সম্পাদনায়,মুহাম্মদ গোলাম হুসাইন
ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর আসল নাম আবু হামিদ মুহম্মদ।তাঁর পিতা ও পিতামহর উভয়ের নামই মুহম্মদ। তিনি খোরাসানের অন্তর্গত তুস নগর এর গাজালা নামক স্থানে জন্ম গ্রহন করেন। তাই সবাই উনাকে ঐ স্থানের নাম অনুযায়ী গাজ্জালী নামেই চিনে।
ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর যুগে পারস্যের সম্রাট ছিলেন সলজুক বংশীয় সুলতান রুকনুদ্দীন তোগরল বেগ। সলজুগ বংশীয় সুলতানের রাজত্বকাল মুসলমানদের চরম উন্নতির যুগ ছিল। তাঁদের পুর্বে ইরান শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত বুইয়া বংশীয় রাজাদের শাসনাধীন ছিল।এই সময় মুসলিম শক্তি সমূহ পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ,আক্রমন-প্রতিআক্রমনের ফলে দুর্বল হয়ে পরেছিল। কিন্তু সলজুক বংশীয় তুর্কীগন ইসলাম গ্রহন করলে তাদের প্রাক ইসলামী স্বভাব চরিত্র ও মুল্যবোধে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয় এবং তাদের মাধ্যমে এক অনুপম সভ্যতা গড়ে উঠে। ফলে তারা মুসলিম বিশ্বের লুপ্ত প্রায় শক্তি ও প্রতিভাকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম হয়। এই শক্তির অভ্যুদয়ের ফলে খ্রীষ্টান শক্তির অগ্রগতি রহিত হয় এবং সমগ্র এশিয়ার এক বিরাট অংশ এই সুলতানগণের অধীনে এসে পড়ে। ঐ যুগে মুসলমানদের বিদ্যার্জন স্পৃহা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায় । তৎকালে প্রচলিত ইহুদী ,খৃষ্টান ও পারসিকদের জ্ঞানার্জন সমাপ্ত করে প্রাচীন গ্রীক,মিশরীয় ও ভারতীয় জ্ঞানারহনে তারা প্রবৃত্ত হন।এ জন্যই জ্যোতিসশাস্ত্র, জড়বাদ, নাস্তিকতা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের মতবাদের সংমিশ্রনে মুসলমান সমাজে বহু মতানৈক্যের এবং ইসলামী বিশ্বাস ও জ্ঞানের সাথে নানারকম মারাত্বক অনৈসলামিক ধর্ম-বিশ্বাস ও জ্ঞান এমন ভাবে মিশে পড়ে যে,খাটি ইসলামী বিশ্বাস ও অনৈসলামী বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য করাই দুরহ হয়ে পড়ে। অত্যধিক পরিমাণে পার্থিব জড়বাদের প্রভাবে ধর্ম জ্ঞানের শ্বাস প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় এবং মুসলমান সমাজে ইসলামী বিশ্বাস ও ধর্মকার্যের ক্ষেত্রে এক চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। তা হতে সমাজকে মুক্ত ও রক্ষা করার দায়িত্বই ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর উপর অর্পিত হয়। এই ক্ষনজন্মা মহাপুরুষের অতুলনীয় প্রতিভা যে নিপুণতার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন, তা সমগ্র বিশ্ব বিস্ময় ও ভক্তিভরে আজীবন স্বরন করবে।
তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্হা-
তৎকালে মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বত্র প্রথমিক স্তর হতে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠত ছিল। ছাত্রগণের খাওয়া-পড়ার খরচ সহ মাদ্রাসার সমস্ত খরচ সরকার বহন করত। তদুপরি সকল মসজিদ ও বহু সঙ্গতিসম্পন্ন লোকদের গৃহেও মাদ্রাসা ব্যবস্থা চালু ছিল। সুতরাং সেইকালে ধনী দরীদ্র সকলের নিকটই শিক্ষার পথ সুগম ছিল। প্রবীণ ও উচ্চশিক্ষিত সুধীজন যে সকল স্থানে শিক্ষাদান করতেন ,সেসব স্হানই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পরিণত হত।
শৈশবকাল ও ছাত্র জীবন-
ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর পিতা ছিলেন দরিদ্র।তথাপি তিনি পুত্রের শিক্ষার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি।ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি শৈশব কালেই পিতৃহীন হন।অন্তিম কালে তাঁর পিতা তাঁর জনৈক বন্ধুর কাছে দুই পুত্র আহমদ ও মুহম্মদ এর প্রতিপালনের ও শিক্ষার ভার অর্পন করেন এবং এ জন্য সামান্য অর্থ প্রদান করেন। শিশুদ্বয় অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন।অতি অল্পকালের মধ্যেই পবিত্রকোরআন হিফ্জ সমাপ্ত করে তারা শহরের একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন।আল্লামা আবু হামিদ আসকারায়েনি, আল্লামা আবু মুহম্মদ যোবায়নি প্রমুখ মহাজ্ঞানী উস্তাদের নিকট তিনি শিক্ষা লাভ করেন।খ্যাতনামা ফিকাহ শাস্ত্রবিদ আল্লামা আহমদ বিন মুহম্মদ রাযকানীর নিকট তিনি ফিকাহশাস্ত্রের প্রাথমিক কিতাবসমুহ অধ্যয়ন করেন।
উচ্চ শিক্ষার জন্য জুরজানে গমন গমন-
তাহেরানে শিক্ষা সমাপ্তির পর ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উচ্চ শিক্ষার জন্য জুরজান শহরে গমন করেন।এখানে তিনি হযরত ইমাম আবু নসর ইসমাইল রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর তত্বাবধানে শিক্ষাগ্রহন আরম্ভ করেন।তাঁর তীক্ষ্ণমেধা ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তিনি পুত্রবৎ স্নেহে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাকে শিক্ষাদানে প্রবৃত্ত হন।তৎকালে শিক্ষকগণ পাঠ্যবিষয়ে যে বিষয়ে শিক্ষাদান করতেন তা শিক্ষার্থীদেরকে হুবহু লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য করা হতো।এ লিখিত নোটগুলিকে ”তালিকাত” বলা হত। এরুপে ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর কাছে তালিকাতের এক বিড়াট ভান্ডার সংগৃহিত হল।
তাহেরানা অভিমুখে যাত্রার পথে সর্বস্ব লুন্ঠন-
জুরজানে অধ্যয়ন সমাপনান্তে ইমাম গাজ্জালী র: জন্মভুমি তাহেরান যাত্রা করেন। পথিমধ্যে দস্যুদল তালীকাত সহ তাঁর সমস্ত কিছু লুন্ঠন করে নেয়।টাকা পয়সা ও অন্যান্য সম্পদ লুন্ঠন হওয়াতে তিনি কোন কষ্ট অনুভব করলেন না । কিন্তু তালিকাত অপহরণে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েলেন। তাই দস্যুসরদারের নিকট অন্তত তাঁর সমস্ত অর্জিত বিদ্যার সন্চ্ঞয় সম্ভার তালিকাত গুলি ফেরত দেয়ার জন্য অনুরোধ করলেন।দস্যু সরদার তাকে উপহাসের স্বরে বলল। “তুমিতো বেশ বিদ্যার্জন করেছ! সবই কাগজে রয়েছে, মনে কিছু নেই। এই কথা বলে সে তার সমস্ত তালিকাত ফিরিয়ে দিল। সরদারের ব্যঙ্গোক্তি ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মনে দাগ কাটল। পরে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি সমস্ত তালিকাত মুখস্ত করে নেন।
নিজামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন-
খোরাশানের অন্তর্গত নিশাপুরে অবস্থিত নিজামিয়া মাদ্রাসা তৎকালে বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। জুরজানের অধ্যয়ন শেষে ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর জ্ঞান পিপাসা নিবৃত হল না। তাই তিনি নিযামিয়া মাদ্রাসায় গমন করলেন। সেখানে তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আলিমরুপে স্বীকৃত ইমামুল হারামাইন রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন এই মাদ্রসার অধ্যক্ষ।দুনিয়ার বহু দেশ হতে বহু লোক উচ্চশিক্ষার জন্য উনার নিকট উপস্হিত হতেন। তিনি এত গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন যে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ হতে সুলতানগণও বিভিন্ন জটিল বিষয়ের মীমাংসার জন্য তাঁর নিকট উপস্থিত হতেন। ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উপযুক্ত শিক্ষক পেয়ে তাঁর তীব্র জ্ঞান পিপাসা মিটাতে লাগলেন। ইমামুল হারামাইনও ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে দর্শন ও জ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে খুব আগ্রহের সহিত শিক্ষা দিতে লাগলেন।
৪৭৮ হিজরিতে ইমামুল হারামাইন রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইন্তিকাল করেন। তিনি ছাত্রগণের নিকট এত প্রিয় ছিলেন যে,তাঁরা তাঁর ইন্তিকালে প্রায় উন্মাদ হয়ে পড়ে। ছাত্রগন প্রায় এক বৎসর কাল উস্তাদের শোকে মুহ্যমান হয়ে থাকে। ইমামা গজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর নিকটও উস্তাদের তিরোধান যাতনা অসহনীয় হয়ে উঠে এবং নিশাপুর তাঁর নিকট অন্দ্ধকার পুরীর ন্যয় মনে হতে লাগলো। তাই তিনি নিশাপুর পরিত্যগ করে বাগদাদ চলে আসেন ও ওখানেই পড়া লেখা শেষ করেন।
দিব্যজ্ঞান বা তাজকিয়ায়ে নফস অর্জনে বাইয়াত গ্রহন-
এই সময় ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর বয়স ছিল মাত্র ২৮ বৎসর। তিনি জানতেন যে কেবল কিতাব পাঠ আল্লাহর জ্ঞান লাভের জন্য যথেষ্ঠ নয়। ইহার জন্য দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন জীবন্ত উস্তাদের নিতান্ত প্রয়োজন। হাদিস শরীফে আছে জ্ঞান দুই প্রকার । এক প্রকার জ্ঞান হচ্ছে জবানী জ্ঞান, অন্য একটি ক্বলবী এলেম বা আত্বিক জ্ঞান। রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা বলেন, ক্বলবী এলেম বা আত্বিক জ্ঞানই হচ্ছে উপকারী জ্ঞান(মেশকাত শরীফ)।
হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, “আমি রসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর কাছ থেকে জ্ঞানের দুটি পাত্র অর্জন করেছি। একটি তোমাদের মধ্যে বিতরণ করেছি অন্যটি করিনি।যদি করতাম তবে আমার কন্ঠদেশ কর্তিত হতো” (বোখারী শরীফ)।
পবিএ কালাম পাকে ইহাকে তাজকিয়া এবং হাদিস শরীফে ইহাকে এহসান নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লমা এর বহুমুখি শিক্ষার মধ্যে এই তাজাকিয়াও ছিল একটি অন্যতম বিষয় ।কালামে পাকে এরশাদ হচ্ছে “তিনিই উম্মিদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন , যিনি তাদেরকে তাজকিয়া করেন এবং কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেন। যদিও ইতিপূর্বে তারা গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল” (সুরা জুময়া, ২)
হজরত ইমাম মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ”যিনি তাসাউফ গ্রহন করলেন কিন্তু ফিক্হ গ্রহণ করলেন না তিনি নিশ্চই কাফের । আর যিনি ফিকহ গ্রহন করলেন কিন্তু তাসাউফ গ্রহন করলেন না, তিনি নিশ্চয়ই ফাসেক। আর যিনি উভয় জ্ঞান গ্রহন করলেন এবং সেই অনুযায়ী আমল করলেন তিনিই মুহাক্কেক বা প্রকৃত দ্বীন গ্রহণ করলেন।”
তাই তিনি তৎকালীন প্রখ্যাত দিব্যজ্ঞান বা এলমে তাসাউফ ধারী বুযুর্গ কামেল হযরত শায়েখ আবু আলী ফারমেদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর পবিত্র হস্তে বাইয়াত হয়ে দিব্য জ্ঞান আহরন করতে থাকেন।
মাদ্রাসার নিযামিয়ার অধ্যক্ষ পদে ইমাম সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি-
বাগদাদে তখন তুর্কিরাজ মালেক শাহের আধিপত্য ছিল । তাঁর প্রধানমন্ত্রী হাসান বিন আলী নিযামুল একজন অসাধারন পন্ডিত ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি ছিলেন । তার নিয়মানুসারেই বাগদাদের বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ‘মাদরাসায়ে নিযামিয়া’ এবং উহার পাঠ্যতালিকা ‘দরসে নিযামী’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে হযরত ইমাম সাহেবকে মাদরাসার অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করেন। তখন তাহার বয়স মাত্র ৩৪ বছর, এত অল্প বয়সেও তিনি অধ্যাপনা ও পরিচালনা কার্যে নিতান্ত দক্ষতা ও নিপুনতার পরিচয় প্রদান করেন। স্বয়ং বাদশাহ ও রাজপুরুষগণও রাজকার্যের জটিল সমস্যাসমূহে তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতেন। এ সময় তার নাম দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন দেশ হতে শত শত ছাত্র তার শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য ছুটে আসেন। মাদ্রাসা নিযামিয়ার খ্যাতিও অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অধ্যাপনার সাথে সাথে তিনি নানা জটিল বিষয়ে গবেষণাও করতে থাকেন। এরুপে তিনি অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী হন।
মাদ্রাসা নিযামিয়া পরিত্যাগ-
প্রভূত যশ ও যোগ্যতার সহিত ইমাম গাযযালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি চার বৎসরকাল মাদ্রাসা নিযামিয়াতে কাজ করেন। নানা জটিল বিষয়াদির চমৎকার ব্যাখ্যা শ্রবণ এবং তাঁর জ্ঞাণের গভীরতা উপলব্ধি করে তার ছাত্রগণ একেবারে বিস্মিত হয়ে পড়ত। এখানে অবস্থানকালে তিনি দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্হরাজি অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। তথাপি তাঁর মন পরিতৃপ্ত হল না। কিসের অভাবে যেন তাঁর মন আনচান করতে লাগলো। অজানাকে জানার এবং অদেখাকে দেখার জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো। যাবতীয় কর্মের প্রতি তাঁর মন বিতৃষ্ণ হয়ে উঠলো। তিনি ব্যাকুল বুঝলেন যে, কেবল পুথিগত জ্ঞান দ্বারা বিশেষ কোন কাজ হয় না। বিশুদ্ধ জ্ঞানের সাথে সাথে একাগ্র সাধণা ও রিয়াযত আবশ্যক। এ সম্পর্কে তিনি নিজে বলেন : ”মানুষের সদ্গুনরাজির বিকাশের জন্য অক্লান্ত সাধনা ও একনিষ্ঠ সংযমের একান্ত আবশ্যক।” এই উপলব্ধির পর স্বীয় স্বভাব ও কর্মের প্রতি মনোনিবেশপূর্বক দেখলাম, আমার কোন কাজই এই নীতির অনুরুপ নয়, যার দ্বারা আমার স্বভাব,আত্না ও মানবতার উন্নতি সাধন হতে পারে। আমি আরও বুঝতে পারলাম যে,আমি প্রবৃত্তির বশবর্তি হয়ে কাজ করছি এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য আমার কোন কাজ হচ্ছে না। তবে আল্লাহর সন্তোষ লাভের নিমিত্ত লোকালয়ে অবস্থান করেই দুনিয়ার সকল মোহ বর্জন করতে হবে। এইরুপ চিন্তা করতে করতে যাবতীয় কর্মের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা ও বইরাগ্যভাব জন্ম নিতে লাগলো। মাদ্রাসার অধ্যাপনা ও পরিচালনার কাজেও শৈইথিল্য দেখা দিল ,মৌনাবলম্বনের স্পৃহা বৃদ্ধি পেল; হযম শক্তি কমতে লাগলো এবং ঔষধেও অশ্রদ্ধা জন্ম নিল। চিকিৎসকগণ বললেন,” এমতাবস্থায় কোন ওষুধই ফলপ্রদ হবে না।” অন্তর দেশ ভ্রমণে বাহির হওয়ার মনস্থ করলাম। দেশের আমীর-উমরাহ,আলিম-উলামা, সুধীমন্ডলী এবং রাজপুরুষগণ এই সংকল্প পরিত্যাগের জন্য আমাকে অনুরোধ করতে লগলেন। কিন্তু আমি মনকে বশে আনতে পারলাম না। পরিশেষে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে হিজরী ৪৮৮ সনের যিলক্বাদা মাসে আমি গোপনে সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হলাম।
হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এক অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে জন্ম গ্রহন করেছিলেন। জাগতিক জ্ঞান তাঁর মনের তীব্র পিপাসা মিটাতে পারেনি। তাই তিনি এবার আধ্যাত্বিক জ্ঞানের অন্নেষনে বেড়িয়ে পড়লেন। শৈশব থেকেই তাঁর ধর্মের প্রতি অনুরাগ ও জ্ঞান পিপাসা ছিল অত্যন্ত প্রবল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সকল দার্শনিকদের মতবাদও তিনি অত্যন্ত মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু তাতেও তাঁর মনের কোন খোরাক মিটলো না। তাই এক অজ্ঞাত রহস্যের সন্ধানে সংসারবিরাগী সুফী-দরবেশের বেশে জীবনের দশটি বৎসর নানা দেশ পর্যটনে তিনি অতিবাহিত করেন। এই পথেই তিনি তাঁর জীবনের চির আকাঙ্খিত রহস্যের সন্ধান খুজে পান। তাঁর মন চির রহস্যময় আল্লাহর স্বরূপ উদঘাটনে সমর্থ হয় এবং তাঁর অন্তরের পিপাসা নিবারিত হয়।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক ও আলেমে দ্বীন ইমাম আবু হামেদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল-গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি জীবনের প্রথম দিকে ছিলেন শাসন কর্তৃপক্ষের নৈকট্যপ্রাপ্ত একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। অন্যান্য আমীর ওমরাহগনের মতই তারও জীবনযাত্রা ছিল বর্নাঢ্য। কিন্তু ভোগ বিলাসপূর্ণ জীবনযাত্রার মধ্যেও তাঁর ভেতরে লুকিয়ে ছিল মুমিন সুলভ একটি সংবেদনশীল মন,যা সমকালীন মুসলিম জনগনের ব্যাপক স্খলন-পতন লক্ষ্য করে নীরবে অশ্রুবর্ষন করতো। ইহুদী-নাসারাদের ভোগ সর্বস্ব জীবনযাত্রার প্রভাবে মারাত্নকভাবে আক্রান্ত মুসলিম জনগনকে ইসলামের সহজ সরল জীবন ধারায় কি করে ফিরিয়ে আনা যায়, এ সম্পর্কে তিনি গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতেন। কোন কোন সময় এ চিন্তাভাবনা তাকে আত্নহারা করে ফেলতো। ভাবনা চিন্তার এক প্রর্যায়ে এ সত্য তাঁর দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো যে ,বর্তমানে মৃতকল্প মুসলিম জাতিকে নবজীবনে উজ্জীবিত করে তোলা একমাত্র দ্বীনের স্বচ্ছ আবে হায়াত পরিবেশনের মাধ্যমেই সম্ভব।আর তা বিলাসপূর্ণ জীবনের অর্গলে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখে হাতে পাওয়া সম্ভব নয়।এ উপলব্ধি তাড়িত হয়েই ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি একদিন পরিবার পরিজন এবং ঘর-সংসার ত্যাগ করে নিরুদ্দেশের পথে বের হয়ে পড়লেন। একদা বহুমুল্যবান পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করা ছিল যার সর্বক্ষনের অভ্যাস, সেই ব্যক্তিই মোটা চট-বস্রে আভ্রু ঢেকে দিনের পর দিন নানা স্হানে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর এ কৃচ্ছতাপূর্ণ তাপস জীবনেরই সর্বাপেক্ষা মুল্যবান ফসল ‘এহইয়াও উলুমুদ্দীন” বা দ্বীনী এলেমের সন্জিবনী সুধা। এই মহা গ্রন্হের প্রভাবেই হিজরী ৬ষ্ঠ শতকের সুচনাকালে ইসলামের ইতিহাসে একটা উল্লেখযোগ্য পটপরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। নুরুদ্দীন জঙ্গী,সালাহউদ্দীন আইয়ুবী প্রমুখ ইসলামের বহু বীর সন্তান -যাদের নিয়ে মুসলিম উম্মাহ গর্ব করে থাকে। এরা সবাই ছিলেন ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর ভাবশিষ্য,’এহইয়াও উলুমুদ্দীন” এর ভক্ত পাঠক।
মাদ্রাসা নিযামিয়াতে অবস্হান কালে হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মুল্যবান পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করতেন। কিন্তু দেশ পর্যটনের সময় তিনি নিতান্ত সাধারণ পোশাকে ও একটি মোটা কম্বল সম্বল করে বের হন। কিন্তু ইহাতেও তাকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। সিরিয়ার পথে তিনি কিছুকাল দামেশক নগরস্হিত উমায়্যা জামে মসজিদে অবস্হান করেন। তৎকলে এই মসজিদের পার্শ্বে একটি বিরাট মাদ্রাসা ছিল। হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই মসজিদের পশ্চিম পার্শ্বস্হ মিনারের এক প্রকোষ্ঠে স্বীয় বাসস্হান নির্ধারণ করেন এবং অধিকাংশ সময়ই তাতে মুরাকাবা -মোশাহাদায় নিমগ্ন থাকতেন।অবসর সময়ে তিনি কিছুসংখ্যক অতি আগ্রহী শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করতেন এবং সময় সময় আলিমগনের সাথে জটিল বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনা করতেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন