সোমবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

ওয়াক্তিয়া ফরজের মতো ওমরি কাযাও ফরজ শুধু তাওবা যথেষ্ট নয় ( মুফতি মুহিউদ্দিন কাসেমি )

এ বিষয়ে বিভিন্ন বই-পুস্তকে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রয়েছে। সবগুলোই উপকারী। আমিও ভাঙাচোরা ও অবিন্যস্ত একটাকিছু দাঁড় করাতে চেয়েছি; কেমন হয়েছে তা পাঠকই বিবেচনা করবে। অন্যের ফায়েদা নয়, আমার উপকারের জন্যেই লিখেছি। তবুও কারো-না-কারো দরকার হতে পারে। একটু ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে।]
.
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সালাত বা নামায। সালাত আরবি শব্দ আর নামায হচ্ছে ফার্সি। অনেক নামায একসঙ্গে কাযা হয়ে গেলে সাধারণের পরিভাষায় এটাকে ‘ওমরি কাযা বলে।’ আর ফিকহের পরিভাষায় قضاء الفوائت বলা হয়। 
নামাযের গুরুত্ব কুরআন-হাদিস দ্বারা সকলের কাছেই প্রমাণিত। হাদিসে নামায পরিত্যাগকারীকে কাফেরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ফরজ নামাযের সংখ্যা পাঁচ : ফজর, জোহর, আসর, মাগরিব, ইশা। আর বিতরের নামায ওয়াজিব। এইসব নামাযের নির্দিষ্ট ওয়াক্ত বা সময় রয়েছে। সময়ের ভেতর নামায আদায় করা ফরজ। তবে কোনো কারণবশত সময়মতো নামায পড়তে না পারলে সময়ের পরেও তা ফরজই থাকে, ফরজ রহিত হয়ে যায় না। নির্ধারিত সময়ে নামায পড়াকে ‘আদা’ বলা হয়। 
নামায নির্ধারিত ওয়াক্তের মধ্যে না পড়ে পরবর্তী সময়ে পড়লে ‘কাযা’ বলা হয়। কুরআন হাদিসে যেমন যথাসময়ে নামায আদায়ের আদেশ দেওয়া হয়েছে, তেমনি সময়মতো আদায় না হলে তা পরে পড়ারও তাগিদ করা হয়েছে। তাই যুগ যুগ ধরে মুহাদ্দিস ও ফকিহগণ এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। মাসআলাটি এত প্রসিদ্ধ যে, সাধারণ মুসলিম সমাজও এ সম্পর্কে অবগত। কিন্তু ইদানীং এ নিয়ে নতুন এক বিভ্রান্তির সূচনা হয়েছে। 
তাদের দাবি হচ্ছে, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ নামায ছেড়ে দিলে কাযা করতে হবে না। তাওবা করলেই মাফ হয়ে যাবে। তবে ঘুমের কারণে ও ভুলবশত নামায ছুটে গেলে কাযা করা আবশ্যক।’ বাস্তবে কি তাই? আমরা সংক্ষিপ্তভাবে বিষয়টি আলোকপাত করব- ইনশাল্লাহ।

হাদিস শরিফে কাযার নীতি :
নামায ব্যতীত আরো কিছু ইবাদতের নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। সময়ের ভেতরে তা পালন করতে না পারলে পরবর্তীতে আদায় করা আবশ্যক। যেমন রোযা ও হজ। নির্ধারিত সময়ে নামায/রোযা/হজ আদায় করতে না পারলে পরবর্তীতে কাযা করে নেওয়া আবশ্যক। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার ও সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন। দুয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক :

১. 
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ - رضى الله عنه - قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ هَلَكْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ « وَمَا أَهْلَكَكَ ». قَالَ وَقَعْتُ عَلَى امْرَأَتِى فِى رَمَضَانَ. قَالَ « هَلْ تَجِدُ مَا تُعْتِقُ رَقَبَةً ». قَالَ لاَ. قَالَ « فَهَلْ تَسْتَطِيعُ أَنْ تَصُومَ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ ». قَالَ لاَ. قَالَ « فَهَلْ تَجِدُ مَا تُطْعِمُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ». قَالَ لاَ - قَالَ - ثُمَّ جَلَسَ فَأُتِىَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- بِعَرَقٍ فِيهِ تَمْرٌ. فَقَالَ « تَصَدَّقْ بِهَذَا ». قَالَ أَفْقَرَ مِنَّا فَمَا بَيْنَ لاَبَتَيْهَا أَهْلُ بَيْتٍ أَحْوَجُ إِلَيْهِ مِنَّا. فَضَحِكَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- حَتَّى بَدَتْ أَنْيَابُهُ ثُمَّ قَالَ « اذْهَبْ فَأَطْعِمْهُ أَهْلَكَ ».
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, একব্যক্তি রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলতে লাগল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি ধ্বংস হয়ে গেছি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, কী কারণে তুমি ধ্বংস হয়েছ? সে বলল, আমি রমজান মাসে আমার স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করে ফেলেছি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি একটি গোলাম আজাদ করতে পারবে? সে বলল, না। রাসুল সা. বললেন, তুমি দুই মাস লাগাতার রোযা রাখতে পারবে? সে বলল, না। রাসুল সা. বললেন, ষাটজন মিসকিন খাওয়াতে পারবে? সে বলল, তাও পারব না। অতঃপর সে বসে রইল। ইতোমধ্যে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট খেজুরভর্তি ঝুড়ি (হাদিয়া বা দান) আসল। রাসুল সা. তাকে বললেন, তুমি এই খেজুর নিয়ে সদকা করে দাও। সে বলল, হুজুর! মদিনার দুই উপত্যকার মাঝে আমার চেয়ে গরিব ও অভাবগ্রস্ত কোনো পরিবার নেই। এ কথা শুনে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে দিলেন; ফলে হুজুরের দাঁত মোবারক দেখা গেল। এরপর রাসুল সা. তাকে বললেন, খেজুর নিয়ে তোমার পরিবারকে খাইয়ে দাও। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ১৮৩৪, ১৮৩৫, ৫০৫৩; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ২৬৫১)। 
এটি অত্যন্ত শক্তিশালী সহিহ হাদিস। এর দ্বারা প্রমাণিত হল, ইচ্ছাকৃতভাবে রোযা নষ্ট করার কারণে রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই ব্যক্তিকে রোযা কাযা করতে বললেন কেন? তাওবা করার কথা বলেননি কেন? সুতরাং ইচ্ছাকৃতভাবে রোযা নষ্ট করার কারণে যেমন কাযা আবশ্যক তদ্রƒপ ইচ্ছাকৃতভাবে নামায পরিত্যাগ করলেও কাযা আবশ্যক।

২.
أَنَّ اِمْرَأَةً مِنْ جُهَيْنَةَ جَاءَتْ إِلَى اَلنَّبِيِّ - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَتْ: إِنَّ أُمِّي نَذَرَتْ أَنْ تَحُجَّ, فَلَمْ تَحُجَّ حَتَّى مَاتَتْ, أَفَأَحُجُّ عَنْهَا? قَالَ: " نَعَمْ ", حُجِّي عَنْهَا, أَرَأَيْتِ لَوْ كَانَ عَلَى أُمِّكِ دَيْنٌ, أَكُنْتِ قَاضِيَتَهُ? اِقْضُوا اَللَّهَ, فَاَللَّهُ أَحَقُّ بِالْوَفَاءِ
হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল, আমার মা হজের মান্নত করেছিলেন। কিন্তু তা আদায় করার আগেই তিনি মারা গেছেন। এখন আমার করণীয় কী? আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় কর। বল তো, তোমার মায়ের কোনো ঋণ থাকলে তুমি কি তা পরিশোধ করতে না? মহিলাটি বলল, হ্যাঁ করতাম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে তোমরা আল্লাহর ঋণও পরিশোধ কর। কারণ, তিনি তাঁর প্রাপ্য পাওয়ার অধিক উপযুক্ত। (সহিহ বুখারি, ১/২৪৯-২৫০। সুনানে নাসায়ি ২/২)

.৩
আরেকটি হাদিসে এসেছে : 
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ : أَنَّ امْرَأَةً جَاءَتْ إِلَى النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَتْ : إِنَّهُ كَانَ عَلَى أُمِّهَا صَوْمُ شَهْرٍ أَفَأَقْضِيهِ عَنْهَا فَقَالَ : « لَوْ كَانَ عَلَى أُمِّكِ دَيْنٌ أَكُنْتِ قَاضِيَتَهُ ». قَالَتْ : نَعَمْ. قَالَ : « فَدَيْنُ اللَّهِ أَحَقُّ أَنْ يُقْضَى ».
১৮৫. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন : এক মহিলা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, আমার মায়ের ওপর একমাসের রোযা ফরজ রয়ে গেছে, আমি কি তার পক্ষ থেকে কাযা করে দেব? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার মায়ের ওপর কোনো ঋণ থাকলে তুমি তা পরিশোধ করতে কি-না? সে বলল, হ্যাঁ করতাম। রাসুল বললেন : তাহলে আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করা অধিক উপযুক্ত। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং- ৩৩১২; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ২৭৪৯)। 
৪.
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أَبِي مَاتَ وَلَمْ يَحُجَّ أَفَأَحُجُّ عَنْهُ قَالَ أَرَأَيْتَ لَوْ كَانَ عَلَى أَبِيكَ دَيْنٌ أَكُنْتَ قَاضِيَهُ قَالَ نَعَمْ قَالَ فَدَيْنُ اللَّهِ أَحَقُّ
১৮৬. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একব্যক্তি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল : হে আল্লাহর রাসুল! আমার পিতা মারা গেছেন। কিন্তু তিনি হজ করতে পারেন নি। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ করতে পারি? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার পিতার কোনো ঋণ থাকলে তুমি কি তা পরিশোধ করতে না? লোকটি বলল, হ্যাঁ। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর ঋণ তো অধিক আদায়যোগ্য। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস নং- ২৬৩৯; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং- ১৫৩৫১)।

উপর্যুক্ত বর্ণনাসমূহে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীÑ اِقْضُوا اَللَّهَ ‘তোমরা আল্লাহর ঋণ পরিশোধ কর’ এবং فَدَيْنُ اللَّهِ أَحَقُّ ‘আল্লাহর ঋণ আদায়ের অধিক উপযুক্ত’ এসব থেকে স্পষ্ট জানা যাচ্ছে, যে ইবাদাত বান্দার ওপর ফরজ বা অবশ্যকর্তব্য, তা থেকে দায়মুক্তির পথ হল তা আদায় করা। নির্ধারিত সময় পার হওয়ার দ্বারা যেমন মানুষের ঋণ থেকে দায়মুক্ত হওয়া যায় না, তেমনি আল্লাহর ঋণ থেকেও দায়মুক্ত হওয়া যায় না।
অন্যান্য ইবাদতের মতো শরিয়তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাযের ক্ষেত্রেও এই মূলনীতি প্রযোজ্য। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও কর্ম এবং সাহাবায়ে কেরামের ‘আছার’ এই প্রমাণই বহন করে। নমুনাস্বরূপ কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিচে দেওয়া গেল :
১. 
একরাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিগণকে নিয়ে সফর করছিলেন। শেষরাতে তাঁরা বিশ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রাবিরতি করলেন এবং হযরত বিলাল রা. -কে ফজরের নামাযের জন্য জাগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। এ দিকে বিলাল রা. এর চোখও লেগে গেল আর এতে করে সবার নামাযই কাযা হয়ে গেল। ঘুম থেকে জাগার পর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে নিয়ে ফজরের নামায পড়লেন। এরপর বললেন, ঘুম বা বিস্মৃতির কারণে যার নামায ছুটে গেল, যখন সে জাগ্রত হবে তখন যেন তা আদায় করে নেয়। হাদিস ও ফিকহের কিতাবে এই রাতটি ليلة التعريس –واقعة التعريس যাত্রাবিরতির রাত এবং এই ঘটনাটি যাত্রাবিরতির ঘটনা নামে পরিচিত। প্রসিদ্ধ সকল হাদিসগ্রন্থেই ঘটনাটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এর অন্যতম বর্ণনাকারী হযরত ইবনে আব্বাস রা. ঘটনাটি বর্ণনা করার পর বলেন, ‘সেই দুই রাকাত নামায (যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাযা হিসেবে আদায় করেছিলেন) আমার কাছে গোটা দুনিয়া থেকে বেশি প্রিয়। (সুনানে বায়হাকি, হাদিস নং- ২৯৯১; মুসনাদে আহমদ ৪/১৮১; হাদিস নং ২৩৪৯।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর খুশির কারণ হল, এই ঘটনার মাধ্যমে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিগণের সামনে এ মূলনীতি স্পষ্ট হল, নামায নির্ধারিত সময়ে আদায়যোগ্য ইবাদাত হলেও যদি তা সময়মত আদায় করা না হয়, তবে পরে হলেও আদায় করতে হবে। (আলইসতিযকার ১/৩০০)
উল্লেখ্য, আমাদের জীবনের সমস্ত ঘটনা ও সমস্যার হুবহু উত্তর হাদিসে পাওয়া যাবে না। দেখুন, আমরা লাগাতার নামায ছেড়ে দিই; কিন্তু রাসুল ও সাহাবিদের যুগে কেউ দুয়েক ওয়াক্ত নামায ইচ্ছাকৃত ছেড়ে দিয়েছে এমন কোনো নজির পাওয়া অসম্ভব। তখন মুনাফিকরাও নামায ছাড়ার সাহস পেত না। কেবল প্রকাশ্য কাফেরগণ নামায পড়ত না। তাই ভুলবশত এক/দুই ওয়াক্ত নামায ছেড়ে দেওয়ার পর যেহেতু রাসুল সা. ও সাহাবায়ে কেরাম কাযা পড়েছেন, এর দ্বারাই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, অনেক ওয়াক্ত নামায ছুটে গেলেও কাযা করা আবশ্যক।
আপনার কাছে উদাহরণত পাঁচ টাকা পেলে দিতে হবে; আর পাঁচ লাখ টাকা পেলে দিতে হবে নাÑ এমন কোনো কথা আছে? 
২. 
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ جَعَلَ عُمَرُ يَوْمَ الْخَنْدَقِ يَسُبُّ كُفَّارَهُمْ وَقَالَ مَا كِدْتُ أُصَلِّي الْعَصْرَ حَتَّى غَرَبَتْ قَالَ فَنَزَلْنَا بُطْحَانَ فَصَلَّى بَعْدَ مَا غَرَبَتْ الشَّمْسُ ثُمَّ صَلَّى الْمَغْرِبَ
১৮৭. হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খন্দকের যুদ্ধের দিন ওমর রা. কাফেরদেরকে গালি দিচ্ছিলেন এবং বলছিলেন- আমি আসর পড়তে পড়তেই সূর্য ডুবে যাচ্ছিল। তিনি আরো বলেন, আমরা তখন বুতহান নামক স্থানে অবতরণ করলাম। তিনি সেখানে সূর্য ডুবার পর আসরের নামায আদায় করলেন। এরপর মাগরিব আদায় করলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৫৭৩; সহিহ মুসলিম ১/২২৬)।

৩. 
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ : نَادَى فِينَا رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَوْمَ انْصَرَفَ مِنَ الأَحْزَابِ أَلاَ لاَ يُصَلِّيَنَّ أَحَدٌ الظُّهْرَ إِلاَّ فِى بَنِى قُرَيْظَةَ قَالَ فَتَخَوَّفَ نَاسٌ فَوْتَ الْوَقْتِ فَصَلُّوا دُونَ بَنِى قُرَيْظَةَ وَقَالَ آخَرُونَ لاَ نُصَلِّى إِلاَّ حَيْثُ أَمَرَنَا رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَإِنْ فَاتَنَا الْوَقْتُ قَالَ فَمَا عَنَّفَ وَاحِدًا مِنَ الْفَرِيقَيْنِ.
হযরত আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফেরার দিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিদের বললেন, তোমাদের কেউ যেন বনি কুরাইযায় না পৌঁছে আসরের নামায না পড়ে। অর্থাৎ বনি কুরাইযায় গিয়ে আসরের নামায পড়বে। 
সাহাবায়ে কেরাম রওয়ানা হলেন। পথে আছরের নামাযের সময় অতিবাহিত হওয়ার উপক্রম হলে কয়েকজন সাহাবি পথেই আছর পড়লেন। আর কয়েকজন বনি কুরাইযায় পৌঁছে সময়ের পর আসরের নামায কাযা পড়লেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকেই তিরস্কার করেননি। (সহিহ বুখারি, ১/১২৯; ২/৫৯০; সহিহ মুসলিম ২/ ৯৬; সুনানে কুবরা লিলবায়হাকি, হাদিস নং- ২০৮৬৯)।

লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে ঘটনা পেশ করা হলে তিনি কাযা আদায়কারী সাহাবিদের একথা বলেন নি যে, নামায শুধু নির্ধারিত সময়েই পড়া যায, সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তা আর পড়া যায় না কিংবা পড়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। 
এসব দৃষ্টান্তের বিপরীতে একটি হাদিস বা সাহাবির বক্তব্যেও একথা বলা হয় নি যে, নির্ধারিত সময়ে পড়া না হলে তা আর পড়তে হবে না, বরং শুধু ইস্তেগফার করাই যথেষ্ট। অতএব এটা স্পষ্ট যে, কারো ওপর যে নামায ফরজ রয়েছে তা আদায় করা ছাড়া দায়মুক্তির কোনো উপায় নেই। শরিয়তসম্মত ওজরের কারণে কাযা হলেও এই বিধান। আর যদি শরিয়তসম্মত ওজর ছাড়া -আল্লাহ না করুন- শুধু অবহেলাবশত নামায ত্যাগ করা হয় তাহলে তা কত মারাত্মক অপরাধ তা বলাবাহুল্য। এক্ষেত্রে ওই নামাযটি আদায় করার পাশাপাশি ইচ্ছাকৃতভাবে নামায নির্ধারিত সময় থেকে বিলম্বিত করার অপরাধে অনুতপ্ত হৃদয়ে আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্ষমাপ্রার্থনা করাও জরুরি। এটি হাদিস শরিফের সুস্পষ্ট মূলনীতি এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্ম, বাণী ও সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত। 
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « إِذَا رَقَدَ أَحَدُكُمْ عَنِ الصَّلاَةِ أَوْ غَفَلَ عَنْهَا فَلْيُصَلِّهَا إِذَا ذَكَرَهَا فَإِنَّ اللَّهَ يَقُولُ أَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِى ». 
আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ নামাযের সময় ঘুমন্ত থাকে কিংবা নামাযের সময় নামাযের কথা ভুলে যায় তাহলে যখন তার স্মরণে আসবে তখনই সে নামায আদায় করে নেবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, তুমি নামায আদায় কর আমাকে স্মরণ করার সময়। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৬০১)।
عَنْ نَافِعِ بْنِ جُبَيْرٍ عَنْ أَبِى عُبَيْدَةَ قَالَ قَالَ عَبْدُ اللَّهِ : إِنَّ الْمُشْرِكِينَ شَغَلُوا النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- عَنْ أَرْبَعِ صَلَوَاتٍ يَوْمَ الْخَنْدَقِ حَتَّى ذَهَبَ مِنَ اللَّيْلِ مَا شَاءَ اللَّهُ ، فَأَمَرَ بِلاَلاً فَأَذَّنَ وَأَقَامَ ، فَصَلَّى الظُّهْرَ ، ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الْعَصْرَ ، ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الْمَغْرِبَ ، ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الْعِشَاءَ. الِاكْتِفَاءُ بِالْإِقَامَةِ لِكُلِّ صَلَاةٍ
আবু উবায়দা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, খন্দকের যুদ্ধে মুশরিকরা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চার ওয়াক্ত নামায কাযা করে দিয়েছিল। এরপর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলাল রা. -কে আযান দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি ইকামাত দিলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোহরের নামায আদায় করলেন। এরপর বিলাল আবার ইকামাত দিলেন নবীজি আসরের নামায আদায় করলেন। এরপর আবার তিনি ইকামাত দিলেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশার নামায পড়ালেন। অর্থাৎ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাযা হয়ে যাওয়া প্রত্যেক নামাযের জন্য প্রতিবার আযান না দিয়ে শুধু ইকামাতের ওপর ক্ষান্ত দিয়েছেন। (সুনানে কুবরা লিলবায়হাকি, হাদিস নং- ১৯৬৭; সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং- ১৬২৬)।

ইজমায়ে উম্মত : 
এ প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল ইজমা। মুসলিম উম্মাহর সকল মুজতাহিদ ইমাম একমত যে, ফরজ নামাজ নির্ধারিত সময়ে আদায় না করলে পরে তা কাযা করতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করুক বা ওজরবশত। এ ব্যাপারে সকল পথ ও মতের ইমামগণ একমত পোষণ করেছেন। আল-মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহর মধ্যে রয়েছে : 
قَال عِيَاضٌ : وَلاَ يَصِحُّ عِنْدَ أَحَدٍ سِوَى دَاوُدَ وَابْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الشَّافِعِيِّ
অর্থাৎ কাজী ইয়ায বলেন, দাউদ ও ইবনে আবদুর রহমান ব্যতীত আর কেউই ইচ্ছাকৃত নামায ছেড়ে দিলে কাযা না করার কথা বলেন না। সবাই কাযা করার কথা বলেন। (খ. ৩৪, পৃ. ২৭)
ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন : বিনা ওজরে কাযা হয়ে যাওয়া ফরজ নামাযের কাযা আদায় করা অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে শরিয়তের অকাট্য দলিল-প্রমাণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন :
নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে ফরয নামায ফরয রোযার মতো কাযা আদায় করতে হবে। এ বিষয়ে দলিল হিসেবে যদিও উম্মতের ইজমাই যথেষ্ট, যার অনুসরণ করা ওই সব শায (তথা সিরাতে মুসতাকিম থেকে বিচ্যুত) মতের প্রবক্তাদের জন্যও অপরিহার্য ছিল, তারপরও কিছু দলিল উল্লেখ করা হল। যথা : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী...( আলইসতিযকার১/৩০২-৩০৩)

কাযা নামায আদায় করাও তাওবার অংশ : 
একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার হক নষ্ট করা হলে শুধু অনুতপ্ত হওয়া ও ইস্তিগফার করা যথেষ্ট নয়; বরং হকদারের পাওনা আদায় করাও তাওবার অংশ। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক সহিহ হাদিসে আল্লাহর হক কে বান্দার হকের সাথে তুলনা করে বলেছেন : دَيْنُ اللَّهِ أَحَقُّ أَنْ يُقْضَى ‘আল্লাহর হক নষ্ট হলে তা আদায় করা বান্দার হকের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।’ অতএব, আলোচ্য মাসআলায় নামাযের কাযা আদায় করা তাওবারই নামান্তর । কৃতকর্মের ওপর অনুতপ্ত হওয়া, আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা, আগামীতে নামায না ছাড়ার বিষয়ে দৃঢ়সংকল্প হওয়া এবং ছুটেযাওয়া নামাযসমূহ আদায় করা- এই সবকিছু মিলেই তাওবা পূর্ণ হবে। শরিয়তের দলিলসমূহ থেকে তাই প্রমাণিত হয় এবং এ ব্যাপারে উম্মতের ইজমাও রয়েছে। মালেকি মাযহাবের বিখ্যাত ফকিহ ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করেন :
وأجمعوا على أن على العاصي أن يتوب من ذنبه بالندم عليه واعتقاد ترك العودة إليه قال الله تعالى ^ وتوبوا إلى الله جميعا ... المؤمنون لعلكم تفلحون ( النور ৩১(
ومن لزمه حق لله أو لعباده لزمه الخروج منه 
وقد شبه عليه السلام حق الله تعالى بحقوق الآدميين وقال ( ( دين الله أحق أن يقضى ) ) 
“ওলামায়ে কেরাম একমত যে, পাপীর জন্যে আবশ্যক হচ্ছে স্বীয় পাপ থেকে তাওবা করবেÑ ওই কাজের ওপর লজ্জিত হয়ে এবং এই সঙ্কল্পের সাথে যে, ওই পাপ আর করবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর... সূরা নূর-৩১।
যে ব্যক্তির ওপর আল্লাহর কিংবা মানুষের হক রয়েছে তা আদায় করা আবশ্যক। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর হক ও অধিকারকে মানুষের অধিকারের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন : دَيْنُ اللَّهِ أَحَقُّ أَنْ يُقْضَى : আল্লাহর হক আদায় করা অধিক উপযুক্ত।”

সুতরাং ভুলবশত নামায পরিত্যাগকারীর নামায কাযা করতে হবে আর ইচ্ছাকৃতভাবে নামায পরিত্যাগকারীর ওপর কাযা না করে কেবল তাওবা করলেই যথেষ্ট হবে- এই মতবাদটি কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমার আলোকে সঠিক নয়। একটি ভ্রান্ত মতবাদ। বর্তমানের তথাকথিত আহলে হাদিস যেসব পূর্বসূরিদের দোহাই দেয় তাদের কেউই এ মতকে সমর্থন করেন না। 
প্রসঙ্গত আহলে হাদিসের কিছু বিষয়ে শক্তিশালী দলিল-প্রমাণ রয়েছে। যেমন রফউল ইয়াদাইন, আমিন জোরে বলা ইত্যাদি। এসব বিষয়ে হানাফিদেরও বাড়াবাড়ি নেই। কারণ, হানাফি মাযহাবমতে রফউল ইয়াদাইন না করা উত্তম, করা জায়েয়। কেউ রফউল ইয়াদাইন করলে নামাযের ক্ষতি হবে না। তদ্রƒপ হানাফিদের মতে আমিন আস্তে বলা উত্তম, জোরে বলা জায়েয়। কেউ আমিন জোরে বললে নামাযের কোনো সমস্যা হবে না। অর্থাৎ মতবিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোর অধিকাংশ উত্তম-অনুত্তম নিয়ে। এবং উভয় পক্ষেরই দলিল রয়েছে।
কিন্তু নামায পরিত্যাগ করলে কাযা করতে হবে না- এই মতবাদটি সম্পূর্ণ ভুয়া, দলিলবিহীন। কুরআন-সুন্নাহ, ইজমায়ে উম্মত এবং উম্মতের ধারাবাহিক আমলের বিরোধী। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন