বাদশা আলমগীর বা সম্রাট আওরঙ্গজেব (শা. ১৬৫৮-১৭০৭) মোগল বংশীয় ষষ্ঠ সম্রাট। দীর্ঘ ৫০ বছর তিনি রাজত্ব করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের পুরো নাম 'আসসুলতানুল আজম আবুল মুজাফফর মুহিউদ্দীন মুহম্মদ আওরঙ্গজেব বাহাদুর আলমগীর বাদশা গাজী'।
মোগল পরিবারের নিয়মানুযায়ী শাহি কায়দায় তিনি রাজপ্রাসাদে লালিত-পালিত হন। শারীরিক বর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। শৈশবের চঞ্চলতায়ই কোরআন-হাদিস-ফিকাহসহ আরবি হস্তাক্ষরবিদ্যায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। কৈশোরের আগেই প্রকাশিত হয় তার সংকলিত নবীজি (সা.) এর ৪০ হাদিসের গ্রন্থ 'আল-আরবাইন'। তার হস্তলেখা ছিল দৃষ্টান্তমূলক সুন্দর। আগেকার যুগে প্রেস বা ছাপাখানা না থাকায় বই-পুস্তক ও কিতাবাদি হাতে লিখে লিখে কপি তৈরি করা হতো। সম্রাট আওরঙ্গজেব শাসনভার গ্রহণের আগে পবিত্র কোরআন ও আল-আরবাইনের কপি স্বহস্তে লিখে মক্কা শরিফের ছাত্রদের জন্য উপহার পাঠাতেন। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে তিনি এতই পারঙ্গমতা লাভ করেছিলেন যে, তার উদ্যোগে রচিত বিখ্যাত ফতোয়ার কিতাব 'ফতোয়া আলমগিরি বা আল-ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়া' পৃথিবীজুড়ে প্রসিদ্ধি পেয়েছে। ফতোয়া আলমগিরিতে মোট ৬০ অধ্যায় ১০০০ অনুচ্ছেদ-পরিচ্ছেদ ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় প্রায় সব মাসলা-মাসায়েল আছে। ফিকহে হানাফির শাখা-প্রশাখাগত মাসাইলের সবচেয়ে বড় সঙ্কলন এটি। তার দরবার ছিল অসংখ্য আলেমের ঠিকানা। তিনি ও তার তত্ত্বাবধানে দরবারের আলেমরা যৌথভাবে এ ফতোয়াসমগ্র রচনা করেছেন। তিনি এ গ্রন্থের কারণে অমর হয়ে থাকবেন। কেয়ামত পর্যন্ত পুরো পৃথিবীর মুসলমান এতে তাদের সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবে। মোল্লা মুহম্মদ জিউন (রহ.) যথার্থই বলেছিলেন,
'আজ থেকে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশা আলমগীর'।
তিনি ছিলেন পাক্কা ঈমানদার, পন্ডিত আলেম, ইবাদতগুজার, খোদাভীরু-মুত্তাকি, বীর্যশালী বীরপুরুষ, ন্যায়পরায়ণ ও মুবাল্লিগ। এমন কোনো ভালো কাজ নেই যা তিনি হাতছাড়া করেছেন। তার যোগ্যতা দিয়েই তিনি মহারাষ্ট্র ভারতবর্ষ শাসন করেছেন। তিনি ছিলেন ইসলামী সংবিধানের বাস্তবায়নকারী খোলাফায়ে রাশেদিনের মূর্তপ্রতীক সুদক্ষ সম্রাট। আওরঙ্গজেব অল্প বয়সেই ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে যেমন দক্ষতা হাসিল করেছিলেন, তেমনি জাগতিক জ্ঞানবিদ্যা, রাজনীতি, নেতৃত্ব ও রণকৌশলেও নিপুণ হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সের ঘটনা। একটা সামরিক হাতি ধেয়ে এসেছিল। সবাই ছোটাছুটি করে পালিয়ে গেল। কিন্তু সাহসী বীর আওরঙ্গজেব মোকাবিলা করে হাতিকে পরাজিত করেছিলেন। মূলত তখন থেকেই তিনি 'বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।
সিংহাসনারোহণের পর সম্রাট আলমগীর ৩০ পারা কোরআন শরিফ মুখস্থ করেছিলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এলেম চর্চায় আত্মনিয়োগ করতেন। দিনে-রাতে অনেক বেশি নফল নামাজ পড়তেন। কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার করতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়তেন। রমজান মাসের শেষ দশক মসজিদে এতেকাফ করতেন। খতম তারাবি নিজে পড়াতেন। তিনি ছিলেন ইবাদতগুজার শ্রেষ্ঠ শাসক, বীরযোদ্ধা, মুজাহিদ-গাজী। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ ৮৮ বছর বয়সে আহমেদ নগরে তিনি ইন্তেকাল করেন। ওয়াদিয়ে কিদ্দিস বা ঋষিদের উপত্যকা নামক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
লেখক : মুফতি আবদুল হালীম
খতিব, টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন পুরাতন জামে মসজিদ
কার্টেসিঃ আলোকিত বাংলাদেশ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন