বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

হযরত শাহজালাল (রহঃ)

১৪ শতাব্দীতে যে সকল অলি-আউলিয়ারা বর্তমান বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে ভূমিকা রেখেছেন তাদের একজন হলেন হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী (রহ.)। ভারত উপমহাদেশে খাজা মইনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-এর পরে এই ভূ-খণ্ডে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী (রহ.)। বাংলাদেশ আসাম তথা বৃহত্তর বঙ্গ ইসলামের আলোকে আলোকিত করার ক্ষেত্রে যাঁর নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং এদেশের সূফি, দরবেশ, আউলিয়াগণের মাঝে যাঁর প্রভাব ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশী লক্ষ্য করা যায় তিনি সুলতানে বাংলা, হযরত মাওলানা শাহজালাল মুজারদ ইয়েমেনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। এতদঞ্চল ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে জনসাধারণের মাঝে তাঁর প্রতি ভালবাসা ও নামের মাহাত্ম্য ব্যাপক ও অতুলনীয়।
নাম 
হযরত শাহ্জালাল মুজারদ ইয়েমেনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর পূর্ণ নাম জালালুদ্দীন জালালুল্লাহ্। আপামর জনসাধারণের মাঝে প্রচলিত নাম হযরত শাহ্জালাল(রহ.)।
লকব/উপাধি
সংক্ষেপে আমরা বলতে চাই যে :
(ক) একজন ব্যক্তি অনেক সময় সমাজে তার জন্ম স্থানের নামে পরিচিত হন। যা তাঁর মূল নামের শেষে সংযুক্ত থাকে। যেমন- হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।
(খ) অনেক সময় একজন ব্যক্তি তার অর্জিত বিশেষ জ্ঞান, প্রজ্ঞা, গুণ বা দক্ষতার কারণে ও সমাজে পরিচিতি লাভ করেন। যেমন- হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলবি রহমাতুল্লাহি আলাইহি।
(গ) একজন ব্যক্তি তার জন্মস্থানের নামে পরিচিত না হয়ে বরং জীবনের দীর্ঘ সময় কিংবা মৃত্যুকাল পর্যন্ত যে স্থানে বাস করেছেন সে স্থানের নামেও পরিচিত হন। যেমন- হাজী এমদাদুল্লা মুহাজিরে মক্কি রহমাতুল্লাহি আলাইহি।
ঐতিহাসিক ও জীবনীকারগণের তথ্যগত বিচ্যুতি ও মতভেদের কারণে হযরত শাহ্জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর জীবনেতিহাস নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলেও উপরোক্ত বিষয়ের আলোকে আমরা বলতে পারি যে হযরত শাহ্ জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি-ই ইবনে বতুতা বর্ণিত জালালুদ্দীন তাবরিজী রহমাতুল্লাহি আলাইহি যা সমসাময়িক এবং পরবর্তি নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বহুমুখি গুণাবলি ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কারণে বাংলার মুসলিম সমাজে বহু লকব বা গুণবাচক উপাধি দ্বারা বিভূষিত। বিভিন্ন শিলালিপি, ঐতিহাসিক ও মনীষীগণের বর্ণনা ও গবেষকগণের রচনাবলীতে সাধারণত নিম্নলিখিত লকবগুলি পাওয়া যায়ঃ শেখ, শায়খুল মাশায়েখ, কুতুব, মুজারদ, মখদুম, সুলতানুল বাংলা, আরিফান বুয়দ, কুতুব বুয়দ, মাওলানা, জালালুদ্দীন, তাবরিজী, ইয়েমেনী, কুন্যাভী, তাইজী, সিরাজী, প্রাচ্য-সূর্য, ইত্যাদি। তাঁর কুনিয়াত হল কোরাইশী।
পিতার নাম 
হযরত শাহজালাল ইয়েমনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর পিতার নাম হযরত শেখ মুহাম্মদ তাবরিজী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি একজন কোরাইশ বংশীয় স্বনামধন্য খ্যাতিমান দরবেশ ছিলেন। তিনি প্রখ্যাত দরবেশ হযরত আবু সাঈদ তাবরিজীর মুরীদ ও খলিফা ছিলেন। হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মত বুজুর্গ ব্যক্তি হযরত আবু সাঈদ তাবরিজী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর ফয়েজ হাসিল করেন। সুতরাং হযরত আবু সাঈদ তাবরিজী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর খিলাফত পাওয়া যে কোন লোকের জন্য সহজ বিষয় ছিল না। সম্ভবত এ কারণেই শেখ মুহাম্মদ কোরাইশী রহমাতুল্লাহি আলাইহি জন্মগতভাবে ইয়েমেনী হলেও সূফী ধারা মোতাবেক নামের শেষে পীরের তাবরিজী উপাধি ধারণ করায় নাম হয়েছে শেখ মুহাম্মদ তাবরিজী রহমাতুল্লাহি আলাইহি যা বিভিন্ন শিলালিপি ও ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়া যায়। শায়খ শাহজালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর বিদুষী মাতা ছিলেন সাইয়্যেদ বংশীয়। হযরত শেখ মুহাম্মদ কোরাইশী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর পিতার নাম ছিল হযরত শেখ ইব্রাহিম কোরাইশী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।
জন্ম ও বংশ পরিচিতি 
ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুসারে গবেষকগণের মতে হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ৭৪৬ হিজরী সনে ১৯শে জিলক্বদ ওফাত (ইন্তেকাল) বরণ করেন। সে মতে তাঁর ১৫০ বছর জীবনকাল ধরে জন্ম সাল হয় ৭৪৬-১৫০= ৫৯৬ হিজরী। তাঁর জন্মস্থান হল ইয়েমেনের তাইজ নগরীর কুন্যা নামক স্থানে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, কোন কোন লেখক হযরত শাহ্জালাল ইয়েমেনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে আলাদা দু জন দরবেশ বর্ণনা করে জালালুদ্দীন তাবরিজীর জন্ম ও ইন্তেকালের তারিখ এবং পান্ডুয়াতে তার মাজার বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু যে সমস্ত গ্রন্থের সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে মূল গ্রন্থে তা বর্ণিত হয়নি। সে গুলো পরবর্তিতে অপ্রমাণিত হয়েছে এবং পান্ডুয়াতে তার মাজার নেই বলে সেখানকার খাদেমগণই বর্ণনা করেন। সেখানে তার জওয়াব সমাধি বা স্মৃতি সৌধ বিদ্যমান।
নসবনামা বা বংশ তালিকা 
  1. হযরত আলী (রা:)
  2. হযরত ফাতেমা (রা:)
  3. ইমাম জয়নুল আবেদীন (রা:)
  4. ইমাম জায়েদ (রা:)
  5. ইমাম আলী আসগর (রা:)
  6. ইমাম তাজউদ্দিন তাইজী (র:)
  7. ইমাম সৈয়দ জাফর সাদিক (রা:)
  8. ইমাম ইব্রাহীম কোরেশী (র:)
  9. হযরত জালাল উদ্দিন সুরুখ (র:)
  10. শায়েখ মহাম্মদ (র:)
  11. হযরত ফাতিমা হাসিনা সাইদা (র:)
  12. হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী (র:)
শিক্ষা 
হযরত শাহ্জালাল ইয়েমেনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর পিতা-মাতা শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার ভার গ্রহণ করেন তাঁর বুযুর্গ মামা সৈয়দ আহ্মদ কবির সোহ্রাওয়ার্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি সোহ্রাওয়ার্দীয়া ত্বরিকার একজন প্রখ্যাত সুফি দরবেশ এবং মক্কার বিশিষ্ট আলেম ছিলেম। হযরত শাহ্জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর শিক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায় হযরত শাহ্জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে তাঁর মুরীদ কর্তৃক মাওলানা সম্বোধন থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে তিনি বিদ্যা শিক্ষায় শিক্ষিত একজন আলেম ছিলেন। এছাড়াও হযরত শায়খ্ আবু সাঈদ তাবরিজী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, হযরত বাহাউদ্দিন সোহ্রাওয়ার্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ৭ম শতাব্দীর মুজাদ্দীদ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর মত জগত খ্যাত তরিকতের ইমাম ও বুযুর্গ দরবেশ সাধকগণের শিষ্যত্ব ও সান্নিধ্যওহযরত কুতুব উদ্দীন বখ্তিয়ার কাকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ফরিদ উদ্দীন শকরগঞ্জ রহমাতুল্লাহি আলাইহি, হযরত নিযামুদ্দীন আউলিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি, হাদীস বিশারদ হযরত বাহাউদ্দীন যাকরিয়া মুলতানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, হযরত শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার রহমাতুল্লাহি আলাইহি, হযরত বোরহানুদ্দীন সাগরজী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর মত যুগের দিকপাল মহান মনীষীগণের সাথে গভীর বন্ধুত্ব থাকাটাও প্রমাণ করে যে, হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি আধ্যাত্মিক অতিন্দ্রীয় জ্ঞান তো বটেই ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য জ্ঞান রাজ্যের বিভিন্ন শাখায় ও বুৎপত্তি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
হযরতের পীরগণ 
হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী রহমাতুল্লাহি আলাইহি শৈশব থেকে প্রায় ২২/২৩/৩০ বছর পর্যন্ত মামা হযরত সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর নিবিড় তত্ত্বাবধানে শরীয়ত ও মারফতের দীক্ষা গ্রহণ ও আধ্যাত্মিক সাধনা করেন। এরপর তিনি আবু সাঈদ তাবরিজী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর নিকট মুরীদ হন এবং তাঁর সোহ্বতে প্রায় দুই বছর কাটান। এরপর হযরত শাহ্জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি সোহ্রাওয়ার্দী ত্বরিকার ইমাম হযরত শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহ্রাওয়ার্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর নিকট মুরীদ হন। এ সূত্রে হযরত শেখ সাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি হন তাঁর পীর ভাই বাসতীর্থ। শাহ্জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রায় ৭ বৎসর শিহাবুদ্দীন সোহ্রাওয়ার্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর সান্নিধ্যে কাটান। তাঁর ইন্তেকালের পর হযরত শাহ্জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি হযরত শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর সুযোগ্য পুত্র শায়খ হযরত বাহাউদ্দিন সোহ্রাওয়ার্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর নিকট মুরীদ হন এবং দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর তাঁর খেদমতে ছিলেন।
শাহজালাল (রহ.) এর শাজরা শরিফ 
  1. হযরত মুহম্মদ (সা:)
  2. হযরত আলী কারামুল্লাহ (রা:)
  3. হযরত হবিব আজমী (রহ:)
  4. হযরত শেখ হায়দর আলী (রহ:)
  5. হযরত শেখ মারুফ কারখী (রহ:)
  6. হযরত শেখ সরিস খতি (রহ:)
  7. হযরত মমসাদ দিনুরী (রহ:)
  8. হযরত শেখ মুহাম্মদ (রহ:)
  9. হযরত শেখ আহমদ দিনুরী (রহ:)
  10. হযরত শেখ অজি উদ্দিন (রহ:)
  11. হযরত আবু নছর জিয়া উদ্দিন (রহ:)
  12. হযরত মখদুম বাহাউদ্দিন (রহ:)
  13. হযরত আবুল ফজল সদর উদ্দিন (রহ:)
  14. হযরত রোকনুদ্দিন আবু ফতাহ (রহ:)
  15. হযরত জালাল উদ্দিন বোখারী (রহ:)
  16. হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহ:)
  17. হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী (রহ:)
সিলেটের পথ ধরে বাংলায় আগমন 
বিভিন্ন জীবনীকারগণের বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে, হযরত শাহজালাল বাংলাদেশের সিলেটের আগমনের পূর্বে একটি স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের বৃত্তান্ত পীর মুর্শিদ ও মামা সৈয়দ আহ্মদ কবীর সোহ্রাওয়ার্দী এবং সংগীয় পীর বাহাউদ্দীন সোহ্রাওয়ার্দীর নিকট বর্ণনা করেন। স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনে অবিলম্বে হিন্দু স্তান যাত্রার আদেশ দেন। স্বপ্নের ইঙ্গিত মতে মুর্শিদ একমুষ্ঠি মাটি তাঁর হাতে দিয়ে বলেন, এই মাটির বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ যেখানে পাইবে সেখানেই তুমি অবস্থান ঠিক করিবে। তিনি আরও বললেন, এই মৃত্তিকা মুষ্ঠি যে স্থানে পরিত্যাগ করিবে সে স্থানের মহত্ত্বের আর তুলনা থাকিবে না। পীরের নির্দেশের পর হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি বাংলাদেশে আসার আগে জন্মভূমি ইয়েমেন গমন করেন। সেখানে পূর্বপুরুষ ও মাতা-পিতার মাজার জিয়ারত করেন এবং উলুহিয়াতের তত্ত্ব প্রচার করেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও গুণে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে লোক তাঁর দিকে ধাবিত হয়। এতে ইয়েমেনরাজ ঈর্ষান্বিত হয়ে হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে বিষ মিশ্রিত শরবত দ্বারা কামালত পরীক্ষা করতে চাইলেন। হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি বিষ মিশ্রিত শরবত বিস্মিল্লাহ বলে পান করলে সে বিষের প্রতিক্রিয়ায় উল্টো ইয়েমেন রাজই মৃত্যুবরণ করে। ইয়েমেনের পরবর্তী রাজা শাহ্জাদা আলী পিতার মৃত্যু এবং শাহ জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর অলৌকিক ঘটনা দেখে তাঁর ভক্তে পরিণত হন এবং শাসকের তখ্তে (সিংহাসনে) না বসে শায়খ শাহ্জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর সাথী হতে চাইলেন কিন্তু হযরত শাহ্জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাকে রাজ্য পরিচালনার ভার দিয়ে ইয়েমেন হতে যাত্রা করেন। ইয়েমেন হতে হযরত শাহ্জালাল বাগদাদ আসেন। বাগদাদে হযরত বাহাউদ্দীন সোহ্রাওয়ার্দীর নিকট হতে পুনরায় বিদায় গ্রহণ করেন। সেখানে থেকে বিশ্বের প্রধান প্রধান জনপদে কিছুদিন করে অবস্থান করে সমরকন্দ, আফগানিস্তান হয়ে মুলতান উপস্থিত হন। মুলতান হতে হযরত শাহ্জালাল দিল্লীতে এসে উপস্থিত হন। ইয়েমেনের শাহ্জাদা আলী সিংহাসন ছেড়ে এ সময়ে তাঁর সাথে মিলিত হন। দিল্লীতে হযরত নিজামুদ্দীন আউলীয়ার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বর্ণিত রয়েছে, হযরত শাহ্জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি দিল্লীতে অবস্থানকালে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি এঁর একজন শিষ্য জানালেন যে, আরব দেশ থেকে এক দরবেশ এসেছেন তিনি নারী মুখ দর্শন করেন না। চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে পথ চলেন এবং সব সময় একজন কম বয়সী সুদর্শন বালক কে সঙ্গে রাখেন। হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া উৎসুক হয়ে একজন শিষ্যকে পাঠালেন দরবেশকে নিয়ে আসার জন্য। হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি অবস্থা বুঝতে পেরে প্রেরিত শিষ্যের হাতে একটি কৌটার মধ্যে তুলা দিয়ে তার উপরে একটি জ্বলন্ত অঙ্গার দিয়ে কৌটার মুখ বন্ধ করে ফেরত পাঠান। হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া কৌটার মুখ খুলে দেখলেন যে, তুলার উপর একটি জ্বলন্ত অঙ্গার কিন্তু এতে তুলার একটি আশও জ্বলছে না। হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ ঘটনা থেকে আগত দরবেশের কামালিয়াত ও ফজিলত বুঝতে পারলেন এবং নিজেই হযরত শাহজালাল ইয়েমেনীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং শ্রদ্ধা ও প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ একজোড়া কবুতর উপহার দেন। সে সময় থেকে আজও এ কবুতর জালালী কবুতর নামে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। দিল্লী থেকে হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি মুর্শীদ প্রদত্ত মাটি সহকারে বাংলাদেশে আগমন করেন। খুলনা, রংপুর, সোনারগাঁ সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সফর করেন। এখানে প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হল, হযরত শাহ্জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি যখন ত্রিপুরা রাজ্যের বর্তমান কুমিল্লা সফর করছিলেন তখন কুমিল্লার মাটির সাথে মুর্শীদ প্রদত্ত মাটির মিল পেয়ে তিনি বলেছিলেন কুহু মিলা। কিংবদন্তি অনুসারে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে সেখান থেকে কুমিল্লা শব্দটির উতপত্তি। কুমিল্লার যে স্থানটিতে একটি টিলার উপরে হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি কিছু দিন অবস্থান করে ধ্যানমগ্ন হয়ে স্রষ্টার ইবাদত বন্দেগীতে নিমগ্ন ছিলেন, সেখানে তাঁর কর্তনকৃত চুল ও নখ প্রোথিত আছে। এখানে নয়নাভিরাম টিলার উপরে ঐ আস্তানাটি রয়েছে। আস্তানাকে কেন্দ্র করে একটি জওয়াব সমাধি, মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। বর্ণিত রয়েছে যে, এই আস্তানাটির নিকটবর্তী শাহ্পুর গ্রামে ভারতের ভাগলপুর হতে আগত প্রায় ২৫০ বছর পূর্বের প্রসিদ্ধ আউলিয়া হযরত শাহ্ নুরুর্দ্দীন আলক্বাদেরী প্রকাশ্যে হযরত বন্দী শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রতি বৃহস্পতিবার হযরত শাহ্জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি মাজার শরীফ সিলেট থেকে চট্টগ্রাম হযরত শাহ্ আমানত রহমাতুল্লাহি আলাইহি দরগায় পদব্রজে সফর করতেন।
সিলেট বিজয় 
সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের আমলে ৭০৩ হিজরীতে শাহজালাল ইয়েমেনী আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে সিলেট বিজয় করেন। বর্ণিত আছে যে, গৌড় গোবিন্দ কর্তৃক শেখ বুরহানুদ্দীনের শিশুপুত্র হত্যার প্রতিবিধানার্থে প্রেরিত সিকান্দার গাজীর বাহিনী গৌড় গোবিন্দের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার কারণে বারবার পরাভূত হয়। অবশেষে হযরত শাহ্জালাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও তাঁর অনুসারী ৩৬০ আউলিয়া সহযোগে গৌড় গোবিন্দের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতাকে পরাভূত করে সিলেট বিজয় করা হয়।
সিলেট নামকরণের কারণ 
এখানে সিলেট নামকরণে একটা কথা প্রচলিত আছে আর তা হলো হযরত শাহজালাল (রহ:) যখন সিলেটের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন রাজার তৈরি করা ব্যারিকেডের শিলা পাথরকে “শিল হট যা” বলে উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে শিলা পাথরগুলো সরে গিয়েছিল বলে জানা যায়। এখান থেকেই সিলেটের নামকরণ হয়েছে বলে ধরা হয়।
ইবনে বতুতার দৃষ্টিতে শাহজালাল ও সিলেট 
হযরত শাহজালাল (রহঃ) তাঁর শেষ জীবন পর্যন্ত ধর্ম প্রচার করে গেছেন। তার ব্যবহার ও অন্যান্য গুণাবলী লক্ষ্য করে বহু হিন্দু এবং বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করেন। বিশ্বের নামকরা পর্যটক মরক্কো তানজানিয়ার অধিবাসী শায়খ সরফ উদ্দিন আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে বতুতা ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে সিলেট সফরে এসে হযরত শাহজালাল (রহ:)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। ইবনে বতুতা সিলেটকে কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত অঞ্চল বলে উল্লেখ করেন এবং সমুদ্র তীরবর্তী একটি গহিন বনভূমি বলেও বর্ণনা করেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী হযরত শাহজালাল (রহ:) পাতলা গড়ন ও খুবই সুন্দর চেহারার অধিকারী এবং বেশ লম্বা ছিলেন। তিনি ছাগলের দুধ পান করতেন। সারা বছরই বলতে গেলে তিনি রোজা রাখতেন ও সারা রাত এবাদতে মশগুল থাকতেন। ইবনে বতুতা ‘রিহালা ইবনে বতুতা’য় হযরত শাহজালাল (রহ:)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের বিভিন্ন বর্ণনা প্রদান করেন। মোগল কবি হযরত আমির খসরুর কবিতার বইয়েও হযরত শাহজালাল (রহ:)-এর সিলেট বিজয়ের উল্লেখ আছে।
ইন্তেকাল 
হযরত শাহজালাল (রহঃ)-এর মৃত্যুবরণের সঠিক তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে। কিন্তু ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ১৫০ বছর বয়সে ৭৪৭ হিজরি ১৩৪৭ সালে ওফাত গ্রহণ করেন বলে জানা যায়। তিনি সিলেটেই সমাহিত হন এবং তাঁর সমাধিস্থল দরগা মহল্লা নামে পরিচিত। তাঁর বাৎসরিক ওরস আরবি জিলকদ মাসের ১৮, ১৯, ২০ তারিখ পর্যন্ত পালন হয়ে থাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন