শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আবু আবদুল্লাহ বিলাল তাঁর নাম।


আবু আবদুল্লাহ বিলাল তাঁর নাম। পিতা রাবাহ এবং মাতা হামামাহ। হাবশী বংশোদ্ভূত ক্রীতদাস। তবে মক্কায় জন্মলাভ করেছিলেন। বনু জুমাহ ছিল তাদের মনিব।

আরবের লোকেরা যখন আভিজাত্যের ও কৌলিণ্যের বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়ে হকের দাওয়াত অস্বীকার করে চলেছিল, তখনই তাঁর অন্তর ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। অল্প কিছু লোক দাওয়াতে হক কবুল করলেও যে সাত ব্যক্তি প্রকাশ্য ঘোষণার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে এ হাবশী গোলাম অন্যতম।

চিরকালই দুর্বলরা অত্যচার উৎপীড়নের শিকার হয়ে থাকে।বিলালের সামাজিক অবস্থানের কারণে তাঁর ওপর অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট নেমে আসে। শাস্তি ও যন্ত্রণার নানা রকম অনুশীলনের মাধ্যমে তাঁর সবর ও ইসতিকলালের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। গলায় উত্তপ্ত বালু, পাথরকুচি ও জ্বলন্ত অংগারের ওপর তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে, গলায় রশি বেঁধে ছাগলের মত শিশুরা মক্কার অলিতে গলিতে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে। তবুও তাওহীদের শক্ত রশি তিনি হাত ছাড়া করেননি। আবু জাহল তাঁকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে পিঠের ওপর পাথরের বড় চাক্কি রেখে দিত। মধ্যাহ্ন সূর্যের প্রচণ্ড খরতাপে তিনি যখন অস্থির হয়ে পড়তেন, আবু জাহল বলতোঃ ‘বিলাল, এখনো মুহাম্মাদের আল্লাহ থেকে ফিরে এসো।’ কিন্তু তখনো তার পবিত্র মুখ থেকে ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ ধ্বনি বের হতো।

অত্যাচারী মুশরিকদের মধ্যে উমাইয়্যা ইবন খালাফ ছিল সর্বাধিক উৎসাহী। সে শাস্তি ও যন্ত্রণার নিত্য নতুন কলা-কৌশল প্রয়োগ করতো। নানা রকম পদ্ধতিতে সে তাঁকে কষ্ট দিত। কখনো গরুর কাঁচা চামড়ায় তাঁকে ভরে, কখনো লোহার বর্ম পরিয়ে উত্তপ্ত রোগে বসিয়ে দিয়ে বলতোঃ ‘তোমার আল্লাহ লাত ও উয্‌যাহ’ কিন্তু তখনো এ তাওহীদ প্রেমিক লোকটির যবান থেকে ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ ছাড়া আর কোন বাক্য বের হতো না। মুশরিকরা বলতো, তুমি আমাদের কথিত শব্দগুলিই উচ্চারণ করো। তিনি বলতেনঃ ‘আমার যবান ঠিক মত তোমাদের শব্দগুলি উচ্চারণ করতে পারে না।’

হযরত বিলাল প্রথম ব্যক্তি, আযানের দায়িত্ব যাঁর ওপর অর্পিত হয়। বিলালের উচ্চ ও হৃদয়গ্রাহী আযান ধ্বনি শুনে নারী পুরুষ, কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে কেউ ঘরে স্থির থাকতে পারতো না। মসজিদে তাওহীদের ধারক-বাহকদের ভীড় জমে উঠলে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. দরজায় গিয়ে আওয়ায দিতেনঃ ‘হাইয়ালাস সালা, হাইয়ালাল ফালাহ, আস্‌সালাহ ইয়া রাসূলাল্লাহ- হে আল্লাহর রাসূল! নামায উপস্থিত।’ রাসূল সা. বেরিয়ে আসতেন, বিলাল তাকবীর দিতেন।

রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় অবস্থান বা সফরের সময়, উভয় অবস্থায় বিলাল ছিলেন তাঁর বিশেষ মুয়াজ্জিন। তিনি সিরিয়া অভিযানে অংশগ্রহণ করলেন। ১৬ হিজরী সনে হযরত উমারের সিরিয়া সফরকালে অন্যান্য সামরিক অফিসারদের সাথে বিলালও ‘জাবিয়া’ নামক স্থানে খলীফাকে স্বাগত জানান এবং ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ সফরে তিনি খলীফার সংগী হন। সফরের এক পর্যায়ে একদিন খলীফা বিলালকে অনুরোধ করলেন আযান দেওয়ার জন্য। বিলাল বললেনঃ ‘যদিও আমি অঙ্গীকার করেছি, রাসূলুল্লাহর সা. পর আর কারো জন্য আযান দিব না, তবে আজ আপনার ইচ্ছা পূরণ পূরণ করবো।’ এ কথা বলে তিনি এমন হৃদয়গ্রাহী আওয়াযে আযান দিলেন যে উপস্থিত জনতার মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিল। হযরত ’উমার এত কাঁদলেন যে তাঁর বাক রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। হযরত আবু ’উবাইদা ও হযরত মুয়ায বিন জাবাল রা. কান্নায় ভেংগে পড়েছিলেন। সবারই মনে তখন নবী-যুগের ছবি ভেসে উঠছিল, অন্তরে তখন এক বিশেষ অনুভূতি জেগে উঠেছিল।

দীর্ঘদিন যাবত হযরত বিলাল রা. সিরিয়ায় বসবাস করতে থাকেন। একদিন স্বপ্নে দেখলেনঃ রাসূল সা. বলছেনঃ ‘বিলাল, এমন নিরস জীবন আর কতকাল? আমার যিয়ারতের সময় কি তোমার এখনো হয়নি?’ এ স্বপ্ন তাঁর প্রেম ও ভালোবাসার ক্ষত আবার তাজা করে দিল। তখুনি তিনি মদীনা রওয়ানা হলেন এবং পবিত্র রওজা মুবারকে হাজির হয়ে জবাই করা মোরগের মত ছটফট করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহর সা. কলিজার টুকরা হযরত হাসান ও হুসাইনকে রা. জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকেন। তাঁরা দু’জন সে দিন সকালে ফজরের আযান দেওয়ার জন্য হযরত বিলালকে রা. অনুরোধ করেন। তাঁদের অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। সুবহে সাদিকের সময় মসজিদে নববীর ছাদে দাঁড়িয়ে তিনি ‘আল্লাহু আকবর’ বলছিলেন, আর সে ধ্বনি মদীনার অলিতে গলিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল। তাঁর সে আযান ধ্বনি শুনে মদীনার জনগণ তাকবীর ধ্বনি দিয়ে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছিল।

তিনি যখন ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলাল্লাহ’ বললেন, তখন মদীনার নারী-পুরুষ সকলের অস্থিরভাবে কাঁদতে কাদতে ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের দিকে দৌড়াতে শুরু করেন। বর্ণিত আছে, এমন ভাব-বিহ্বল দৃশ্য মদীনায় আর কখনো দেখা যায়নি। 

এ নিষ্ঠাবান রাসূলপ্রেমিক হিজরী ২০ সনে প্রায় ষাট বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। দিমাশকের ‘বাবুস সাগীরের’ কাছেই তাঁকে দাফন করা হয়।

চারিত্রিক সৌন্দর্য হযরত বিলালের রা. মর্যাদা ও সম্মানকে অত্যধিক বাড়িয়ে দিয়েছিল। হযরত উমার বলতেনঃ ‘আবু বকর আমাদের নেতা এবং তিনি আমাদের নেতা বিলালকে আযাদ করেছেন।’

মক্কায় যে অত্যাচার ও উৎপীড়ন হযরত বিলাল সহ্য করেছিলেন, তাদ্বারাই তাঁর সহ্যশক্তি, ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। কেউ তাঁর কোন গুণের কথা বললে বলতেনঃ ‘আমি তো শুধু একজন হাবশী, কাল পর্যন্তও যে দাস ছিল।’ সততা, নিষ্কলুষতা ও বিশ্বস্ততা ছিলো তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

হযরত বিলাল যেহেতু রাসূলুল্লাহর সা. বিশেষ মুয়ায্‌যিন ছিলেন এ কারণে অধিকাংশ সময় মসজিদেই কাটাতে হতো। রাত দিনের বেশী সময় ইবাদতে অতিবাহিত করতেন। একবার রাসূল সা. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার কোন্‌ ভালো কাজটির জন্য সবচেয়ে বেশী সাওয়াবের আশা করো? বললেনঃ ‘আমি তো এমন কোন ভালো কাজ করিনি। তবে প্রত্যেক অজুর পরে নামায আদায় করেছি।’

সহীহ ইবন খুযাইমা গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, একদিন রাসূল সা. বিলালকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেনঃ বিলাল, কিসের বদৌলতে তুমি আমার আগেই জান্নাতে পৌঁছে গেলে? গতরাতে আমি জান্নাতে প্রবেশ করে তোমার ‘খশ্‌খশা’ আওয়ায শুনতে পেলাম।’ বিলাল বললেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কোন গুনাহ করলেই দু’রাকায়াত নামায আদায় করি। আর অজু চলে গেলে তখনি আবার অজু করে আমি দু’রাকায়াত নামায আদায় করে থাকি।’

-- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – প্রথম খণ্ড (সংক্ষেপিত)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন