সোমবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৬

ফিক্বাহ্ শাস্ত্রের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা।

আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারহমাতুল্লাহি ওয়াবারকাতুহ।
ফিক্বাহ্ শাস্ত্রের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা।
✍🏻 উক্ত বিষয়ে আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরি(রঃ) বলেন,
¤بسم الله الرحمن الرحيم¤
💢কুরআন বুঝা হাদীসের উপর নির্ভরশীল এবং হাদীস বুঝা ফিকহের উপর নির্ভশীল।তাই অহী নাযিলের কালে আল-কুরআনে ফিকহ্ চর্চ্চার কথা বলা হয়েছে।
■তাই আল্লাহ বলেন,
فمال هؤلاءالقوم لا يكادون يفقهون حديثا
পক্ষান্তরে তাদের পরিণতি কি হবে, যারা কখনও কোন কথা বুঝতে চেষ্টা করে না। [নিসাঃ৭৮]
ومنهم من يستمع إليك وجعلنا على قلوبهم اكنة أن يفقهوه وفي آذانهم وقرأ
তাদের কেউ কেউ আপনার দিকে কান লাগিয়ে থাকে।কিন্তু আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ রেখে দিয়েছি যাতে একে না বুঝে এবং তাদের কানে বোঝা ভরে দিয়েছি। [আনআমঃ২৫]
انظر كيف نصرف الآيات لعلهم يفقهون
দেখ, আমি কেমন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিদর্শনাবলী বর্ণনা করি যাতে তারা বুঝে নেয়। [আনআমঃ৬৫]
قد فصلنا الايت لقوم يفقهون.
নিশ্চয় আমি প্রমাণাদি বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি তাদের জন্যে, যারা চিন্তা করে [আনআমঃ৯৮]
আর জান ও মালের দ্বারা আল্লাহর রাহে জেহাদ করতে অপছন্দ করেছে এবং বলেছে, এই গরমের মধ্যে অভিযানে বের হয়ো না। বলে দাও, উত্তাপে জাহান্নামের আগুন প্রচন্ডতম। যদি তাদের বিবেচনা শক্তি থাকত। [তওবাঃ৮১]
মোহর এঁটে দেয়া হয়েছে তাদের অন্তরসমূহের উপর। বস্তুতঃ তারা বোঝে না।[তওবাঃ৮৭]
আর সমস্ত মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে।[তওবাঃ১২২]
আল্লাহ ওদের অন্তরকে সত্য বিমুখ করে দিয়েছেন! নিশ্চয়ই তারা নির্বোধ সম্প্রদায়। [তওবাঃ১২৭]
■তারা বলল-হে শোয়ায়েব (আঃ) আপনি যা বলেছেন তার অনেক কথাই আমরা বুঝি নাই, আমারা তো আপনাকে আমাদের মধ্যে দূর্বল ব্যক্তি রূপে মনে করি। [হূদঃ৯১]
সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যে যাকিছু আছে সমস্ত কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এবং এমন কিছু নেই যা তার সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করে না। কিন্তু তাদের পবিত্রতা, মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। [বনী-ঈসরাইলঃ৪৪]
✔আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ রেখে দেই, যাতে তারা একে উপলব্ধি করতে না পারে এবং তাদের কর্ণকুহরে বোঝা চাপিয়ে দেই। যখন আপনি কোরআনে পালনকর্তার একত্ব আবৃত্তি করেন, তখন ও অনীহাবশতঃ ওরা পৃষ্ট প্রদর্শন করে চলে যায়। [বনী-ঈসরাইলঃ৪৬]
তার চাইতে অধিক জালেম কে, যাকে তার পালনকর্তার কালাম দ্বারা বোঝানো হয়, অতঃপর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তার পূর্ববর্তী কৃতকর্মসমূহ ভুলে যায়? আমি তাদের অন্তরের উপর পর্দা রেখে দিয়েছি, যেন তা না বোঝে এবং তাদের কানে রয়েছে বধিরতার বোঝা। [কাহফঃ৫৭]
অতঃপর  যখন তিনি দুই পর্বত প্রচীরের মধ্যস্থলে পৌছলেন, তখন তিনি সেখানে এক জাতিকে পেলেন, যারা তাঁর কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। [কাহফঃ৯৩]
যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।[তোয়াহাঃ২৮]
■পরন্তু তারা সামান্যই বোঝে [ফাতহঃ১৫]
নিশ্চয়  তোমরা তাদের অন্তরে আল্লাহ তা’আলা অপেক্ষা অধিকতর ভয়াবহ। এটা এ কারণে যে, তারা এক নির্বোধ সম্প্রদায়। [হাশরঃ১৩]
■অতএব তারা বুঝে না। [ম্যনাফিকুনঃ৩]
✔ ভূ ও নভোমন্ডলের ধন-ভান্ডার আল্লাহরই কিন্তু মুনাফিকরা তা বোঝে না। [মুনাফিকুনঃ৭]
■রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেনঃ-
■স্বর্ণ-রৌপ্যের ন্যায় মানুষ খনিতুল্য।তাদের মধ্যকার যারা জাহিলী যুগে উত্তম তারা ইসলামের যুগেও উত্তম।[মুসলিম]
■তিনি আরও বলেনঃ-
যারা তোমাদের(সাহাবাদের) অনুসারী হবে।পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে লোক আসবে এবং দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করবে যখন তারা তোমার কাছে আসবে তখন তাদের সৎ উপদেশ দিবে। [তিরমিযী]
ইবন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
একবার রাসূলুল্লাহ(সাঃ) মসজিদে দুটি দল দেখলেন।তখন তিনি বললেন দুটি দলই উত্তম।একটি দল আল্লাহকে ডাকছে ও তারদিকে ঝুকে পড়ছে।আল্লাহ তাদের ডাকে সাড়া দিতেও পারেন আবার নাও পারেন। আরেকটি দল ফিকাহ শিখছে।মূর্খদের ফিকাহ শিক্ষা প্রদান করছে।এরাই উত্তম।আর মাই নিজেই প্রেরিত হয়েছি শিক্ষক হিসেবে।অতঃপর তিনি সেই দলটির সাথে বসে যান”।[দারিমী]
ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একবার তার জন্য এই দুআ করেছিলেন যে, আল্লাহ তুমি তাকে দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞান দান কর এবং তাকে কুরআনের ব্যাখ্যা শিখিয়ে দাও।
রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেছেন,
আল্লাহ যখন কারও কল্যাণ ইচ্ছা করেন তখন আল্লাহ তাকে দ্বীনের ফাকাহাত ও জ্ঞান দান করেন এবং তাকে হিদায়াতের অমীয় বাণী দ্বারা আলোক মণ্ডিত করেন।
অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে,
একজন ফকীহ শয়তানের উপর হাজার আবিদ অপেক্ষা উত্তম।
✴অন্যত্র বলা হয়েছে,
আল্লাহ যার মঙ্গল চান তিনি তাকে দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান দান করেন।
■রাসূলুল্লাহ(সাঃ) আরও ইরশাদ করেন,
প্রত্যেক বস্তুর স্তম্ভ আছে আর দ্বীন ইসলামের স্তম্ভ হল ফিকহ।
■অপর এক হাদীসে আছে,
ফিকাহ নিয়ে কিছু সময় আলোচনা করার জন্য কিছু সময় দেওায় ষাট বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম।
✔উমর(রাঃ) বলেন,
নেতৃত্ব হাসিল করার পূর্বে তোমরা ফিকহ হাসিল কর।
✔ইমাম শাফিঈ(রঃ) বলেন,
ফিকাহ ছাড়া ইসলামী উম্মাহের জীবন নেই। কারণ ফিকাহ হল হালাল-হারামের চিহ্ন নির্ধারণকারী।
✔ফিকাহ সংকলনের গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন,
আমার উম্মতের একটি দল থাকবে যারা সর্বদা সত্যের উপর থাকবে এবং তাদেরকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না।
রাসূলে পাক(সাঃ) এই বিষয়টি তার উম্মাতকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, এই উম্মাত কখনও বিভ্রান্ত ও বিপদগামী হবে না। এই উম্মতের ভিতর থেকে দ্বীনী শিক্ষা কখনও সরে যাবে না। আর সে জন্য তাদের মধ্যকার অনবরত ফিকহচর্চ্চা অব্যাহত থাকবে।এরই আলোকে ইসলামী ফিকহ সংকলন করা হয়।এই ফিকহশাস্ত্র সংকলনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
■যেসকল কারণে ইসলামী ফিকহ সংকলন করা হয় যা হলঃ
■১। কুরআনে কোন কোন বিষয়ে কেবলমাত্র মূলনীতিসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে কিন্তু তার বিস্তারিত কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয় নাই।বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছাড়া কখনও তা আমাদের পক্ষে উপলব্দ্বি করা সম্ভব নয় তা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে।তাই এরজন্য ফিকহ সংকলনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
■২। কুরআনের কোন কোন স্থানে পরস্পর বিপরীতমুখী আয়াত দেখা যায়।যেমন আল্লাহ এক জায়গায় ইরশাদ করেন,
আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং নিজেদের স্ত্রীদেরকে ছেড়ে যাবে, তখন সে স্ত্রীদের কর্তব্য হলো নিজেকে চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা। তারপর যখন ইদ্দত পূর্ণ করে নেবে [বাকারাঃ২৩৪]
আবার অন্যস্থলে তিনি বলেন,
তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের ঋতুবর্তী হওয়ার আশা নেই, তাদের ব্যাপারে সন্দেহ হলে তাদের ইদ্দত হবে তিন মাস। আর যারা এখনও ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি, তাদেরও অনুরূপ ইদ্দতকাল হবে। গর্ভবর্তী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তানপ্রসব পর্যন্ত। [তালাকঃ৪]
✔এই সকল বিষয়ের সমাধান ফিকাহ শাস্ত্রে রয়েছে।
৩। কখনও কখনও কুরআন-হাদীসে বাহ্যিক সংঘর্ষ দেখা যায়।যেমন আল্লাহ বলেন,
কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর। [মুজাম্মিলঃ২০]
আবার হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে,
সুরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না।
এই সংকট নিরসনে ফিকহের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
৪। মাঝে মধ্যে পরস্পর বিরোধী হাদীসের মধ্যকার সঠিক সমাধানের জন্য ফিকহের প্রয়োজনীয়তা আছে।
এক হাদীসে বলা হয়েছে,
সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না।
আবার অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে,
ইমামের কিরআত হল মুক্তাদীর কিরাআত।
এখন জামাআতের সাথে সালাত আদয় করলে কি কিরাআয় তিলওয়াত করতে হবে কি হবে না তার সমাধানের জন্য ফিকাহচর্চ্চা করতে হবে।
✔৫। কুরআন-হাদীসে একাধিক অর্থবোধক শব্দাবলী রয়েছে যা সামঞ্জস্য বিধানের দাবী রাখে।অন্যথায় কুরআন-হাদীসের উপর আমল করা দুষ্কর হয়ে যাবে। যেমন আল্লাহ বলেন,
আর তালাকপ্রাপ্তা নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন কুরু পর্যন্ত। [বাকারাঃ২২৮]
■এখানে কুরুহ শব্দের দ্বারা দুটি অর্থ ইঙ্গিত করা হয় যার একটি হল পবিত্রতা ও অপরটি হল অপবিত্রতা।এখানে কোন অর্থে তা ব্যবহৃত হবে তার সমাধানের জন্য ফিকহশাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
এক হাদীসে বলা হয়েছে, যে বর্গাচাষ বর্জন করে না, সে যেন আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ব যুদ্ব করে।
অপর এক হাদীসে এসেছে,
সব ধরনের বর্গাচাষ অবৈধ নয়।
✔। স্থান,কাল ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়।ইসলাম যেহেতু,পূর্ণাংগ জীবনব্যবস্থা তাই এই কারণে তা কুরআন-হাদীস মোতাবেল সমাধান হওয়া উচিৎ।যেমনঃ মানব ক্লোনিং,শেয়ার ব্যবসা ইত্যাদি।
✔৭। আরবী ভাষার দক্ষতা সমানভাবে থাকলেও কুরআন-হাসদীসের জ্ঞানে তা থাকে না।অথচ কুরআন-হাদীস থেকে মাসালা বের করার জন্য আরবী ভাষা জানার পাশাপাশি কুরআনের শানে নূযুল,হাদীসের শানে উরুদ,মুহকাম,মুতাশাবিহাত,আম-খাস,মুজমাল,মুফাসসাল,ছরী-কিনায়া,নাসিখ-মানসুখ,রিজালশাস্ত্র,জারাহ তাদীল ইত্যাদি ধরনের জ্ঞান রাখা দরকার।
✔৮<> যুগের সাথে সাথে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটতে থাকে আর তা সমাধানের সঠিক দিক-নির্দেশনা কুরআন-হাদীসে পাওয়া না গেলেও তখন ফকীহগণ ইজতিহাদের মাধ্যমে সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করতেন এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে ফিকাহ সংকলন অপরিহার্য হয়ে দাড়ায়।
✔
৯<> উসমান(রাঃ) এর ইন্তিকালের পর থেকে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটতে থাকে।তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্বারের জন্য হাদীস জাল করা আরম্ভ করে। কিছু স্বার্থাণ্বেষী আমীরবর্গ তাদের নিজ নিজ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য হাদীস জাল করা শুরু করে।তখন সেই সকল জাল হাদীসের বিস্তার রোধে ফিকাহ সংকলনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়াতা সকলে উপলব্দ্বি করা শুরু করে।
ফিকাহের ক্রমবিকাশঃ-
ফিকাহশাস্ত্রের ক্রমবিকাশ একদিনে সম্পন্ন হয় নাই।বরং তা অনেকদিনে বিভিন্ন কলা-কৌশলের মাধ্যমে বিকাশিত হয়। ফিকাহশাস্ত্রের ক্রমবিকাশকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়
যা হলঃ
১.রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর যুগ
২.সাহাবাদের যুগ।
৩.তাবিঈদের যুগ।
৪.ফিকহ সংকলনের যুগ।
৫.তাকলীদ প্রারম্ভের যুগ
৬.খালিস তাকলীদের যুগ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন