খাত্তাব এবং যাইদ একই মায়ের সন্তান হলেও বিশ্বাসের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক।
যাইদ জাহিলিয়্যাতের যুগেও এক আল্লাহর উপাসনা করতেন।তিনি কুরাইশদের মূর্তিপূজা সহ্য করতে পারতেন না,তিনি মূর্তির নামে উৎসর্গ করা খাবারও খেতেন না।তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে কুরাইশদের মধ্যে তিনিই ইবরাহীম (আ) এর ধর্ম অনুসরণ করছেন। তিনি কুরাইশদের মূর্তিপূজাকে প্রকাশ্যে নিন্দা করতেন।
অন্যদিকে খাত্তাব মূর্তিপূজার একনিষ্ঠ সমর্থক।যাইদের কারণে সে অপমানিত বোধ করত।তাই যাইদকে সে নির্যাতন করে মক্কার বাইরে পাহাড়ে নির্বাসিত করে এবং একদল যুবককে নির্ধারণ করে রাখে যাতে যাইদ কাবায় না প্রবেশ করতে পারেন।
বিতাড়িত যাইদ সত্য ধর্মের সন্ধানে ইরাকের মসুল থেকে সিরিয়া পর্যন্ত যান এবং ধর্মযাজক ও ভাইদের থেকে জানতে পারেন যে মক্কাতেই অতি নিকটে শেষ নবী আসার সম্ভাবনা রয়েছে।মক্কায় ফিরে আসার পথে সিরিয়ার দক্ষিণ সীমান্তে 'লাখম' নামক স্থানে তিনি আক্রান্ত হন এবং রাসূলুল্লাহ (স) এর নবুওয়াত লাভের পূর্বেই তিনি মারা যান।রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, কিয়ামতের দিন যাইদ একা এক উম্মতের মর্যাদা নিয়ে উত্থিত হবেন।
অনেক বছর পরের কথা। খাত্তাবও মারা গেছে।খাত্তাবের ছেলে ঊমারের সাথে যাইদের ছেলে সাইদের ভালোই সম্পর্ক এখন।এমনকি উমারের বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাবকেও বিয়ে দেয়া হল সাঈদের সাথে।
মুহাম্মাদ (স) ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলে সাঈদ (রা) এবং ফাতিমা (রা) দুজনেই ইসলাম গ্রহণ করলেন।অপরদিকে উমার নতুন ধর্মের কট্রর বিরোধীদের একজনে পরিণত হলেন।তবে অন্যান্য বিরোধীদের সাথে তার পার্থক্য ছিল। অন্যরা যেখানে নিজেদের ব্যাক্তিগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থহানির ভয়ে ইসলামের বিরোধিতা করত,উমার নিজ ধর্মের মান রক্ষার্থে বিরোধিতা করতেন।
খাত্তাব ঊমারকে কাবা ও তার আশেপাশের সকল মূর্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
ঊমারের বয়স তখন ২৬।ঊমার পরিস্কার দেখতে পেলেন মক্কায় এখন দুইটি ধর্ম।তার বাপদাদাদের ধর্ম ও উপাস্যদেরকে একদল মানুষ পরিত্যাগ করছে।ঊমার এসবের পিছনে একটি কারণই খুজে পেলেন।সে কারণকে অপসারণ করলেই সমস্যার সমাধান।
তাই একদিন তিনি নাঙ্গা তলোয়ার হাতে বেরিয়ে পড়লেন।পথে দেখা হল স্বগোত্রের নুয়াইম ইবন আব্দুল্লাহরর (রা) সাথে।নুয়াইম ততদিনে গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।উমারের ক্রোধান্বিত চেহারা দেখে নুয়াইম জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ।ঊমার জানালেন, তিনি মুহাম্মাদ (স) এর নিকটে যাচ্ছেন।উদ্দেশ্য তাকে হত্যা করা।কারণ মুহাম্মাদ (স) কুরাইশদের বিভক্ত করেছেন।
নুয়াইম ঊমারকে নিরস্ত করতে ভয় দেখালেন যে, একাজ করতে গিয়ে নিজেই মারা পড়বে।কিন্তু ঊমার দৃঢ়সংকল্প। ঊমারের অবিচলতা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যে করেই হোক ঊমারের মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে হবে যাতে করে তিনি মুহাম্মাদ (স) ও অন্য মুসলিমদের আগেই সতর্ক করে দিতে পারেন।
এর মানে হচ্ছে নুয়াইমকে অন্য কারো সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হবে। ঊমারের আত্মীয় অন্য কোন সাহাবীদের খবর দিয়ে দিতে হবে যারা কিনা নুয়াইমের মতই নিজেদের ইসলামকে গোপন করে রেখেছিলেন।কিন্তু নুয়াইম জানতেন, এমন পরিস্থিতিতে একাজ করার জন্যে তারা তাকে ক্ষমা করে দিবে।এমনকি হয়ত বাহবাও জানাবে।
'হে ঊমার, প্রথমে নিজের ঘরে যাও এবং নিজ পরিবারকে ঠিক কর।" নুয়াইম (রা) শেষ চেস্টা করলেন।
'তাদের কি হয়েছে?' ঊমারের প্রশ্ন।
'তোমার বোন জামাই সাঈদ এবং তোমার বোন ফাতিমা।তারা মুহাম্মাদের (স) দ্বীনের অনুসারী।' নুয়াইম (রা) বললেন।
একটিও কথা না বলে ঊমার সোজা বোনের বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলেন।সাঈদ (রা) এবং ফাতিমা বিনতে খাত্তাব (রা) তখন যুহরাহ গোত্রের দরিদ্র খাব্বাব ইবন আল-আরাত (রা) এর কাছে কোরআন শিখছিলেন। সম্প্রতি নাযিল হওয়া সূরা ত্বাহার প্রথম দিককার কিছু আয়াত তারা পাঠ করছিলেন
ঊমারের আভাষ পেয়ে খাব্বাব তখন বাড়ীর আরেকটি কক্ষে আত্মগোপন করলেন।ঊমার বোন ও ভগ্নীপতীকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেনঃ 'তোমাদের এখানে গুনগুন আওয়াজ শুনছিলাম তা কিসের?'
তাঁরা উত্তর দিলেনঃ'আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম।'
ঊমার বললেনঃ 'সম্ভবত তোমরা নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করে বিধর্মী হয়েছো।'
সাঈদ (রা) জবাবে বললেনঃ 'তোমার ধর্ম ছাড়া অন্য কোথাও যদি সত্য থাকে তুমি কি করবে উমর ?'
ঊমার একথায় রাগান্বিত হয়ে তাঁর ভগ্নীপতির উপর ঝাপিয়ে পরলেন এবং দু’পায়ে তাঁকে ভীষভাবে মাড়াতে লাগলেন।ফাতিমা বিনতে খাত্তাব (রা) তাঁর স্বামীকে বাচাতে এগিয়ে এলে উমর তাকে ধরে এনে এমন মার দিলেন যে, তাঁর মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেল। ঊমারের বোন ফাতিমা (রা) তখন রাগে উত্তজিত হয়ে বলে উঠলেনঃ 'সত্য যদি তোমার দ্বীনের বাইরে অন্য কোথাও থেকে থাকে, তাহলে আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আরো স্বাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রাসুল।'
বোনের রক্ত ও অকুতোভয় সত্যের সাক্ষ্য ঊমারকে ভীষণ ধাক্কা দিল।ঊমার লিখতে পড়তে জানতেন।বোনকে বললেন,'তোমরা যা পাঠ করতেছিলে তা আমাকে দাও। আমি দেখতে চাই এতে কি রয়েছে।'
ফাতিমা বললেনঃ 'আমাদের ভয় হচ্ছে, তুমি এটিকে অপদস্ত করবে এবং আমাদেরকে তা আর ফেরত দিবেনা।'
উমার দেব-দেবীর নামে শপথ করে বললেনঃ 'অবশ্যই তা ফেরত দিবে।'
ফাতিমার মনে আশার সঞ্চার হল হয়ত প্রিয় ভাই ইসলাম গ্রহণ করবে।
তিনি বললেনঃ 'ও আমার ভাই! তুমি তোমার মূর্তিপূজার কারণে অপবিত্র হয়ে আছ। পবিত্র লোক ব্যতীত অন্য কেউ কুরআন স্পর্শ করতে পারেনা।'
উমার উঠে গোসল করে আসলেন এবং মুশাফ থেকে সূরা ত্বহার প্রথমাংশ পাঠ করেই বললেনঃ 'কত সুন্দর আর কত মহৎ এই কথাগুলি।'
এ কথা শুনে খাব্বাব (রা) বের হয়ে এসে বললেনঃ
'আপনার ব্যাপারে আল্লাহর নবীর (স) দু’আ কবূল হয়ে গেছে। কেননা আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, "হে আল্লাহ! উমার ইবনে খাত্তাব অথবা আবু জাহেল ইবনে হিশাম- এ দু’জনের একজনের মাধ্যমে ইসলামকে শক্তিশালী কর।" হে উমার! তুমি আল্লাহকে ভয় কর। হে উমার! তুমি আল্লাহকে ভয় কর।'
উমার তখন বললেনঃ 'হে খাব্বাব! মুহাম্মাদ(স) কোথায় আছেন? আমাকে দেখিয়ে দাও। আমি তাঁর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করবো।'
খাব্বাব (রা) বললেনঃ 'তিনি একদল সাহাবীসহ সাফা পাহাড়ের নিকস্থ আরকাম (রা) এর বাড়িতে অবস্থান করছেন।'
উমার তরবারি হাতে নিয়েই সেদিকে চললেন। দরজায় গিয়ে করাঘাত করার সাথে সাথে একজন দাড়িয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখলেন, উমার উন্মুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে উপস্থিত। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সংবাদ দিলেন।
হামযাহ (রাঃ) বললেনঃ তাকে আসতে বল। সে যদি ভাল নিয়তে এসে থাকে তাহলে তার সাথে আমরা ভাল ব্যবহার করব। আর যদি মন্দ নিয়তে এসে থাকে তবে আমরা তার তলোওয়ার দিয়েই তাকে হত্যা করব।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তাকে আসার অনুমতি দাও।
ঊমার ভিতরে প্রবেশ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার চাদর ধরে শক্ত করে টান দিয়ে তাকে কক্ষের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে বললেনঃ
'হে খাত্তাবের পুত্র উমার! কি কারণে তুমি এখানে এসেছো? আল্লাহর শপথ! আমার মনে হয় তোমার উপরে আল্লাহর শাস্তি নাজিল হওয়ার পূর্বে বিরত হবেনা।'
এ কথা শুনে উমার (রাঃ) বললেনঃ 'হে আল্লাহর রাসূল! আমি এসেছি আল্লাহর প্রতি এবং আল্লাহর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়নের জন্যে।'
এ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন উঁচু কন্ঠে তাকবীর পাঠ করলেন, যা শুনে ঘরের সকলেই বুঝতে সক্ষম হল যে, উমার (রা) মুসলমান হয়ে গেছে। মুসলমানগণ সেখান থেকে বের হয়ে আসলেন। ঊমারের (রা) ইসলাম গ্রহন সকল সাহাবীদেরকে পুলকিত করল।
এই ছিল ঊমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী।নিঃসন্দেহে এটি ছিল ইসলামের এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস।
তথ্যসূত্রঃ
১।ইবনে ইসহাক (রহ) এর সীরাতে রাসূলুল্লাহ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন