ও বিদ্যা চর্চাকে উৎসাহিত করে তাতে সহযোগিতা করেছে।
“হিস্ট্রি অফ দ্যা আরব”-এর গ্রন্থকার ড. ফিলিপ হিট্রি লিখেন-
মুসলিম খলিফা ওমরের নির্দেশে আলেকজান্দ্রিয়া পাঠাগার ধ্বংস করা হয়েছিল, প্রায় ছয় মাস ধরে সেনাপতিদের জন্য সে সব গ্রন্থরাজি পুড়িয়ে শহরের অগণিত বাথরুমের পানি গরম করা হত- এ, সেই সব কাল্পনিক কাহিনীর একটি, আপাত বোধে উপভোগ্য হলেও অসত্যের অনুপ্রবেশে যা ইতিহাসকে কলুষিত করে। বাস্তব ঐতিহাসিক সত্য এই যে, আলেকান্দ্রিয়ার সেই বিখ্যাত পাঠাগার ইসলামের বহু পূর্বেই খৃষ্টপূর্ব ৪৭ অব্দে জুলিয়াস সিজারের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। অবশিষ্ট ধ্বংসস্ত্মূপের উপর পুনরায় যে পাঠাগার গড়ে উঠেছিল তাও ৩৮৯ খৃষ্টাব্দে সম্রাট নোভিসিয়ূসের নির্দেশে সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তাই এ অহ্‌চলে ইসলামী বিজয়াভিযানের সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় কোন উল্লেখযোগ্য পাঠাগারের অস্ত্মিত্বই ছিল না। সমকালীন কোন ঐতিহাসিকও ওমরের বিরুদ্ধে পাটাগার ধ্বংসের অভিযোগ আনেননি। আব্দুল্লাহ আল বাগদাদী (মৃত-৬২৯) বাহ্যত প্রথম ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম এই কাল্পনিক ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি কেন এমন করেছিলেন তা আমরা জানি না। আমরা শুধু হতাশ হয়ে লক্ষ্য করি, পরবর্তী অনেক ঐতিহাসিক এই অসত্য বর্ণনায় তার রেখার উপর কলম চালিয়েছেন। বরং অনেক ক্ষেত্র আরো ফুলিয়ে ঝাঁপিয়ে এই অসত্য ঘটনা লিপিবদ্ধ করছেন।
Philip K. Kitti, Hutary of the Arabs, London, 1970, P. 166.
একত্ববাদের মূলনীতির উপর ইসলামী সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত এবং এক ব্যতিক্রম ধারায় তা অন্যান্য সভ্যতা থেকে স্বতন্ত্র। যার অভাবে পূর্ববর্তী প্রায় সকল সভ্যতা ছিল রুদ্ধ, তুলনামূলক অবিকশিত, ইসলামী সভ্যতা মানুষকে সেই চিন্তানৈতিক স্বাধীনতা দান করে বিকাশ উপযোগী প্রগতিশীল এক সভ্যতা গড়ে তুলে। সেই মুক্ত পরিবেশে অনুকূল আবহাওয়া পেয়ে যাবতীয় বিদ্যা, জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্রুত ও ব্যাপকভাবে উন্মেষিত ও বিকশিত হতে থাকে।
মুক্ত জ্ঞানচর্চা ও তার সাধকদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানানোর কাল দাগ থেকে পূর্ববর্তী কোন জাতির সভ্যতার ইতিহাস মুক্ত নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ইসলামকেও অন্যান্য সভ্যতার ইতিহাসের সাথে তুলনা করা, সম্পৃক্ত করা- মুক্ত গবেষকগণ স্বীকার করেছেন, তা অবশ্যই এক ঐতিহাসিক অবিচার।
বাস্তব সত্য তো এই যে, ইউরোপ নয় গভীর অর্থে ইসলামই আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতার যুগের জনক, অন্তত ভিত্তি স্থাপক। এ এমন এক ঐতিহাসিক সত্য যা অস্বীকার করা প্রকারান্তরে সত্য ইতিহাসকেই অস্বীকার করা। মুক্ত জ্ঞান চর্চা ব্যাহত নয়, ইসলামী যুগেই এবং ইসলামী উদারনীতির ফলেই তা যে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত হয়েছে এবং এর ফলে ইসলামের কোল জুড়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় অসংখ্য বড় বড় পন্ডিত-বিজ্ঞান-গবেষক জন্মগ্রহণ করেছেন- ব্যাপকভাবে ঐতিহাসিকগণ এ সত্য স্বীকার করেছেন। তার চেয়ে বড় কথা বিতর্কমূল কোন তত্ত্ব নয়, এ ইতিহাস, যা কোন পন্ডিতের স্বীকৃতির অপেক্ষায় বসে থাকে না।
প্রফেসর হোল্ট এবং আর কয়েকজন পাশ্চাত্য গবেষকের সমন্বিত প্রয়াসে “কেম্ব্রিজ হিস্ট্রি অব ইসলাম” নামে ইসলামী ইতিহাসের উপর সুবিস্ত্মৃত এক গ্রন্থ রচিত হয়। উক্ত গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে Literary impact of Islam on the moern West নামে এক অধ্যায়ে ব্যাপক বিশেস্নষণের সাহায্যে একথা প্রমাণ করা হয় যে, উৎকর্ষের লগ্নে ইসলাম দারুণভাবে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিল। বিস্তারিত আলোচনা করে প্রবন্ধকার উপসংহারে বলেন- মধ্য যুগ জুড়ে বিদ্যাচর্চার প্রায় সকল ধারা প্রাচ্য থেকেই পাশ্চাত্যের দিকে প্রবাহিত ছিল। তখন ইসলামই ছিল পাশ্চাত্যের শিক্ষক-
during the Middle Ages the trend was almost entirely from East to West (when Islam acted as the teacher of the West) (p.888-89).
ফরাসী বুদ্ধিজীবী বেরন কারডিভাস্কে স্বীকার করেছেন যে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরবগণ বাস্তবিকই প্রভূত সফলতা অর্জন করেছিলেন-
The Arabs have really achieved great things in science.
তবে সব কিছুর পর তাঁরা এও বলেছেন- যে স্বভাবজাত প্রতিভা, জ্ঞান মনষ্কতা ও সৃজনী চেতনায় গ্রীকরা ছিল উজ্জীবিত-কম্পমান আরবদের মাঝেও তা ছিল, আমাদের এরূপ অমূলক আশা না করাই উচিত। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সব কিছুর পূর্বে আরবরা ছিল গ্রীকদের শিষ্য। তাদের বিজ্ঞান মূলত গ্রীক বিজ্ঞানেরই প্রলম্বিত প্রকাশ। The iegacy of Islam (1931)
মান্টগোমরী ওয়ান্ট উক্ত উদ্ধৃতি উল্লেখ করে, আরবরা শুধুই গ্রীকদের অনুগত শিষ্য এবং বিশ্বস্ত অনুবাদক ছিল- এ ধারণা খ-ন করেন। তিনি আরবদের নিছক অনুবাদক ও বাহকের মর্যাদা দেয়ার পক্ষে নন। তিনি লিখেছেন, ইউরোপের এই উন্নতির পিছনে আরব জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের অবদান অনেক-
Arab science philosophy… contributed greatly to developments in Europe (p.232).
কিন্তু সেই সাথে মান্টগোমরী ওয়ার্ট প্রথমোক্ত বক্তব্যের চেয়ে আরো আপত্তিকর মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, তবে এতে কোনই সন্দেহের অবকাশ নেই যে, আরবরা গ্রীকদের শিষ্য ছিল। বিজ্ঞান ও দর্শনের ক্ষেত্রে আরবে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, গ্রীক গ্রন্থ সম্ভারের অনুবাদ বিপ্লবের ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল-
Science and philosophy is Arabic came into existence through the stimulus of translations from Greek (p. 226).
গ্রীক গ্রন্থ সম্ভারই আরবদের বৈজ্ঞানিক চৈতন্যোদয় ঘটিয়েছিল- এই ধারণা সঠিক নয়। বিষয়টি এমন নয় যে, গ্রীক অনুবাদ পড়ে আরবদের চিন্তায় বৈজ্ঞানিক চেতনার উন্মেষ-বিন্যাস গড়ে উঠেছিল। বরং কোরআন ও একত্ববাদের বিশ্বাস গ্রহণ করার ফলেই তাদের মাঝে মুক্ত চিন্তা ও বৈজ্ঞানিক চেতনার সাড়া জেগেছিল। এরপর, বরং এর ফলেই তারা গ্রীকসহ অন্যান্য ভাষার জ্ঞান-সমৃদ্ধ গ্রন্থরাজি অনুবাদ করে এবং বিজ্ঞান ও দর্শনে নিজস্ব উল্লেখযোগ্য সংযোজনে তাকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলে।
ইতিহাসের মুক্ত গবেষকগণ স্বীকার করেছেন যে, আরবরা বিজ্ঞান ও দর্শনে গ্রীকদের শিষ্য ছিল, একথা যেমন সত্য তেমনি এ সত্যও অনস্বীকার্য যে, তারা শুধুই গ্রীক বিদ্যার অনুবাদক ছিলেন না বরং তাতে তাদের নিজস্ব আবিষ্কার ও সংযোজনও ছিল বিপুল।
যেমন আরবরা গ্রীকদের থেকে চিকিৎসা বিদ্যা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু গ্রীকদের পুথিতে ছিল না, চিকিৎসা বিজ্ঞানে তারা এমন সংযোজন ঘটিয়েছিলেন, তা হল আরবদের হাতেই সর্বপ্রথম মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল গড়ে উঠে। আব্বাসী খেলাফত আমলে বাগাদাদে পৃথিবীর সর্বপ্রথম মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়।
এই সময়েই কায়রোতে গড়ে উঠে এক উন্নত হাসপাতাল, যাতে একই সঙ্গে ৮০০০ রোগীর আবাসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। পুরুষ ও মহিলাদের জন্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন ওয়ার্ড। ঐ হাসপাতালে প্রতিটি রোগের স্বতন্ত্র বিভাগ ছিল এবং সকল বিভাগে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সার্বক্ষণিক সেবা নিশ্চিত করা হয়েছিল। আর হাসপাতালের ভিতরেই চমৎকার ব্যবস্থাপনায় একটি উন্নত লাইব্রেরী এবং একটি আলোচনা কক্ষের ব্যবস্থা আরবদের উৎকর্ষের পরিচয় বহন করে। (পৃঃ ২২৭)
অনুরূপ চিকিৎসাশাস্ত্রে আরবদের একাডেমিক সংযোজনও ছিল অসাধারণ। আরব চিকিৎসা বিজ্ঞানী যাকারিয়া আল রাযী (মৃতঃ- ৯২৩ খৃঃ) চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর পৃথিবীর সর্ব প্রথম বিশ্বকোষ রচনা করেন। এই বৃহৎ গ্রন্থে তিনি সর্ব প্রকার ব্যাধি ও তার চিকিৎসা প্রণালী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। যে কোন রোগের আলোচনায় রাযী প্রথমে গ্রীক, সিরিয়া, ভারতীয় ও আরব চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের অভিমত বর্ণনা করেছেন। পরিশেষে নিজের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেছেন। তিনি গ্রন্থটি পূণ্র্‌ঙ্গ করে যেতে পারেননি। তাঁর পর তার শিষ্যরা তা পূর্ণ করেছিলেন। পরবর্তীতে নামে ল্যাটিন ভায়ায় অনূদিত হয়ে গ্রন্থটি ইউরোপে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।
আরব চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মধ্যে ইবনে সিনা (মৃঃ ১৩৩৭ খৃঃ) কতটা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল কানুন নামে ল্যাটিন ভায়ায় অনূদিত হয়ে ইউরোপে ব্যাপক প্রচার লাভ করে। ইবনে সিনার গ্রন্থ ইউরোপিয়ানদের কাছে গ্যালেন ও হিপক্রিটাসের গ্রন্থগুলোর চেয়ে অধিক অনুসরণীয় ছিল। ষোড়শ শতক পর্যন্ত ইবনে সিনার চিকিৎসাদর্শন ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে রেখেছিল। শুধু ১৫শ শতকেই ইউরোপে আল কানুনের ১৬ সংস্ককণ নিঃশেষ হয়ে যায়।
বস্তুত একাদশ শতকের সূচনাতেই আরবীয় চিকিৎসা বিজ্ঞান চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। এরপর সপ্তদশ শতক পর্যন্ত তার সর্ব গ্রহণযোগ্যতা বজায় ছিল।
আব্দুল্লাহ ইবনুল বাইতার:
আব্দুল্লাহ ইবনুল বাইতার (মৃঃ ১২৫৮ খৃঃ) দিলেন একজন আরবীয় উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। ফিলিপ হিট্রি লিখেন- বিভিন্ন উদ্ভিদের উপর ব্যাপক গবেষণা করার জন্য এবং তথ্য সংগ্রহ করার উদ্দেশ্য তিনি এশিয়া আফ্রিকার অধিকাংশ অঞ্চল ভ্রমণ করেন। এই সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি অনেক উদ্ভিদের উপর গবেষণা করেন এবং সেগুলোর প্রয়োগ অভিজ্ঞদাও অর্জন করেন। এরপর তিনি প্রায় দেড় হাজার উদ্ভিদ সম্পর্কে তার গবেষণার ফলাফল সম্বলিত একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমকালে যা ছিল সবচেয়ে বিস্ত্মৃত গ্রন্থ। ১৮৫৮ খৃস্টাব্দে গ্রন্থটি ল্যাটিনে অনূদিত হয়। এর ফলে আব্দুল্লাহ আল বাইতারের গবেষণা সমগ্র ইউরোপে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। (পৃঃ ৫৭৫-৭৬)
চিকিৎসা বিজ্ঞান, সৌরবিজ্ঞান ও গণিতে বিপুল সাফল্যের পর মুসলিম বিজ্ঞানীদের সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক অবদান ছিল রসায়ন শাস্ত্রকে শাস্ত্রের গন্ডি পেরিয়ে বাস্তব প্রয়োগে ফলপ্রসূ করে তোলা। এর মাধ্যমেই পৃথিবী সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ বিধি সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছিল।
পদার্থ বিজ্ঞানে যিনি বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রচলন করেছিলেন-যা ছিল গ্রীকদের নিছক অনুমানের উপর এক সফল উত্তরণ -ইতিহাস বলে তিনিও ছিলেন একজন মুসলমান মধ্যযুগে পদার্থ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আর রাযীর পর জাবের ইবনে হাইয়ান যত গভীরভাবে বাস্তব অভিজ্ঞতার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন এবং যত স্পষ্টভাবে তা বর্ণনা করেছেন, তার পূর্ববর্তী কোন পদার্থ বিজ্ঞানীর পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। রসায়নে শাস্ত্রীয় জ্ঞান ও বাস্তব প্রয়োগ পদ্ধতি, উভয়ের উৎকর্ষে জাবেরের উত্তরণীয় অবদান বিপুল- He more clearly recognised and started the importance of experimentation than any other early alchemist and made notwworthy advance in both the theory and practice of chemistry (p.380)
১৫ শতক পর্যন্ত ইউরোপে রসায়ন বিদ্যায় জাবেরের গ্রন্থই চূড়ান্ত প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত ছিল। ১৮ শতকে পূর্ণ উত্তারিত ও সমৃদ্ধিপ্রাপ্ত যে পশ্চত্য রসায়ন শাস্ত্র জাবের ছিলেন তার প্রথম ভিত্তি স্থাপক। বলা হয় যে, বিচিত্র বিষয়ে রচিত জাবেরের গ্রন্থ সংখ্যা ছিল প্রায় দু’ হাজার। একক প্রয়াসে কোন রচয়িতার রচনা সম্ভার এত বিপুল জাবেরপূর্ব ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত নেই।
অবিন্যস্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে এখানে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হল মাত্র। ইসলাম মুক্ত জ্ঞানের শত্রম্ন নয় বরং তার উদার উৎসাহদাতা পৃষ্ঠপোষক -এই সত্যকে আবরনমুক্ত করার জন্য এই যথেষ্ট মনে করছি। প্রাচীন সময়ে যে সব জাতি বহুত্ববাদ ও নানান কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল, নিজেদের ভেদ উন্মোচিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তারাই মুক্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের বিরোধীতা করেছে। বহুত্ববাদ ও কুসংস্কার নিমূর্লের জন্যই ইসলামের আগমন। তাওহীদ তথা একত্ববাদ সমৃদ্ধ ইসলাম এক পরম সত্য। সত্যান্বেষী জ্ঞান চর্চা সর্বদা সত্যকেই প্রবলভাবে প্রকাশিত করে, তাই ইসলাম সর্বদা মুক্ত জ্ঞান চর্চাকে উৎসাহিত করেছে। কখনই তার বিরোধিতা করেনি।
মুক্ত অনুকূল পরিবেশ :
ইসলামের এক মহৎ অবদান
শিরিক তথা বহুত্ববাদ ও নানা সংস্কারের বিস্তারে প্রাচীন সময়ে পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, কল্পনা বিলাস, পুরাণ ও কবিত্বের বিকাশের পক্ষে সে পরিবেশ হয়ত উপযোগী ছিল, কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাইন্টিফিক চেতনার উন্মেষ-অগ্রগতির পক্ষে তা কখনই অনুকূল না। এই কারণেই প্রায় সমগ্র প্রাচীন বহুত্ববাদের দৌরাত্ম্য নিঃচিহু করে ইসলামী বিপ্লব যখন নতুন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করল ইতিহাসে সর্বপ্রথম তখনই বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান নানা শাখা-উপশাখায় বিকশিত হতে লাগল।
প্রাচীন গ্রীস:
প্রাচীন গ্রীক মন-মানসে যে জিনিসটির প্রবল প্রভাব ছিল, তা হল “গ্রীক মেথোলজি” গ্রীক মেথোলজি কি, তা এক কথায় প্রকাশ করা যাবে না। এই বিষয়টির উপর অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এমনকি “ইনসাইক্লোপিডিয়া অফ গ্রীক মেথোলজি” নামে এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র বিশ্বকোষ রয়েছে।
প্রাচীন গ্রীসে বিভিন্ন দেব-দেবী ও বীর -বীরঙ্গনাদের নিয়ে নানা অদ্ভুত ও উদ্ভট পুরাণ ও কল্পকাহিনী প্রচলিত ছিল। তবে বিনোদনের সরল আবেদন নিয়ে নয়, গ্রীক মানসে এইসব উপস্থিত হয়েছিল বিশ্বাসের প্রবল প্রতাপ নিয়ে। শোচনীয়ভাবে গ্রীকরা বিশ্বাস করত এইসব উপকথায়। এই অবস্থা যে চেতনার, যেখানে এই সব অলিক কাহিনী সত্যের মর্যাদা পায়, সে চেতনা দ্বারা কবিত্ব হতে পারে, শিল্পের কল্পনা নির্মাণ হতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক সত্য উদঘাটনের উৎসবে তা কখনই মুখর হয়ে উঠতে পারে না। এই কারণেই প্রাচীন গ্রীস, বিজ্ঞানের উন্মেষ বিকাশের অনুকূল ছিল না। তাই অনেক কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী জন্ম দিয়ে প্রাচীন গ্রীস বিখ্যাত এবং অবশ্যই নন্দিত। কিন্তু যাকে বলে ‘বিজ্ঞানী’-প্রাচীন গ্রীস এমন সন্তানের জন্মগৌরব থেকে বঞ্চিত।
গ্রীস ছিল দেবতা প্রাচুর্যের দেশ। প্রাচীন গ্রীসের ‘স্বাস্থ্যকর জলবায়ুতে’ সমাবেত হয়েছিলেন রাজ্যের সব দেবতারা। প্রতিটি জিনিসের ছিল ভিন্ন ভিন্ন দেবতা। তাদের ঘিরে ছিল যত অদ্ভুত কল্পনার জাল বুণা। নিঃসন্দেহে শিল্প-কবিত্বের বিকাশের জন্য এই পরিবেশ খুবই উপযোগী। তাই দেখা যায়, সেই সময়ে গ্রীসে এবং অন্যান্য ইউরোপীয় অঞ্চলে এমন অনেক শিল্পকর্ম গড়ে উঠেছিল যার প্রধান প্ররোচক ছিল গ্রীক মেথলোজি। এমন কি আজও কোন কোন পাশ্চাত্য সাহিত্য গ্রীক মেথোলজির মোহনীয় প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।
গ্রীস ছিল প্রাচীন সময়ের উন্নত ও সম্রদ্ধতম সভ্যতা। কিন্তু এ এক বাস্তব সত্য যে, গ্রীস তার যাবতীয় সমৃদ্ধি উৎকর্ষ সত্ত্বেও ইউরোপে বৈজ্ঞানিক যুগের সূচনা করতে পারেনি। মুসলমানদের থেকে বৈজ্ঞানিক চেতনা-বিন্যাস গ্রহণ করেই ইউরোপ এক প্রবল বৈজ্ঞানিক চেতনায় জেগে উঠেছিল। শিরিক তথা বহুত্ববাদের সংস্কার উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক ছিল। তাওহীদ তথা একত্ববাদের বিশ্বাস সকল প্রকার অগ্রগতির দ্বার অবারিত করেদিল।
রোমান সভ্যতা
ইনসাইক্লোপিডিয়ার প্রবন্ধকার লিখেন-খৃস্টপূর্ব সময়ে সমগ্র পাশ্চাত্য জগতের উপর প্রবল প্রতাপ নিয়ে রোম ছিল এক সমৃদ্ধ সভ্যতা। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাস অনুসন্ধানকারীদের নিকট রোম এক অন্ধকার এলাকার নাম। বস্তুত রোমান সভ্যতা সীমাহীন শক্তি অর্জন করেছিল। সমরবিদ্যা এবং উহার সফল প্রয়োগে সাধন করেছিল প্রকৃত উন্নতি। উপরন্তু গ্রীকদের বিপুল জ্ঞানের উত্তরাধিকার তারা পেয়েছিল সরাসরি, অতি সহজে। কিন্তু এর পরও রোমান সভ্যতা হাজার বছরের আয়ুষ্কালে একজন বৈজ্ঞানিকও জন্ম দিতে পারেনি-
ইতিহাসে গবেষকগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রোমানদের এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করেছিন। কোন কোন ঐতিহাসিকের অভিমত এই যে, দীর্ঘকাল ধরে যে ইন্দ্রজাল রোমান সভ্যতাকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল জগত সম্পর্কে বাস্তব স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনায় অভ্যস্থ হওয়ার ব্যাপারে তাই ছিল তাদের সামনে প্রধান প্রতিবন্ধক। প্রাচীন পৃথিবীতে এমন কয়টি সভ্যতা রয়েছে, যার অনুকূল পরিবেশে তার জ্ঞান-বিজ্ঞান মুক্তি লাভ করেছিল- কোন ব্যক্তি যদি বিষয়টি এইভাবে চিন্তা করেন তাহলে তার চিন্তায় প্রশ্নের ধরণই পাল্টে যাবে এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রোমানদের এই ব্যর্থতাকে তার কাছে একটি সাধারণ ঘটনা বলে মনে হবে এবং প্রাচীন গ্রীস সভ্যতা এক বিস্ময় নিয়ে তার সামনে প্রতিভাত হবে। কিন্তু রোমানরা ছিল পৌত্তলিক, এক অসার অবাস্তব সংস্কার সমগ্র রোমান চিন্তাকে অবসন্ন করে রেখেছিল, এই ঐতিহাসিক তথ্যের তাৎপর্য যখন আমরা উপলব্ধি করতে পারব তখন আমাদের কাছে এর উত্তর খুবই সহজ মনে হবে। মূলত রোমানদের এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ ছিল বহুত্ববাদ ও অসার পৌত্তলিকতা, যা তাদের মুক্ত জ্ঞান চর্চা ও বাস্তবমুখী গবেষণাকে স্তব্ধ করে রেখেছিল। প্রকৃতির পবিত্রতার সংস্কার তাকে অধিকারের পথে বাঁধা হয়েছিল।
ইনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটিনিকার প্রবন্ধকার ‘হিস্ট্রি অফ সাইন্স’ শিরোনামে লিখেন- জগৎ প্রকৃতিকে আজ যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় মানব ইতিহাসে তা এক সম্পূর্ণ নতুন ঘটনা। অতীতের প্রধান প্রধান সভ্যতাগুলো বিভিন্ন বিদ্যা-জ্ঞান, দর্শন, রাষ্ট্রনীতি, ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিল সত্য, কিন্তু বর্তমানে যা বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনা ও বিন্যাস-পদ্ধতি বলে পরিচিত, অতীতে কোন সময়েই তার অস্ত্মিত্ব ছিল না। প্রাচীন গ্রীস, মেসোপটেমিয়া, ভারত, সর্বত্রই অভিন্ন ইতিহাস।
বস্ত্মুত প্রাচীন সভ্যতাগুলো বিজ্ঞান-বিরোধী, কমপক্ষে তা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। যদিও প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বেই গ্রীক এমন চিন্তা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল- কোন কোন ক্ষেত্রে আজকের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাথে যা তুলনীয়। কিন্তু পরিমার্জন-সংযোজনের ধারাবাহিকতায় তা ক্রমশ অগ্রসরমান ও জীবন্ত থাকেনি। তাই ইতিহাসের এক পর্যায়ে তা অনুধাবন করতে পারে, এমন লোকই দুর্লভ হয়ে পড়ল। আধুনিক বিজ্ঞানের যে বিপুল শক্তি, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার যে গভীর প্রভাব-মানব ইতিহাসের তা এক নতুন অভিজ্ঞতা।
দাবি করা হয় যে, কালের বিবেচনায় ইউরোপীয় বিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল খৃস্টপূর্ব পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে, গ্রীক দর্শনের বিকাশের মধ্য দিয়ে। তবে সেই প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের বক্তব্য-দর্শন খুব কমই আমাদের নিকট এসে পৌছেছে। যাও এসেছে তাও বিচ্ছিন্ন-খন্ডিত এবং সেই লেখকদের মাধ্যমে, যারা জন্মেছিলেন তাদের শত শত বর্ষ পরে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে নিজেদের লেখায় তারা তাদের সংক্ষিপ্ত কিছু বক্তব্য উল্লেখ করেছেন মাত্র। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সব উদ্ধৃতিগুলোও ভ্রান্তি মুক্ত নয়। যেমন দার্শনিক থেলিসের একটি বিখ্যাত উক্তি হল “সব কিছু পানি” আপাত দৃষ্টিতে একে একটি দার্শনিক উক্তি বলে মনে হয়। কিন্তু পূর্ণ বক্তব্যটি পড়লে স্পষ্ট হয় যে, এ এক আদিম সংস্কারাচ্ছন্ন অস্পষ্ট কথন মাত্র।তার সম্পূর্ণ বক্তব্যটি এমন- “সব কিছুই পানি এবং সমগ্র জগৎ দেবতাদের দ্বারা পরিব্যপ্ত”
থেলিস ছিলেন সেই প্রাচীন দার্শনিক যার সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনিই ছিলেন পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক। আনুমানিক খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে তিনি বর্তমান ছিলেন। তার সম্পর্কে বিস্তারিত ও নিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না। এমন বলা হয় যে, তিনি প্রাচীন সময়ের সপ্ত বিজ্ঞদের অন্যতম। কিন্তু তার রচনা আমাদের নিকট পৌছায়নি এবং তার সম্পর্কে সমকালীন কোন রেকর্ডও সংরক্ষিত নেই।
মূলত গ্রীক, রোম- বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের অনগ্রসরতার প্রধান কারণ ছিল বহুত্ববাদ।বহুতাবাদ প্রসূত বিশ্বাস-সংস্কার তাদের থেকে হরণ করে নিয়েছিল সেই মূল্যবান সম্পদ, যাকে বলে বাস্তববাদী চিন্তা-চেতনা, যার আনুকূল্য ছাড়া বিজ্ঞানের উন্মেষ-বিকাশ, কোনটাই সম্ভব নয়।
জ্ঞানের পথে যাত্রা:
গ্রীস ইউরোপের অন্তর্গত একটি রাজ্য। প্রাচীন সময়ে এখানে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক প্রতিভা জন্মগ্রহণ করেন, আর্কিমিডাস ছিলেন তাদের অন্যতম। বলা হয় যে, তিনি প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু যন্ত্র, যেমন চড়কা আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু শূন্যতা ও অন্ধকারের দীর্ঘ ইতিহাসে এ যেন এক ক্ষনিকের বিদ্যুত চমক। ক্ষণিকের জন্য জ্বলে তা যেন সহসা আবার মিলিয়ে গেল। গ্রীসে, আরো ব্যাপক অর্থে ইউরোপে তিনি বিজ্ঞান-মুখর কোন যুগের সূচনা করতে পারেননি। বরং স্বয়ং তার নিজের পরিণতিই ছিল চরম শোচনীয়। শহরতলীয় বালুর উপর জ্যামিতির কোন জটিল সমস্যা নিয়ে মগ্ন অবস্থায় এক রোমান সৈন্য তাকে হত্যা করেছিল। ইতিহাসে প্রাচীন গ্রীক বিজ্ঞান ও আধুনিক ইউরোপীয় বিজ্ঞানের মাঝে এক দীর্ঘ বিরতি লক্ষ্য করা যায়। খৃস্টপূর্ব ২৬০ অব্দে গ্রীসে আর্কিমিডাস চড়কা আবিষ্কার করেন। এরপর ১৪৫০ অব্দে জার্মানের গুটেনবার্গ ছাপাখানা আবিষ্কার করে ইউরোপীয় সমৃদ্ধ বিজ্ঞান যুগের সূচনা করেন। মাঝখানে হাজার বছরের দীর্ঘ এক শূন্যতা।
কেন এমন হল? গ্রীক বিজ্ঞান ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিকতায় কেন এক সম্পন্ন পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে পারল না? ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে সেই পরিবেশ ছিল না, যাতে মুক্ত জ্ঞানচর্চা স্বাধীনভাবে অগ্রসর হতে পারে। ইসলামের আবির্ভাবের ফলে একত্ববাদের ভিত্তিতে যে বিপ্লব সংঘটিত হল তাই ইতিহাসে সর্বপ্রথম সেই অনুকূল আবহাওয়া সৃষ্টি করল যাতে বাঁধাহীনভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারা বিকশিত হতে পারে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবিচ্ছিন্ন ক্রমোন্নতির ধারাবাহিক ইতিহাস যে জাতির রয়েছে ইতিহাসে তারাই জ্ঞানের জনক-ধারক, ইত্যাদি গৌরব পেতে পারে। গ্রীক বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানচর্চা, আবিষ্কার কর্ম, সময়-প্রতিবেশের অসহযোগের কারণে ধারাবাহিক অগ্রগতির গৌরব অর্জন করতে পারেনি। বরং ক্ষণিকের জন্য জ্বলে উঠে তা পুনরায় গহীন অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। এরপর ইসলামী বিপ্লবের ফলে বহুত্ববাদ মুক্ত যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হল তাতে সূচিত হল সেই বৈজ্ঞানিক তৎপরতার, দীর্ঘ পরিক্রমার পর যা আজকের এই ঐশ্বর্যমন্ডিত পরিণতি লাভ করেছে।
গ্রীক বিজ্ঞানীদের যা কিছু কীর্তি-আবিষ্কার তার সবই উপলব্ধি-মতবাদ এবং একাডেমিক গবেষণার মাঝে সীমাবদ্ধ। প্রতিবেশের প্রতিকূলতার কারণেই বাস্তব প্রয়োগে তা কখনই ফলবান হয়ে উঠেনি। যেমন এ্যারিস্টটল প্রকৃতি সম্পর্কে তার বিপুল গবেষণার ফলাফল লিপিবদ্ধ করে গেছেন কিন্তু তার সমগ্র জীবনের কোন দর্শনের বা বিজ্ঞান তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ও অভিজ্ঞদা অর্জনের একটি দৃষ্টান্তও নেই। তর্কশাস্ত্রে গ্রীকদের উন্নতি, উৎকর্ষ স্বতঃস্বীকৃত। কিন্তু প্রযুক্তি ও প্রয়োগ বিজ্ঞানে ক্ষেত্রে গ্রীক ইতিহাস শূন্য-মলিন।
ক্ষমাহীন অনুসন্ধান স্পৃহা যখন মানব মেধাকে অস্থির-ব্যাকুল করে তুলে মূলত তখনই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জন্মলগ্ন, বিকাশ ঋতু। প্রাচীন সময়ে এই অনুসন্ধিৎসা কোন কোন ব্যক্তিপ্রতিভাকে সাময়িকভাবে দোলা দিলেও প্রতিবেশের প্রতিকূলতার কারণে কখনই তা ব্যাপক আলোড়নের পরিণতি লাভ করতে পারেনি।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্মেষ-বিকাশের জন্য যে মুক্ত জ্ঞানচর্চার পরিবেশ দরকার ইসলামী একত্ববাদের বিপ্লব বিশ্বকে সেই পরিবেশ উপহার দিয়েছিল। প্রকৃতির গবেষণা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানবমেধা ও আচরণ সম্পূর্ণ স্বাধীন-ইসলামের ঘোষণা ছিল এমনই উদার। এর ফলে মুক্ত জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির এক ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হল। এই স্পন্ধন প্রথমে মক্কাতে সূচীত হলেও ক্রমশ মদিনা, সিরিয়া, বাগদাদ, সিসিলি, ইটালী ঘুরে সমগ্র ইউরোপ বরং সমগ্র বিশ্বে তার প্রতিস্পন্ধন ছড়িয়ে পড়ল। সূচিত হল যাকে বলে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পসমৃদ্ধ যুগ।
ধর্ম ও পবিত্রতার ধারণা:
নাথান সোডারব্লোম ১৯৯৩ সালে বলেছিলেন-পবিত্রতার ধারণা ধর্মের মৌল বিশ্বাস- তারপর থেকে অদ্যাবধি, ধর্মের উদ্ভব-বিকাশ, মানব সমাজে তার বিবর্তন সম্পর্কে ব্যাপকবিস্ত্মৃত গবেষণা-পর্যালোচনা হয়েছে। জার্মানী, ফরাসী ইংরেজী-আধুনিক কালের ইত্যাদি বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অসংখ্য গবেষণাসমৃদ্ধ নিবন্ধ গ্রন্থ রচিত হয়েছে। পবিত্রতার ধারণা ধর্মের মৌল বিশ্বোস- আধুনিক অধিকাংশ ধর্ম-বিজ্ঞানী এ ব্যাপারে একমত। কোন বস্তুসত্ত্বা পরম-পবিত্র হওয়ার অর্থ হচ্ছে, সাধারণত মানুষের মাঝে পাওয়া যায় না এবং সাধারণ মানব বুদ্ধিতে যা ব্যাখ্যাতীত এমন কিছু রহস্যময় গুণ সমষ্টিতে তা বৈশিষ্ট্যময় হয় ওঠা। ইনসাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজান ইন্ডিাথিক্স এ ‘পবিত্রতা’ এই শিরোনামে এ বিষয়ে বিশদ আলোকপাত করা হয়েছে।
এই পবিত্রতার ধারণা কোন কল্পনা বা মনগড়া বিশ্বাস নয় বরং তা মানুষের গভীরে প্রোথিত এক স্বতঃচৈতন্য।এক স্রষ্টার উদ্দেশ্য মানুষ যখন তার এই স্বভাব-উপলব্ধি-উচ্ছ্বাস নিবেদন করে তখনই তা সার্থকতা লাভ করে। কিন্তু অধিকাংশ সময় মানুষের এই আবেগ অস্থানে, স্রষ্টাকে ছেড়ে সৃষ্টির প্রতি উচ্ছ্বসিত হয়ে নিষ্ফলতায় অবসিত হয়। এর কারণ স্রষ্টা এক অদৃশ্যমান বিমূর্ত সত্য। মর্ত্য চোখে যার অবলোকন অসম্ভব। অথচ স্থূলতাপ্রীতি মানুষের এক আদিম প্রকৃতি।তাই বৃহৎ ও মহত্বের চমক নিয়ে যা কিছু তার দৃষ্টি ও অনুভবের সামনে প্রতিভাত হয় পরম-পবিত্রের মহিমা আরোপ করে তাকেই সে পুজা করতে আরম্ভ করে। এ মানুষের এক আদিম প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তির প্ররোজনায়ই প্রাচীন সময়ে গড়ে উঠেছে সেই সব অপসংস্কার বিশুদ্ধ ধর্ম মতে যাকে বলা হয় ‘শিরিক’ বা বহুত্ববাদ আর দর্শনের পরিভাষায় প্রকৃতিপূজা।
পবিত্রতার এই স্বভাব প্রেরণা ক্ষমাহীনভাবে মানুষকে কোন মহান সত্তার সামনে অবনত হতে উদ্বুদ্ধ করে। তার মূল্যবান শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য একমাত্র স্রষ্টা- সকল যুগের পয়গম্বরগণ মানুষকে এই শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বোধ মানুষ ভাবল সুদূর আকাশে অবস্থিত স্রষ্টার প্রতি তার শ্রদ্ধা কিভাবে নিবেদিত হতে পারে। তাই বিমূর্ত উপাসনায় আস্থা হারিয়ে মানুষ মেতে ওঠে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপসনায়। চাঁদ, সরুজ, নক্ষত্র, সমুদ্র ইত্যাদি, বিশ্ব প্রকৃতিতে যা কিছু মহিমান্বিত ও বিশাল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তাকেই সে ভেবেছে স্রষ্টার প্রতিরূপ, প্রতিনিধি বা ক্ষুদে দেবতা- তাই পূজনীয়। এই ভুল বিশ্বাস থেকেই গড়ে উঠেছিল মানব জাতির প্রকৃতি পূজার দীর্ঘ শোচনীয় ইতিহাস।
পবিত্রতার ধারণাই ধর্মের মৌল বিশ্বাসগুলোর অন্যতম। বর্তমান সময়ের প্রায় সকল ধর্ম-বিজ্ঞানী এই ব্যাপারে এক মত। এর অর্থ হচ্ছে সাধারণ মানুষের নেই, সাধারণ বোধ ও জ্ঞানে ব্যাখ্যাতীত, বিশেষ কিছু সত্ত্বা ও বস্তুকে ঘিরে এমন রহস্যময় গুণ ও শক্তির সংস্কার গড়ে ওঠা।
এই বিশ্বাসে গড়ে ওঠা পরম-পবিত্রদের দয়ার কথা ভেবে মানুষ আশায় বুক বেঁধেছে, তবে তা খুব কম। অধিকাংশ সময় তাদের ক্ষমতা ও শক্তির কথা কল্পনা করে ভয়ে কেঁপে ওঠেছে আদিম মানুষ। তাদের সামনে নিজেকে অনুভব করেছে চরম অসহায়-তাঁদের কৃপানির্ভর। তাদের সন্তুষ্টি লাভ ও রোষ থেকে মুক্তির আশায় তাদের উপাসনা করেছে, তাদের নামে বলি দিয়েছে, চরণে নিবেদন করেছে নানা নৈবেদ্য। এভাবে আদিম মানুষ গিয়েছে নানা ভুল পথে। তবে অনেক মানুষ এখনও রয়ে গেছে সেই আদিমতায়। বড় নির্মমভাবে তারা এখনও বিশ্বাস করে সেই সব হাস্যকর ধারণা ও প্রথায়। চন্দ্র, সূর্য, পাথর, পশু-পাখি আর রাজা-পুরোহিত-এমন বিচিত্র ক্ষেত্রে ও সত্ত্বাকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে এই সব বিশ্বাস। যুগে যুগে গড়ে ওঠেছেও।
ইনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটেনিকার নিবন্ধকার লিখেছেন-
সন্ত,পুরোহিত, বাদশাহ-এমন বিশেষ ব্যক্তি ও জনবিশ্বাসে পুণ্যাত্মাগণ, বিশিষ্ট স্থান যেমন মন্দির উপাসনালয় এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক নিদর্শন-সমুদ্র, চন্দ্র, সূর্য-এমন বিচিত্র বিষয়কে ঘিরে এই পবিত্রতার বিশ্বাস বিকশিত হতে পারে। ধর্মীর অনুশাসন পালন, বিভিন্ন প্রথা, অনুষ্ঠান সংঘটনের ক্ষেত্রে যেহেতু পুরোহিত, ধর্মযাজকদের বিশেষ ভূমিকা ও সংশ্লিষ্টতা থাকে তাই জনসাধারণ তাদেরকে এই সব ব্যাপারে পরমেশ্বরের প্রতিনিধি বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। বিশেষ ক্ষমতার অভিব্যক্তিতে রাজন্য শ্রেণী স্বভাবতই জনসাধারণ থেকে স্বতন্ত্র। তাই তারা দেবতার বংশধর ঈশ্বরের হাতিয়ার-অবলম্বন, জন বিশ্বাসে গড়ে ওঠে এই সব হাস্যকর কিংবদন্তি।
পবিত্রতার বিশ্বাস ধর্মের মৌল ভিত্তি-এই ধারণা পোষণ করেন দৃষ্টান্ত স্বরূপ এমন কয়েকজন নৃবিজ্ঞানীর নাম এখানে উল্লেখ করা হল-
পবিত্রতার বিশ্বাস ধর্মের মৌল ধারণা-আধুনিক ধর্ম বিজ্ঞানীদের এই অভিমত অবশ্যই সঠিক। কিন্তু এ উদ্ভূত-স্থুল কোন মনোভাবনা নয় বরং তা সৃষ্টিলগ্নেই মানুষের সত্তার গভীরে প্রেথিত এক স্বভাবচৈতন্য। এক স্রষ্টা ছাড়া অন্য কোন সত্তা বা বস্তুর উদ্দেশ্য তা যদি নিবেদিত হয়, বিভ্রান্ত মানব বিশ্বাস যদি বিধাতা ভিন্ন অন্য কাউকে পরম পবিত্রময় বলে গ্রহণ করে, তাহলে এই স্বভাব প্রেরণার চরম অপব্যবহার হয় এবং এই বিশ্বাস হয়ে ওঠে সর্ব প্রকার অকল্যাণের আকড়। মানুষ যখন অপরমকে পরমের মর্যাদার অধিষ্ঠিত করে, পবিত্রতম হিসেবে বিশ্বাস করে তখন সে হয় সকল উন্নতিরুদ্ধ এক অবিকশিত মানুষ।
প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে ঘিরে কিংবা কোন সত্ত্বা বা মহামানবকে স্পর্শ করে-এই দু’ভাবেই অপরমে পরম পবিত্রের বিশ্বাস গড়ে ওঠে। সমগ্র প্রাচীন সময় জুড়ে অপবিশ্বাসের এ দু’টি ধারাই বিবিধ আকৃতিতে মানব সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল। আদিম মানুষের মেধা-উপলব্ধি যে ছিল অবিকশিত -অবৈজ্ঞানিক-এই ছিল তার প্রধান কারণ।
পবিত্রতার ধারণা মানুষের মনের এক সতত বিশ্বাস, স্বভাব প্রেরণা-উপলব্ধি -এমন এক মনোবৃত্তি, মানুষের অন্যন্য মনোভাবের মত নিদির্ষ্ট অর্থবোধক কোন শব্দের মাধ্যমে যার দ্যোতনা আনা সম্ভব নয়। শব্দের সীমাবদ্ধ বোধের সাহায্যে শুধু তার দিকে ইঙ্গিত করা যেতে পারে। এই বিবেচনা উপব্ধিতে রেখে, পবিত্রতার ধারণা ধর্মের মৌল বিশ্বাস-আধুনিক ধর্ম বিজ্ঞানীদের এই অভিমতের সাথে আমি এক মত। তবে তা স্বভাবজাত, না তাদের মতানুসারে নিছক মনগড়া- কাল্পনিক?
সে বিষয়ে আমি বলব এ মানুষের এক স্বভাবজাত প্রেরণা। সৃষ্টিগতভাবেই তার সত্তার গভীরে প্রেথিত। মানুষ তার এই অভ্যন্তরীণ প্রেরণার সীমাহীন তাগিদেই উদ্ধারহীনভাবে কোন সত্তাকে পবিত্র বিশ্বাস করে তার সম্মুখে আনত হয়। তবে একত্ববাদ ও বহুত্ববাদ, ভুল ও সঠিক, এই দু’ভাবেই বিকশিত হতে পারে পবিত্রতার বিশ্বাস।
মানুষ যদি এক স্রষ্টাকে পবিত্র বিশ্বাস করে তাঁর উপাসনা করে তাহলে এক পরম বাস্তবতার সমার্থনে তার সেই স্বভাবজাত প্রেরণা সত্য-স্বার্থক হয়ে ওঠে। কেননা, যিনি প্রকৃতই পরমপবিত্র, এই বিশ্বাসে তাকেই পবিত্র বলে গ্রহণ করা হয়।
কিন্তু পরিচিত পরিম-লে আপাত দৃষ্টিতে যা কিছু অস্বাভাবিক, মহৎ অলৌকিকের মিথ্যে প্রতিভাস জাগায়, অধিকাংশ সময় তাকেই মানুষ পবিত্র বলে ভুল করে। তাকে পূজা করতে, তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন ব্যগ্র হয়ে ওঠে নির্বোধ মানুষ। এ এক সত্য প্রেরণার অসত্য প্রয়োগ। যা একমাত্র স্রষ্টার প্রাপ্য আত্মসভাবের উপর অবিচার করে মানুষ তাই নিবেদন করছে স্রষ্টাভিন্ন সত্তার প্রতি। বিশুদ্ধ ধর্মমতে একেই বলে শিরিক বা বহুত্ববাদ, ভিন্ন শব্দে যাকে বলা যায় “কল্পনা পূজা”।
স্রষ্টা ভিন্ন সত্তায় পবিত্রতার বিশ্বাস, এই ভ্রান্ত সংস্কারই আদিম মানুষের মেধাকে অবরুদ্ধ, আচ্ছন্ন ও বিপুল সম্ভাবনাকে অবিকশিত রেখেছিল। এর ফলেই বিজ্ঞানের প্রকাশ-বিকাশ বিলম্বিত হয়েছিল সহস্র বছর। এক স্রষ্টাকে পবিত্রতম মানলে চিন্তায় ও আচরণে মানুষ কোন সীমাবদ্ধতার শিকার হয় না। কেননা, মানুষের অধিকার, বিচরণ সীমার অনেক ঊর্ধ্বে এক পবিত্রতম স্থানে স্রষ্টার অবস্থান। কিন্তু যা কিছু মানুষের পরিচিত পরিম-লের আওতায়, অধিকারের বলয়ের মধ্যে অবস্থিত- যেমন প্রকৃতি; তার বিভিন্ন অনুষঙ্গ, তাকে যদি মানুষ পবিত্র বলে বিশ্বাস করে তাহলে তার সামনে একটি সীমাবদ্ধতার সমস্যা দেখা দেয়। কেননা, যা পবিত্র তাকে শুধু দূর থেকে সম্ভ্রমে পূজা করা যায, তাকে অধিকার করা যায় না। অথচ প্রকৃতিই হল বিজ্ঞানের কর্মভূমি, চাষক্ষেত্র, প্রকৃতির মুক্ত গবেষণা, তার সম্ভাবনা আবিষ্কারের অপর নামই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। এভাবে এই অপবিশ্বাস মানুষের বিপুল সম্ভাবনাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। বিজ্ঞানের বিকাশকে বাঁধাগ্রস্ত করে। যার সৃষ্টি মানুষের উপকার-ব্যবহারের জন্য, সে প্রকৃতিকে মানুষের অধিকার ও ব্যবহারের সীমা থেকে সরিয়ে স্থাপন করে পূজায় বেদীতে। কিন্তু প্রকৃত বিশ্বাস বলে স্রষ্টা ছাড়া সব কিছুই নিছক সৃষ্টি, চিন্তায় ও আচরণে মানুষ তার ব্যাপারে স্বাধীন।
প্রকৃতির পবিত্রতার এই অপ্রাকৃত বিশ্বাসই প্রাচীন ইতিহাস জুড়ে মানুষের মেধা ও চিন্তাকে অবিকশিত রেখেছে। বিজ্ঞানের আবির্ভাবকে বিলম্বিত করেছে সহস্র বছর। মানুষের চিন্তা ও আচরণের স্বাধীনতা দিয়ে, পূজার বেদী থেকে নামিয়ে প্রকৃতিকে মানুষের মুক্ত গবেষণা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সামনে স্থাপন করে ইসলামী বিপ্লবই সর্বপ্রথম একটি বিজ্ঞানমুখর সময়ের সূচনা করেছিল। ফলে এটা আজ চিরসত্য বলে প্রমাণিত যে, ইসলামই আধুনিক সভ্যতার জনক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন