মুফতী রফীকুল ইসলাম মাদানী
রাসূল (সা.) এর সম্মানিত সাহাবীগণের মূল্যবান বাণী ও তাদের অনুসৃত আদর্শ আমাদের জন্য পাথেয় এবং অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। আর এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সর্বসম্মত আক্বীদা। পক্ষান্তরে লা-মাযহাবী বা সালাফীদের আক্বীদা হলো যে, সাহাবাদের কোনো বাণী তাদের অনুসৃত আদর্শ অনুসরণযোগ্য নয় এবং অনুসরণ করা ধর্মহীনতা ও অন্ধ বিশ্বাসের নামান্তর।
তাদের উক্ত আক্বীদার প্রমাণ স্বরূপ ভারতবর্ষে লা-মাযহাবীদের প্রধান মুখপাত্র নবাব ছিদ্দিক্ব হাসান খানের কয়েকটি উক্তি নিম্নে প্রদত্ত হল-
“আর রওজাতুন নাদীয়াহ” নামক গ্রন্থে তিনি লিখেন-
قول الصحابی لاتقوم بہ حجۃ وفھم الصحابی لیس بحجۃ
“সাহাবাগণের (রা.) কথা দলীল স্বরূপ পেশ করা যাবে না।” { আর রাওজাতুল নাদীয়া-পৃ.১/১৪১} এবং তাদের বুঝ নির্ভরযোগ্য নয়। { আর রাওজাতুল নাদীয়া-পৃ.১/১৫৪}
অন্য গ্রন্থে আরও লিখেন-
وفعل الصحابی لایصلح حجۃ
“এবং সাহাবাগণের আমল দলীল হওয়ার উপযোগী নয়।”{ আততাজ আল-মুক্বাল্লিদ-পৃ.১৯২}
লা-মাযহাবীদের সর্বাধিনায়ক সাইয়্যেদ নযীর হুসাইন বলেন-
زیراکہ قول صحابی حجت نیست
“সাহাবীদের কথা প্রমাণযোগ্য নয়”। { ফাতাওয়ায়ে নজীরিয়া-পৃ.১/৩৪০}
লা-মাযহাবীদের আক্বীদা সাহাবায়ে কিরামের (রা.) আদর্শ অনুসরণের ব্যাপারে অনীহার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদের কতিপয় আলেম ভ্রষ্ট শিয়াদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সাহাবাদেরকে ফাসেক্বও বলেছে। লা-মাযহাবীদের বিশেষ মুখপাত্র নবাব ওয়াহিদুযযামান তার রচিত গ্রন্থ ‘নুযুলুল আবরারে’ লিখেছেন-
إن من الصحابۃ من ھو فاسق کالولید ومثلہ یقال فی حق معاویۃ وعمر ومغیرۃ وسمرۃ۔
“সাহাবাদের মধ্য হতে কিছু সংখ্যক ফাসেক্বও ছিল, যেমন-ওয়ালিদ, তেমনি ভাবে মুয়াবিয়া, উমর, মুগীরা ও সামুরা (রা.) প্রমুখ সম্বন্ধেও অনুরূপ বলা যেতে পারে ”।(!) { নুযুলুল আবরার, পৃ.২/৯৪ }
সম্মানিত পাঠক সমাজ ! সাহাবায়ে কিরাম (রা.) কি আমাদের সালাফ বা পূর্বসূরী নয়? নয়কি তাদের অনুসৃত আদর্শ আমাদের জন্য পাথেয়? আর তাঁরাই যদি আমাদের পূর্বসূরী না হয়, তাহলে কারা হবে? সুতরাং সাহাবা সম্বন্ধেই যাদের এ হীন মন্তব্য আর আক্বীদা তাদের সালাফী দাবি করা অবান্তর, হাস্যকর ও গভীর চক্রান্ত বৈ আর কি হতে পারে? যদি হযরত সাহাবায়ে কিরাম (রা.) সম্বন্ধে তাদের এরূপ ধারণা আর এরূপ বৈরী আক্বীদা হয় তাহলে সাহাবা পরবর্তী তাবেয়ী ও আইম্মায়ে মুজতাহিদগণ সম্বন্ধে তাদের কেমন জঘন্যতম আক্বীদা ও বিরাগ-বিকর্ষণ হবে তা আর উল্লেখ করার অপেক্ষা রাখে না। এমতাবস্থায় আমাদের প্রশ্ন হলো এতদসত্বেও কোন সূত্রে, কোন যুক্তিতে তারা সালাফী দাবি করে? নিরপেক্ষভাবে অনুসন্ধান করলেই দেখা যাবে যে, তারা মূলত ক্বাজী মুহাম্মদ ইবনে আলী আশ-শাওকানী (মৃত১২৫৫হিজরী) এবং শায়খ মুহাম্মদ নাছীরুদ্দীন আলবানীর (মৃত ১৯৯৯ইং-১৪১৯হি.) অনুসরণ-অনুকরণ, তথা তাক্বলীদ করে চলছে। আর তারা ইমামগণের তাক্বলীদ করাকে সম্পূর্ণ রূপে হারাম ও শিরক হিসেবে অভিহিত করেছেন। অথচ তারাই লা-মাযহাবীদের ইমামের পদ অলঙ্কৃত করেছেন। এছাড়া একই মতাদর্শের বিধায় লা-মাযহাবীরা সুবিধামতো কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইমাম ইবনে হাযাম, (মৃত৪৫৬হিজরী) ইবনে তাইমিয়্যাহ (মৃত৭২৮ হিজরী) ইবনুল ক্বাইয়্যিম (মৃত ৭৫১) এবং মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহহাব নজদী (মৃত১২০৬হিজরী) প্রমুখেরও অনুসরণ করে আসছে বলে বাস্তবে দেখা যায়।
সুতরাং এ প্রশ্নটি থেকেই যায় যে, তথাকথিত “সালাফী” দাবিদাররা ৫ম শতাব্দী বা ১৪ শতাব্দী তথা নিকৃষ্টতম যুগের লোকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যদি সালাফী দাবি করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে তাহলে সাহাবা এবং প্রথম যুগের ইমাম বিশিষ্ট তাবেয়ী ইমামে আযম আবু হানীফা (রহ. জন্ম ৮০ হিজরী, মৃত ১৫০হি.) অথবা ইমাম মালেক (রহ. মৃত১৭৯হি.) অথবা ইমাম শাফেয়ী (রহ. মৃত ২০৪হি.) অথবা ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ. মৃত ২৪১হিজরী) প্রমুখ প্রথিতযশা ইমামগণ কর্তৃক প্রদত্ত কুরআন হাদীসের ব্যাখ্যার অনুসরণ যাঁরা করে আসছে তাঁরা “সালাফী” হবে না কেন? বরং আমরা বলব তাঁরাই হলো প্রকৃত “সালাফী”। আর তথাকথিত “সালাফী” নামের ধব্জাধারীরা নামে মাত্র “সালাফী”। সালফে সালেহীন বা পূর্ববর্তী সৎ ও মহৎ ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের কোনো সামঞ্জস্যতা নেই। তাই তারা সালাফী নয়, বরং তারা হলো “খেলাফী” অর্থাৎ বিরুদ্ধাচরণকারী। কারণ, তারা সালফ বা পূর্বসূরীদের কেবল খেলাফ ও বিরুদ্ধাচরণই করে আসছে, সালফে সালেহীনের আনুগত্যের লেশমাত্রও তাদের মধ্যে নেই। হ্যাঁ , সাম্প্রতিককালে শায়খ নাছীরুদ্দীন আলবানী এবং সউদি আরবের “রবী আল-মাদখালী ও মুহাম্মদ আল-মাদখালী প্রমুখ কট্টরপন্থী ব্যক্তিদের আনুগত্য ও তাক্বলীদ করতে তাদেরকে দেখা যাচ্ছে। আর এরাই তাদের সালফ তথা পূর্বসূরী ও অনুকরণযোগ্য ইমাম বলে বিবেচিত। সুতরাং বলা যেতে পারে, তারা এ সমস্ত কট্টরপন্থী سلف السعودیین )সালাফুস সাউদিয়্যিন) সউদি সালফের অনুসরণ করে হিসেবে তারা সালাফী। পক্ষান্তরে সমস্ত মুসলিম উম্মাহ সালফে সালেহীনের অনুসরণ করে বিধায় তারা হলো প্রকৃত অর্থে “সালাফী”।
এ অধ্যায়ে আশাকরি প্রতীয়মান হয়েছে যে, সালফে সালেহীনের সঙ্গে যাদের সামঞ্জস্যতা নেই তাদেরই নাম রেখেছে “সালাফী”, আর হাদীসের সাথে যাদের কোন সম্পর্ক নেই তাদের নাম রেখেছে “আহলে হাদীস”। উল্লেখ্য যে, সালফের সঙ্গে যে তাদের সামঞ্জস্যতা নেই বা হাদীসের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই তা তেমন মারাত্মক ব্যাপার নয়, মারাত্মক হলো সালফের সঙ্গে কোন সামঞ্জস্যতা না থাকা সত্বেও নিজেদের নাম সালাফী রাখা এবং সালাফী দাবি করা। আর হাদীসের সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্বেও নিজেদের নাম আহলে হাদীস রাখা। কেননা এ নামের মুখোশ পরে সরলমনা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে তারা সহজে প্রতারণা করতে সক্ষম হচ্ছে। মোটকথা, তাদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জাল হিসেবে তারা এ সমস্ত নাম ও ইসলামী পরিভাষা গুলো ব্যবহার করে আসছে। তাই এ নাম ও পরিভাষা সমূহের আসল রূপ উম্মোচন করা এবং এর মূল রহস্য উদঘাটন করে তা অনুধাবন করা প্রতিটি সত্যানুসন্ধিৎসু, ঈমানদার, উদার মুসলিমের একান্ত অপরিহার্য কর্তব্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন