বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

এভিয়েশনের অগ্রদূত


উসমানী খিলাফতের বিরুদ্ধে সবসময় যে ভূল অভিযোগটি করা হয়, তা হলো উসমানী খিলাফতের সময় মুসলিম সভ্যতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো উন্নতি হয় নি । ওরিয়েন্টালিস্ট ঐতিহাসিকগন দাবি করেন উসমানী শাসকগন ধর্ম ও বিজ্ঞানকে সবসময় আলাদা করে দেখেছেন, যা পূর্ববর্তী মুসলিম শাসকগন কখনোই করেন নি । কিছু ক্ষেত্রে এবং শুধু মাত্র কিছু সময়ের জন্য তাদের এ অভিযোগ সত্য হলেও , ইতিহাস ঘাটলে আমরা উসমানী সাম্রাজ্যের অসংখ্য বৈজ্ঞানিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নিদর্শন দেখতে পাবো । এসব কাজের ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ১৬০০ সালের দিকে ইস্তাম্বুলে (বর্তমানে তুরস্ক) দুইভাইয়ের আকাশে ওড়ার প্রচেষ্টা । 
“মানুষেরও ওড়ার ক্ষমতা আছে”, সম্ভবত এ ধারনাটাই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে আকর্ষনীয় অভিপ্রায় । বিগত হাজার বছর ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তের অসংখ্য মানুষ চেষ্টা করেছে পৃথিবীর আকর্ষন বলকে তুচ্ছ করে পাখির মত আকাশে ডানা মেলার । নবম শতাব্দীতে আব্বাস ইবনে ফিরনাস নামক একজন স্প্যানিশ মুসলিম বিজ্ঞানী কর্ডোভাতে একটি ইঞ্জিনবিহীন গ্লাইডারের ডিজাইন করে তা বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন । তিনি এ কাজে পাখির পালক দ্বারা আবৃত ডানা ব্যবহার করেছিলেন । তার ওড়ার এ প্রচেষ্টা সফল হয়েছিলো, এবং তিনি কিছুক্ষন ওড়তে সক্ষম হন । তবে দূর্ঘটনাবশত ল্যান্ডিং-এর সময় ক্র্যাশ করেন । পরবর্তীতে তিনি এ সেক্টরে কাজের উৎসাহ হাড়িয়ে ফেলেন । 

আব্বাস ইবনে ফিরনাসের ব্যর্থতার পর, ১৬০০ সালের দিকে হেজারাফেন আহমেদ সেলেবী (Hezarafen Ahmed Celebi) নামের আরেকজন সাহসী ব্যাক্তি এ কাজে চেষ্টা চালান এবং সফলতা অর্জন করেন । হেজারাফেন আহমেদ সেলেবী বিভিন্ন জ্ঞানে অভিজ্ঞ একজন মানুষ ছিলেন । উসমানী খিলাফতের স্বর্ণযুগে তিনি ইস্তাম্বুলে বসবাস করতেন । ১৬৩০ সালে তিনি নিজের শরীরের সাথে যুক্ত করতে সক্ষম এমন একজোড়া পাখার ডিজাইন করেন । 
উসমানী ইতিহাসবিদ এবং পরিব্রাজক এভলিয়া সেলেবীর তথ্যানুসারে, হেজারাফেন আহমেদ সেলেবী তার পাখাসহ ইস্তাম্বুলের গালাটা টাওয়ার থেকে লাফ দেন এবং বসফরাস অতিক্রম করে সোজা ডোগানসিলার স্কয়ারে (Dogancilar Square) অবতরন করেন । তার যাত্রাপথ প্রায় দুই মাইলের মত ছিলো । উচু টাওয়ার এবং টাওয়ারটি পাহাড়ের ওপর হওয়ার কারনে তিনি এ দূরত্ব অতিক্রম করার মত উচ্চতা অর্জন করতে পেরেছিলেন, যা তাকে সফলভাবে বসফরাস অতিক্রম করতে সহায়তা করেছিলো ।
বসফরাস প্রনালীটি ইস্তাম্বুলকে দুটি ভাগে ভাগ করেছে । এর একভাগ পরেছে এশিয়া মহাদেশে, অন্যভাগ ইউরোপে । তাই হেজারাফেন আহমেদ সেলেবীকে পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বপ্রথম আন্তঃমহাদেশীয় উড্ডয়নে সক্ষম মানব হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে । হেজারাফেন তার এ গৌরবময় কাজের জন্য সুলতান চতুর্থ মুরাদের নিকট হতে স্বর্নমুদ্রা দ্বারা পুরস্কৃত হন । পরবর্তীতে সুলতানের সভাসদরা সুলতানকে বোঝান যে, হেজারাফেন আহমেদ সেলেবী সালতানাতের জন্য হুমকিস্বরুপ । হেজারাফেন আহমেদ সেলেবীকে নির্বাসন দেয়া হলো ।**

সম্ভবত নিজ ভাই হেজারাফেন আহমেদ সেলেবীর দ্বারা অনুপ্রানিত হন তার ছোটভাই লাগারী হাসান সেলেবী (Lagari Hasan Celebi)। তিনিও পৃথিবীর অভিকর্ষকে পাশ কাটিয়ে আকাশে ওড়ার চেষ্টা চালাতে লাগলেন । ১৬৩৩ সালে তিনি মানুষকে বহনযোগ্য একটি রকেট ইঞ্জিনের ডিজাইন করেন । তার তৈরিকৃত এ রকেট ইঞ্জিনটিকে শক্তির যোগান দিতো ৩০০ পাউন্ডেরও বেশি গানপাউডার । এভলিয়া সেলেবীর (Evliya Celebi)-র তথ্যানুসারে, সুলতান মাহমুদের কন্যার জন্ম উপলক্ষে বসফরাস প্রনালীর তীরে তিনি তার রকেটটির পরীক্ষা চালান । স্থানটি সুলতানের বাসভবন তোপকাপী প্যালেসের (Topkapi Palace) নিকটবর্তী ছিলো । 

রকেটটি ব্যাবহার করে তিনি প্রায় ৩০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত উঠতে সক্ষম হন । জ্বালানী শেষ হয়ে গেলে তিনি তার নিজের ডিজাইন করা পাখা ব্যাবহার করে গ্লাইড করেন এবং বসফরাস প্রনালীতে অবতরন করেন । পরে সাঁতার কেটে তীরে পৌছান । তার ভাইয়ের মতই নিজের কৃতিত্বপূর্ন অর্জনের জন্য সুলতান তাকে স্বর্নমুদ্রা দ্বারা পুরস্কৃত করেন এবং তিনি একটি অশ্বারোহী বাহিনীর অফিসার হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন । এ মহান বিজ্ঞানী পরবর্তীতে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে শাহাদাৎ বরন করেন ।

[ লেখাটি Lost Islamic History সাইটের “Pioneers of aviation : 17Th Century Flight In Istanbul” শীর্ষক আর্টিকেলের অনুবাদ ]

**হেজারাফেন আহমেদ সেলেবীর নির্বাসনের ঘটনাটি পরে আমি কিছুটা আশ্চর্য হয়েছিলাম । মুসলিম শাসকরা সাধারনত কখনোই জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথে বাধা দিতেন না, বরং যারা জ্ঞান চর্চা করতেন তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন । তাহলে হেজারাফেনের কি দোষ ছিলো ? আমি সুলতান চতুর্থ মুরাদের জীবনী পাঠ করলাম । তিনি উসমানী সাম্রাজ্যের এক বিপদময় মূহুর্তে ক্ষমতায় বসেন । বহিঃশত্রুর আক্রমনে উসমানী সাম্রাজ্য অস্থীতিশীল, এ সুযোগে সাম্রাজ্যের সুযোগ সন্ধানী উইপোকারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যাস্ত । ফলে গোটা সাম্রাজ্য হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে । এমনকি এ সময় তারা সাম্রাজ্যে কয়েকবার বিদ্রোহ ঘটাতেও সক্ষম হয় । কাজেই সাম্রাজ্যের এমন পরিস্থিতিতে হয়তো হেজারাফেনকে কোনো কারনে কোনো ষড়যন্ত্রে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছিলো বা তিনি নিজেই কোনো ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন । নিশ্চিত না হয়ে কিছুই বলা যাবে না । কাজেই হেজারাফেনের নির্বাসন নিয়ে দয়া করে কেউ জল ঘোলা করবেন না । - অনুবাদক 

অনুবাদ – মাসুদ ফেরদৌস ইশান ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন