লায়ন অফ দ্যা ডেজার্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইতালীয় ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী লিবিয়ার অবিসংবাদিত নেতা ওমর-আল-মুখতারের বীরত্বগাঁথা। ১৯৮১ সালে মুক্তি পাওয়া এই মুভিটি পরিচালনা করেছেন সিরিয়ান-আমেরিকান পরিচালক মুস্তফা আক্কাদ, যিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র আর্-রিসালাহ্ তথা দ্যা ম্যসেজের পরিচালক হিসেবেই বেশি পরিচিত। আর্-রিসালাতের মতোই এই মুভিটিও নির্মিত হয়েছে লিবীয় নেতা মুয়াম্মার-আল-গাদ্দাফীর অর্থায়নে। গাদ্দাফীর রেখে যাওয়া যে অল্প কয়েকটি কাজ বিদ্রোহীরা এখনও মুছে ফেলার চেষ্টা করছে না, তার মধ্যে এই মুভিটি অন্যতম।
ওমর-আল-মুখতার ছিলেন ঐতিহাসিক সেনুসী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। পেশায় তিনি ছিলেন মূলত মাদ্রাসার কুরআনের শিক্ষক। কিন্তু ১৯১১ সালে ইতালীয়রা লিবিয়া আক্রমণ করলে তা প্রতিরোধ করতে গিয়ে ধীরে ধীরে তিনিই হয়ে ওঠেন লিবিয়ার মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে অবিরত সত্য ও ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করে অবশেষে ১৯৩১ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর তিনি ইতালিয়ানদের হাতে আটক হন। মাত্র তিন দিনের মধ্যেই এক প্রহসনের বিচারে তড়িঘড়ি করে ১৬ই সেপ্টেম্বর ৭০ বছরের এই বৃদ্ধকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
মুভির কাহিনী শুরু হয় মূলত ১৯২৯ সাল থাকে, যখন ইতিলির ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনায়ক বেনিতো মুসোলিনি ওমর-আল-মুখতার তথা লিবিয়ান মুজাহিদীনদেরকে দমন করার জন্য কুখ্যাত জেনারেল গ্র্যাজিয়ানিকে লিবিয়াতে পাঠায়। গ্র্যাজিয়ানি তার সাথে করে নিয়ে আসে বিপুল সংখ্যক ট্যাংক, সাঁজোয়া যান এবং বোমারু বিমান, যার তুলনায় লিবিয়ান যোদ্ধাদের সংখ্যা এবং অস্ত্রশস্ত্র ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। গ্যাজিয়ানি পুরাো লিবিয়া জুড়ে বিশাল বিশাল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প স্থাপন করে। শুধুমাত্র ১৯২৯-৩০ সালেই এই সব ক্যাম্পের এক লক্ষ বন্দীর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
কনসেন্ট্রেশন ক্যম্পের বাইরের জীবনটা ছিল মূলত প্রতিরোধের জীবন। ওমর-আল-মুখতার এবং তার অনুসারী জিহাদী যোদ্ধারা কুফরা, সাবহা প্রভৃতি এলাকার পাহাড়ে-পর্বতে লুকিয়ে জীবন যাপন করতো এবং সুযোগ মতো বেরিয়ে এসে চোরাগুপ্তা হামলা করে আবার উধাও হয়ে যেতো। সাহারার বালির উপর দিয়ে ঘোড়ার ক্ষুর ছুটিয়ে ইতালিয়ান ব্যাটালিয়ানদেরকে নিজেদের পাতা অ্যমবুশে ফেলে দিত। পুরা মুভিটি জুড়েই এসব খন্ড খন্ড যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ওমর-আল-মুখতারের নেতৃত্বে লিবিয়ার যোদ্ধাদের গেরিলা ওয়ারফেয়ারের চিত্রগুলোই উঠে এসেছে। এর পাশাপাশি সমান ভাবে উঠে এসেছে ওমরের যোদ্ধা বেশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানবিক চেহারাটাও।
মুভিটিতে ওমর-আল-মুখতার চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন অস্কার জয়ী ইতালীয় অভিনেতা অ্যান্থনি কুইন। এই অ্যান্থনি কুইনই রিসালাহ্ চরিত্রে মহানবীর চাচা আমীর হামজা এবং লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া চলচ্চিত্রে উবায়দা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু ওমর চরিত্রে তার অভিনয় অন্য সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেছে। আমার দেখা কোন বাস্তব চরিত্রের অনুকরনে করা অভিনয়ের মধ্যে এটা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনয়। মুভিতে তার কথাবার্তা বলার স্টাইল, অঙ্গভঙ্গি, হাঁটা-চলার স্টাইল একেবারে পারফেক্ট লিবিয়ান বৃদ্ধদের মতো। এই মুভিটা ছোটবেলা থেকে প্রতি বছর লিবিয়ান রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল আল-জামাহিরিয়া থেকে দেখে নিয়মিত দেখানো হত। কিন্তু আমরা তো বটেই, অধিকাংশ লিবিয়ানও বুঝতে পারত না যে, এই অভিনেতা লিবিয়ান না! তার হাঁটা-চলা, কথা-বার্তার ভঙ্গির সাথে আমাদের বাড়িওয়ালা বুড়া সহ আর দশটা টিপিক্যাল লিবিয়ান বুড়ার বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই।
শুধুমাত্র মুভিটা গাদ্দাফীর টাকায় নির্মিত বলেই লাইম লাইটে আসতে পারে নি। হলিউড প্রডাকশন হলে নিঃসনদেহে এটা বেশ কিছু পুরস্কার পেয়ে যেত। অন্তত ওমর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অ্যান্থনি কুইন আর কিছু না হোক, অস্কারের নমিনেশন তো অবশ্যই পেত। অ্যান্থনি কুইন নিজেও এই চরিত্রটার প্রতি বেশ দুর্বল ছিলেন। এই মুভিতে ওমর চরিত্রটি করার জন্য তাকে সত্যিকারের ওমরের মতো দাড়ি রাখতে হয়েছিল। চরিত্রটা তার এতোই পছন্দ হয়েছিল যে, শ্যুটিং শেষ হওয়ার পরেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত তিনি ঐ স্টাইলেই দাড়ি রেখে দিয়েছিলেন।
মুভিটি নির্মাণে পরিচালক অথেন্টিসিটি রক্ষার জন্য বেশ কষ্ট করেছেন। মুভিটির শ্যুটিং হয়েছে লিবিয়ার বিভিন্ন স্থানে। বিশেষ করে যুদ্ধের দৃশ্যগুলো শ্যুট করা হয়েছে একেবারে সেই যুদ্ধগুলোর ঐতিহাসিক স্থানগুলোতেই। মুভিতে মুসোলিনির শেভ করার দৃশ্যে যেই ক্ষৌরকারকে দেখানো হয়, সে সত্যি সত্যিই মুসোলিনির ক্ষৌরকার ছিল। মুভিটিতে যুদ্ধের দৃশ্যগুলোতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আমলের যে প্রাচীন ট্যাংকগুলো দেখানো হয়, সেগুলো সত্যিই লিবিয়াতে ব্যবহৃত হয়েছিল। মুভিতে ব্যবহারের জন্য বিভিন্নদেশের জাদুঘর থেকে সেগুলো ধার করা হয়। মুভিটিতে কিছু যুদ্ধের দৃশ্যে এবং কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের এক্সট্রা চরিত্রে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ দেখা যায়, তারা মূলত লিবিয়ান আর্মির সদস্য। গাদ্দাফী এই মুভি নির্মানে সহযোগিতার জন্য লিবিয়ান আর্মির ৫০০০ সৈন্যকে নিযুক্ত করেন।
মুভিতে ইতালীয় জেনারেল গ্র্যাজিয়ানির সামনে ওমর-আল-মুখতারের মুখে একটা অসাধাণ ডায়লগ ছিল, “নাহনু লান্ নাসতালেম; নানসোর, আও নামূত”। অর্থাত্ We will never surrender, we’ll either win, or we’ll die.
মুভিটা মুক্তির পর থেকে দীর্ঘদিন ইতালিতে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সিলভিও বার্লুস্কোনির সাথে গাদ্দাফীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্র ধরে ২০০৯ সালে গাদ্দাফীর ইতালি সফরের সময় এই নিষাধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। ইতালি সফরের সময় গাদ্দাফী তার জামার বুকে ওমর-আল-মুখতারের শিকল বাঁধা গ্রেপ্তার হওয়া ছবিটা পরিধান করেন। ইতালির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্মিত হলেও আইএমডিবি সহ ইন্টারনেটে বিভিন্ন সাইটের রিভিউ এবং কমেন্ট থেকে বুঝা যায়, স্বয়ং ইতালিয়ানরাও এই মুভিটাকে পছন্দ করেছে। IMDBতে এই মুভির রেটিং 7.8। অবশ্য আমার ব্যক্তিগত রেটিং 8.5।
সংগৃহীত ও ঈষৎ পরিমারজিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন