বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৬

ইসলামের স্বর্ণযুগ এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান, পর্বঃ১ লিখেছেনঃউমাইর চৌধুরী


হুনায়েন ইবনে ইসহাক (৮০৯-৮৭৩ খৃষ্টাব্দ)
জন্ম: ইরাক
কর্মস্থল: হাউস অফ উইসডোম/বাইত আল হিকমাহ, বাগদাদ
অবদান: অপথ্যালমোলোজি এবং ট্রান্সলেশন

ইরাকের এক আরব খৃষ্টান পরিবারে তার জন্ম। তার বাবা ছিল ফার্মাসিস্ট। ছোট থেকেই ডাক্তার হবার ইচ্ছা। বড় হয়ে চলে আসেন বাগদাদে। সেখানে ইউহান্না ইবনে মাসায়াহ নামের এক বিখ্যাত ডাক্তারের ছাত্র হিসেবে মেডিকেলীয় পড়ালেখা শুরু। মাত্রাতিরিক্ত কৌতুহল, ওস্তাদের উপরে বাড়াবাড়িসহ বিভিন্ন কারনে তাকে ইউহান্না বহিষ্কার করেন। এরপর হুনায়েন তার ওস্তাদের সামনেই প্রতিজ্ঞা করেন যে একদিন এ বাগদাদেই তার চেয়ে ভাল ফিজিশিয়ান হিসেবে ফিরে আসবেন।

দেশে-বিদেশে ঘুরে তিনি ল্যাটিন এবং গ্রীক শিখে ফেলেন। সিরিয়া-আর্মেনিয়া অঞ্চলের প্রাচীন ভাষা সিরিয়াকও জানতেন তিনি। গ্রীক ভাষায় তার দক্ষতা এত বেশী ছিল যে স্বল্প সময়ে বিখ্যাত গ্রীক ফিজিশিয়ান গ্যালেনসহ আরো অনেকের বই পড়ে ফেলেন এবং সে অনুযায়ী মেডিকেল ফিল্ডে কাজ শুরু করেন। ফিরে আসেন বাগদাদে। তার খ্যাতি পৌছে যায় তার সাবেক ওস্তাদের কানে। তার ওস্তাদ এবার তার সাথে সমঝোতায় আসেন। দুজনে মিলে শুরু করেন কাজ। বাগদাদে তৎকালীন সময়ে 'শেখ অফ ট্রান্সলেশন' নামে তাকে চিনত মানুষ। 

তখন বাগদাদে জ্ঞান-বিজ্ঞানের রমরমা অবস্থা। মুসলিম বিজ্ঞানীদের সোনালী দিনের শুরু। মুসলমানদের আগে এই জ্ঞান-বিজ্ঞান ছিল গ্রীকদের কাছে। সেসব গ্রীক বই এর অনুবাদ হওয়া দরকার ছিল আরবীতে। স্বভাবতই গ্রীক জানা লোকদের কদর তখন অনেক। অনুবাদ কাজে একেবারে প্রথম দিকে যারা হাত দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিথ্যাত এই হুনায়েন ইবনে ইসহাক। তার অনুবাদকর্মের কথা পৌছে যায় আব্বাসীয় খলিফা মামুনের দরবারে। মামুন তাকে বাইত আল হিকমাহ বা 'জ্ঞান চর্চা কেন্দ্রে'-র ইন-চার্জ হিসেবে নিয়োগ দেন। বিখ্যাত সব গ্রীক বই এর আরবী ট্রান্সলেশনের দায়িত্বও পড়ে তার উপর। এর মাধ্যমে মূলত হুনায়েন এবং তার ছাত্রদের হাত দিয়ে মধ্যযুগে মুসলমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে অগ্রযাত্রা তার ভিত্তি স্থাপিত হয়।

অবদান
১. অপথ্যালমোলজি: তার 'Ten Treatises on Ophthalmology' বই এর কারনে মেডিসিনের এই ফিল্ডে তার অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। চোখের সিস্টেমিক ট্রিটমেন্টের জন্য এটাই ইতিহাসের সর্বপ্রথম বই ছিল। তখনকার মেডিকেল ছাত্রদের টেক্সবুকের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয় এটি। এ বই এ তিনি চোখের ডিটেইলস এনাটমি এবং বিভিন্ন রোগের সিম্পটমস এবং ট্রিটমেন্টের কথা বর্ণনা করেন। তার আগে কেউ এত সুক্ষভাগে চোখের এনাটমির বর্ণনা দিতে পারেনি। চোখের টিউমার, সিস্ট এবং ক্যাটারাক্টের কথা এসেছে এখানে। করনিয়াল আলসারসহ আরো কিছু সমস্যার সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্টের পদ্ধতি বাতলে দেবার কারনে তাকে সেসময়ের একজন বিখ্যাত সার্জন হিসেবেও ধরা হয়।

২. ফিজিশিয়ান হিসেবে: খলিফা আল মুতাওয়াক্কিল এর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন তিনি। সেসময় ব্যক্তিগত রেষারেষি এবং রাষ্ট্রীয় জুলুম-নির্যাতনে খলিফার চিকিৎসকদেরও ভূমিকা থাকত। অনেক রাজ চিকিৎসক বিষ তৈরী প্রয়োগের চমৎকার সব পদ্ধতি জানতেন। খলিফা হুনায়েনকে একবার এরকম কিছু করে দেখাতে বলেন। হুনায়েন অস্বীকার করেন। ভাল সম্পর্ক থাকার পরও তাকে কারাবন্দী করেন খলিফা। হুনায়েন পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে একজন চিকিৎসকের কাজ রোগীকে সেবা দিয়ে সুস্থ্য করা, বিষ প্রয়োগ তার মূলনীতি বিরুদ্ধ কাজ।

এছাড়া সে যুগের মেডিকেল ছাত্রদের জন্য তার দুটো কাজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। "Kitab ila Aglooqan fi Shifa al Amraz" এবং “Questions on Medicine.” এ দুটো বই মেডিসিন ফিল্ডে বিগিনার বা নবীন ছাত্রদের জন্য অনেক সহায়ক ছিল। মেডিসিনের ফান্ডামেন্টাল অ্যাসপেক্টস এবং কিছু ডিফিকাল্ট ম্যাটেরিয়ালস বুঝার জন্য সহজ গাইড ছিল তার কোয়েশ্চেনস অন মেডিসিন বইটি। 
৩. অনুবাদ: তার সবেচেয় দামী অনুবাদকর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম De materia Medica, রোমান চিকিৎসক এবং ফার্মাসিস্টদের হ্যান্ডবুক হিসেবে ব্যবহৃত এ বই। বিখ্যাত গ্রীক ফিজিশিয়ান এবং সার্জন গ্যালেনের বহু লেখা তিনি আরবদের জন্য অনুবাদ করে দেন। যা পরবর্তীতে মেডিকেল ফিল্ডে মুসলমানদেরকে ব্যাপক উন্নতির দিকে যেতে সহায়তা করে। গ্যালেনের “On Sects” , “On Anatomy of the Veins and Arteries'', “Art of Physic” সহ বহু বই তিনি অনুবাদ করেন। এছাড়া বিখ্যাত গ্রীক ফিলোসফার এরিস্টটলের ''Metaphysics'' এবং প্লেটোর ''Timaeus'' এবং ''Republic'' ও আরবীতে লিখা হয় তার হাত দিয়েই। 

৪. অন্যান্য: জগৎ এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করে তিনি বেশ কিছু বই লিখেছেন। যেমন- 
Kitāb khawass al-ahidr (“On the Properties of Stones”),
Kitāb al-Jildba (“On Agriculture“)
Maqāla fī͗-alwān (“On Colors”)
Fi͗l-daw’ wa haqīqatih (“On Light and on Its Nature”)
Maqāla fi tawallud al-nār bayn at-hajarayn (“On the Generation of Fire Between Two Stones”)
Maqāla fi͗l-sabab al-ladhī min ajlihi sārat miyāli al-bahr māliha (“The Reason That the Waters of the Sea Are Salty”)
Jawdmi’ li-Kitāb Aristū fi͗l āthar al-Udwiyya (“Compendium of Meteorology”)
Maqāla fīl-madd wal-jazr (“On Ebb and Flow“)
Maqāla af͑āl al-shams wal-qamar (“On the Effects of the Sun and the Moon”)
Maqāla fī qaw.s qazah (“On the Rainbow”)

ধর্ম এবং ধর্মের প্রয়োজনীয়তা, স্রষ্টার অস্তিত্ব, ধর্মের সঠিক-বেঠিক বিষয় এসব বিষয়েও তা কিছু দার্শনিক কিতাব উল্লেখযোগ্য। যেমন-
Maqāla fī khalq al-insfān we annahu min maslaliatihi wal-tafaddul ͑alaylu an tcila muhtfājan (“On the Creation of Man and that it Is in His Interest and That It Is a Grace for Him to Have Been Created Needy”) 
Kitfāh fī idrfāk haqfīqat al-adyfān (“How One Grasps the Truth of Religions”)
fī kayfiyyat idrak haqiqat al-diydna (“How to Understand the Truth of Religion”)

ছবি: The eye according to Hunain ibn Ishaq. From a manuscript dated circa 1200

সূত্র: উইকিপিডিয়া, মুসলিম হেরিটেজ, বিট্রানিকা, এনসাইক্লোপিডিয়া, গুগল


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন