মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ)।
আজ ৮ রমজান।
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের এক শোকাবহ দিন আজ।
১৪০৭ হিজরী সনের (১৯৮৭ সালের ৭ মে) এই দিনে ইন্তিকাল করেন বহুল আলোচিত ‘তওবার রাজনীতির’ প্রবর্তক মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ)।
আকাবিরে উম্মতের সুযোগ্য উত্তরসূরি হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন উপমহাদেশের ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক পথ প্রদর্শক।
তিনি ১৮৯৫ সালে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর থানাধীন লুধুয়া গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি স্থানীয় মক্তব ও প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষা সমাপনের পর ভারতের পানিপথ মাদরাসায় সহীশুদ্ধভাবে পবিত্র কুরআনুল কারীম শিক্ষা লাভ করেন এবং হেফজ শেষ করেন।
পরে ভারতের প্রসিদ্ধ মোজাহেরুল উলূম সাহরানপুর মাদরাসা ও বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে তিনি হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ, তর্কশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন।
শিক্ষা সমাপনের পর ১৯১৮ সনে হাকীমুল উম্মত মোজাদ্দেদে মিল্লাত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহ)-এর কাছে আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন এবং খেলাফত লাভ করেন।
দেশে ফিরে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইউনুছিয়ায় শিক্ষকতার পাশাপাশি দেশব্যাপী ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করেন।
পরে ঢাকায় এসে আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) ও আব্দুল ওয়াহহাব পীরজী (রহ.) হুজুরের সাথে বড়কাটারা আশরাফুল উলূম মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
হাফেজ্জী হুজুর (রহ) ঢাকার বিখ্যাত জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ, জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া কামরাঙ্গীরচর, জামিয়া এমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ, মাদরাসায়ে ইশাআতুল উলূম লুধূয়া, লক্ষ্মীপুরসহ সারা দেশে দু’শতাধিক দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ) সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজপতি, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, শাসকবর্গসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণকে সংশোধনের দাওয়াত দিতেন এবং ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী সকলকে পরিচালিত হতে অনুপ্রাণিত করতেন।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান, জিয়াউল হক, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ও ইরানের প্রেসিডেন্ট ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেনীর সাথে সাক্ষাত করেও হাফেজ্জী হুজুর (রহ) তাদেরকে ইসলাহ-সংশোধনের নছিহত করেন এবং স্ব স্ব দেশে মানবজাতির মুক্তির জন্য কুরআনের বিধান বাস্তবায়ন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শে রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য দাওয়াত দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে প্রায় সবাই হাফেজ্জী হুজুরকে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে জানতেন, চিনতেন সমীহ করতেন।
হাফেজ্জী হুজুর (রহ) ছিলেন এক বিশাল মহীরুহ। অনন্য ছিল তার প্রতিটি কর্ম। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ আলেম, শিক্ষক, সংস্কারক, পীর-মোর্শেদ, মুজাদ্দিদ, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক এবং আধ্যাত্মিক জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, খাঁটি নায়েবে রাসূল।
তার জীবনের অমর কীর্তি হচ্ছে, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তওবার রাজনীতি, নির্বাচনী জিহাদ এবং বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করা। চিন্তা-চেতনার মৌলিকতায় হাফেজ্জী হুজুরের রাজনীতি ছিল এক ভিন্ন জিজ্ঞাসা, ভিন্ন অনুভূতির সঞ্চার। রাজনৈতিক ময়দানে কালজয়ী আদর্শ হিসেবে তার দরদমাখা আহ্বান সে দিন নবদিগন্তের দিশা দিয়েছিল।
হাফেজ্জী হুজুর (রহ) ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক ময়দানে আবির্ভূত হন। তওবার রাজনীতির প্রবতনের মাধ্যমে তিনি এদেশে রাজনীতিতে সংস্কারের ডাক দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ভোটের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ ও অসৎ লোকদের ক্ষমতায় পাঠানো হচ্ছে, সেই ভোটের মাধ্যমেই যোগ্য, সৎ ও আল্লাহওয়ালা মানুষদের নির্বাচিত করে ক্ষমতায় পাঠাতে হবে। তাদেরকে দেশ চালানোর দায়িত্ব দিতে হবে। তাহলেই সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে।
হাফেজ্জী হুজুর (রহ) বলতেন, ইসলামের নামে অর্জিত স্বাধীন এদেশে ইসলামী হুকুমত না থাকায় সবচেয়ে বড় অনিয়ম হচ্ছে। জান-মাল ঈমান ইজ্জতের ওপর জুলুম চলছে। শাসকেরা শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। রক্ষক আজ ভক্ষক সেজেছে। ইনসাফের আদালত জুলুমের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলতেন, এ জামানায় সবচেয়ে বড় হচ্ছে ভোটের গুনাহ। কারণ, ভোটের দ্বারা অধর্ম ও অধার্মিককে ক্ষমতায় বসানো হচ্ছে। তারা ক্ষমতায় গিয়ে আল্লাহ এবং তার বান্দাদের হক নষ্ট করছে। এতে করে ভোটদাতা জনগণ গুনাহের অংশীদার হচ্ছেন।
ভোটের গুনাহ থেকে বাঁচতে দেশবাসীকে তওবার আহ্বান জানিয়ে হাফেজ্জী হুজুর (রহ) বলেন, তওবার উসূল-বা বিধান হচ্ছে, যেমন গোনাহ তেমন তওবা, ভোট দিয়ে গুনাহ করা হয়েছিল। তাই ভোট দিয়েই তার তওবা করতে হবে। এতদিন অপাত্রে ভোট দিয়ে যে গুনাহ করা হয়েছে, এবার ইসলামী হুকুমত কায়েমের উদ্দেশ্যে সুপাত্রে ভোট দিয়ে ভোটের তওবা সম্পন্ন করতে হবে। মূলত গায়রুল্লাহর প্রবর্তিত প্রতারণার রাজনীতি থেকে আল্লাহ প্রবর্তিত সততার রাজনীতিতে ফিরে আসার নামই হচ্ছে তার তওবার রাজনীতি।
বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিপ্লব কায়েমের লক্ষ্যে ১৯৮১ সালের ২৯ নবেম্বর হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ) গঠন করেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন।
খোলাফায়ে রাশেদার অনুকরণে খেলাফত পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য হাফেজ্জী হুজুর (রহ)-এর নেতৃত্ব ও কর্মধারা ছিল সহীহ আন্দোলনের মাইলফলক।
সুন্নাতে নববীর দৃঢ় অনুসারী হাফেজ্জী হুজুরের (রহ) মধ্যে ক্ষমতার মোহ ছিল না। তিনি প্রচলিত ধোঁকা ও প্রতারণার রাজনীতিতে ভেসে যাননি। তিনি নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে কোনো আপস করেননি। প্রচলিত রাজনীতির সাথে তাল মিলিয়ে কখনোই ইসলামী আদর্শ, নিয়মনীতি ও শরীয়তের বিধানকে জলাঞ্জলি দেননি।
১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) শত শত মাইলের পথ একটানা সফর ও সভা-সমাবেশ করার পরও তার নফল ইবাদত, জিকির-আজকার ও নিয়মিত আমলে কোনো কমতি ঘটেনি।
সফরসঙ্গীরা যখন ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতেন, তখনো তিনি জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায়ে লেগে যেতেন। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তিনি তাহাজ্জুদ নামায পড়তেন। ফজর নামাযের জন্য সফর সঙ্গীদের ডেকে তুলতেন। তার সালাত ও ইবাদত আমাদের জন্য আদর্শ।
তিনি আজীবন কম কথা ও বেশি জিকির, তেলাওয়াত ও ইবাদত করতেন। সংযম ও বিনয়ী তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। তার জীবন অবিচলভাবে নির্ভীক চিত্তে দ্বীনের রাস্তায় পথ চলার সাহস অনুপ্রেরণা জোগায়।
তথ্যসহায়তা: মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদীর লেখা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন