ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বাংলার সাথে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সুদূর অতীতকালে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব থেকে আরবরা এ উপমহাদেশে যাত্রা করে আসছে। হযরত ইউসূফের (আ.) আমল থেকেই এ উপমহাদেশের সাথে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক চালু ছিল। হযরত ঈসার (আ.) জন্মের কয়েক হাজার বছর পূর্ব থেকে ধনী আরবের সাবা সম্প্রদায়ের লোকেরা এ উপমহাদেশের উত্তর-পূর্ব এলাকায় পালতোলা জাহাজে করে যাতায়াত করতো। আবর থেকে চীনের মাঝ পথে তাদের কয়েকটি ঘাঁটি ছিল। প্রথম ঘাঁটি ছিল মালাবার। মালাবার উপকূল হয়ে আবরগণ চীনের পথে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতো।
আরবদের সামুদ্রিক বাণিজ্য প্রসার হওয়ার সাথে সাথে এ উপমহাদেশের উপকূল অঞ্চলে অবস্থিত প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর আশে পাশে আরবদের স্থায়ী উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। দণি ভারতের মালাবার, কালিকট, চেরর এবং চট্টগ্রাম ও আরাকান উপকূলে আরব জনগণের এরূপ বসতি কয়েক শতাব্দী পূর্বেই গড়ে উঠেছিল। আরবদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে দু’বার এসব উপনিবেশ নৌবহর নোঙর করতো। ফলে ইসলামের আগমণের সাথে সাথেই তা এদেশের জনগণের কাছে পৌছেছিল। কারণ ইসলামের আবির্ভাব তখন সমগ্র আরবে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এরূপ সাড়া জাগানো খবর বণিকদের মাধ্যমে এ উপমহাদেশে পৌঁছেনি এমনটি ধারণা করা অসঙ্গত বলে মনে হয়। এসময় রাসূলের (সা.) আবির্ভাব এবং তাঁর প্রচারিত ধর্ম ইসলামের কথা লোকমুখে এক চমকপ্রদ খবর হিসেবে প্রচারিত হতো বলে অনুমেয় হয়। এর প্রমাণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে একদিন গুজরাটের রাজা ভোজ তাঁর ইমারতের ছাদে ওঠেন এবং চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত দেখতে পান। এ রহস্য উদঘাটনের জন্য তিনি ব্রাহ্মণদের ডেকে পাঠান। তারা যোগ সাধানা করে বললেন-আরবদেশে এক মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি তাঁর ধর্মের সত্যতা প্রমাণের জন্য আঙ্গুলের ইশারায় এ অলৌকিক ঘটনা দেখিয়েছেন। রাজা হযরত মুহাম্মদের (সা.) কাছে দূত পাঠালেন ও সাথে একখানি পত্র দিলেন। তাতে লিখেন, হে মহামান্য! আপনার এমন একজন প্রতিনিধি আমাদের দেশে পাঠান, যিনি আমাদের আপনার সত্য ধর্ম শিক্ষা দিতে পারেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর জনৈক সাহাবীকে হিন্দে পাঠিয়ে দেন। তিনি রাজা ভোজকে ইসলামের বায়’য়াত করান। তাঁর নাম রাখেন ‘আব্দুল্লাহ। রাজার ধর্ম পরিবর্তনে প্রজারা বিদ্রোহী হয়ে উঠে। তারা রাজার পরিবর্তে রাজার ভাইকে সিংহাসনে বসায়। যে সাহাবী এসেছিলেন তিনি এদেশেই ইন্তিকাল করেন। তাঁর ও ‘আব্দুল্লাহর (রাজা ভোজ) মাজার গুজরাটের দারদা শহরেই রয়েছে।
অপর এক বর্ণনায় রতন আল-হিন্দ নামে এক লোক মহানবীর (সা) সমীপে গিয়ে সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন বলে জানা যায়। আরবে রাসূলুল্লাহর (সা.) ইসলাম প্রচারের কথা জানতে পেরে স্মরণদ্বীপের বাসিন্দারা রাসূলের (সা.) কাছে দূত পাঠান। এ দূত মদীনায় পৌঁছে হযরত ‘উমরের (রা.) খিলাফত কালে। হযরত ‘উমরের (রা.) সাথে তার সাাৎ হয়। তিনি কিছু কাল সেখানে অবস্থন করেন। তিনি ইসলাম ও ইসলামের নবী ও সাহাবীদের সম্পর্কে প্রত্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। দেশের ফেরার পথে ঐ দূত বেলুচিস্তানের কাছে মাকরান এলাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার সাথী স্মরণদ্বীপের কাছে তাদের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। এতে স্মরণদ্বীপের জনগণের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়। স্মরণদ্বীপের রাজাও এ সময় ইসলাম গ্রহণ করেন বলে জানা যায়।
রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবদ্দশায় তাঁর কয়েকজন সাহাবী ভারতের মালাবার উপকূলে আগমন করেন। সেখানে তাঁরা চেরুমল ও পেরুমল নামক হিন্দু রাজার সাাৎ করেন। এ রাজা ইসলাম গ্রহণ করেন। রাজা শরীফ ইব্ন মালিক নামক একজন আরবীয় মুসলিমকে ভূমি প্রদান করেন ও ইসলাম প্রচারের অনুমতি দেন। আরবীয় বণিকগণ সমগ্র মালাবার উপকূলে ও দাণিাত্যে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। মালাবারের ইসলাম প্রচারকারী মুহাজিরগণ মোপলা নামে পরিচিত।
ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, চেরর রাজ্যের শেষ রাজা চেরুমল ইচ্ছাপূর্বক সিংহাসন ত্যাগ করে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করার অভিলাষে মক্কা নগরীতে গমন করে রাসূলের (সা.) সান্নিধ্যে হাজির হন। তাঁর নিকট ইসলামের বায়‘আত গ্রহণ করেন। মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময রাজা আল্লাহ্র নবীর জন্য আদা ও এদেশে তৈরি একটি তরবারীসহ কিছু মূল্যবান উপহার সামগ্রী সঙ্গে করে নেন। নবী করীম (সা.) সেই আদা নিজে খান এবং সাহাবীদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। সেই সময় থেকেই স্থানীয় মুসলিম ও অমুসলিমগণ এ ধারণা পোষণ করতো যে, রাজা কিছুকাল রাসূলের (সা.) সান্নিধ্যে অবস্থান করেন। পরে দেশে ফেরার পথে শহর নামক স্থানে ইন্তিকাল করেন।
--লিখেছেন ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন