সোমবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

ওয়াক্তিয়া ফরজের মতো ওমরি কাযাও ফরজ শুধু তাওবা যথেষ্ট নয় ( মুফতি মুহিউদ্দিন কাসেমি )

এ বিষয়ে বিভিন্ন বই-পুস্তকে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রয়েছে। সবগুলোই উপকারী। আমিও ভাঙাচোরা ও অবিন্যস্ত একটাকিছু দাঁড় করাতে চেয়েছি; কেমন হয়েছে তা পাঠকই বিবেচনা করবে। অন্যের ফায়েদা নয়, আমার উপকারের জন্যেই লিখেছি। তবুও কারো-না-কারো দরকার হতে পারে। একটু ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে।]
.
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সালাত বা নামায। সালাত আরবি শব্দ আর নামায হচ্ছে ফার্সি। অনেক নামায একসঙ্গে কাযা হয়ে গেলে সাধারণের পরিভাষায় এটাকে ‘ওমরি কাযা বলে।’ আর ফিকহের পরিভাষায় قضاء الفوائت বলা হয়। 
নামাযের গুরুত্ব কুরআন-হাদিস দ্বারা সকলের কাছেই প্রমাণিত। হাদিসে নামায পরিত্যাগকারীকে কাফেরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ফরজ নামাযের সংখ্যা পাঁচ : ফজর, জোহর, আসর, মাগরিব, ইশা। আর বিতরের নামায ওয়াজিব। এইসব নামাযের নির্দিষ্ট ওয়াক্ত বা সময় রয়েছে। সময়ের ভেতর নামায আদায় করা ফরজ। তবে কোনো কারণবশত সময়মতো নামায পড়তে না পারলে সময়ের পরেও তা ফরজই থাকে, ফরজ রহিত হয়ে যায় না। নির্ধারিত সময়ে নামায পড়াকে ‘আদা’ বলা হয়। 
নামায নির্ধারিত ওয়াক্তের মধ্যে না পড়ে পরবর্তী সময়ে পড়লে ‘কাযা’ বলা হয়। কুরআন হাদিসে যেমন যথাসময়ে নামায আদায়ের আদেশ দেওয়া হয়েছে, তেমনি সময়মতো আদায় না হলে তা পরে পড়ারও তাগিদ করা হয়েছে। তাই যুগ যুগ ধরে মুহাদ্দিস ও ফকিহগণ এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। মাসআলাটি এত প্রসিদ্ধ যে, সাধারণ মুসলিম সমাজও এ সম্পর্কে অবগত। কিন্তু ইদানীং এ নিয়ে নতুন এক বিভ্রান্তির সূচনা হয়েছে। 
তাদের দাবি হচ্ছে, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ নামায ছেড়ে দিলে কাযা করতে হবে না। তাওবা করলেই মাফ হয়ে যাবে। তবে ঘুমের কারণে ও ভুলবশত নামায ছুটে গেলে কাযা করা আবশ্যক।’ বাস্তবে কি তাই? আমরা সংক্ষিপ্তভাবে বিষয়টি আলোকপাত করব- ইনশাল্লাহ।

হাদিস শরিফে কাযার নীতি :
নামায ব্যতীত আরো কিছু ইবাদতের নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। সময়ের ভেতরে তা পালন করতে না পারলে পরবর্তীতে আদায় করা আবশ্যক। যেমন রোযা ও হজ। নির্ধারিত সময়ে নামায/রোযা/হজ আদায় করতে না পারলে পরবর্তীতে কাযা করে নেওয়া আবশ্যক। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার ও সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন। দুয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক :

১. 
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ - رضى الله عنه - قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ هَلَكْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ « وَمَا أَهْلَكَكَ ». قَالَ وَقَعْتُ عَلَى امْرَأَتِى فِى رَمَضَانَ. قَالَ « هَلْ تَجِدُ مَا تُعْتِقُ رَقَبَةً ». قَالَ لاَ. قَالَ « فَهَلْ تَسْتَطِيعُ أَنْ تَصُومَ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ ». قَالَ لاَ. قَالَ « فَهَلْ تَجِدُ مَا تُطْعِمُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ». قَالَ لاَ - قَالَ - ثُمَّ جَلَسَ فَأُتِىَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- بِعَرَقٍ فِيهِ تَمْرٌ. فَقَالَ « تَصَدَّقْ بِهَذَا ». قَالَ أَفْقَرَ مِنَّا فَمَا بَيْنَ لاَبَتَيْهَا أَهْلُ بَيْتٍ أَحْوَجُ إِلَيْهِ مِنَّا. فَضَحِكَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- حَتَّى بَدَتْ أَنْيَابُهُ ثُمَّ قَالَ « اذْهَبْ فَأَطْعِمْهُ أَهْلَكَ ».
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, একব্যক্তি রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলতে লাগল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, কী কারণে তুমি ধ্বংস হয়েছ? সে বলল, আমি রমজান মাসে আমার স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করে ফেলেছি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি একটি গোলাম আজাদ করতে পারবে? সে বলল, না। রাসুল সা. বললেন, তুমি দুই মাস লাগাতার রোযা রাখতে পারবে? সে বলল, না। রাসুল সা. বললেন, ষাটজন মিসকিন খাওয়াতে পারবে? সে বলল, তাও পারব না। অতঃপর সে বসে রইল। ইতোমধ্যে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট খেজুরভর্তি ঝুড়ি (হাদিয়া বা দান) আসল। রাসুল সা. তাকে বললেন, তুমি এই খেজুর নিয়ে সদকা করে দাও। সে বলল, হুজুর! মদিনার দুই উপত্যকার মাঝে আমার চেয়ে গরিব ও অভাবগ্রস্ত কোনো পরিবার নেই। এ কথা শুনে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে দিলেন; ফলে হুজুরের দাঁত মোবারক দেখা গেল। এরপর রাসুল সা. তাকে বললেন, খেজুর নিয়ে তোমার পরিবারকে খাইয়ে দাও। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ১৮৩৪, ১৮৩৫, ৫০৫৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ২৬৫১)। 
এটি অত্যন্ত শক্তিশালী সহিহ হাদিস। এর দ্বারা প্রমাণিত হল, ইচ্ছাকৃতভাবে রোযা নষ্ট করার কারণে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই ব্যক্তিকে রোযা কাযা করতে বললেন কেন? তাওবা করার কথা বলেননি কেন? সুতরাং ইচ্ছাকৃতভাবে রোযা নষ্ট করার কারণে যেমন কাযা আবশ্যক তদ্রƒপ ইচ্ছাকৃতভাবে নামায পরিত্যাগ করলেও কাযা আবশ্যক।

২.
أَنَّ اِمْرَأَةً مِنْ جُهَيْنَةَ جَاءَتْ إِلَى اَلنَّبِيِّ - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَتْ: إِنَّ أُمِّي نَذَرَتْ أَنْ تَحُجَّ, فَلَمْ تَحُجَّ حَتَّى مَاتَتْ, أَفَأَحُجُّ عَنْهَا? قَالَ: " نَعَمْ ", حُجِّي عَنْهَا, أَرَأَيْتِ لَوْ كَانَ عَلَى أُمِّكِ دَيْنٌ, أَكُنْتِ قَاضِيَتَهُ? اِقْضُوا اَللَّهَ, فَاَللَّهُ أَحَقُّ بِالْوَفَاءِ
হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল, আমার মা হজের মান্নত করেছিলেন। কিন্তু তা আদায় করার আগেই তিনি মারা গেছেন। এখন আমার করণীয় কী? আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় কর। বল তো, তোমার মায়ের কোনো ঋণ থাকলে তুমি কি তা পরিশোধ করতে না? মহিলাটি বলল, হ্যাঁ করতাম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে তোমরা আল্লাহর ঋণও পরিশোধ কর। কারণ, তিনি তাঁর প্রাপ্য পাওয়ার অধিক উপযুক্ত। (সহিহ বুখারি, ১/২৪৯-২৫০। সুনানে নাসায়ি ২/২)

.৩
আরেকটি হাদিসে এসেছে : 
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ : أَنَّ امْرَأَةً جَاءَتْ إِلَى النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَتْ : إِنَّهُ كَانَ عَلَى أُمِّهَا صَوْمُ شَهْرٍ أَفَأَقْضِيهِ عَنْهَا فَقَالَ : « لَوْ كَانَ عَلَى أُمِّكِ دَيْنٌ أَكُنْتِ قَاضِيَتَهُ ». قَالَتْ : نَعَمْ. قَالَ : « فَدَيْنُ اللَّهِ أَحَقُّ أَنْ يُقْضَى ».
১৮৫. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন : এক মহিলা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, আমার মায়ের ওপর একমাসের রোযা ফরজ রয়ে গেছে, আমি কি তার পক্ষ থেকে কাযা করে দেব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মায়ের ওপর কোনো ঋণ থাকলে তুমি তা পরিশোধ করতে কি-না? সে বলল, হ্যাঁ করতাম। রাসুল বললেন : তাহলে আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করা অধিক উপযুক্ত। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং- ৩৩১২; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ২৭৪৯)। 
৪.
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أَبِي مَاتَ وَلَمْ يَحُجَّ أَفَأَحُجُّ عَنْهُ قَالَ أَرَأَيْتَ لَوْ كَانَ عَلَى أَبِيكَ دَيْنٌ أَكُنْتَ قَاضِيَهُ قَالَ نَعَمْ قَالَ فَدَيْنُ اللَّهِ أَحَقُّ
১৮৬. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একব্যক্তি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল : হে আল্লাহর রাসুল! আমার পিতা মারা গেছেন। কিন্তু তিনি হজ করতে পারেন নি। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ করতে পারি? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার পিতার কোনো ঋণ থাকলে তুমি কি তা পরিশোধ করতে না? লোকটি বলল, হ্যাঁ। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর ঋণ তো অধিক আদায়যোগ্য। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস নং- ২৬৩৯; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং- ১৫৩৫১)।

উপর্যুক্ত বর্ণনাসমূহে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীÑ اِقْضُوا اَللَّهَ ‘তোমরা আল্লাহর ঋণ পরিশোধ কর’ এবং فَدَيْنُ اللَّهِ أَحَقُّ ‘আল্লাহর ঋণ আদায়ের অধিক উপযুক্ত’ এসব থেকে স্পষ্ট জানা যাচ্ছে, যে ইবাদাত বান্দার ওপর ফরজ বা অবশ্যকর্তব্য, তা থেকে দায়মুক্তির পথ হল তা আদায় করা। নির্ধারিত সময় পার হওয়ার দ্বারা যেমন মানুষের ঋণ থেকে দায়মুক্ত হওয়া যায় না, তেমনি আল্লাহর ঋণ থেকেও দায়মুক্ত হওয়া যায় না।
অন্যান্য ইবাদতের মতো শরিয়তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাযের ক্ষেত্রেও এই মূলনীতি প্রযোজ্য। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও কর্ম এবং সাহাবায়ে কেরামের ‘আছার’ এই প্রমাণই বহন করে। নমুনাস্বরূপ কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিচে দেওয়া গেল :
১. 
একরাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিগণকে নিয়ে সফর করছিলেন। শেষরাতে তাঁরা বিশ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রাবিরতি করলেন এবং হযরত বিলাল রা. -কে ফজরের নামাযের জন্য জাগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। এ দিকে বিলাল রা. এর চোখও লেগে গেল আর এতে করে সবার নামাযই কাযা হয়ে গেল। ঘুম থেকে জাগার পর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে নিয়ে ফজরের নামায পড়লেন। এরপর বললেন, ঘুম বা বিস্মৃতির কারণে যার নামায ছুটে গেল, যখন সে জাগ্রত হবে তখন যেন তা আদায় করে নেয়। হাদিস ও ফিকহের কিতাবে এই রাতটি ليلة التعريس –واقعة التعريس যাত্রাবিরতির রাত এবং এই ঘটনাটি যাত্রাবিরতির ঘটনা নামে পরিচিত। প্রসিদ্ধ সকল হাদিসগ্রন্থেই ঘটনাটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এর অন্যতম বর্ণনাকারী হযরত ইবনে আব্বাস রা. ঘটনাটি বর্ণনা করার পর বলেন, ‘সেই দুই রাকাত নামায (যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাযা হিসেবে আদায় করেছিলেন) আমার কাছে গোটা দুনিয়া থেকে বেশি প্রিয়। (সুনানে বায়হাকি, হাদিস নং- ২৯৯১; মুসনাদে আহমদ ৪/১৮১; হাদিস নং ২৩৪৯।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর খুশির কারণ হল, এই ঘটনার মাধ্যমে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিগণের সামনে এ মূলনীতি স্পষ্ট হল, নামায নির্ধারিত সময়ে আদায়যোগ্য ইবাদাত হলেও যদি তা সময়মত আদায় করা না হয়, তবে পরে হলেও আদায় করতে হবে। (আলইসতিযকার ১/৩০০)
উল্লেখ্য, আমাদের জীবনের সমস্ত ঘটনা ও সমস্যার হুবহু উত্তর হাদিসে পাওয়া যাবে না। দেখুন, আমরা লাগাতার নামায ছেড়ে দিই; কিন্তু রাসুল ও সাহাবিদের যুগে কেউ দুয়েক ওয়াক্ত নামায ইচ্ছাকৃত ছেড়ে দিয়েছে এমন কোনো নজির পাওয়া অসম্ভব। তখন মুনাফিকরাও নামায ছাড়ার সাহস পেত না। কেবল প্রকাশ্য কাফেরগণ নামায পড়ত না। তাই ভুলবশত এক/দুই ওয়াক্ত নামায ছেড়ে দেওয়ার পর যেহেতু রাসুল সা. ও সাহাবায়ে কেরাম কাযা পড়েছেন, এর দ্বারাই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, অনেক ওয়াক্ত নামায ছুটে গেলেও কাযা করা আবশ্যক।
আপনার কাছে উদাহরণত পাঁচ টাকা পেলে দিতে হবে; আর পাঁচ লাখ টাকা পেলে দিতে হবে নাÑ এমন কোনো কথা আছে? 
২. 
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ جَعَلَ عُمَرُ يَوْمَ الْخَنْدَقِ يَسُبُّ كُفَّارَهُمْ وَقَالَ مَا كِدْتُ أُصَلِّي الْعَصْرَ حَتَّى غَرَبَتْ قَالَ فَنَزَلْنَا بُطْحَانَ فَصَلَّى بَعْدَ مَا غَرَبَتْ الشَّمْسُ ثُمَّ صَلَّى الْمَغْرِبَ
১৮৭. হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খন্দকের যুদ্ধের দিন ওমর রা. কাফেরদেরকে গালি দিচ্ছিলেন এবং বলছিলেন- আমি আসর পড়তে পড়তেই সূর্য ডুবে যাচ্ছিল। তিনি আরো বলেন, আমরা তখন বুতহান নামক স্থানে অবতরণ করলাম। তিনি সেখানে সূর্য ডুবার পর আসরের নামায আদায় করলেন। এরপর মাগরিব আদায় করলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৫৭৩; সহিহ মুসলিম ১/২২৬)।

৩. 
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ : نَادَى فِينَا رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَوْمَ انْصَرَفَ مِنَ الأَحْزَابِ أَلاَ لاَ يُصَلِّيَنَّ أَحَدٌ الظُّهْرَ إِلاَّ فِى بَنِى قُرَيْظَةَ قَالَ فَتَخَوَّفَ نَاسٌ فَوْتَ الْوَقْتِ فَصَلُّوا دُونَ بَنِى قُرَيْظَةَ وَقَالَ آخَرُونَ لاَ نُصَلِّى إِلاَّ حَيْثُ أَمَرَنَا رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَإِنْ فَاتَنَا الْوَقْتُ قَالَ فَمَا عَنَّفَ وَاحِدًا مِنَ الْفَرِيقَيْنِ.
হযরত আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফেরার দিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিদের বললেন, তোমাদের কেউ যেন বনি কুরাইযায় না পৌঁছে আসরের নামায না পড়ে। অর্থাৎ বনি কুরাইযায় গিয়ে আসরের নামায পড়বে। 
সাহাবায়ে কেরাম রওয়ানা হলেন। পথে আছরের নামাযের সময় অতিবাহিত হওয়ার উপক্রম হলে কয়েকজন সাহাবি পথেই আছর পড়লেন। আর কয়েকজন বনি কুরাইযায় পৌঁছে সময়ের পর আসরের নামায কাযা পড়লেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকেই তিরস্কার করেননি। (সহিহ বুখারি, ১/১২৯; ২/৫৯০; সহিহ মুসলিম ২/ ৯৬; সুনানে কুবরা লিলবায়হাকি, হাদিস নং- ২০৮৬৯)।

লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে ঘটনা পেশ করা হলে তিনি কাযা আদায়কারী সাহাবিদের একথা বলেন নি যে, নামায শুধু নির্ধারিত সময়েই পড়া যায, সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তা আর পড়া যায় না কিংবা পড়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। 
এসব দৃষ্টান্তের বিপরীতে একটি হাদিস বা সাহাবির বক্তব্যেও একথা বলা হয় নি যে, নির্ধারিত সময়ে পড়া না হলে তা আর পড়তে হবে না, বরং শুধু ইস্তেগফার করাই যথেষ্ট। অতএব এটা স্পষ্ট যে, কারো ওপর যে নামায ফরজ রয়েছে তা আদায় করা ছাড়া দায়মুক্তির কোনো উপায় নেই। শরিয়তসম্মত ওজরের কারণে কাযা হলেও এই বিধান। আর যদি শরিয়তসম্মত ওজর ছাড়া -আল্লাহ না করুন- শুধু অবহেলাবশত নামায ত্যাগ করা হয় তাহলে তা কত মারাত্মক অপরাধ তা বলাবাহুল্য। এক্ষেত্রে ওই নামাযটি আদায় করার পাশাপাশি ইচ্ছাকৃতভাবে নামায নির্ধারিত সময় থেকে বিলম্বিত করার অপরাধে অনুতপ্ত হৃদয়ে আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্ষমাপ্রার্থনা করাও জরুরি। এটি হাদিস শরিফের সুস্পষ্ট মূলনীতি এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্ম, বাণী ও সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত। 
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « إِذَا رَقَدَ أَحَدُكُمْ عَنِ الصَّلاَةِ أَوْ غَفَلَ عَنْهَا فَلْيُصَلِّهَا إِذَا ذَكَرَهَا فَإِنَّ اللَّهَ يَقُولُ أَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِى ». 
আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ নামাযের সময় ঘুমন্ত থাকে কিংবা নামাযের সময় নামাযের কথা ভুলে যায় তাহলে যখন তার স্মরণে আসবে তখনই সে নামায আদায় করে নেবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, তুমি নামায আদায় কর আমাকে স্মরণ করার সময়। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৬০১)।
عَنْ نَافِعِ بْنِ جُبَيْرٍ عَنْ أَبِى عُبَيْدَةَ قَالَ قَالَ عَبْدُ اللَّهِ : إِنَّ الْمُشْرِكِينَ شَغَلُوا النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- عَنْ أَرْبَعِ صَلَوَاتٍ يَوْمَ الْخَنْدَقِ حَتَّى ذَهَبَ مِنَ اللَّيْلِ مَا شَاءَ اللَّهُ ، فَأَمَرَ بِلاَلاً فَأَذَّنَ وَأَقَامَ ، فَصَلَّى الظُّهْرَ ، ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الْعَصْرَ ، ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الْمَغْرِبَ ، ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الْعِشَاءَ. الِاكْتِفَاءُ بِالْإِقَامَةِ لِكُلِّ صَلَاةٍ
আবু উবায়দা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, খন্দকের যুদ্ধে মুশরিকরা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চার ওয়াক্ত নামায কাযা করে দিয়েছিল। এরপর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলাল রা. -কে আযান দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি ইকামাত দিলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোহরের নামায আদায় করলেন। এরপর বিলাল আবার ইকামাত দিলেন নবীজি আসরের নামায আদায় করলেন। এরপর আবার তিনি ইকামাত দিলেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশার নামায পড়ালেন। অর্থাৎ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাযা হয়ে যাওয়া প্রত্যেক নামাযের জন্য প্রতিবার আযান না দিয়ে শুধু ইকামাতের ওপর ক্ষান্ত দিয়েছেন। (সুনানে কুবরা লিলবায়হাকি, হাদিস নং- ১৯৬৭; সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং- ১৬২৬)।

ইজমায়ে উম্মত : 
এ প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল ইজমা। মুসলিম উম্মাহর সকল মুজতাহিদ ইমাম একমত যে, ফরজ নামাজ নির্ধারিত সময়ে আদায় না করলে পরে তা কাযা করতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করুক বা ওজরবশত। এ ব্যাপারে সকল পথ ও মতের ইমামগণ একমত পোষণ করেছেন। আল-মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহর মধ্যে রয়েছে : 
قَال عِيَاضٌ : وَلاَ يَصِحُّ عِنْدَ أَحَدٍ سِوَى دَاوُدَ وَابْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الشَّافِعِيِّ
অর্থাৎ কাজী ইয়ায বলেন, দাউদ ও ইবনে আবদুর রহমান ব্যতীত আর কেউই ইচ্ছাকৃত নামায ছেড়ে দিলে কাযা না করার কথা বলেন না। সবাই কাযা করার কথা বলেন। (খ. ৩৪, পৃ. ২৭)
ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন : বিনা ওজরে কাযা হয়ে যাওয়া ফরজ নামাযের কাযা আদায় করা অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে শরিয়তের অকাট্য দলিল-প্রমাণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন :
নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে ফরয নামায ফরয রোযার মতো কাযা আদায় করতে হবে। এ বিষয়ে দলিল হিসেবে যদিও উম্মতের ইজমাই যথেষ্ট, যার অনুসরণ করা ওই সব শায (তথা সিরাতে মুসতাকিম থেকে বিচ্যুত) মতের প্রবক্তাদের জন্যও অপরিহার্য ছিল, তারপরও কিছু দলিল উল্লেখ করা হল। যথা : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী...( আলইসতিযকার১/৩০২-৩০৩)

কাযা নামায আদায় করাও তাওবার অংশ : 
একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার হক নষ্ট করা হলে শুধু অনুতপ্ত হওয়া ও ইস্তিগফার করা যথেষ্ট নয়; বরং হকদারের পাওনা আদায় করাও তাওবার অংশ। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক সহিহ হাদিসে আল্লাহর হক কে বান্দার হকের সাথে তুলনা করে বলেছেন : دَيْنُ اللَّهِ أَحَقُّ أَنْ يُقْضَى ‘আল্লাহর হক নষ্ট হলে তা আদায় করা বান্দার হকের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।’ অতএব, আলোচ্য মাসআলায় নামাযের কাযা আদায় করা তাওবারই নামান্তর । কৃতকর্মের ওপর অনুতপ্ত হওয়া, আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা, আগামীতে নামায না ছাড়ার বিষয়ে দৃঢ়সংকল্প হওয়া এবং ছুটেযাওয়া নামাযসমূহ আদায় করা- এই সবকিছু মিলেই তাওবা পূর্ণ হবে। শরিয়তের দলিলসমূহ থেকে তাই প্রমাণিত হয় এবং এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমাও রয়েছে। মালেকি মাযহাবের বিখ্যাত ফকিহ ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করেন :
وأجمعوا على أن على العاصي أن يتوب من ذنبه بالندم عليه واعتقاد ترك العودة إليه قال الله تعالى ^ وتوبوا إلى الله جميعا ... المؤمنون لعلكم تفلحون ( النور ৩১(
ومن لزمه حق لله أو لعباده لزمه الخروج منه 
وقد شبه عليه السلام حق الله تعالى بحقوق الآدميين وقال ( ( دين الله أحق أن يقضى ) ) 
“ওলামায়ে কেরাম একমত যে, পাপীর জন্যে আবশ্যক হচ্ছে স্বীয় পাপ থেকে তাওবা করবেÑ ওই কাজের ওপর লজ্জিত হয়ে এবং এই সঙ্কল্পের সাথে যে, ওই পাপ আর করবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর... সূরা নূর-৩১।
যে ব্যক্তির ওপর আল্লাহর কিংবা মানুষের হক রয়েছে তা আদায় করা আবশ্যক। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর হক ও অধিকারকে মানুষের অধিকারের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন : دَيْنُ اللَّهِ أَحَقُّ أَنْ يُقْضَى : আল্লাহর হক আদায় করা অধিক উপযুক্ত।”

সুতরাং ভুলবশত নামায পরিত্যাগকারীর নামায কাযা করতে হবে আর ইচ্ছাকৃতভাবে নামায পরিত্যাগকারীর ওপর কাযা না করে কেবল তাওবা করলেই যথেষ্ট হবে- এই মতবাদটি কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমার আলোকে সঠিক নয়। একটি ভ্রান্ত মতবাদ। বর্তমানের তথাকথিত আহলে হাদিস যেসব পূর্বসূরিদের দোহাই দেয় তাদের কেউই এ মতকে সমর্থন করেন না। 
প্রসঙ্গত আহলে হাদিসের কিছু বিষয়ে শক্তিশালী দলিল-প্রমাণ রয়েছে। যেমন রফউল ইয়াদাইন, আমিন জোরে বলা ইত্যাদি। এসব বিষয়ে হানাফিদেরও বাড়াবাড়ি নেই। কারণ, হানাফি মাযহাবমতে রফউল ইয়াদাইন না করা উত্তম, করা জায়েয়। কেউ রফউল ইয়াদাইন করলে নামাযের ক্ষতি হবে না। তদ্রƒপ হানাফিদের মতে আমিন আস্তে বলা উত্তম, জোরে বলা জায়েয়। কেউ আমিন জোরে বললে নামাযের কোনো সমস্যা হবে না। অর্থাৎ মতবিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোর অধিকাংশ উত্তম-অনুত্তম নিয়ে। এবং উভয় পক্ষেরই দলিল রয়েছে।
কিন্তু নামায পরিত্যাগ করলে কাযা করতে হবে না- এই মতবাদটি সম্পূর্ণ ভুয়া, দলিলবিহীন। কুরআন-সুন্নাহ, ইজমায়ে উম্মত এবং উম্মতের ধারাবাহিক আমলের বিরোধী। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

নারী-পুরুষের নামাযে পদ্ধতিগত পার্থক্য ( মুফতি মুহিউদ্দিন কাসেমি )

নারী-পুরুষ মানুষ হিসেবে সমান হলেও শরিয়তের বিধানের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে, যা সর্বজনস্বীকৃত। তদ্রƒপ নামাযেও কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন :
১. পুরুষের জন্যে নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখা ফরজ, এতটুকু ঢেকে নামায পড়লেই পুরুষের নামায হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে নারীর চেহারা ও হাত-পা ছাড়া পুরো শরীর ঢেকে রাখতে হয়। নামাযেও তাই। 
২. পুরুষ ইমাম হতে পারে, নারী ইমাম হতে পারে না।
৩. মহিলা আযান দিতে পারে না, কেবল পুরুষই আযান দেয়।
৪. ইকামত শুধু পুরুষ দিতে পারে, নারী নয়।
৫. পুরুষের জন্যে জামাতের সাথে নামায পড়া ওয়াজিব বা সুন্নতে মুয়াক্কাদা; কিন্তু নারীর জন্যে ঘরের কোণে নামায পড়াকে উত্তম বলা হয়েছে।
৬. জুমুআ ও ঈদের নামায পুরুষের ওপর ফরজ ও ওয়াজিব; মহিলাদের ওপর ফরজ বা ওয়াজিব নয়।
৭. নামাযে সতর্ক করার মতো কোনো ঘটনা ঘটলে পুরুষকে তাসবিহ পড়ার হুকুম এসেছে; অথচ এক্ষেত্রে নারীদের হুকুম হচ্ছে তাসফিক অর্থাৎ হাতে শব্দ করা।
নারী-পুরুষের এসব পার্থক্য অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত- যা সকলেই গ্রহণ করেছেন। তদ্রƒপ নারী-পুরুষের মধ্যে নামায আদায়ের পদ্ধতির মাঝেও কিছু পার্থক্য রয়েছে; যাতে নারীর সতর ও পর্দার প্রতি বিশেষ বিবেচনা করা হয়েছে। 
নারী-পুরুষের মাঝে নামাযের পদ্ধতিগত যেসব পার্থক্য রয়েছে :
১. পুরুষ তাকবিরে তাহরিমার সময় উভয় হাত কানের লতি পর্যন্ত উত্তোলন করবে; আর নারী হাত তুলবে কাঁধ পর্যন্ত।
২. পুরুষ হাত নাভীর নিচে বাঁধবে, আর নারী বাঁধবে বুকের ওপর।
৩. পুরুষ রুকুর সময় পূর্ণ ঝুঁকে রুকু করবে, আর নারী অল্প ঝুঁকবে।
৪. পুরুষ সেজদা করার সময় উভয় হাত পেট ও উরু থেকে দূরে থাকবে; পক্ষান্তরে নারী জড়োসড়ো হয়ে পেট উরুর সঙ্গে মিলিয়ে সেজদা করবে।
৫. পুরুষ উভয় বৈঠকে বাম পায়ের ওপর ভর দিয়ে ডান পা খাড়া করে বসবে; আর নারী উভয় পা বাম দিকে বের করে দিবে তখন বাম রানের ওপর ডান রান থাকবে। 
হাদিস দ্বারা এসব পার্থক্য প্রমাণিত। তবে কোনো মহিলা যদি এসব পার্থক্য বজায় না রেখে নামায পড়ে তাহলে তার নামায হয়ে যাবে বটে সুন্নত ও মুস্তাহাবের খেলাফ হবে।
এবার হাদিসগুলো লক্ষ্য করুন :
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- :« إِذَا جَلَسْتِ الْمَرْأَةُ فِى الصَّلاَةِ وَضَعَتْ فَخِذَهَا عَلَى فَخِذِهَا الأُخْرَى ، وَإِذَا سَجَدْتْ أَلْصَقَتْ بَطْنَهَا فِى فَخِذَيْهَا كَأَسْتَرِ مَا يَكُونُ لَهَا ، وَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَنْظُرُ إِلَيْهَا وَيَقُولُ : يَا مَلاَئِكَتِى أُشْهِدُكُمْ أَنِّى قَدْ غَفَرْتُ لَهَا ».
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : মহিলা যখন নামাযের মধ্যে বসে তখন যেন (ডান) উরু অপর উরুর ওপর রাখে। আর যখন রুকু করে তখন যেন পেট উরুর সঙ্গে মিলিয়ে রাখে; যা তার সতরের জন্যে অধিক উপযোগী। আল্লাহ তাআলা তাকে দেখে (ফেরেশতাদের প্রতি সম্বোধন করে) বলেন : হে আমার ফেরেশতারা! তোমরা সাক্ষী থাক আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। (সুনানে কুবরা লিলবায়হাকি, হাদিস নং- ৩৩৩২৪; জামেউল আহাদিস, হাদিস নং- ১৭৫৯; কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ২০২০৩)।

عَنْ يَزِيدَ بْنِ أَبِى حَبِيبٍ : أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- مَرَّ عَلَى امْرَأَتَيْنِ تُصَلِّيَانِ فَقَالَ :« إِذَا سَجَدْتُمَا فَضُمَّا بَعْضَ اللَّحْمِ إِلَى الأَرْضِ ، فَإِنَّ الْمَرْأَةَ لَيْسَتْ فِى ذَلِكَ كَالرَّجُلِ ».
ইয়াযিদ ইবনে আবি হাবিব রহ. বলেন : একবার রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযরত দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন; তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশে) বললেন : সেজদা করার সময় শরীর জমিনের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে। কেননা, মহিলারা এক্ষেত্রে পুরুষের মতো নয়। (সুনানে কুবরা লিলবায়হাকি, হাদিস নং- ৩৩২৫; কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ১৯৭৮৭; জামেউল আহাদিস, হাদিস নং- ২১১০)। 
عن وائل بن حجر قال : جئت النبي صلى الله عليه و سلم فقال ...: يا وائل بن حجر إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها 
হযরত ওয়াইল ইবনে ওজর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আগমন করলাম, তখন তিনি আমাকে (অনেক কথার মধ্যে এটাও) বললেন : হে ওয়াইল ইবনে হুজর! যখন তুমি নামায শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর। (আল-মুজামুল কাবির, হাদিস নং- ২৮; জামেউল আহাদিস, হাদিস নং- ২৬৩৭৭; কানযুল উম্মাল, হাদিস নং- ১৯৬৪০)। 
উল্লিখিত হাদিসগুলো দ্বারা স্পষ্ট অনুমেয় যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের নামাযে পার্থক্য রয়েছে। কারণ, এর দ্বারা নারীদের সতর ও পর্দা সুরক্ষিত থাকে সুন্দরভাবে। তাছাড়া এই হাদিসগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বিরোধপূর্ণ অন্য কোনো হাদিস নেই, যাতে বলা হয়েছে যে, নারী-পুরুষের নামাযে কোনো পার্থক্য নেই। তবে একটি সহিহ হাদিসে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :
عَنْ مَالِكِ بْنِ الْحُوَيْرِثِ - رضي الله عنه - قَالَ : قَالَ رَسُولُ اَللَّهِ - صلى الله عليه وسلم - - صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي
হযরত মালেক ইবনে হুয়াইরিস রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : তোমরা ওইভাবে নামায পড় যেভাবে আমাকে নামায পড়তে দেখ। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৫৬৬২)।
এই হাদিসে বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করে যদি বলা হয় যে, ‘হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে নামায পড়েছেন, হুবহু সেভাবেই সকলকে নামায পড়তে হবে এবং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু পুরুষ ছিলেন তাই নারীগণও হুুজরের মতো নামায পড়বে।’ তাহলে আমরা বলব, এই হাদিসে তো সতরের পার্থক্য নেই, এবার বলা শুরু করুন যে, নারীদের পর্দা ছাড়াই নামায হয়ে যাবে!। এটা কেউই বলতে পারবে না।
মূলত এই হাদিসের প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে। খন্দকের যুদ্ধের সময় ধারাবাহিকভাবে চার ওয়াক্ত নামায কাযা হয়ে যায়। ওই কাযা নামায পড়ার সময় রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন : ‘তোমরা আমার মতো নামায আদায় কর।’ অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে কাযা নামাযগুলো পড়। অথবা তাদিলে আরকান অর্থাৎ নামাযের প্রত্যেকটি রুকন ধীরস্থিরে আদায় করার জন্যে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আদেশ দিয়েছেন। (তুহফাতুল আহওয়াজি : ১/৪৫২)। 
তাছাড়া এই হাদিস দ্বারা যদি নারী-পুরুষের নামারে পদ্ধতিগত পার্থক্য নিষেধ করা সম্পর্কে বর্ণিত হতো, তাহলে হাদিসের যে কোনো একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা থাকত। কিন্তু কোনো ব্যাখ্যাগ্রন্থেই তা আলোচিত হয়নি।
উপরন্তু হাদিসের মর্ম, রহস্য ও ব্যাখ্যা সাহাবায়ে কেরাম ভালোভাবে জানতেন। এবার দেখা যাক সাহাবায়ে কেরাম নারী-পুরুষের নামাযের পদ্ধতিগত পার্থক্যের ব্যাপারে কী বলেন?

সাহাবায়ে কেরামের অভিমত :
عَنْ عَلِيٍّ ، قَالَ : إذَا سَجَدَتِ الْمَرْأَةُ فَلْتَحْتَفِز ، وَلْتَضُمَّ فَخِذَيْهَا.
হযরত আলি রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহিলা যখন সেজদা করে তখন যেন জড়সড় হয়ে সেজদা করে এবং উভয় উরু পেটের সঙ্গে মিলিয়ে রাখে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং- ২৭৯৩; মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস নং- ৫০৭২)।

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ؛ أَنَّهُ سُئِلَ عَنْ صَلاَةِ الْمَرْأَةِ ؟ فَقَالَ : تَجْتَمِعُ وَتَحْتَفِزُ.
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে, মহিলা কীভাবে নামায আদায় করবে? তিনি বললেন : খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সঙ্গে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং- ২৭৯৪)।
এই হাদিস দ্বারা বুঝা গেল, মহিলাদের জন্যে জড়সড় হয়ে নামায পড়ার হুকুম কেবল সেজদার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং পুরো নামাযেই এর প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়।

তাবেয়িদের অভিমত :
حَدَّثَنَا هُشَيْمٌ ، قَالَ : أَخْبَرَنَا شَيْخٌ لَنَا ، قَالَ : سَمِعْتُ عَطَاءً ؛ سُئِلَ عَنِ الْمَرْأَةِ كَيْفَ تَرْفَعُ يَدَيْهَا فِي الصَّلاَةِ ؟ قَالَ : حَذْوَ ثَدْيَيْهَا.
হুশাইম বর্ণনা করেন, আমাদের একজন উস্তাদ বলেছেন. আমি বিখ্যাত তাবেয়ি আতা ইবনে রাবাহ রহ. -কে বলতে শুনেছি যখন তার কাছে জিজ্ঞেস করা হল, মহিলা নামাযে কীভাবে হাত উঠাবে? তখন তিনি বলেন : বুক বরাবর। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং- ২৪৮৬)।
حَدَّثَنَا رَوَّادُ بْنُ جَرَّاحِ ، عَنِ الأَوْزَاعِيِّ ، عَنِ الزُّهْرِيِّ ، قَالَ : تَرْفَعُ يَدَيْهَا حَذْوَ مَنْكِبَيْهَا.
বিখ্যাত তাবেয়ি ইমাম যুহরি রহ. বলেন : মহিলা কাঁধ বরাবর হাত তুলবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং- ২৪৮৭)।
حَدَّثَنَا خَالِدُ بْنُ حَيَّانَ ، عَنْ عِيسَى بْنِ كَثِيرٍ ، عَنْ حَمَّادٍ ؛ أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ فِي الْمَرْأَةِ إذَا اسْتَفْتَحَتِ الصَّلاَةَ ، تَرْفَعُ يَدَيْهَا إلَى ثَدْيَيْهَا.
তাবেয়ি হাম্মাদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলতেন : মহিলা নামায শুরু করলে উভয় হাত বুক বরাবর উঠাবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং- ২৪৮৮)।
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ بَكْرٍ ، عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ ، قَالَ : قُلْتُ لِعَطَاءٍ : تُشِيرُ الْمَرْأَةُ بِيَدَيْهَا بِالتَّكْبِيرِ كَالرَّجُلِ ؟ قَالَ : لاَ تَرْفَعُ بِذَلِكَ يَدَيْهَا كَالرَّجُلِ ، وَأَشَارَ فَخَفَضَ يَدَيْهِ جِدًّا ، وَجَمَعَهُمَا إلَيْهِ جِدًّا ، وَقَالَ : إنَّ لِلْمَرْأَةِ هَيْئَةً لَيْسَتْ لِلرَّجُلِ ، وَإِنْ تَرَكَتْ ذَلِكَ فَلاَ حَرَجَ.
ইবনে জুরাইজ বলেন, আমি তাবেয়ি আতা ইবনে আবি রাবাহকে জিজ্ঞেস করলাম, মহিলা তাকবিরের সময় পুরুষের মতো হাত উঠাবে? তিনি বললেন, মহিলা পুরুষের মতো হাত উঠাবে না। এরপর তিনি (মহিলাদের হাত তোলার ভঙ্গি দেখালেন এবং) তার উভয় হাত (পুরুষের চেয়ে) অনেক নিচুতে রেখে শরীরের সঙ্গে খুব মিলিয়ে রাখলেন এবং বললেন, মহিলাদের পদ্ধতি পুরুষ থেকে ভিন্ন। তবে এমন না করলেও সমস্যা নেই। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং- ২৪৮৯)।
حَدَّثَنَا يُونُسُ بْنُ مُحَمَّدٍ ، قَالَ : حدَّثَنِي يَحْيَى بْنُ مَيْمُونٍ ، قَالَ : حَدَّثَنِي عَاصِمٌ الأَحْوَلُ ، قَالَ : رَأَيْتُ حَفْصَةَ بِنْتَ سِيرِينَ كَبَّرَتْ فِي الصَّلاَةِ ، وَأَوْمَأَتْ حَذْوَ ثَدْيَيْهَا
আসেম আহওয়াল বলেন, আমি হাফসা বিতে সিরিনকে দেখেছি, তিনি নামাযে তাকবির বলার সময় বুক বরাবর হাত উঠিয়েছেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং- ২৪৮৯)।
حَدَّثَنَا ابْنُ مُبَارَكٍ ، عَنْ هِشَامٍ ، عَنِ الْحَسَنِ ، قَالَ : الْمَرْأَةُ تَضْطَمُّ فِي السُّجُودِ
বিখ্যাত তাবেয়ি হাসান বসরি রহ. বলেন : মহিলা জড়সড় হয়ে গুটিয়ে সেজদা করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং- ২৭৯৭)।
حَدَّثَنَا وَكِيعٌ ، عَنْ سُفْيَانَ ، عَنْ مَنْصُورٍ ، عَنْ إبْرَاهِيمَ ، قَالَ : إذَا سَجَدَتِ الْمَرْأَةُ فَلْتَلْزَقْ بَطْنَهَا بِفَخِذَيْهَا ، وَلاَ تَرْفَعْ عَجِيزَتَهَا ، وَلاَ تُجَافِي كَمَا يُجَافِي الرَّجُلُ.
প্রখ্যাত তাবেয়ি হযরত ইবরামি নাখয়ি রহ. বলেন : মহিলা সেজদা করার সময় পেটকে উরুর সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে। তার নিতম্বকে উঁচু করে রাখবে না এবং পুরুষের মতো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ফাঁকা রাখবে না। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং- ২৭৯৭)।

এমন অনেক তাবেয়ির উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে, যারা নারী-পুরুষের নামাযের পদ্ধতিগত পার্থকের অভিমত দিয়েছেন, ফতোয়া দিতেন। 
হাদিসের বিশাল সঙ্কলন মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বার মধ্যে ৪৩ নং অনুচ্ছেদ হচ্ছে : المرأة كيف تَكُونُ فِي سُجُودِهَا ؟ : অর্থাৎ ‘মহিলার সেজদা করার পদ্ধতি।’ এই শিরোনামের অধীনে তিনি ছয়জন সাহাবি ও তাবেয়ির ফতোয়া উল্লেখ করেছেন। একই কিতাবের ৪৪ নং অনুচ্ছেদ হচ্ছে : 
في المرأة كَيْفَ تَجْلِسُ فِي الصَّلاَةِ : ‘মহিলার বৈঠকের পদ্ধতি।’ এই অনুচ্ছেদের অধীনে তিনি দশজন সাহাবি ও তাবেয়ির অভিমত উল্লেখ করেছেন। যার দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, নামাযের পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ভিন্নতা অবশ্যই রয়েছে। যদিও তা সুন্নত বা মুস্তাহাব হোক। কারণ, তা পরিত্যাগ করলে নারীর নামায ভঙ্গ হবে না।

চার ইমামের বক্তব্য : 
কুরআন-সুন্নাহর সংক্ষিপ্ত ও অবিন্যস্ত বিধান ফিকহের মধ্যে সুন্দর ও গোছালোভাবে বিধৃত হয়েছে। ফিকহের ক্ষেত্রে পুরো বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম চার ইমামেরই অনুসারী। মুসলমানগণ কুরআন-হাদিসের প্রায়েগিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে চার ইমামেরই অনুসরণ করে থাকে। অনেক মাসআলায় চার ইমাম ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন ইজতিহাদের ভিত্তিতে। এর সবগুলোই সঠিক; তবে কোনো একটি অধিক সঠিক হতে পারে। এই মতভিন্নতার পেছনে অবশ্যই দলিল রয়েছে; হতে পারে কারো দলিল একটু দুর্বল। মনে রাখতে হবে, কোনো বিষয়ে যদি চার ইমাম অর্থাৎ ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ি ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. ঐকমত্য পোষণ করেন তখন বিষয়টির গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়ে যায়। চার ইমাম এক হয়ে যাওয়া কোনো চাট্টিখানি কথা নয়। তখন বিষয়টি ইজমা’র পর্যায়ে চলে যায়, যার বিরোধিতা করা কোনো মুসলিমেরই উচিত নয়। যাক, আমাদের আলোচিত মাসআলায়ও চার ইমামের ফিকহ একই মত পোষণ করেছেন। অর্থাৎ নারী-পুরুষের নামাযের পদ্ধতিগত পার্থক্যের ব্যাপারে তারা স্পষ্ট অভিমত দিয়েছেন।

ফিকহে হানাফি : 
احب الينا ان تجمع رجليها في جانب ولا تنتصب انتصاب الرجل
আমাদের মতে মহিলাদের নামাযে বসার মুস্তাহাব তরিকা হল, উভয় পা একপাশে মিলিয়ে রাখবে, পুরুষের মতো এক পা দাঁড় করিয়ে রাখবে না। (ইমাম মুহাম্মদ রহ. প্রণীত, কিতাবুল আসার : ১/২৮১)। 
বিষয়টি হানাফি ফিকহের যে কোনো কিতাবে সবিস্তারে উল্লেখ হয়েছে। যেমন ফাতাওয়া শামি, বাদায়েউস সানায়ে, ফাতাওয়া আলমগিরি, ফাতহুল কাদির ইত্যাদি।

ফিকহে মালেকি :
মালেকি মাযহাবের বিখ্যাত ইমাম ও সুলেখক আল্লামা আবুল আ¦বাস আল-কারাফি রহ. বলেন : 
وأما مساواة النساء للرجال ففي النوادر عن مالك تضع فخذها اليمنى على اليسرى وتنضم قدر طاقتها ولا تفرج في ركوع ولا سجود ولا جلوس بخلاف الرجل
পুরুষ ও মহিলাদের নামারে পদ্ধতি এক কি-না? এ বিষয়ে ইমাম মালেক রহ. থেকে নাওয়াদেরে বর্ণিত আছে, (বসার সময়) মহিলা ডান উরু বাম উরুর ওপর রাখবে এবং যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে বসবে। রুকু, সেজদা ও বৈঠক কোনো সময়ই ফাঁক ফাঁক হয়ে বসবে না; পক্ষান্তরে পুরুষের পদ্ধতি ভিন্ন। (আয-যাখিরা : ২/১৯৩)। 
( قال الشَّافِعِيُّ ) وقد أَدَّبَ اللَّهُ تَعَالَى النِّسَاءَ بِالِاسْتِتَارِ وَأَدَّبَهُنَّ بِذَلِكَ رَسُولُهُ صلى اللَّهُ عليه وسلم وَأُحِبُّ لِلْمَرْأَةِ في السُّجُودِ أَنْ تَضُمَّ بَعْضَهَا إلَى بَعْضٍ وَتُلْصِقَ بَطْنَهَا بِفَخِذَيْهَا وَتَسْجُدَ كَأَسْتَرِ ما يَكُونُ لها وَهَكَذَا أُحِبُّ لها في الرُّكُوعِ وَالْجُلُوسِ وَجَمِيعِ الصَّلَاةِ أَنْ تَكُونَ فيها كَأَسْتَرِ ما يَكُونُ لها
আল্লাহ তাআলা মহিলাদেরকে পুরোপুরি আবৃত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আর রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও অনুরূপ শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আমার নিকট পছন্দনীয় হল, সেজদা করার সময় মহিলারা এক অঙ্গের সঙ্গে আরেক অঙ্গ মিলিয়ে রাখবে, পেট উরুর সঙ্গে সংযুক্ত রাখবে এবং এমনভাবে সেজদা করবে যেন সতরের পুরোপুরি সরুণ হয়। ঠিক তেমনিভাবে রুকু, বৈঠক ও পুরো নামায এমনভাবে আদায় করবে যেন সতরের পুরোপুরি হেফাজত থাকে। (কিতাবুল উম্ম : ১/১১৫)।

ফিকহে হাম্বলি : 
فأما المرأة فذكر القاضي فيها روايتين عن أحمد إحداهما ترفع لما روى الخلال بإسناده عن أم الدرداء وحفصة بنت سيرين أنهما كانتا ترفعان أيديهما وهو قول طاوس ولأن من شرع في حقه التكبير شرع في حقه الرفع كالرجل فعلى هذا ترفع قليلا قال أحمد رفع دون الرفع والثانية لا يشرع لأنه في معنى التجافي ولا يشرع ذلك لها بل تجع نفسها في الركوع والسجود وسائر صلاتها
তাকবিরের সময় মহিলারা হাত তুলবে কি-না? এ ব্যাপারে কাজী ইয়াজ ইমাম আহমদ রহ. থেকে দুটি মত উল্লেখ করেছেন। প্রথম অভিমত অনুযায়ী হাত তুলবে। কেননা, খাল্লাল স্বীয় সনদে উম্মে দারদা ও হাফসা বিনতে সিরিন থেকে বর্ণনা করেন যে, তারা নামাযে হাত উঠাতেন। ইমাম তাউসও তা-ই বলেন। তাছাড়া যার ব্যাপারে তাকবির বলার নির্দেশ রয়েছে তার জন্যে হাত উঠানোর নির্দেশ আছে। যেমন পুরুষ করে থাকে; এ হিসেবে মহিলারা হাত উঠাবে, তবে সামান্য। ইমাম আহমদ বলেন, মহিলা পুরুষের তুলনায় নিচে হাত উঠাবে। 
দ্বিতীয় মত হচ্ছে, মহিলাদের জন্যে হাত উঠানোররই বিধান নেই। কেননা, হাত উঠালে কোনো অঙ্গকে ফাঁক করতেই হয়; অথচ মহিলাদের জন্যে এর বিধান দেওয়া হয়নি। বরং তাদের নিয়ম হল, রুকু-সেজদাসহ পুরো নামাযে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখবে। (আল-মুগনি : ১/৫৪৭)।

গায়রে মুকাল্লিদ আলেমদের অভিমত : 
এসব হাদিস থাকার কারণে গায়রে মুকাল্লিদ আলেমগণও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, প্রখ্যাত আহলে হাদিস আলেম নবাব সিদ্দিক হাসান খান রহ. ‘আউনুল বারি’তে তা স্বীকার করেছেন। আহলে হাদিসের ফতোয়া দেখা যেতে পারে : ফাতাওয়া গযনবিয়্যা : ২৭-২৮; ফাতাওয়া উলামায়ে আহলে হাদিস : ৩/১৪৮-১৪৯)।

ওয়াজের মাহফিল কেন প্রভাব ফেলতে পারে না? মুহিউদ্দিন কাসেমি

আমাদেরকে যখন কোথাও ওয়াজ মাহফিলে বয়ান ও বক্তৃতা করার জন্যে দাওয়াত করা হয়, তখন প্রথমেই আমরা আশা করি যে, আমাদের নাম শুনেই মাহফিলে অনেক মানুষের সমাগম হবে এবং এমন আলোচনা যেন করতে পারি যা ঐতিহাসিক স্মৃতি হয়ে সকলের মুখে মুখে থাকে। দীর্ঘদিন এর প্রশংসা করা হয়। আর মাহফিলের উদ্যোক্তারা যদি বাহ্যিক আদর-আপ্যায়ন এবং অভ্যন্তরীণ আপ্যায়ন (টাকা-পয়সা, হাদিয়া) এর মাঝে একটু ত্রুটি করে তাহলে আমরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ও নারাজ হই। কখনো এ অসন্তুষ্টির কথা সবার সামনে প্রকাশ করে দিই। অন্যথায় এ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে, আগামীতে এখানে আর আসব না। আমরা যদি আমন্ত্রিত বক্তা হই আর ঘটনাক্রমে সময়ের সঙ্কীর্ণতার কারণে বয়ান করতে না পারি তাহলে রাগ ও অসন্তুষ্টির শেষ থাকে না। আমরা এতই গর্বিত ও আত্মতুষ্ট যে, স্টেজে বসে অন্য কারো আলোচনা আনন্দের সাথে শুনতে পারি না। মনে মনে কামনা করি, জলদি তার আলোচনা শেষ হোক বা তার আলোচনা শেষ করানো হোক এবং আমার আলোচনা শুরু হোক, যেন মনখুলে বয়ান করা যায়। 
এসবের কারণ হল, আমরা নিজেকে সবার চেয়ে ভালো বক্তা ও আলোচক মনে করে থাকি। অথচ এটা ভীষণ ক্ষতিকর ও ভয়ানক বিষয়।

আলেমের জন্যে ফেতনা : 
যায়েদ ইবনে হাবিব রহ. বলেন : আলেম ও ফকিহের ফেতনার বিষয় হল, সে অন্যের আলোচনা শোনার তুলনায় নিজের কথা বলতে বেশি পছন্দ করে। অথচ এমন বক্তা আলোচনা করছে যার আলোচনা যথেষ্ট, তার আলোচনা না করলেও চলবে। (অর্থাৎ অন্য যোগ্য ব্যক্তির উপস্থিতিতেও নিজের কথা বলাকে জরুরি মনে করে, যেন মানুষ ভাবে সে অনেক বড় আলেম)। [কিতাবুয যুহদ- ১৬]
নসর ইবনে হাজেব রহ. বলেন : হযরত ইমাম আবু হানিফা রহ. ওমর ইবনে যর এর বয়ান শোনার জন্যে গমন করতেন। এবং তাতে কোনো লজ্জাবোধ করতেন না। একবার মানুষজন দেখল, ইমাম আবু হানিফা রহ. অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ওয়াজ শুনছেন এবং তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। [উকুদুল জিমান- ২২৯]
আজ আমরা অন্যের ওয়াজ শোনার সময়ই পাই না। আমরা ভাবি, এই লোক কী ওয়াজ করবে? তার ওয়াজ শোনার কোনো দরকার নেই। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বলেন : কোনো ব্যক্তি যখন কোথাও মাহফিলে বয়ান করে আর তখন তার বয়ান নিজের কাছে ভালো মনে হয়, সে আত্মতৃপ্তি লাভ করে, সেসময় তার জন্যে কর্তব্য হল বয়ান বন্ধ করে দেওয়া। আর যদি কেউ এমন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয় যেখানে চুপ করে বসে থাকা আত্মগরিমার অন্তর্ভুক্ত সেখানে কিছু বয়ান করা কাম্য। [কিতাবুয যুহদ- ৬৭]
আমাদের আকাবিরদের এমন অনেক ঘটনা আছে, তারা বক্তৃতা করতে করতে যখন মনে করলেন, এ কথা আমাদের বড়ত্বের মাধ্যম হবে তখন তৎক্ষণাৎ বয়ান বন্ধ করে বসে পড়েন।

হযরত শায়খুল হিন্দ রহ. এর শিক্ষণীয় ঘটনা : 
শায়খুল হিন্দ হযরত মাও. মাহমুদ হাসান দেওবন্দি রহ. এর ইলমি ও রুহানি ফয়েজ পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। একবার তিনি হাকিমুল উম্মত হযরত মাও. আশরাফ আলি থানবি রহ. এর দাওয়াতে কানপুর গমন করেন। অনেকবার আবেদনের পর ওলামাদের একটি মজলিসে বয়ান করতে সম্মত হলেন। ইলমি পরিবেশে হযরতের মন খোলামেলা ছিল। অত্যন্ত উচ্চাঙ্গীন বিষয় আলোচনা করছিলেন। তখন বিদআতের প্রতি অনুরাগী আলেম মাও. লুতফুল্লাহ আলিগড়ি মজলিসে প্রবশে করেন। তাকে দেখামাত্রই হযরত শায়খুল হিন্দ বয়ান বন্ধ করে বসে যান। পরবর্তীতে হযরত মাও. ফখরুল হাসান সাহেব রহ. জিজ্ঞেস করেন, হঠাৎ বয়ান বন্ধ করে দিলেন কেন? উত্তরে বলেন : যখন মৌলবি লুতফুল্লাহ প্রবেশ করল তখন ভাবলাম, এখনই মূল আলোচনা করার সময়; সে জানতে পারবে ইলম কী জিনিস! তাই সে সময় ওয়াজে ইখলাস বা নিষ্ঠা ছিল না। এ কারণে ওয়াজ বন্ধ করে দিয়েছি। [আরওয়াহে সালাসা- ৪০৭]
আল্লাহু আকবার! এটাই হচ্ছে ইখলাস! একটু চিন্তা করুন, এমন মজলিসে আমরা সুযোগ পেলে অনুসন্ধান ও খোঁজাখুঁজি করে এমন কথা বলার চেষ্টা করতাম যা কারো চিন্তা ও ধারণায়ই নেই। যেন উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ ইশ ইশ বলে এবং প্রশংসা করতে বাধ্য হয়। নাউজুবিল্লাহ!

লোকজনের সমাগম মূল বিষয় নয় : 
ত‌দ্রূপ আমাদের আকাবিরগণ এ ব্যাপারেও কোনো গুরত্ব দেননি যে, তাদের মাহফিলে অনেক মানুষের সমাগম হোক। বরং যখন যেখানে ফায়েদা মনে করেছেন সেখানেই অল্প লোকদের মাঝেও মনখুলে বয়ান করেছেন, যেমনটি বড় বড় মজলিসে করতেন। 
হাকিমুল উম্মত হযরত মাও. আশরাফ আলি থানবি রহ. এর মাওয়ায়েজ দেখুন। আশ্চর্য হতে হয় যে, মাত্র ২০/২৫ জন মানুষ সামনে বসে আছে। আর তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইলম ও মারেফতের ফুল ঝড়াচ্ছেন। পক্ষান্তরে আমাদের অবস্থা হল, মাহফিল ভরা না হলে আমাদের মেজাজ ঠিক হয় না। বরং মানুষ কম থাকার কারণে আলোচ্যবিষয়ও ভুলে যায়। কেমন যেন আমরা মাহফিলগুলোকে দীনের প্রচার নয় বরং নিজের পরিচয়-পরিচিতির মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছি। কেননা, দীন প্রচার করা উদ্দেশ্য হলে আমরা দুই-চারজনের সামনেও বয়ান করতে কখনো লজ্জাবোধ করব না। অথচ অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, অনেক সময় ছোট্ট মাহফিলের বয়ান দ্বারা এমন ফায়েদা হয় যা বিশাল বিশাল মাহফিল দিয়ে হয় না। তদ্রƒপ আমাদের মনে ইখলাস থাকলে অন্যে কোনো বক্তার বয়ান শুনতে কখনোই খারাপ লাগার কথা নয়। বরং আমরা মনে করতাম, এর দ্বারাও উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে। এমনকি আরো খুশি হওয়ার দরকার ছিল যে, আমার দায়িত্ব সে পালন করে দিচ্ছে।

মাও. আতাউল্লাহ শাহ বুখারি রহ. এর ঘটনা :
স্বীয় যুগের অদ্বিতীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী বক্তা ও ওয়ায়েজ মাও. আতাউল্লাহ শাহ বুখারি রহ. একবার একটি মাহফিলে তাশরিফ নিয়ে গেলেন। সেখার তাঁর পূর্বে মাও. মুহাম্মদ আলি জালেন্দরির বয়ান হচ্ছিল। তাঁর বয়ানের মাঝে শাহ সাহেব বাহ বাহ দিচ্ছিলেন এবং সুবহানাল্লাহ বলছিলেন। অবশেষে যখন শাহ সাহেবেরে বয়ানের পালা আসল তখন তিনি এই বলে মাহফিল সমাপ্ত ঘোষণা করে দিলেন যে, মাওলানার বয়ানের পর আমার বয়ানের কোনো প্রয়োজন নেই। অথচ শাহ সাহেবের নাম শুনেই মানুষ একত্রিত হয়েছিল। [বিস বড়ে মুসলমান]
.
সফল জীবন যাদের গ্রন্থ থেকে।

সমূদ্রের মধ্যে যাদেরকে ভাসতে দেখতে পাচ্ছেন


সমূদ্রের মধ্যে যাদেরকে ভাসতে দেখতে পাচ্ছেন তারা সিরিয়ান অসহায় বাবা । এর কারন ইজরাইলের সৈন্যরা যে শিশুদের কেই বেসি হত্যা করছে । তাই ইজরাইলের সৈন্যদের হাত থেকে কলিজার টুকরা শিশুকে প্রানে বাঁচাতে সিরিয়া থেকে ১০ কিঃমিঃ সমূদ্র পথে আদরের সন্তানটিকে নিয়ে এভাবেই পারি দিয়ে গ্রীস উপকুলে পৌছানোর জন্য প্রানান্তর চেষ্টা করছে অসহায় বাবা । কারন কোন বাবা, মা কি পারবে, চোখের সামনে তার আদরের কলিজার টুকরা শিশুটিকে হত্যা করার নির্মম দৃশ্য দেখতে ?? আর সমূদ্রের এই দৃশ্য দেখেই বা কোন ভাই, বোন, বাবা, মা কি পারবে তাদের চোখের অশ্রু ধরে রাখতে ? দৃশ্যটি দেখে হয়তো অনেকেই অশ্রু ধরে রাখতে পারবেন না । চিত্‍কার করে কাঁন্না করতে ইচ্ছে করছে...এমনকি কাঁদছেও গোটা বিশ্ব ।।।
এসব দৃশ্য বিশ্ব বিবেক কে প্রশ্ন করে, সত্যিই কি মানুষ্যত্ব বলে কিছু আছে ? 
বিশ্বে হ্মমতাশীল মোরলরা আপনাদের স্বার্থের খেলা এবার থামান । আমরা সমূদ্রে ভেসে থাকা অসহায় বাবার ও শিশুর প্রান বাঁচানোর প্রানান্ত কষ্টের দৃশ্য ও দানবিক কর্পোরেট বিশ্বায়ন আর দেখতে চাই না । আমার চাই সবার নিরাপদ বাসযোগ্য একটি মানবিক বিশ্বায়ন । 
.
হে আল্লাহ তুমি এদেরকে রহ্মা কর- 
_____আমীন.


রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

ঈমান ও হেদায়েত মুসলমানের মূল্যবান সম্পদ : মুফতী মোহাম্মদ আমীন- অনুবাদ: মাওলান আলী উসমান

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ
যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি  অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন। [সূরা আনকাবুত : ৬৯]

হেদায়েত পৃথিবীর সবচেয়ে মূলবান ধন। আল্লাহ তাআলার নিকট যত সম্পদের ভা-ার রয়েছে তারমধ্যে হেদায়েত সবচেয়ে দামী। হেদায়েতের মূল্য এত উঁচুমানের যে, মানুষের মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত ও নি¤œ পর্যায়ের একজন মানুষকে যে হেদায়েত দান করা হয়েছে তা সারা দুনিয়া ও তার মাঝে যে সম্পদ রয়েছে তা মিলেও এর মূল্য হতে পারে না। যেমন একজন ব্যক্তি যার দুনিয়ার কোনো সম্পদ নাই, আরাম আয়েশ, ভোগবিলাসিতার কোনো উপকরণ তার কাছে নাই। ছিড়াফারা কাপড় পরিধান করে জঙ্গলের কুড়ে ঘরে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাকে হেদায়েত দান করেছেন, তাহলে ঐ ব্যক্তি পৃথিবীর সবচেয়ে সফলকাম ব্যক্তি। কারণ সেই ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনেও সফলকাম আখেরাতের জীবনেও সফলকাম। অপর দিকে এক ব্যক্তি, সমস্ত দুনিয়ার নেতৃত্ব যার হাতে, তার হুকুমে চলে দুনিয়ার সমস্ত রাজা বাদশাহগণ, কিন্তু তার কপালে হেদায়েত জুটে নাই অথচ সে হেদায়েতের মুহতাজ তাহলে সে এতসব কিছু পেয়েও দুনিয়ার জীবনে বিফল আখেরাতের জীবনেও আজীবনের কষ্টে নিপতিত হবে। এ কথাটি আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে সুন্দর করে ইরশাদ করেন- ‘যদি গোনাহগারদের কাছে পৃথিবীর সবকিছু থাকে এবং তার সাথে সমপরিমাণ আরও থাকে, তবে অবশ্যই তারা কেয়ামতের দিন সে সবকিছুই নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে মুক্তিপণ হিসেবে দিয়ে দেবে। অথচ তারা দেখতে পাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন শাস্তি যা তারা কল্পনাও করত না। [সূরা যুমার : ৪৩]
প্রিয় পাঠক! এখন ভাবার বিষয় হলো, কাফের সম্প্রদায় দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ এমন কোন মূলবান জিনিসটির জন্য বিনিময় হিসেবে দিয়ে দিতে চায়? সেটা কি জিনিস? যা একজন সাধারণ মুসলমানের কাছে বিদ্যমান; অথচ প্রভাবশালী কাফেরের কাছে তা নাই, যার ফলে তারা পেরেশানিতে লিপ্ত থাকে? সে জিনিসটা আর কিছু নয় তা হলো হেদায়েত, যার জন্য একজন কাফের সারা পৃথিবীর সম্পদ দিতে তৈরি হয়ে যাবে। সুতরাং বুঝা যায় হেদায়েত হলো সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ যার বিনিময় সারা দুনিয়া দিয়েও পুরা হবে না।
سبحان الله বলার ফযীলত
একবার হযরত সুলাইমান আ. বাতাসে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তাঁর সম্পর্ক ছিল উর্ধ্বাকাশে আল্লাহর সাথে। সুলাইমান আ.কে সিংহাসনসহ বাতাসে উড়তে দেখে এক গ্রাম্য ব্যক্তি যমীনে বসে বলল,
আল্লাহ তাআলা সুলাইমান আ. কে ঐ ব্যক্তির سبحان الله বলার আওয়াজ শুনিয়ে দিলেন। সুলাইমান আ. বাতাসকে হুকুম করলেন গ্রাম্য ব্যক্তির কাছে যাওয়ার জন্য। বাতাস সিংহাসন নিয়ে  নির্দিষ্ট গ্রামে গিয়ে থামল এবং সুলাইমান আ. গ্রাম্য ব্যক্তিকে তলব করলেন। বেদুইন তো ভয়ে আঁটসাঁট। তিনি শান্তনা দিয়ে বললেন, তুমি আমার সিংহাসন আকাশে উড়তে দেখে কি বাক্য উচ্চারণ করছিলে? গ্রাম্য লোকটি বলল, আশ্চর্য হয়ে আমি  سبحان الله  বলেছিলাম।
সুলাইমান আ. বলেন  سبحان الله  শব্দটি বলার মূল্য একজন সুলাইমানের রাজত্বের কি দাম! যদি সারা পৃথিবীও এর মুকাবেলায় দেয়া হয় তাও এর সমান মূল্য হবে না।
হাদীস শরীফে আবু মালেক আশআরী রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন-   الحمد لله  মিযানের পাল্লা ভারি করে দেয় এবং  سبحان الله  والحمد لله  যমীন এবং আসমানের মধ্যবর্তী জায়গা সওয়াব দ্বারা ভরে দেয়। নামায কিয়ামতের দিন নূর হবে এবং সাদকা বান্দার পক্ষে দলিল হবে, আর ধৈর্য্য কিয়ামতের দিন তোমার জন্য আলো আর পবিত্র কুরআন তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে দলিল হবে। [মুসলিম, রিয়াজুস সালেহীন, ধৈর্য্য অধ্যায়]
হেদায়েত এত মূল্যবান হওয়ার কারণে এটা অর্জন করাও কঠিন হওয়ার কথা ছিল। কারণ যে জিনিস দামী তার অর্জনও কষ্টের এবং কঠিন হয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা হেদায়েতেরমত মহামূল্যবান সম্পদ যা সারা পৃথিবীর চেয়েও মূল্যবান তার অর্জন দয়াময় প্রভু এতটা সহজ করে দিলেন যে, এর চেয়ে সহজ বস্তু পৃথিবীতে আর কোথাও খোঁজে পাওয়া যাবে না। এর কারণ হলো আল্লাহ তাআলার বিশ্বজাহান সৃষ্টির শুরু থেকেই একটি নিয়ম চলে আসছে, যে জিনিসের প্রয়োজন মানুষের কম লাগে তার অর্জন আল্লাহ কঠিন করে দিয়েছেন। আর যে জিনিস মানুষের অহরহ প্রয়োজন তা আল্লাহ তাআলা সহজ করে দিয়েছেন।
একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করি- চারটি জিনিস পৃথিবীতে আছে যেমন- (১) সোনা রোপা (২) পরিধেয় কাপড় (৩) পানি (৪) বাতাস।

প্রথম সোনা চান্দি
এই সমস্ত ধাতু খুব কমই মানুষের ব্যবহারে লাগে। ব্যবহার তো দূরের কথা যদি সারা জীবন কেউ তার দেখা নাও পায় তবুও তার জিন্দেগী আরামের সাথে অতিবাহিত হয়। আমাদের চারিপাশে সামাজিক পরিবেশে অনেক পরিবার তো এমন পাওয়া যায়, যারা সোনা চান্দি কোনো দিন দেখেই নাই। যেহেতু সোনা রোপা মানুষের খুব কম ব্যবহারে লাগে। সে জন্য আল্লাহ তাআলা তা অর্জন করা কঠিন করে দিয়েছেন। অনেক কষ্ট মেহনত করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হয়তবা অল্প কিছু অর্জন করা যায়।

দ্বিতীয় পরিধেয় কাপড়
কাপড় মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। সোনা রূপার তুলনায় এর ব্যবহার অনেক বেশি। কাপড় ব্যতীত মানুষের জীবন যাপন কঠিন। কিন্তু এমন না যে একজন মানুষ কাপড় ছাড়া বাঁচবে না। পৃথিবীর কোনো কোনো জায়গায় এমনও তো দেখা যায় যে, কাপড় ছাড়া মানুষ জীবন যাপন করছে। যেমন আফ্রিকার কোনো কোনো জায়গায় এমনটা মাঝে মাঝে দৃষ্টিগোচর হয়। মোটকথা, পরিধেয় কাপড় সোনা রূপার তুলনায় মানুষের ব্যবহারে বেশি প্রয়োজন পরে এবং এ কাপড় সংগ্রহ করাও সোনা রূপার তুলনায় সহজ।

তৃতীয় পানি
পানি মানুষের বেশি প্রয়োজন পড়ে। পানির প্রয়োজন সোনা চান্দি, পরিধেয় কাপড় ইত্যাদি থেকেও বেশি প্রয়োজন হয়। এমনকি পানি ছাড়া মানুষের জিন্দেগী অতিবাহিত করা বা বেঁচে থাকার চিন্তাও করা যায় না। যদি পানি না থাকে তাহলে মানুষ বাঁচতে পারে না। এরপরেও এমন না যে পানি ছাড়া দুই একদিন বাঁচতে পারবে না। তাই দয়াময় আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের দিকে খেয়াল করে পানিকে সোনা রূপা, পোশাক পরিচ্ছেদ ইত্যাদি থেকে সহজ করে দিয়েছেন। সাধারণত কোনো টাকা পয়সা ছাড়াই পানি পাওয়া যায়। তারপরও বেশি সংকট দেখা দিলে কখনও অল্প টাকাতেও পানি পাওয়া যায়।

চতুর্থ হলো বাতাস
বাতাস এমনি একটি পদার্থ যা ছাড়া মানুষ ক্ষণিকের জন্যও বাঁচতে পারে না। বাতাসের প্রয়োজন মানুষের জন্য সোনা চান্দি, কাপড়, পানি ইত্যাদি থেকেও বেশি প্রয়োজন। বাতাস যদি না থাকে মানুষ তো শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারবে না। বাতাস ছাড়া মানুষ এক মিনিটও বাঁচতে পারে না। অথচ বাতাসকে আল্লাহ তাআলা এত সহজ করে দিয়েছেন যে একজন ব্যক্তি চাই সে বাদশা হোক বা ফকির, ধনী হোক বা গরীব, মুসাফির হোক বা মুকিম ব্যবসায়ি হোক বা চাকুরিজীবি বা আরো যত পেশা তার হতে পারে প্রত্যেকের জন্য যতটুক প্রয়োজন ততটুকুই গ্রহণ করতে পারে। এটার জন্য না কোনো টাকা পয়সার প্রয়োজন না কোনো কষ্ট পোহাতে হয় আর না কেহ তা গ্রহণ করতে বাঁধা দেয়। এককথায় যে জিনিসের প্রয়োজন যতটুকু আল্লাহ তাআলা সেই জিনিসকে বান্দার জন্য তত সহজ করে দিয়েছেন। আর যে জিনিসের প্রয়োজন তুলনামূলক যত কম আল্লাহ তাআলা তা অর্জন করাও তত কঠিন করে দিয়েছেন।

হেদায়েত মানুষের জন্য সবচেয় প্রয়োজন
এখন চিন্তার বিষয় হলো উল্লিখিত চারটি জিনিস ছাড়া এমন কোনো জিনিস আছে যা মানুষের বেশি প্রয়োজন পরে? সাধারণত মানুষের সোনা রূপা, পেশাকা পরিচ্ছদ, পানি এবং বাতাসের প্রয়োজন বেশি পরে। যদি চিন্তা করা হয় তবে দেখা যাবে যে এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন রয়েছে আরেকটি জিনিসের তার নাম হলো ‘হেদায়েত’। বাতাস ছাড়া মানুষ কমছেকম ৩০ সেকে- থাকতে পারে। কিন্তু হেদায়েত ছাড়া একজন মানুষ এক সেকে-ও থাকতে পারে না। কেননা যদি মানুষ এই হেদায়েতের সম্পদ অর্জন করতে না পারে, আর সোনা রূপা, ধন-সম্পদ হাসিল করে। পানি বাতাস তার কাছে প্রচুর পরিমানে থাকে, তাহলে তার দুনিয়ার জীবন হয়তো সুখেই অতিবাহিত হবে; কিন্তু এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। কেননা মানুষের হায়াত তো এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে। এটাকে না কোনো বাদাশার বাদশাহি ধরে রাখতে পারবে, যারা রেশমের সুন্দর সুন্দর পোশাক পরিধান করে এবং দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পাতাসের বেগে চড়ে বেড়ায়। না কোনো সম্পদশালীর সম্পদ ফিরিয়ে রাখতে পারবে, যারা দুনিয়ার বড় বড় অট্টালিকায় বাস করে আর এরকম দুনিয়ার অত্যাধুনিক জাহাজে করে ঘুরে বেড়ায়। আর না কোনো ডাক্তারের ডাক্তারী এই হায়াতকে বেধেঁ রাখতে পারবে। আবার ঝুপড়িতে বসবাসকারী শুকনা রুটি খেয়ে ছেড়া কাপড় পরিধান করে দিনাতিপাতকারী ব্যক্তির জীবনও একদিন শেষ হয়ে যাবে। হয়ত তাদের জন্য সেই জীবনটা হবে ক্ষণিকের জন্য কষ্টের। তারপরও একদিন হইজীবনের ইতিটানবে দুনিয়ার সকল মানুষের। আল্লাহ তআলা ইরশাদ করেন- প্রত্যেক সত্ত্বাকে মৃত্যু আস্বাদন করতে হবে। আর নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিনে তোমাদের প্রাপ্য পুরোপুরি তোমাদের আদায় করা হবে। কাজেই যাকে আগুন থেকে বহুদূরে রাখা হবে ও স্বর্গোদ্যানে প্রবিষ্ট করা হবে, নিঃসন্দেহ সে হল সফলকাম। আর এই দুনিয়ার জীবন ধোঁকার সন্বল ছাড়া কিছুই নয়। [সূরা আল ইমরান : ১৮৫]
অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন- প্রত্যেক সত্ত্বাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। আর আমরা তোমাদের পরীক্ষা করি মন্দ ও ভাল দিয়ে যাচাই করে। আর আমাদের কাছেই তোমাদের ফিরিয়ে আনা হবে। [সূরা আম্বিয়া : ৩৫]
কিন্তু আফসোসের বিষয়, যদি দুনিয়া থেকে একজন মানুষ এভাবে চলে যায় যে তার হেদায়েত নসীব হয় নাই, তাহলে সে দুনিয়ার জীবনেও বরবাদ হতভাগ্য; আখেরাতের অসীম, অনন্ত জীবনও বরবাদ ও দুর্ভোগে পোহাতে হবে। হেদায়েতহীন ব্যক্তি সারা জীবন শান্তি, আরাম আয়েশ ও প্রশান্তির খোঁজে জীবন পার করে দেয়; কিন্তু তা সে খোঁজ পায় না। বরং দুনিয়ার যিন্দেগীতে সে হায় হুতাশ, অস্থির, দুঃখ কষ্ট ও অশান্তিতে কাটায়।
মোটকথা, হেদায়েত মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তাই তা হাসিল করাও সহজ করে দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা। রাজা বাদশা, ধনী গরিব, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আমির উমারা রাজ প্রাসাদের উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ে থেকেও যেমন হেদায়েত অর্জন করতে পারে, তেমনি একজন গরীব ফকীর রাস্তার ভিখারীও আল্লাহর অলী, গাউস, কুতুব বুজুর্গ হতে পারে। হেদায়েত হাসিল করার জন্য আল্লাহ তাআলা সকলের জন্য তা ব্যাপক করে দিয়েছেন। যেন কিয়ামতের দিন কোনো ভিক্ষুক একথা বলতে না পারে যে, হে আল্লাহ! হেদায়েত তো অনেক দামী জিনিস আর আমার কাছে তো কোনো টাকা পয়সা ছিল না। খুব খেয়াল করলে দেখা যাবে ইসলামের প্রতিটি আহকাম যেমন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে সমাসীন আমীর উমারা, রাজা বাদশা আদায় করতে পারে, তেমনি তা পালন করতে পারে সমাজের সাধারণ থেকে সাধারণ ফকীর, মিসকিন, খেটে খাওয়া মজদুরও। যেমন নামায, রোযা, পর্দা, সুন্দর ব্যবহার ইত্যাদি  একজন বাদশা যেমন পালন করতে পারে একজন ফকীর বা খেটে খাওয়া একজন আদায় করতে পারে।
ঈমান ও হেদায়েত অর্জনের তরিকা
আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে হেদায়েত লাভের দুটি পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন-
প্রথম পদ্ধতি: যেহেতু হেদায়েতের মালিক আল্লাহ তাআলা। পবিত্র কুরআনে ঘোষাণ হয়েছে-  হে নবী! আপনি যাকে ভালবাসেন তাকে হেদায়েত দিতে পারেন না। [সূরা কাসাসা : ৫৬] তাই তার কাছেই হেদায়েত চাইতে হবে। তাহলে আল্লাহ তাআলা দয়া করে নিজ মেহেরবানিতে হেদায়েতের দৌলত দান করবেন। এজন্য বেশি বেশি দোআ করতে হবে। আর আল্লাহ তাআলা সেই হেদায়েত চাওয়ার দোআও শিখিয়েছেন- اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ  (হে আল্লাহ!) আমাদের তুমি সহজ-সঠিক পথে পরিচালিত করো। [সূরা ফাতিহা : ৪]
এই দোআটি সূরা ফাতিহাতে উল্লেখ করেছেন। এজন্য এই সূরার এক নাম হলো ‘তালিমুল মাসআলা’। আল্লাহ তাআলা এই সূরা দিয়ে আল্লাহর কাছে চাওয়া শিখিয়েছেন। এখানে যে সওয়াল করা শিখিয়েছেন এটা দুনিয়াবী কোনো সম্পদ চাওয়া শিখাননি; বরং তিনি মানুষের জীবনের সবচেয় মূল্যবান জিনিস হেদায়েত চাওয়া শিখিয়েছেন। আর এই চাওয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। কেননা বাদশাহ নিজেই দরখাস্ত লিখে বান্দাকে দিয়েছেন এবং বলেছেন তোমরা এভাবে আমার কাছে চাও। আর এর কবুলিয়তের কথা তো তিনি অন্য আয়াতে ঘোষণা করেছেন এভাবে- ‘আর যখন আমার বান্দারা আমার সন্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তখন  তো! আমি নিঃসন্দেহ অতি নিকটে। আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনার জবাব দিই যখনি সে আমাকে আহ্বান করে। কাজেই তারা আমার প্রতি সাড়া দিক আর আমাতে ঈমান আনুক, যাতে তারা সুপথে চলতে পারে। ’ [সূরা বাকারা : ১৮৬]

দ্বিতীয় তরিকা: আল্লাহ তাআলা পবিত্র কালামে ইরশাদ করেন-
وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ পক্ষান্তরে যারা আমার জন্য সংগ্রাম করে, আমি অবশ্যই তাদের পরিচালিত করব আমার পথগুলোয়। আর আল্লাহ্ নিশ্চয়ই সৎকর্মীদের সাথেই রয়েছেন। [সূরা আনকাবুত : ৬৯]
অর্থাৎ হেদায়েতওয়ালা মেহনত করা হলে অবশ্যই হেদায়েত দেওয়া হবে। দ্বীনের মেহনত করলে আল্লাহ তাআলা ওয়াদা করছেন যারা দ্বীনের জন্য মেহনত করে তারা হেদায়েতের জন্যই মেহনত করে।
আয়াতে لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا এর অর্থ হলো, আমি অবশ্যই তাদের পরিচালিত করব আমার পথগুলোয় অর্থাৎ আমি আমার সত্ত্বা পর্যন্ত পৌঁছা যাবে এমন রাস্তা অবশ্যই তাদের দান করব। দুনিয়ার বাস্তব জীবনে দেখা যায়, যে ব্যক্তি যে জিনিসের উপর মেহনত করে সে সেটা পেয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, এক ব্যক্তি সকাল সন্ধ্যা দুধ বিক্রি করে, দুধের তালাশে সারাদিন ঘুরে তাহলে অবশ্যই তার ঘরে দুধ পাওয়া যাবে। তেমনিভাবে একজন রুটি তৈরিকারী সে সারাদিন রুটি বানায় তাহলে তার ঘরের মানুষ, তার সন্তানাদিরা না খেয়ে থাকবে না। অবশ্যই রুটি খাবে, যদিও গ্রামের অন্য ঘরের লোকেরা না খেয়ে থাকে। এভাবে আমরা আমাদের চতুরপার্শ্বে লক্ষ করলে দেখতে পাবো, দুনিয়াতে যারা যে জিনিসের উপর মেহনত করে প্রতিদান স্বরুপ সে তা অর্জন করে। যেখানে দুনিয়ার সামান্য জিনিসের উপর মেহনত করলে তা পাওয়া যায়, তাহলে হেদায়েতের জন্য মেহনত করলে মহান আল্লাহ তাআলা বুঝি মাহরুম রাখবেন? এটা কখনই হতে পারে না। দ্বীনের মেহনত করার জন্য, হেদায়েতের মেহনত করার জন্য আল্লাহ তাআলা হযরত আদম আ. থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা. পর্যন্ত এক লক্ষ চব্বিশ হাজার আম্বিয়া কেরাম কে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন এবং সকলেই হেদায়েতের মেহনত করেছেন আর উনারা প্রত্যেকেই হেদায়েত প্রাপ্ত ছিলেন। তাঁরা রাত দিন নিজ নিজ উম্মতের পিছনে পিছনে ঘুরেছেন, তাদের কাছে গিয়ে দাওয়াত দিয়েছেন ঈমান ও হেদায়েত লাভের জন্য। যাদের ভাগ্যে হেদায়েত ছিল তারা হেদায়েত পেয়েছে আর যাদের ভাগ্য মন্দ তারা বঞ্চিত হয়েছে।
মোটকথা, হেদায়েত লাভের দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো, হেদায়েতওয়ালী মেহনত করতে হবে। আল্লাহ পাকের ওয়াদা রয়েছে হেদায়েতের মেহনতকারীদের অবশ্যই হেদায়েত দিবেন। মনে করেন, একভাই অন্য ভাইকে বলল, নামায পড়েন। তাহলে প্রথম ভাই কিভাবে নামায না পড়ে থাকতে পারে? অথবা বলল, আপনি রোযা রাখুন তাহলে সে নিজে কিভাবে রোযা ভাঙ্গবে? অথবা বলল, ভাই, আপনারা চুরি করবেন না, তাহলে সে নিজে কিভাবে চুরি করতে পারে?

হেদায়েতের মেহনতের প্রকারভেদ
হেদায়েত লাভের জন্য বিভিন্ন প্রকারের মেহনত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে যে কোনো এক প্রকার গ্রহণ করলেও সেটা হেদায়েতের মেহনত বলে গণ্য হবে। হেদায়েতের মেহনতকে কোনো একটি পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধ করা ঠিক না। সারা দুনিয়ায় দীন জিন্দা করার জন্য এখলাসের সাথে যে সমস্ত মেহনত চলছে সবগুলোই হেদায়েতের মেহনতের বিভিন্ন প্রকার। যেমন তাবলীগ জামাতের নামে সারা দুনিয়ায় একটি দল কাজ করছে, এটাও হেদায়েতে মেহনত। কেউ কেউ আবার দীন প্রতিষ্ঠার জন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করছেন, তাদের সাহায্য সহযোগিতা করছেন এবং সেখানে পড়ছেন পড়াচ্ছেন। আবার কেউ এলায়ে কালিমাতুল্লাহ তথা দীনকে আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে আল্লাহর রাস্তায় শসস্ত্র যুদ্ধ করছেন। এ সব কিছুই দ্বীনের জন্য মেহনত তথা সবাই হেদায়েতের রাস্তায় আছেন। কারো এটা ভাবার কোনো যুক্তি নাই যে দ্বীনের জন্য আমি যে পদ্ধতি গ্রহণ করছি একমাত্র এটাই হেদায়েতের পথ। উদারহরণস্বরূপ বলা যায়- আল্লাহর রাস্তায় ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান সশস্ত্র জিহাদকারী যুবকদের এটা ভাবার কোনো সুযোগ নাই যে, আসল কাজ তো আমরাই করছি আর বাকি মাদরাসার উলামা হযরত এবং তাবলীগ জামাতের লোকেরা সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই করছে না। তেমনি তাবলীগ জামাতের লোকদেরও এটা ভাবার কোনো সুযোগ নাই যে যারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করছে বা মাদরাসায় পড়াচ্ছেন পড়ছেন তারা অনর্থক সময় নষ্ট করছেন। এররকমভাবে মাদরাসার উলামাগণ, তাদেরও এমন ধারণা করা ঠিক না। এর একটি দৃষ্টান্ত হলো- একটি ঘরের ছাদের ওজন ঘরের চার দিকের দেওয়াল বহন করছে। এখন যদি উত্তর দিকের দেওয়াল বলে ছাদের সমস্ত ভর আমি একা বহন করছি তাহলে তার এ দাবী ভুল প্রমাণিত হবে, যখন অপর তিনটি দেওয়াল সরিয়ে ফেলা হবে। ঠিক তেমনি ইসলাম নামের ইমারাতের ভার বহনের ক্ষেত্রে দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত এখলাসের সাথে কর্মকারী সকল দলই শরিক। বরং প্রত্যেকেই মনে করতে হবে যে দ্বীনের মেরুদ- তিনটি জিনিসের উপর প্রতিষ্ঠিত। ১. দাওয়াত ২. তালিম ৩. জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ।
রাসূল সা. এর সাহচর্যের বরকতে সাহাবায়ে কেরাম রা. এমন শক্তি অর্জন করেছিলেন, যে তাঁরা একসাথে সব কাজই করতে পারতেন। তারা একই সময় আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদ ছিলেন, দাঈ ছিলেন, মুফাসসির, ফকীহ এবং মুহাদ্দিস ছিলেন। পরবর্তীতে মানুষের মাঝে যখন ঈমানী দুর্বলতা আসতে শুরু করল, আস্তে আস্তে দ্বীনের এসমস্ত কাজ ভাগ হতে লাগল। একই সাথে একজনের জন্য সবগুলো করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে ইল্লা মাশাআল্লাহ যারা যে লাইনে পারদর্শী তারা সে লাইনে মেহনত করবে এবং অন্যদের জন্য যতটুকু সম্ভব সাহায্য সহযোগিতা করবে কমছেকম দোআর মধ্যে সকলকে শামিল করবে। তাদের বিরোধিতা করবে না। কেননা এসবই দ্বীনের কাজ, হেদায়েতের মেহনত। বারাবাড়ি আর ছাড়াছাড়ি থেকে নিজেকে বাঁচানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
অনেকের মনে শয়তানে প্রশ্ন জাগাতে পারে যে, আমাদের তো হেদায়েতের দৌলত আছেই। আমরা তো মুসলমানদের ঘরেই জন্ম নিয়েছি এবং কালিমা পড়ছি। আমাদের নামও মুসলমান। নামায পড়ি, রোযা রাখি। আমাদের কি প্রয়োজন যে আমরা হেদায়েতের জন্য মেহনত করব হেদায়েতের জন্য দোআ করব? এই কষ্ট করার কি প্রয়োজন?
উত্তরে বলব- প্রথমত আমাদের হেদায়েতেরমত দৌলত আছে, কিন্তু যতটুকু হেদায়েত আমাদের আছে তা অপরিপূর্ণ। পরিপূর্ণ হেদায়েত অর্জনের জন্য দোআ করতে হবে এবং মেহনতও করতে হবে। পরিপূর্ণ হেদায়েত হলো চব্বিশ ঘন্টার যিন্দিগী আল্লাহ তাআলার হুকুমে এবং রাসূল সা. এর সুন্নত তরিকায় অতিবাহিত করা। আল্লাহ তাআলা যেসব কাজের হুকুম করছেন তা পুরোপুরি পালন করা এবং যা থেকে নিষেধ করছেন তা থেকে পুরোপুরি বিরত থাকা। আর রাসূল সা. এর প্রতিটি সুন্নত নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা। তাহলে এখন আমরা নিজেরাই চিন্তা করি আমরা কতটুকু হুকুম পালন করছি এবং রাসূলের সুন্নাত আমার যিন্দিগীতে কতটুকু আসছে, যেহেতু রাসূলের সুন্নাত এবং আল্লাহর হুকুম পুরোপুরি পালন করতে পারছি না, বুঝা গেল আমার হেদায়েত অপূর্ণাঙ্গ রয়ে গেছে। তাই এই নাকেস হেদায়েত কামেল করার জন্য আল্লাহর কাছে  হেদায়েতের জন্য দোআ ও পুরোপুরি মেহনত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মেনে নিলাম আমার হেদায়েত নাকেস তবুও এটা এত দামী যে সারা দুনিয়া দিয়ে হলেও এর মূল্য হবে না। কেননা যার কাছে যত দামী জিনিস থাকে তার ভয়ও সেরকম, না জানি কখন লুটেরার দল লুট করে নিয়ে যায়। ঠিক আমাদেরও সেইরকম দামী জিনিস হেদায়েতের দৌলত রয়েছে। এটাও তো লোট করে নেয়ার ভয় আছে। শয়তান এবং মনের কুপ্রবৃত্তি সর্বদায় আমার পিছনে লেগে আছে কিভাবে আমার মহামূল্যবান সম্পদ হেদায়েত ছিনিয়ে নেওয়া যায়। সে জন্য এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হেদায়েতের পিছনে ঈমানের পিছনে মেহনত করতে হবে। যেন আল্লাহ তাআলা ছিনতাইকারীদের ছিনতাই থেকে আমাদের ঈমান ও হেদায়েতকে রক্ষা করেন।

আব্দুল কাদের জিলানী রহ. এর ঈমানী পরীক্ষা
হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহ. শেষ বয়সে একটি জঙ্গলে বসবাস করছিলেন। তিনি সেখানে মুরাকাবায় মগ্ন ছিলেন। হঠাৎ মেঘের আকৃতিতে আকাশের দিক থেকে একটি নূরের ঝলকানি ছায়াপাত করল এবং সেখান থেকে আওয়াজ আসল- হে আব্দুল কাদের! আমি তোমার খোদা, তুমি মেহনত করে আমার অনেক ইবাদত করেছ, অনেক মুজাহাদা করেছ, অনেক চেষ্টা সাধানা করেছ, অনেক কষ্ট করে আমাকে খুশি করেছ। আমি খুশি হয়ে আজ তোমার উপর থেকে নামায মাফ করে দিলাম, রোযা মাফ করে দিলাম। এমনকি তোমার উপর থেকে দ্বীনের সব আহকামাত রহিত করে দিলাম। আজ থেকে তুমি স্বাধীন। তোমাকে দ্বীনের ব্যাপারে কিছুই জিজ্ঞাসা করা হবে না। তোমার মন যা চায় তা করে বেড়াও। আব্দুল কাদের জিলানী রহ. তাৎক্ষণিক বললেন-

দূর হয়ে যা। তুই অভিশপ্ত শয়তান, ধোঁকাবাজ ইবলিস। আল্লাহর প্রিয় বান্দা আম্বিয়ায়ে কেরামের চেয়ে বেশি কষ্ট সাধনাকারী ইবাদতগুজার বান্দা আর কে হতে পারে? দ্বীনের জন্য মুজাহাদা, রিয়াজত করা তাদের চেয়ে বেশি আর কে আছে করতে পারে? অথচ আল্লাহ তাআলা তাদের থেকে নামায রোযাসহ দ্বীনের কোনো আহকামাত রহিত করেননি। আর আমি কে, যে আমার থেকে তা উঠিয়ে নেয়া হবে? হে আল্লাহ! অভিশপ্ত শয়তান হতে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
দ্বিতীয়বার আবার আওয়াজ আসল, হে আব্দুল কাদের! প্রায় সত্তর জন আবদাল দুনিয়া হতে অতিবাহিত হয়েছে যাদের শেষ বয়সে আমি ধোঁকা দিয়ে গোমরা করেছি, কিন্তু আজ তোমার ইলম তোমাকে আমার ধোঁকা থেকে বাচিয়েছে। অন্যথায় তুমিও পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে। আব্দুল কাদের রহ. দ্বিতীয়বার আবার বললেন-                                        দূর হয়ে যা। জালেম! এটা তোর দ্বিতীয় হামলা। আমার ইলম আমাকে বাঁচাতে পারেনি; বরং আল্লাহর রহমত এবং তার সাহায্য না পেলে আমিও তোর ধোঁকায় পথভ্রষ্ট হয়ে যেতাম।
সুতরাং বুঝা গেল আমাদের হেদায়েত নাকেস বা অপূর্ণাঙ্গ। তাকে পরিপূর্ণ করা আমাদের উচিত। তাছাড়া যতটুকু হেদায়েত আমাদের আছে তাও লুটে নেয়ার সমূহ ভয় রয়েছে। এ জন্য এটা সংরক্ষণ করাও আমাদের দায়িত্ব। এজন্য আল্লাহ তাআলা সূরা ফাতিহাতে যেমন হেদায়েত চাওয়ার নিয়ম শিখিয়েছেন, সূরা আলে ইমরানেও এভাবে দোআ শিখিয়েছেন-
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ  আমাদের রব! আমাদের অন্তরকে বিপথগামী করো না আমাদের হেদায়েত করার পরে, আর তোমার নিকট থেকে আমাদের করুনা প্রদান কর। নিশ্চয় তুমি নিজেই পরম বদান্য। [সূরা আলে ইমরান : ৮]
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝার এবং আমল করার তাওফিক দান করুন আমিন।

মুরতাদের নির্মম পরিণতি : মুফতী পিয়ার মাহমুদ

মুরতাদের পরিচয়: কোনো মুসলমান ইসলামের কোন মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস কিংবা বিধান অথবা ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়কে মানতে অস্বীকার করা কিংবা তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা অথবা কটুক্তি ও অবমাননাকর কোন কথা বলার নামই হলো মুরতাদ হওয়া। মাআরিফুল কুরআন: ৭/২২৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩৪৪, হিন্দিয়া: ২/২৫৩ ইকফারুল মুলহিদীন- ৭২,১৯৯।

মুরতাদের প্রকার: মুরতাদ দু’ প্রকারের হয়ে থাকে। (১) নিজেই নিজের মুরতাদ হওয়ার ঘোষণা দেয়। (২) যে ঈমান বিনষ্টকারী কোন আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করে অথবা অনুরূপ কোন কথা কাজের সঙ্গে জড়িত থেকে নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করে। এই প্রকারের মুরতাদকে মুনাফিক, মুলহিদ ইত্যাদিও বলা হয়। সকল ইরতিদাদ বা মুরতাদই সাধারণ কুফরের চেয়ে ভয়াবহ। কারণ সাধারণ কুফর তো হলো সত্যদীন ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা। কিন্তু ইরতিদাদ বা মুরতাদ হওয়া কেবল সত্যদীন গ্রহণ থেকে বিরত থাকা কিংবা নিছক বিমুখতা নয়, বরং তা ত্যাগ করে আল্লাহ, রাসূল এবং দীনে হকের প্রতি সরাসরি বিদ্রোহ করা। ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, তাদেরকে অপদস্থ করা। কোন ধর্ম গ্রহণের পর তা বর্জনের অর্থ সে ধর্মকে অভিযুক্ত করা। যা দীনে হককে মিথ্যা হওয়ার অবান্তর অপবাদ। পাশাপাশি পৃথিবীতে ফাসাদ তথা অনর্থ ও বিপর্যয় সৃষ্টিও বটে। এজন্য মুরতাদের শাস্তি সাধারণ কাফেরের চেয়ে কঠিন ও মর্মন্তুদ।



মুরতাদের শাস্তি

সকল পাপের ক্ষেত্রেই সাধারণ নিয়ম হলো কৃতপাপের শাস্তি হয়তো দুনিয়াতে ভোগ করবে নয়তো পরকালে। দুনিয়ায় ভোগ করলে পরকালে মাফ পেতে পারে। আর দুনিয়ায় পার পেলে পরকালে তার শাস্তি ভোগ করতেই হবে। অপরাধ অনুপাতে সাজার ধরণ ও পরিমাণ হবে। তবে ইরতিদাদের শাস্তির ব্যাপারটি ভিন্ন। এর জন্য যেমন দুনিয়াতেও রয়েছে শাস্তি তেমনি পরকালেও রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। স্বঘোষিত মুরতাদ হোক কিংবা অঘোষিত মুরতাদই হোক, উভয় প্রকার মুরতাদেরই ইহকালীন শাস্তি হল প্রশাসন মুরতাদকে প্রথম তওবার প্রতি আহবান করবে। যদি তওবা করে ফেলে তাহলে তো ভালো; তার শাস্তি মওকুফ হয়ে যাবে। অন্যথায় তার উপর মুরতাদের নির্ধারিত শাস্তি মৃত্যুদ- কার্যকর করবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, “যদি মুরতাদ মুনাফিকরা, যাদের অন্তরে ব্যধি রয়েছে এবং মদীনায় ভয়ংকর সংবাদ রটনাকারীরা নিবৃত্ত না হয়, তাহলে অবশ্যই আমি আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করব। আর তখন তারা আপনার প্রতিবেশী হিসাবে বেশীদিন টিকে থাকতে পারবে না। যে কদিন থাকবে অভিশপ্ত অবস্থায় থাকবে। এ জাতীয় লোকদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে ধরা হবে আর হত্যা করা হবে।”[(আহযাব: ৬০-৬১]

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও দুশমনী করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টির পায়তারা করে, তাদের শাস্তি কেবল মৃত্যুদ- বা শূলিবিদ্ধ করে হত্যা করা অথবা হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা কিংবা নির্বাসিত তথা কারাগারে নিক্ষেপন করা। এতো হলো কেবল তাদের পার্থিব অপমান। পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর শান্তি।” [মায়েদাহ- ৩৩]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, “যে নিজের দীন পরিবর্তন করে মুরতাদ হবে, তাকে হত্যা করে ফেলবে” [বুখারী-৬৯২২, তিরমিযী- ১৪৫৮, আবু দাউদ- ৪৩৫১, আহমাদ- ১৮৭১] অপর বর্ণনায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, “যে মুসলমান সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। আর আমি আল্লাহর রাসূল, ‘তাকে তিন কারণের কোন একটি ছাড়া হত্যা করা বৈধ নয়। (১) অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, (২) বিবাহিত ব্যক্তির ব্যভিচার, (৩) ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হওয়া।’ [বুখারী: হাদীস- ৬৮৭৮, তিরমিযী- ১৪০২, বায়হাকী- ৮/১৯৪]

তুসতার নামক এলাকা বিজয়ের পর হযরত উমর রা. সংবাদবাহীদের জিজ্ঞেস করলেন, বিজিত এলাকা তুসতারে কোন বিরল ঘটনা ঘটেছে কি? উপস্থিত লোকেরা বলল, এক মুসলমান ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। ফলে আমরা তাকে গ্রেফতার করি। উমর রা. বললেন, তার সাথে তোমার কী আচরণ করেছ? তারা বলল আমরা তাকে হত্যা করেছি। উমর রা. বললেন (এমনটি না করে) যদি তাকে একটি কক্ষে আবদ্ধ করে রাখতে আর ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রতিদিন রুটি দিতে আর এইভাবে তিন দিন তার কাছে তওবা আহবান করতে তাহলে কতইনা ভাল হতো! তখন সে তওবা করলে তো করত: অন্যথায় তাকে হত্যা করে ফেলতে। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা- ২৯৫৮৮ অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, মহানবী সা. ইয়ামানে হযরত আবু মুসা আশসারী রা. এর নিকট হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. কে পাঠালেন। তিনি সেখানে পৌঁঁছলে আবু মুসা রা. তাকে স্বাগত জানালেন এবং বসার জন্য আসন এগিয়ে দিলেন। হঠাৎ দেখা গেল আবু মুসা আশআরীর পাশে এক ব্যক্তিকে বেঁধে রাখা হয়েছে। মুআজ রা. বললেন, এর কি হলো? একে এভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে কেন? উত্তরে আবু মুসা বললেন, সে ইহুদী ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছিল। কিন্তু পরে আবার ইসলাম ত্যাগ করে বিকৃত ধর্মে ফিরে গেছে। একথা শুনে মুয়াজ রা. বললেন একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সা. এর নির্দেশ ও ফায়সালা এটাই। আবু মুসা রা. বললেন, হ্যাঁ ঠিক আছে। আপনি একটু বসুন। কিন্তু তিনি বললেন, না, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না।

এটাই আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের ফায়সালা ও নির্দেশ। একথা তিনি তিনবার বললেন। অবশেষে আবু মুসা রা. লোকটিকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। ফলে তাকে হত্যা করা হলো (আবু দাউদ- ৪৩৫৪

মুরতাদদের শাস্তি মৃত্যুদ- এর উপর উম্মতের সকল মাযহাব, সকল শ্রেণী-গোষ্ঠী একমত। কোনকালেই কোন আলেমে দীনের এ ব্যাপারে দ্বিমত বা দ্বিধা ছিল না। শরীয়তের পরিভাষায় একে ইজমা বলে। ইজমা শরীয়তের তৃতীয় দলিল। এ ব্যাপারে ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদ-। সকল আলেমে দ্বীনের অনুসৃত নীতি এটাই [তিরমিযী: ১/২৭০] আততামহিদ নামক গ্রন্থে রয়েছে, যে তার দীন ত্যাগ করে মুরতাদ হয় তাকে হত্যা করা বৈধ হয়ে যাবে এবং তার শিরচ্ছেদ করা হবে। মুরতাদের এ শাস্তির ব্যাপারে পুরো উম্মতের ইজমা রয়েছে (আততামহীদ ইবনু আব্দিল বার ৫/৩০৬ সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল মুগনীতে আছে সকল মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদ-। এ ব্যাপারে সকল আলেমে দীনের ইজমা রয়েছে [আল মুগনী, ইবনে কুদামা হাম্বলী: ১২/২৬৪] এ বিষয়ে আরো দেখুন বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ইবনে রুশদ মালেকী: ২/৩৪৩; আল ইলাম, ইবনে হাজার মক্কী শাফেয়ী: ৪০০, ইলাউস সুনান: ১২/৫৯৯; আল মুহীতুল বুরহানী: ৭/৪৪৩; রাসায়েলে আল্লামা শামী: ১/৩১৬

এ দলিলগুলো বাদ দিলেও সাধারণ যুক্তিও বলে মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদ-ই হওয়া উচিত। কেননা মুরতাদ মূলত: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী। তাই সে সমাজে অবস্থান করলে সংঘাত-সহিংসতা, বিপর্যয় ও আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটবে। ফলে এমন ব্যক্তি বেঁচে থাকার মাঝে কোন কল্যাণ ও মঙ্গলের আশা করা যায় না। তাই তাকে হত্যা করে ফেলাই অধিক উত্তম ও কল্যাণকর। ইলামুল মুওয়াক্কিঈন: ২/৮৪।

মুরতাদ এতো জঘন্য অপরাধী যে, মৃত্যুর পর কররস্থ করার আগেই তার শাস্তি ও লাঞ্ছনা শুরু হয়ে যায়। প্রত্যেক মৃত ব্যক্তিকে তার স্বধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দাফন পূর্বক্রীয়া সম্পন্ন করে স্বধর্মের কবরস্থানে দাফন করা হয়। পক্ষান্তরে ধর্মত্যাগী নাস্তিক-মুরতাদের বিধান আলাদা। এদের জানাযা পড়া হারাম। এদের জানাযায় অংশগ্রহণ কিংবা ইমামতি করা সুস্পষ্টই হারাম। কোন ধর্মের কবরস্থানেই এদেরকে জায়গা দেয়া যাবে না। তাই এ জাতীয় লোকদের জানাযা আদায় না করে আলাদা কোন স্থানে গর্ত করে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হবে। ইরশাদ হয়েছে, “কখনো তাদের (মুনাফিক-মুরতাদদের) কেউ মারা গেলে আপনি তাদের জানাযা পড়বেন না এবং দুআ ইস্তিগফার কিংবা দাফন-কাফনের জন্য তার কবরের পাশে দাঁড়াবেনও না। (কারণ) তারা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং নাফরমান অবস্থায় মারা গেছে ।” [তওবা-৮৪] এই আয়াতটি সকল প্রকার কাফের মুরতাদদের জানাযা অবৈধ হওয়ার সুস্পষ্ট দলিল [কুরতুবী: ৮/৪০] এ ব্যাপারে সকল ফকীহ একমত। এবিষয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই (কিতাবুল আছল: ১/৪১১) মাবসূত লিসসারাখসী: ২/৫৪; আল-মুদাওয়ানা:১/১৬৩; মাওয়াহিবুল জলীল: ৩/৭০] মুরতাদদের জন্য সকল প্রকার ইসালে সওয়াব কিংবা এর জন্য অনুরোধ বা সুপারিশ করাও নিষিদ্ধ। তার জন্য দুআ করলে কবুল তো হবেই না বরং দুআ’কারী ও অনুরোধকারী উভয়ে উল্টো হারাম কাজ করার গুনাহে লিপ্ত হবে। তাই কেউ না বুঝে বা না জেনে এরূপ করে ফেললে অনতিবিলম্বে আল্লাহর দরবারে তওবা ইস্তিগফার করে নিবে। [তওবা: ৮০, ১১৩, ১১৪; হুদ: ৪৫, ৪৬, ৪৭; আল মাজমূ: ৫/১২০]

পরপারেও তার জন্য আছে ভয়ংকর শাস্তি। কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছে, “তোমাদের কেউ যদি মুরতাদ হয়ে যায় আর মুরতাদ অবস্থায়ই মারা যায় তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের সকল নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। এরাই হলো জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” [বাকারা:২১৭] অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয় যারা তাদের সামনে হেদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পরও ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়েছে এদের কি দশা হবে, তখন যখন ফেরেশতারা এদেব মুখম-ল ও পশ্চাৎদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে। এ শাস্তি এজন্য যে, তারা এমন মতবাদ বেছে নিয়েছে যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে এবং তারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করে। তাই আল্লাহ তাদের আমলগুলো বরবাদ করে দেন।” [মুহাম্মদ: ২৫, ২৭, ২৮]।





লেখক পরিচিতিঃ লেখক ও শিক্ষক

আলজেরিয়ায় মুসলিমদের জবাই করে হত্যার পর ফ্রেঞ্চ সেনাদের গর্বিত পোজ।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে উসমানী খিলাফতের সেনাপতিরা ও উসমানী গ্র্যান্ড মুফতি গ্যালিপলি যুদ্ধের মানচিত্র বিশ্লেষণ করছেন।


উসমানী খিলাফতকে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক ধরা হতো


আপনারা হয়তো জানেন,তৎকালীন উসমানী খিলাফতকে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক ধরা হতো।যদিও উসমানী খিলাফত তার শেষের সময়ে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় ভারতবর্ষের উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলো না, কিন্তু ভারতীয় মুসলিমরা(ইন্ডিয়া,পাকিস্তান,বাংলাদেশ) সবসময় উসমানী খলিফাকে তাদের ইমাম অর্থাৎ নেতা মনে করতো।এই উপমহাদেশের বিখ্যাত আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের শুরু করা খিলাফত আন্দোলনের কথা হয়তো আপনারা অনেকেই জানেন।ছবিতে আমাদের উপমহাদেশের মুসলিমদের ১৯১৩ সালের বলকান যুদ্ধে উসমানীদের কঠিন পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করে তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে দেখা যাচ্ছে।

১৯০৮ সালে উসমানী খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ চীনা মুসলিমদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য চীনের বেইজিং এ একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় খোলেন।এই ফটোটি বিশ্ববিদ্যালয়টির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের।


১৫৪৩ সালে নির্মিত ইস্তাবুল শহরের শেহজাদে মসজিদের জ্যামিতিক নকশা।মসজিদের ডিজাইনার মুসলিম বিশ্বের বিখ্যাত স্থপতি মিমার সিনান।


ঐতিহাসিক চেচনিয়া দিবস


১৯৪৪ সালে এই দিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে রাশিয়ার সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও হিংস্র শাসক জোসেফ স্টালিন এর নির্দেশে ককেশাস অঞ্চলের ইংগুশেটিয়া ও চেচনিয়া থেকে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে গরু বাছুরের মত গাদাগাদি করে মালবাহি ট্রেনে করে, প্রচন্ড শীত বরফচ্ছাদিত সাইবেরিয়া ও কাজাকিস্তানে নির্বাসন দেয়া হয় । দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকার পর রুগ-শোক, দুর্ভিক্ষ থেকে খুব অল্প সংখ্যক লোক জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিল ।।

তাদের অপরাধ ছিল একটাই, আর তা হল, তারা চেয়েছিল ঈমান, ইসলাম,আমল ও ইজ্জতের জিন্দেগী জীবন যাপন করতে । কিন্তু সেটা সহ্য করতে পারেনি চরম জংগি নাস্তিক রাশিয়ার শ্বেত ভল্লুকেরা ।

আজও চেচনিয়া ইঙ্গুশেটিয়ার মুসিলিমরা এই দিনকে ভারি শ্বাস ফেলে কালো দিবস হিসেবে স্বরন করে ।। তাই বলে কি থেমে গেছে তাদের ঈমান ও স্বাধীনতার স্পৃহা ? না থামেনি , ইমাম শামিল, হাজী মুরাদের উত্তরসূরীরা আজ আবধি চালিয়ে যাচ্ছে ঈমান, ইসলাম ও স্বধীনতার আন্দোলন , যা করেছিলেন তাদের পূর্বপুরুষেরা ।
এ যেন "শীর দেগা নেহি দেগা আমামা"

অবাক হই যখন দেখি বালাদেশের কিছু মানুষরুপী শয়তানগুলো লেলিন, স্টালিনকে মহান বিপ্লবী হেসেবে প্রচার করে ইনিয়ে বিনিয়ে এদেশের মানুষকে তাদের বিষাক্ত মতবাদকে গিলে খাওয়াতে চায় , যারা অগনিত বনী বনি আদমের রক্ত পানকরে, হাড় ও মাংশের উপর পা মাড়িয়ে ক্ষমতার সিড়িতে আরোহন করেছে ।গণহত্যা ও হিংস্রতার প্রতিযোগীতায় এডলফ হিটলার যার ধারে কাছে যেতে পারেনি । আর তাদের মানবতা, মানবধীকার ইত্যাকার আসল রুপ ।।
আল্লাহ আমদের সবাইকে কুফফার চক্রান্ত বুঝার এবং তা থেকে বাচার তাওফীক্ব দান করুন । আমীন ।।

খায়রুদ্দীন বারবারুস



মৌলভী মুহাম্মাদ বাকের


১৮৫৭ সাল : উর্দু আখবার পত্রিকার এডিটর জনাব মৌলভী মুহাম্মাদ বাকেরকে কুফফার বৃটিশ হায়েনারা সিপাহী বিপ্লবে জড়িত থাকার কারনে কামানের নলের মুখে বেধে শহীদ করে দেয় । এভাবে নাম না জানা আরো কত অগণিত মুজাহিদীনদের শহীদ করা হয়েছে , সে ইতিহাস আমরা কতটুকু জানি ।
সিপাহী বিপ্লব নিয়ে লেখা একটি মূল্যবান বই আপনাদের সাথে আগামীকাল শেয়ার করবো ইনশাআল্লাহ।

রাশিয়ায় আমাদের মুসলিমদের ইতিহাসঃ অস্থিত্ব রক্ষার সংগ্রামে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমান


আসুন জেনে নেই রাশিয়ায় আমাদের মুসলিমদের ইতিহাসঃ অস্থিত্ব রক্ষার সংগ্রামে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমান

রুশ বলয়ভূক্ত ক্রিমিয়ার ঐতিহ্যসমৃদ্ধ তাতার মুসলিম জনগোষ্টী তিন শ’ বছরের বাধা-বিপত্তি ও গোলামীর জিঞ্জির ছিড়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর সংগ্রামে বিজয়ী হতে চলেছে। অব্যাহত নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও গণ নির্বাসন চালিয়েও তাতারদের মুসলিম জাতিসত্ত্বা মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। আবার তারা জেগে উঠছে ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিজস্ব বলয়ে। কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে আবার দেখা দিয়েছে ইসলামী নবজাগরণ। নতুন নতুন মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে এবং আনুপাতিক হারে বেড়ে চলেছে নামাযীদের সংখ্যা। উত্তরাধিকার ঐতিহ্য ও তাওহিদী চেতনায় জীবন গড়ার তাগিদ তীব্রভারে অনুভূত হচ্ছে তাতারদের মাঝে। হারিয়ে যাওয়া তাতার ভাষার পুনরুজ্জ্বীবনের জন্য ক্রিমিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গড়ে উঠেছে তাতার ভাষা স্কুল।

ভৌগলিক অবস্থানঃ

ক্রিমিয়ান তাতার হচ্ছে কৃষ্ণ সাগরের উত্তর উপকূলে অবস্থিত ইউক্রেনের একটি স্বায়িত্বস্বাসিত প্রজাতন্ত্র। বহু উত্তান পতনের নীরব সাক্ষী ক্রিমিয়া। ক্রিমিয়ার এ বিস্তীর্ণ অঞ্চল শত বছর ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও শাসকদের দ্বারা শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। ২৬, ২০০ কিলোমিটারের আয়তন বিশিষ্ট ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্রের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৯, ৭৩, ১৮৫ জন। ক্রিমিয়া হচ্ছে ক্রিমিয়ান তাতারদের জন্মভূমি, যারা নৃতাত্ত্বিকভাবে সংখ্যালঘু। গোটা জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ ক্রিমিয় তাতার। ক্রিমিয়ান তাতারদের পূর্বপুরুষ হচ্ছে তুর্কী। ত্রয়োদশ শতাব্দী হতে তারা ক্রিমিয়ান উপদ্বীপে বসবাস করে আসছে।

পূর্বের অবস্থানঃ

মূল তাতারগণ পঞ্চম শতাব্দীতে গোবী মরুভূমির উত্তর পশ্চিমে বসবাস করত। নবম শতাব্দীতে খিতানগণ তাদের এলাকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলে তারা দক্ষিণ অভিমূখে যাত্রা করে। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল শাসন কায়েম করে। চেঙ্গিস খানের দৌহিত্র বাতু খানের পরিচালনায় তাতারগণ পশ্চিম দিকে রাশিয়ার সমতল অভিমূখে রওনা হয়। যাত্রার সময় তারা তাদের সাথে তুর্কী উরাল বংশোদ্ভুত জনগণকেও সাথে নিয়ে যায়। চেঙ্গিস খানের বংশধর বার্কাই খানের (১২৫৭-১২৬৭) আমলে তাতারদের সাথে ইসলামের পরিচয় ঘটে।

ইসলামে প্রবেশঃ

উযবেগের (১৩১৩-১৩৪০) ক্ষমতায় আরোহণের আগ পর্যন্ত এতদঞ্চলে ইসলাম ব্যাপকতা লাভ করেনি। চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি তাতাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। চতুর্দশ শতকে পরিভ্রমণকারী পর্যটকগণ এতদঞ্চলে ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতার নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেন। সময়ের বিবর্তনে ইসলামী অনুশাসন, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি তাতারদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

তাতার রাজ্য

কিপচাক সাম্রাজ্যের (Golden Hordes) পতনের পর উক্ত অঞ্চলের উপর গড়ে উঠা তাতার রাজ্য সমূহের মধ্যে ক্রিমিয়াই ছিল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী স্বাধীন রাজশক্তি। ক্রিমিয়ার এই তাতার বংশের রাজত্বকাল ১৪২০ হতে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ সাড়ে তিন শ’ বছর স্থায়ী হয় এবং সিংকোরাপোলকে রাজধানী করে পর্যায়ক্রমে ৬২ জন তাতার খান ক্ষমতায় অধিষ্টিত থেকে রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। কাজান বংশের প্রতিষ্ঠাতা উলুঘ মুহাম্মদের জনৈক ভ্রাতা তাশ-তিমুর তোখতামিশের সেনাপতি ছিলেন এবং তিনিই ক্রিমিয়ায় তাতার বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।

জার আইভানকে পরাজিত করে মস্কো জয়

গীরাই খান নামে পরিচিত তাতার শাসকদের সাথে পোলান্ডের ডিউক ও উসমানীয় তুর্কী সুলতানগণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে ক্রিমিয়া অবস্থিত হওয়ায় এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে সবাই সজাগ ছিলেন। বহিঃশত্র“র আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তাতারগণ দু’লাখ সদস্য বিশিষ্ট দূর্ধর্র্ষ সেনাবাহিনী গঠন করেন যার মাধ্যমে পোলান্ড, রাশিয়া ও কোসাকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালিত হয়। এমনকি ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দওলত গিরাই এর নেতৃত্বে তাতার বাহিনী রাশিয়ার জার আইভানকে পরাজিত করে মস্কো নগরী বিধ্বস্ত করে দেয় এবং জারকে কর প্রদানে বাধ্য করে। সে সময় ককেসাস, দাগিস্তান ও রুমালিয়ার উপরও তাতারদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া জয়ঃ ১ম ক্যাথরিন

অবশেষে কৃষ্ণ সাগরের উপর আধিপত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রাশিয়ার জারিন ক্যাথারিণ ১৭৩৬ ও ১৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিমিয়াকে বিধ্বস্ত করে দেয় এবং ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে রুশ ও কোসাক বাহিনী ক্রিমিয়ার রাজধানী সিংকোরাপোল দখল করে নেয়। কৃষ্ণ সাগরে রুশদের অবাধে প্রবেশের মহামতি পিটারের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন ক্রিমিয়া দখলের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করল।

ক্রিমিয়া স্বাধীন রাজ্য

১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সম্পাদিত কুচকায়নারজির সন্ধিতে ক্রিমিয়া স্বাধীন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৭৭৪ হতে ১৭৭৬ সাল পর্যন্ত তাতারগন নির্বিঘ্নে ক্রিমিয়া ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ব্যবসা বানিজ্য সম্প্রসারন করেন। নিজেদের সন্তানদেরকে তাঁরা উচ্চ শিক্ষার জন্য বুখারার বিখ্যাত মাদ্রাসায় পাঠাতে থাকেন। এমনকি তাতারদের পূর্ব পুরুষগণ যারা খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা আবার ইসলাম ধর্মে ফিরে আসেন। কিন্তু তাতারদের এ স্বাধীনতা প্রাপ্তি বেশী দিন স্থায়ী হয়নি।

সন্ধি ভঙ্গঃ ২য় ক্যাথরিন

পরিশেষে ক্রিমিয়ার খান শাহীন গিরাই এর সাথে তুর্কী সুলতানের মনোমালিন্যের সুযোগে সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ৯ই এপ্রিল জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিণ ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভূক্ত করে নেন। উক্ত ঘোষণায় তাতারদের ধর্মীয়, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার অক্ষুন্ন থাকার আশ্বাস দেয়া হলেও তা আদৌ কার্যকর হয়নি।

রুশদের অধীনে ক্রিমিয়া

বস্তুত রুশদের অধীনে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলিম জাতি গোষ্ঠীর পরবর্তী ইতিহাস বড়ই মর্মন্তুদ ও হৃদয়স্পর্শী। জারদের অনিয়ন্ত্রিত বর্বরতায় তাতারগণ সীমাহীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়নের শিকার হন এমনকি জোর পূর্বক তাতারদের ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়। নিজেদের সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ভিত্তি যখন বিধ্বস্ত হয়ে যায় তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও দু’লাখ পঞ্চাশ হাজার তাতার মুসলিম নারী-পুরুষ স্বদেশভূমি পরিত্যাগ করে তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নেন। শত নিগ্রহ ও নির্যাতন স্বত্ত্বেও যারা পৈত্রিক বাস্তুভিটা পরিত্যাগ করেনি তাদের উপর নেমে আসে পৈশাচিকতার খড়গ কৃপাণ।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ

১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে এতদঞ্চল সাময়িক ভাবে তুরস্ক ও ইংরেজদের অধীনে চলে যায়। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতি তাতার মুসলমানদের জন্য সৃষ্টি করে নতুন বিপদ। রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অপরাধে ক্রিমিয়ার তাতারদের অভিযুক্ত করা হয়। জার সন্ত্রাসীগোষ্ঠী জিঘাংসার উন্মত্ততায় নির্বিচারে ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও নিপীড়ন চালিয়ে তাতারদের নির্মূল প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে এ Ethning cleansing অভিযান।

ইতিহাসবিদ জি, হ্যান্বলী Central Asia শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে,
১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিমিয়ায় যেখানে তাতার মুসলমানদের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ, নির্মূল অভিযানের ফলে ১৯১৭ সালে সে সংখ্যা এসে দাঁড়ায় মাত্র এক লাখে।
সোভিয়েত সোশ্যালিষ্ট রিপাবলিক ইউনিয়নের (USSR) অন্তর্ভূক্ত

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে বলশেভিকগণ ক্রিমিয়াকে সোভিয়েত সোশ্যালিষ্ট রিপাবলিক ইউনিয়নের (USSR) অন্তর্ভূক্ত করে নেয়। ১৯২০ হতে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট সাত বছর স্বায়ত্বশাসিত প্রজাতন্ত্র হিসেবে ক্রিমিয়া পর্যাপ্ত স্বাধীনতা ভোগ করে। এমনকি রাশিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টি ও মিল্লি ফিরকা কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। তাতার ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয় এবং মুসলমানগণ সরকারী উচ্চপদে নিযুক্তি লাভ করেন। কিন্তু দূর্ভাগ্য ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানদের এ সৌভাগ্য বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে মস্কো সরকার তাতার জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নির্মূল করার জন্য পূর্বাপেক্ষা কঠোরতম পন্থায় আঘাত হানে। তাতার মুসলমানদের স্বাধীনভাবে বাঁচার স্বপ্নসাধ সাময়িকভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পূর্বে পুরো ক্রিমি য়ায় মসজিদের সংখ্যা ছিল ১৭৫০, বলশেভিক বিপ্লবের পর তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় মাত্র ১০০ তে।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ ও ষ্ট্যালিন

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় পুরো তাতার জনগোষ্ঠীকে ষ্ট্যালিন নাজী জার্মানীর দালাল হিসেবে অভিযুক্ত করে প্রতিশোধের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৪ সালে ষ্ট্যালিন সরকার ক্রিমিয়ান তাতারদের ভাষাকে সিরিলিক (Cyrillic) অক্ষরে পরিবর্র্তিত করে দেয়। রুশ বুদ্ধিজীবিদের মাধ্যমে ক্রিমিয়দের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে মুছে ফেলা হয়। পারিবারিক জীবনে, সামাজিক বন্ধনে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রচন্ডরূপে ধ্বস নামে। অতঃপর শুরু হয় তাতার মুসলমানদের পুনঃ উৎখাতের পালা। ষ্ট্যালিনের নির্দেশে তাতার মুসলমানদেরকে নিজ মাতৃভূমি ক্রিমিয়া হতে জোর করে বের করে দেয়া হয়। বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ, যুবা-বৃদ্ধ ও শিশু গণহত্যার শিকার হয়ে পড়ে। অধিকাংশ তাতার বাস্তু-ভিটা ও সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে সাইবেরিয়া ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিশেষত উযবেকিস্তানে উদ্বাস্তু রূপে আশ্রয় নেয়। তাতারগণ সোভিয়েত শাসনের প্রতি ‘অনুগত’ নয় ষ্ট্যালিনের এ যুক্তিই ছিল নির্বাসনের ভিত্তি। তিনি তাতারদের ‘অবিশ্বস্ত নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে,
৫০ হাজার থেকে এক লাখ তাতারকে ষ্ট্যালিন দেশ ত্যাগে বাধ্য করেন। বিপুল সংখ্যক তাতারের জীবন প্রদীপ নিভে যায় কারা অন্তরালে। তখনকার আদমশুমারী অনুযায়ী তাতার মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে।
ষষ্টদশ ও বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে জার রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রিমিয়ার জনগণের প্রতি দমন মূলক শাসন ও পক্ষপাতদুষ্ট আর্থ-সামাজিক নীতি গ্রহণ করেও ব্যাপকভাবে এ অঞ্চলকে রুশীয়করণ করতে ব্যর্থ হয়। অধিকাংশ জনগণ রুশ আত্নীকরণকে দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ইসলামী পরিচিতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইসলামী অনুশাসন প্রতিপালনের প্রতি দৃঢ়তার ফলে তাতার জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সামাজিক পরিমন্ডলে বসবাস করেও একটি ভারসাম্যপূর্ণ রীতি বজায় রাখতে সক্ষম হন। প্রবল বিপত্তি সত্ত্বেও মুসলমান পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকাকে তাতারগণ গৌরব মনে করেন।

ইতোমধ্যে আড়াই লাখ তাতার স্বদেশে ফিরে আসলেও বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। বাকীদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বাধাগ্রস্থ হয়। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে কিন্তু একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে ক্রিমিয়ার তাতারদের স্বাধীনতা তো দূরের কথা নিজ মাতৃভূমিতে তাদের প্রত্যাবাসনের কাজ টুকু পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি।

হে আল্লাহ! তুমি ক্রিমিয়ার মুসলমানদের রক্ষা কর। তাদের জন্যে একজন অলী নির্ধারন করে দাও। আমিন।
(সালাহুদ্দিনের ঘোড়া পেইজ থেকে সংগৃহীত)