রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মুরতাদের নির্মম পরিণতি : মুফতী পিয়ার মাহমুদ

মুরতাদের পরিচয়: কোনো মুসলমান ইসলামের কোন মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস কিংবা বিধান অথবা ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়কে মানতে অস্বীকার করা কিংবা তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা অথবা কটুক্তি ও অবমাননাকর কোন কথা বলার নামই হলো মুরতাদ হওয়া। মাআরিফুল কুরআন: ৭/২২৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩৪৪, হিন্দিয়া: ২/২৫৩ ইকফারুল মুলহিদীন- ৭২,১৯৯।

মুরতাদের প্রকার: মুরতাদ দু’ প্রকারের হয়ে থাকে। (১) নিজেই নিজের মুরতাদ হওয়ার ঘোষণা দেয়। (২) যে ঈমান বিনষ্টকারী কোন আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করে অথবা অনুরূপ কোন কথা কাজের সঙ্গে জড়িত থেকে নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করে। এই প্রকারের মুরতাদকে মুনাফিক, মুলহিদ ইত্যাদিও বলা হয়। সকল ইরতিদাদ বা মুরতাদই সাধারণ কুফরের চেয়ে ভয়াবহ। কারণ সাধারণ কুফর তো হলো সত্যদীন ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা। কিন্তু ইরতিদাদ বা মুরতাদ হওয়া কেবল সত্যদীন গ্রহণ থেকে বিরত থাকা কিংবা নিছক বিমুখতা নয়, বরং তা ত্যাগ করে আল্লাহ, রাসূল এবং দীনে হকের প্রতি সরাসরি বিদ্রোহ করা। ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, তাদেরকে অপদস্থ করা। কোন ধর্ম গ্রহণের পর তা বর্জনের অর্থ সে ধর্মকে অভিযুক্ত করা। যা দীনে হককে মিথ্যা হওয়ার অবান্তর অপবাদ। পাশাপাশি পৃথিবীতে ফাসাদ তথা অনর্থ ও বিপর্যয় সৃষ্টিও বটে। এজন্য মুরতাদের শাস্তি সাধারণ কাফেরের চেয়ে কঠিন ও মর্মন্তুদ।



মুরতাদের শাস্তি

সকল পাপের ক্ষেত্রেই সাধারণ নিয়ম হলো কৃতপাপের শাস্তি হয়তো দুনিয়াতে ভোগ করবে নয়তো পরকালে। দুনিয়ায় ভোগ করলে পরকালে মাফ পেতে পারে। আর দুনিয়ায় পার পেলে পরকালে তার শাস্তি ভোগ করতেই হবে। অপরাধ অনুপাতে সাজার ধরণ ও পরিমাণ হবে। তবে ইরতিদাদের শাস্তির ব্যাপারটি ভিন্ন। এর জন্য যেমন দুনিয়াতেও রয়েছে শাস্তি তেমনি পরকালেও রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। স্বঘোষিত মুরতাদ হোক কিংবা অঘোষিত মুরতাদই হোক, উভয় প্রকার মুরতাদেরই ইহকালীন শাস্তি হল প্রশাসন মুরতাদকে প্রথম তওবার প্রতি আহবান করবে। যদি তওবা করে ফেলে তাহলে তো ভালো; তার শাস্তি মওকুফ হয়ে যাবে। অন্যথায় তার উপর মুরতাদের নির্ধারিত শাস্তি মৃত্যুদ- কার্যকর করবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, “যদি মুরতাদ মুনাফিকরা, যাদের অন্তরে ব্যধি রয়েছে এবং মদীনায় ভয়ংকর সংবাদ রটনাকারীরা নিবৃত্ত না হয়, তাহলে অবশ্যই আমি আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করব। আর তখন তারা আপনার প্রতিবেশী হিসাবে বেশীদিন টিকে থাকতে পারবে না। যে কদিন থাকবে অভিশপ্ত অবস্থায় থাকবে। এ জাতীয় লোকদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে ধরা হবে আর হত্যা করা হবে।”[(আহযাব: ৬০-৬১]

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও দুশমনী করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টির পায়তারা করে, তাদের শাস্তি কেবল মৃত্যুদ- বা শূলিবিদ্ধ করে হত্যা করা অথবা হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা কিংবা নির্বাসিত তথা কারাগারে নিক্ষেপন করা। এতো হলো কেবল তাদের পার্থিব অপমান। পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর শান্তি।” [মায়েদাহ- ৩৩]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, “যে নিজের দীন পরিবর্তন করে মুরতাদ হবে, তাকে হত্যা করে ফেলবে” [বুখারী-৬৯২২, তিরমিযী- ১৪৫৮, আবু দাউদ- ৪৩৫১, আহমাদ- ১৮৭১] অপর বর্ণনায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, “যে মুসলমান সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। আর আমি আল্লাহর রাসূল, ‘তাকে তিন কারণের কোন একটি ছাড়া হত্যা করা বৈধ নয়। (১) অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, (২) বিবাহিত ব্যক্তির ব্যভিচার, (৩) ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হওয়া।’ [বুখারী: হাদীস- ৬৮৭৮, তিরমিযী- ১৪০২, বায়হাকী- ৮/১৯৪]

তুসতার নামক এলাকা বিজয়ের পর হযরত উমর রা. সংবাদবাহীদের জিজ্ঞেস করলেন, বিজিত এলাকা তুসতারে কোন বিরল ঘটনা ঘটেছে কি? উপস্থিত লোকেরা বলল, এক মুসলমান ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। ফলে আমরা তাকে গ্রেফতার করি। উমর রা. বললেন, তার সাথে তোমার কী আচরণ করেছ? তারা বলল আমরা তাকে হত্যা করেছি। উমর রা. বললেন (এমনটি না করে) যদি তাকে একটি কক্ষে আবদ্ধ করে রাখতে আর ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রতিদিন রুটি দিতে আর এইভাবে তিন দিন তার কাছে তওবা আহবান করতে তাহলে কতইনা ভাল হতো! তখন সে তওবা করলে তো করত: অন্যথায় তাকে হত্যা করে ফেলতে। মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা- ২৯৫৮৮ অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, মহানবী সা. ইয়ামানে হযরত আবু মুসা আশসারী রা. এর নিকট হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. কে পাঠালেন। তিনি সেখানে পৌঁঁছলে আবু মুসা রা. তাকে স্বাগত জানালেন এবং বসার জন্য আসন এগিয়ে দিলেন। হঠাৎ দেখা গেল আবু মুসা আশআরীর পাশে এক ব্যক্তিকে বেঁধে রাখা হয়েছে। মুআজ রা. বললেন, এর কি হলো? একে এভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে কেন? উত্তরে আবু মুসা বললেন, সে ইহুদী ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছিল। কিন্তু পরে আবার ইসলাম ত্যাগ করে বিকৃত ধর্মে ফিরে গেছে। একথা শুনে মুয়াজ রা. বললেন একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সা. এর নির্দেশ ও ফায়সালা এটাই। আবু মুসা রা. বললেন, হ্যাঁ ঠিক আছে। আপনি একটু বসুন। কিন্তু তিনি বললেন, না, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না।

এটাই আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের ফায়সালা ও নির্দেশ। একথা তিনি তিনবার বললেন। অবশেষে আবু মুসা রা. লোকটিকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। ফলে তাকে হত্যা করা হলো (আবু দাউদ- ৪৩৫৪

মুরতাদদের শাস্তি মৃত্যুদ- এর উপর উম্মতের সকল মাযহাব, সকল শ্রেণী-গোষ্ঠী একমত। কোনকালেই কোন আলেমে দীনের এ ব্যাপারে দ্বিমত বা দ্বিধা ছিল না। শরীয়তের পরিভাষায় একে ইজমা বলে। ইজমা শরীয়তের তৃতীয় দলিল। এ ব্যাপারে ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন, মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদ-। সকল আলেমে দ্বীনের অনুসৃত নীতি এটাই [তিরমিযী: ১/২৭০] আততামহিদ নামক গ্রন্থে রয়েছে, যে তার দীন ত্যাগ করে মুরতাদ হয় তাকে হত্যা করা বৈধ হয়ে যাবে এবং তার শিরচ্ছেদ করা হবে। মুরতাদের এ শাস্তির ব্যাপারে পুরো উম্মতের ইজমা রয়েছে (আততামহীদ ইবনু আব্দিল বার ৫/৩০৬ সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল মুগনীতে আছে সকল মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদ-। এ ব্যাপারে সকল আলেমে দীনের ইজমা রয়েছে [আল মুগনী, ইবনে কুদামা হাম্বলী: ১২/২৬৪] এ বিষয়ে আরো দেখুন বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ইবনে রুশদ মালেকী: ২/৩৪৩; আল ইলাম, ইবনে হাজার মক্কী শাফেয়ী: ৪০০, ইলাউস সুনান: ১২/৫৯৯; আল মুহীতুল বুরহানী: ৭/৪৪৩; রাসায়েলে আল্লামা শামী: ১/৩১৬

এ দলিলগুলো বাদ দিলেও সাধারণ যুক্তিও বলে মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদ-ই হওয়া উচিত। কেননা মুরতাদ মূলত: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী। তাই সে সমাজে অবস্থান করলে সংঘাত-সহিংসতা, বিপর্যয় ও আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটবে। ফলে এমন ব্যক্তি বেঁচে থাকার মাঝে কোন কল্যাণ ও মঙ্গলের আশা করা যায় না। তাই তাকে হত্যা করে ফেলাই অধিক উত্তম ও কল্যাণকর। ইলামুল মুওয়াক্কিঈন: ২/৮৪।

মুরতাদ এতো জঘন্য অপরাধী যে, মৃত্যুর পর কররস্থ করার আগেই তার শাস্তি ও লাঞ্ছনা শুরু হয়ে যায়। প্রত্যেক মৃত ব্যক্তিকে তার স্বধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দাফন পূর্বক্রীয়া সম্পন্ন করে স্বধর্মের কবরস্থানে দাফন করা হয়। পক্ষান্তরে ধর্মত্যাগী নাস্তিক-মুরতাদের বিধান আলাদা। এদের জানাযা পড়া হারাম। এদের জানাযায় অংশগ্রহণ কিংবা ইমামতি করা সুস্পষ্টই হারাম। কোন ধর্মের কবরস্থানেই এদেরকে জায়গা দেয়া যাবে না। তাই এ জাতীয় লোকদের জানাযা আদায় না করে আলাদা কোন স্থানে গর্ত করে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হবে। ইরশাদ হয়েছে, “কখনো তাদের (মুনাফিক-মুরতাদদের) কেউ মারা গেলে আপনি তাদের জানাযা পড়বেন না এবং দুআ ইস্তিগফার কিংবা দাফন-কাফনের জন্য তার কবরের পাশে দাঁড়াবেনও না। (কারণ) তারা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং নাফরমান অবস্থায় মারা গেছে ।” [তওবা-৮৪] এই আয়াতটি সকল প্রকার কাফের মুরতাদদের জানাযা অবৈধ হওয়ার সুস্পষ্ট দলিল [কুরতুবী: ৮/৪০] এ ব্যাপারে সকল ফকীহ একমত। এবিষয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই (কিতাবুল আছল: ১/৪১১) মাবসূত লিসসারাখসী: ২/৫৪; আল-মুদাওয়ানা:১/১৬৩; মাওয়াহিবুল জলীল: ৩/৭০] মুরতাদদের জন্য সকল প্রকার ইসালে সওয়াব কিংবা এর জন্য অনুরোধ বা সুপারিশ করাও নিষিদ্ধ। তার জন্য দুআ করলে কবুল তো হবেই না বরং দুআ’কারী ও অনুরোধকারী উভয়ে উল্টো হারাম কাজ করার গুনাহে লিপ্ত হবে। তাই কেউ না বুঝে বা না জেনে এরূপ করে ফেললে অনতিবিলম্বে আল্লাহর দরবারে তওবা ইস্তিগফার করে নিবে। [তওবা: ৮০, ১১৩, ১১৪; হুদ: ৪৫, ৪৬, ৪৭; আল মাজমূ: ৫/১২০]

পরপারেও তার জন্য আছে ভয়ংকর শাস্তি। কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছে, “তোমাদের কেউ যদি মুরতাদ হয়ে যায় আর মুরতাদ অবস্থায়ই মারা যায় তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের সকল নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। এরাই হলো জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” [বাকারা:২১৭] অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয় যারা তাদের সামনে হেদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পরও ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়েছে এদের কি দশা হবে, তখন যখন ফেরেশতারা এদেব মুখম-ল ও পশ্চাৎদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে। এ শাস্তি এজন্য যে, তারা এমন মতবাদ বেছে নিয়েছে যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে এবং তারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করে। তাই আল্লাহ তাদের আমলগুলো বরবাদ করে দেন।” [মুহাম্মদ: ২৫, ২৭, ২৮]।





লেখক পরিচিতিঃ লেখক ও শিক্ষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন